সরল গরল-সংবিধানে ধর্মের ফয়সালা বড় চ্যালেঞ্জ by মিজানুর রহমান খান

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন কভার করতে গিয়ে যেসব বিষয় আমাকে আকর্ষণ করে, তার একটি ছিল শপথ অনুষ্ঠান। ২০ মে রাজভবনের অনুষ্ঠানে ৩৪ জন মন্ত্রী যখন পৃথকভাবে শপথ নিচ্ছিলেন, তখন কিছুটা অবাক হচ্ছিলাম। কেন তাঁরা খামোখা সময় নষ্ট করছেন? ৩৪ জন মন্ত্রী দুটি করে শপথবাক্য পাঠ করছিলেন—একটি মন্ত্রিত্বের, অন্যটি গোপনীয়তার।


ভাবছিলাম, সবাই একসঙ্গে একই শপথবাক্য পাঠ করবেন, তাতে সময়ও বাঁচবে। কথা যখন একই, সবাইকে আলাদা আলাদা করে তা বলতে হবে কেন? এক সুরে বললেই তো হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এর বৈচিত্র্য লক্ষ করি। দুটি বৈচিত্র্য—ধর্ম ও ভাষাগত। প্রত্যেক মন্ত্রী তাঁর নিজ নিজ উপাস্য ও ভাষা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। সে কারণে ব্যক্তিভেদে উচ্চারিত হচ্ছিল নিজ নিজ উপাস্যের নাম। একজন সংখ্যালঘু মন্ত্রী শপথ নিলেন উর্দুতে। তাঁর মাথায় ছিল জিন্নাহ টুপি। পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি জিন্নাহর অনুসারী কি না। তিনি হেসে এড়িয়ে যান। আরেক সংখ্যালঘু মন্ত্রী শপথবাক্য পাঠ করলেন ইংরেজিতে, গডের নামে।
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম দুর্গ পতনের অন্যতম কারণ হলো, সংখ্যালঘুরা তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের স্পিকার হাসিম আবদুল হালিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে কথা হলো। আমার মতে, সিঙ্গুর বা নন্দিগ্রাম নয়, সাচার কমিটিই বামদের খেয়েছে। বামদের প্রস্তাবে ভারতে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থা অনুধাবনে কেন্দ্রীয় সরকার সাচার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের রিপোর্টই পশ্চিমবঙ্গে বামদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এই প্রতিবেদন সংখ্যালঘুদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পাকা রাস্তাটি সংখ্যালঘু এলাকার ঠিক একটু আগে থেমে গেছে। স্কুল-কলেজ এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা সংখ্যালঘুদের উপকারে আসেনি। সাচার কমিটির রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল ২০০১ সালের আদমশুমারি রিপোর্টের ভিত্তিতে। তখন পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিল ২৬ শতাংশ। ২০১১ সালের শুমারিতে এটা প্রায় ৩০ শতাংশ হতে পারে। সাচার কমিটি দেখায়, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব আড়াই শতাংশের কম।
আমি যখন এই রিপোর্ট নিয়ে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তখন তিনি এর সত্যতা উড়িয়ে দেননি। বরং তিনি অহংকারের সঙ্গে বলেছিলেন, ওসব আপনাদের মাথায় ঢুকবে না। ভারতে সংখ্যালঘুরা যে পিছিয়ে, তা-ও চিহ্নিত করেছে কমিটি। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন আসলে সংখ্যালঘুরাই ঘটিয়েছে। ২০০৬ সালের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে বামরা এবার ১১ লাখ ভোট বেশি পেয়েছে। তাদের মোট ভোট প্রাপ্তি ৪১ শতাংশ। এ ধরনের ভোটের হার অবামরাও এতকাল পেয়ে এসেছে। কিন্তু তাতে মহাকরণ করায়ত্ত হয়নি কখনোই। এবারই প্রথম সংখ্যালঘুরা তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ভবিষ্যতে শুধু ভারত নয়, বিশ্বের আরও বহু গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের আসা-যাওয়া অনেকটাই নির্ধারণ করে দেবে তারাই। বাংলাদেশেও হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে না।
ক্ষমতার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও প্রভাব সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনেরাও কম দেখায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকাশ্য অবস্থান হচ্ছে, বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে। কিন্তু অনেকের বিশ্বাস, তিনি তাঁর এই অবস্থান বদলাতে পারেন। দেশের বাস্তবতার পাশাপাশি তাঁকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অবস্থাও বিবেচনায় নিতে হবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা সংবিধানে ধর্মের কী অবস্থান থাকবে, সে বিষয়ে কম সচেতন মনে করার কারণ নেই। প্রশ্নটি ঢের বেশি রাজনৈতিক কৌশলগত।
সংবিধানে ধর্মের অবস্থান কী হবে, সেই শিক্ষাটা আজকের পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে নিলে সংশ্লিষ্ট সব মহলই উপকৃত হতে পারে। রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? এই প্রশ্নটি একটি স্বাভাবিক ও সহজাত চিন্তার ফসল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ অনেকেরই মুখে তা উচ্চারিত হচ্ছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতেরা বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম প্রশ্নে বিরাট সুবিধাবাদী অবস্থানের পরিচয় দিয়েছেন।’ সেনগুপ্তের যুক্তি উপেক্ষা করা যায় না, বাহাত্তরে যখন বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মবিহীন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আমরা পেয়েছিলাম, তখনো যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশকে স্বীকারই করেনি। এ-ও সত্য যে পঁচাত্তরের আগে আমরা এই প্রশ্নে বিভক্ত ছিলাম না। বাহাত্তরের সংবিধানের ভিত্তিতে তিয়াত্তরে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে বিরোধী দলের যে কণ্ঠস্বর ছিল, সেখানে ধর্ম প্রাধান্য পায়নি।
এখন কোনো কারণে যদি আপস করা হয়, তাহলে তা কোন শর্তে করা হবে, সেদিকে যেন বিশেষ নজর দেওয়া হয়। সেদিক থেকে কমিটিতে হাসানুল হক ইনুর বিশেষ প্রস্তাবটি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর প্রস্তাবটি নিম্নরূপ:
‘সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কর্তৃক প্রবর্তিত পঞ্চম সংশোধন ও অষ্টম সংশোধনের ফলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” এবং ২ (ক)তে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” বিধানটি যুক্ত হয়। এই দুটি প্রস্তাবনা সংবিধানের মূল কাঠামো ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধর্মের রাজনীতিকীকরণ এবং রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ উভয় কর্মই গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, সমাজকে বিভক্ত করে এবং ধর্মের পবিত্রতাও নষ্ট করে। অতএব, “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” ও “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”সংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা দরকার।
আমার এই প্রস্তাবে “বিশেষ কমিটি” যদি একমত না হতে পারে, সে ক্ষেত্রে আমার আপাতত বিকল্প প্রস্তাব হচ্ছে, “বিশেষ কমিটি” আপাতত এই দুটি প্রশ্নে সংসদে কোনো সুপারিশ প্রদান করবে না। অর্থাৎ কমিটি “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” ও “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” রাখার পক্ষে কোনো সুপারিশ করবে না। ফলে সংবিধানে তা বহালই থেকে যাবে। ভবিষ্যতে এই প্রশ্নে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। ভবিষ্যৎ বলে দেবে কোন দিকে যেতে হবে।’
আমি জনাব ইনুর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। রাশেদ খান মেনন কমিটিতে যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও সমগুরুত্বে বিবেচনার দাবি রাখে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এর আগে একটি আপসরফার বিষয়ে যে ইঙ্গিত রেখেছিলেন, মেনন তা যেন আরেকটু পরিশীলিত করেছেন। তাঁর মতে, নতুন ২ক অনুচ্ছেদ হবে এ রকম, ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম। একই সঙ্গে প্রজাতন্ত্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগণও রহিয়াছেন। প্রজাতন্ত্র সকল ধর্ম শান্তিতে প্রতিপালন নিশ্চিত করিবে।’ তাঁর দ্বিতীয় বিকল্প, ‘প্রজাতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম। একই সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগণও রহিয়াছেন। প্রজাতন্ত্র সব ধর্মের সম-অধিকার নিশ্চিত করিবে।’
আসলে রাষ্ট্রধর্ম মানে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম। এই অর্থে পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দু ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর মানে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা।
সেনগুপ্তের তরফে শুনেছিলাম, ‘বিসমিল্লাহ’র বাংলা তরজমায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা আনা হবে। বলা হবে, ‘পরম করুণাময়ের নামে আরম্ভ করিতেছি’। আর বিদ্যমান রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে অন্য প্রধান ধর্মগুলোও যুক্ত করা হবে।
পশ্চিমবঙ্গের স্পিকার হাসিম আবদুল হালিমের কথা কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, ভারতের গণপরিষদে ধর্মের অবস্থান কী হবে, সেই প্রশ্নে তিন দিন বিতর্ক হয়েছিল। তারপর সিদ্ধান্ত আসে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি সংযোজনের। এবং তাঁর মতে, এই একটিমাত্র দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ভারতীয় গণতন্ত্র কখনো ভেঙে পড়েনি। পাকিস্তানেরটা ভেঙে গেছে। তিনি আমাকে প্রায় চ্যালেঞ্জ করে বললেন, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসার পরও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ফিরিয়ে আনা দুরূহ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের যুক্তি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়: দুটি অবস্থার মৌলিক পার্থক্য বিবেচনায় নিতে হবে। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম একটি নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল। সেটা আওয়ামী লীগই করেছিল। কিন্তু আজ ৩৫ বছরের ব্যবধানে দলটি আওয়ামী লীগই আছে। ৩৫ বছর ধরে তা সংবিধানে বহাল রয়েছে। এখন প্রশ্ন এসেছে বাদ দেওয়া না দেওয়ার। এটা সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি।
তাঁর সঙ্গে একমত হয়েও আমরা সংসদ নেতা শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখতে পারি। প্রতিপক্ষের অবাঞ্ছিত চোখরাঙানি এবং অন্ধকারের শক্তির দাপট ও বিধ্বংসী ক্ষমতা বিবেচনায় রাখতেই হবে। মাথা বাঁচিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু রাজনীতিকদের জীবনে বিরল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ আসে। এটা তেমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তিনি ইতিমধ্যেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আসছে। এটা একটা মিথ। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। তবে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের হার বাড়লেও বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে। ৩৪ বছর পরে হলেও পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের বামপ্রীতির মিথ ভেঙে গেছে। বাংলাদেশে কী হবে? ধর্মের প্রশ্নে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার পরিণামটাও বিবেচনায় নিতে হবে।
পুনশ্চ: বিএনপি সংসদের কমিটিতে না আসার শূন্যতা পূরণ হয়েছে অনেকটাই সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করে। এতে একটা নতুনত্ব আছে। আমরা সংবিধান বিষয়ে সংসদে নাগরিক সমাজের বক্তব্য জানতে চাই। বিষয়ভিত্তিক যেমন—ধর্মের প্রশ্নে কে কী অভিমত দিয়েছেন, তার কার্যধারা কমিটি যদি গুছিয়ে প্রকাশ করে, তাহলে তা হবে এক অনবদ্য সংসদীয় দলিল। এই অনুশীলন সম্ভবত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদেরও ভ্রূণ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.