বাঘা তেঁতুল-ভুল সবই ভুল by সৈয়দ আবুল মকসুদ
৩২তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কী থাকবে, তা আমি এখনই বলে দিতে পারি। বলে দিতে পারি এ জন্য যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মতোই সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আগামীবার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকবে: এশিয়ায় সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান—(ক) আলাওল (খ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (গ)
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (ঘ) সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশে শিক্ষার মান এত উঁচু এবং তরুণদের সারা দিনরাত মোবাইল ফোনে কথা বলার পরেও পড়াশোনার অভ্যাস এত বেশি যে, শিক্ষার্থীরা ভাগাভাগি করে চারটিতেই টিক মারবেন। খ-তে সবচেয়ে বেশি টিক পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাঁরা করেন, তাঁরা গত ৪০ বছরের কোনো না কোনো সময় উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। কলেজ এখন একটি বাতিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সবাই চাইছে, স্কুলটা কোনো রকমে পার হয়ে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। ৯০ বছর আগে দেশে যত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, আজ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ তত। আরও ৬০টির অনুমতির জন্য আবেদনপত্র পড়েছে। এমন সব মানুষ আবেদন করেছেন বা সুপারিশ করেছেন যে কার সাধ্য তা রোধিবে দিয়ে বালির বাঁধ।
৩১তম বিসিএস প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা হয়ে গেল। একটি প্রশ্ন ছিল: রহিম, করিম ও গাজী তিনজনে একটি কাজ করতে পারে যথাক্রমে ১৫, ৬ ও ১০ দিনে। তারা একত্রে তিনজনে কাজটি কত দিনে শেষ করতে পারবে? উত্তরে চারটি অপশন ছিল—(ক) ২১ দিনে (খ) ১৮ দিনে (গ) ৭ দিনে (ঘ) ১৫ দিনে। আমার মতো গণিত-অজ্ঞ নয়, সত্যি যাঁরা গণিতজ্ঞ, তাঁরা বলছেন, চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে তিন দিন।
পরীক্ষার্থীদের কারও উচিত ছিল, প্রশ্নপত্রের মার্জিনে লিখে দেওয়া: তিনজন একসঙ্গে কাজটি করবে না। কারণ, দেশের নেতারা তিনজন তো দূরের কথা, দুজনও একসঙ্গে কাজ করা পছন্দ করেন না। সুতরাং রহিম, করিম ও গাজী একসঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই পারে না।
আরেকটি প্রশ্ন ছিল: বাংলাদেশ কোন সাল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছে? চারটি অপশন—(ক) ১৯৮২ (খ) ১৯৮৫ (গ) ১৯৭৫ (ঘ) ১৯৮৯। চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে ১৯৮৮ সাল। প্রশ্ন তৈরিকারী বলবেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কবে গেল সেটা বড় কথা নয়, ডলার কত এল সেটাই আসল। প্রশ্নপত্রে, ডলারের কথা নেই কেন?
এর আগে ৩০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও ভুল ও অসংগতি ছিল। এবারের ভুলের ব্যাপারে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভুলের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তবে পরীক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না।’
কর্মকর্তা বিব্রত বা লজ্জিত হননি। সোজা বলে দিয়েছেন, সমস্যা হবে না। এ দেশে কোনো অপরাধ, অপকর্ম ও ভুলেই যেকোনো সমস্যা হয় না, তা কে না জানে। সমস্যা না হলে ভুল করতে দোষ কী? খুব বড় ভুল যদি হয়, তা হলে ভুলকরনেওয়ালা মাথা চাপড়ে বলবেন: জোট সরকারের সময় আমারে যে-বিপদে ফেইলা দিছিল যে বাঁচারই কথা না। তাড়াতাড়ি নির্বাচনটা না দিলে এক্কেবারে গেছিলাম। তা ছাড়া ঊনত্রিশে ডিসেম্বর জীবন বাজি রাইখা—।
পিএসসির পরীক্ষার দায়িত্বরত একজন সদস্য ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করে থাকেন না—এ জন্য এমনটা হতেও পারে। পরীক্ষার্থীদের অযথা উদ্বিগ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করেন না, চেয়ারম্যান করেন না, সচিব করেন না, মন্ত্রী করেন না—তা সবাই জানে। তবে কেউ না কেউ তো করেন। যিনি করেছেন, এখন আর তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
পরীক্ষা গ্রহণেও ছিল নানা রকম অনাচার। পরীক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। ৫৯৬ পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে বিভ্রান্তি। একাধিক পরীক্ষার্থীর একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর। সিট খুঁজতে ও পরীক্ষাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষার্থীদের কিছু সুবিধার ব্যবস্থাও করে দেন পিএসসির কর্মকর্তারা। ‘পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।’ মানা হয়নি কারণ, পরীক্ষা দিচ্ছেন কোন প্রজন্ম ও সংগঠনের সদস্যরা, তা তো বিবেচনা করতে হবে এবং মাথায়-হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ফেরার সাধ এই বীরের দেশেও খুব কম মানুষেরই রয়েছে।
সমাজে ও রাষ্ট্রে সবকিছু চক্রাকারে হয়। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। নৈতিকতা ও শিক্ষার মান উঁচু হলে সুশিক্ষিত মানুষ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাছাই করে সবচেয়ে সেরাদের প্রশাসনে নিয়োগ দিলে ভালো ও দক্ষ প্রশাসন পাওয়া যায়। নিম্নমানের শিক্ষা, কারসাজি করে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে, মেধাবীরা সুযোগ না পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসন ধ্বংস হয়ে যায়। তা যে যায়, তার প্রমাণ গত ৪০ বছরের বাংলাদেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাঁরা করেন, তাঁরা গত ৪০ বছরের কোনো না কোনো সময় উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। কলেজ এখন একটি বাতিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সবাই চাইছে, স্কুলটা কোনো রকমে পার হয়ে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরে গেছে সারা দেশ। ৯০ বছর আগে দেশে যত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, আজ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ তত। আরও ৬০টির অনুমতির জন্য আবেদনপত্র পড়েছে। এমন সব মানুষ আবেদন করেছেন বা সুপারিশ করেছেন যে কার সাধ্য তা রোধিবে দিয়ে বালির বাঁধ।
৩১তম বিসিএস প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা হয়ে গেল। একটি প্রশ্ন ছিল: রহিম, করিম ও গাজী তিনজনে একটি কাজ করতে পারে যথাক্রমে ১৫, ৬ ও ১০ দিনে। তারা একত্রে তিনজনে কাজটি কত দিনে শেষ করতে পারবে? উত্তরে চারটি অপশন ছিল—(ক) ২১ দিনে (খ) ১৮ দিনে (গ) ৭ দিনে (ঘ) ১৫ দিনে। আমার মতো গণিত-অজ্ঞ নয়, সত্যি যাঁরা গণিতজ্ঞ, তাঁরা বলছেন, চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে তিন দিন।
পরীক্ষার্থীদের কারও উচিত ছিল, প্রশ্নপত্রের মার্জিনে লিখে দেওয়া: তিনজন একসঙ্গে কাজটি করবে না। কারণ, দেশের নেতারা তিনজন তো দূরের কথা, দুজনও একসঙ্গে কাজ করা পছন্দ করেন না। সুতরাং রহিম, করিম ও গাজী একসঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই পারে না।
আরেকটি প্রশ্ন ছিল: বাংলাদেশ কোন সাল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছে? চারটি অপশন—(ক) ১৯৮২ (খ) ১৯৮৫ (গ) ১৯৭৫ (ঘ) ১৯৮৯। চারটি অপশনই ভুল। সঠিক উত্তর হবে ১৯৮৮ সাল। প্রশ্ন তৈরিকারী বলবেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কবে গেল সেটা বড় কথা নয়, ডলার কত এল সেটাই আসল। প্রশ্নপত্রে, ডলারের কথা নেই কেন?
এর আগে ৩০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও ভুল ও অসংগতি ছিল। এবারের ভুলের ব্যাপারে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভুলের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তবে পরীক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না।’
কর্মকর্তা বিব্রত বা লজ্জিত হননি। সোজা বলে দিয়েছেন, সমস্যা হবে না। এ দেশে কোনো অপরাধ, অপকর্ম ও ভুলেই যেকোনো সমস্যা হয় না, তা কে না জানে। সমস্যা না হলে ভুল করতে দোষ কী? খুব বড় ভুল যদি হয়, তা হলে ভুলকরনেওয়ালা মাথা চাপড়ে বলবেন: জোট সরকারের সময় আমারে যে-বিপদে ফেইলা দিছিল যে বাঁচারই কথা না। তাড়াতাড়ি নির্বাচনটা না দিলে এক্কেবারে গেছিলাম। তা ছাড়া ঊনত্রিশে ডিসেম্বর জীবন বাজি রাইখা—।
পিএসসির পরীক্ষার দায়িত্বরত একজন সদস্য ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করে থাকেন না—এ জন্য এমনটা হতেও পারে। পরীক্ষার্থীদের অযথা উদ্বিগ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। পিএসসির সদস্যরা প্রশ্নপত্র করেন না, চেয়ারম্যান করেন না, সচিব করেন না, মন্ত্রী করেন না—তা সবাই জানে। তবে কেউ না কেউ তো করেন। যিনি করেছেন, এখন আর তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
পরীক্ষা গ্রহণেও ছিল নানা রকম অনাচার। পরীক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। ৫৯৬ পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে বিভ্রান্তি। একাধিক পরীক্ষার্থীর একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর। সিট খুঁজতে ও পরীক্ষাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষার্থীদের কিছু সুবিধার ব্যবস্থাও করে দেন পিএসসির কর্মকর্তারা। ‘পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।’ মানা হয়নি কারণ, পরীক্ষা দিচ্ছেন কোন প্রজন্ম ও সংগঠনের সদস্যরা, তা তো বিবেচনা করতে হবে এবং মাথায়-হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ফেরার সাধ এই বীরের দেশেও খুব কম মানুষেরই রয়েছে।
সমাজে ও রাষ্ট্রে সবকিছু চক্রাকারে হয়। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। নৈতিকতা ও শিক্ষার মান উঁচু হলে সুশিক্ষিত মানুষ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাছাই করে সবচেয়ে সেরাদের প্রশাসনে নিয়োগ দিলে ভালো ও দক্ষ প্রশাসন পাওয়া যায়। নিম্নমানের শিক্ষা, কারসাজি করে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিলে, মেধাবীরা সুযোগ না পেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসন ধ্বংস হয়ে যায়। তা যে যায়, তার প্রমাণ গত ৪০ বছরের বাংলাদেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments