চারদিক-পিঠা মামা by শারমিন নাহার
ঢিমে আঁচে জ্বলছে ছয়টি চুলা। পাঁচটিতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা ছোট্ট কড়াই আর বাকিটাতে বড় একটা হাঁড়ি। হাঁড়িটায় চাটনিজাতীয় কিছু একটা হবে হয়তো। বড় বালতিতে আতপ চালের গুঁড়া গুলিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এরই মধ্যে কড়াই তেতে উঠেছে। কাপে ভরে আতপ চালের গোলা ঢেলে দিচ্ছেন তাতানো কড়াইতে।
আর এ সবকিছুই নিপুণ হাতে করে চলেছেন মোহাম্মদ মোবারক। সবাই বলেন ‘পিঠা মামা’ মোবারক। নিউমার্কেট ১ নম্বর গেট থেকে এগিয়ে চারুকলার শাহনেওয়াজ হলের গেটে দেখা মেলে তাঁর। চার চাকার ভ্যানগাড়ির ওপরই দোকানদারি করেন তিনি।
দোকানের সামনে এসে গরম পিঠার অর্ডার দিতেই মোবারক মামা বলেন, ‘খাড়ান, কেবল তো আইলেন, একটু জিরান।’ এরপর মাথায় গামছা বেঁধে পুরো মনোযোগটা দেন পিঠা বানানোর দিকে। তাই কথা বলার ফুরসত মেলা ভার। দাঁড়িয়ে থাকি মামার ব্যস্ততা কমার আশায়। এরই মধ্যে ‘পিঠা মামা’র বড় ছেলে জুয়েল স্কুল থেকে এসে হাত লাগিয়েছে কাজে। এবার খানিকটা দম ফেলার ফুরসত পেলেন মোহাম্মদ মোবারক।
বাড়ি তাঁর সিলেটের লালাবাগ গ্রামে। বাবাকে হারিয়েছেন খুব ছোটবেলায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় হওয়ায় সংসারের দায়িত্বটা চেপে যায় তাঁর কাঁধে। জীবিকার তাগিদে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় আসেন কাজের খোঁজে। প্রথমদিকে কিছুদিন ছোটখাটো ঠেকা কাজ করতেন। এরপর শুরু করেন পিঠার ব্যবসা। তা-ও প্রায় ২০-২২ বছর আগের কথা।
প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে পিঠা বিক্রি করলেও পাঁচ বছর হলো চারুকলার শাহনেওয়াজ হলের গেটে দোকানদারি করছেন। নিউমার্কেট ছাড়া শাহনেওয়াজ হল, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা তাঁর নিয়মিত খদ্দের। তাঁর কাছে পিঠা খেতে গেলে উপরি হিসেবে মিলবে কয়েক পদের চাটনি আর ভর্তা। কালিজিরা, সরষে আর চিংড়ির ভর্তা প্রতিদিনই তৈরি করেন তিনি। কারণ, গরম পিঠার সঙ্গে ঝাল ভর্তা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। তবে শীতের দিনে চিতই পিঠার সঙ্গে ভাপা পিঠাও বানান মোবারক মামা।
প্রশ্ন করি, অন্য কিছু না করে কেন পিঠা বানানো শুরু করলেন? পিঠা মামা বলেন, আসলে চিতই পিঠা ভেজাল ও মুক্তভাবে বানানো যায়, আবার খেয়েও সবাই তৃপ্তি পায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পিঠা বানান বলেও দাবি করেন তিনি। আজিমপুর কবরস্থানের পাশে আইয়ুব আলী কলোনিতে বড় ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। ছোট ছেলে, এক মেয়ে আর মাকে নিয়ে বউ থাকে দেশে।
সারা দিনের ব্যস্ততা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মোবারক মামা বলেন, ‘ফজরের আজান পড়লে ঘুম ভাঙে। তার পর থেকে দুই হাত আর জিরনি দেয় না (বিশ্রাম নেয় না)।’ আতপ চাল ধুয়ে গুঁড়া করতে নিয়ে যান নিউমার্কেটে। প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ কেজি চালের পিঠা বানান তিনি। চাল গুঁড়া করা শেষে শুরু হয় ভর্তা বানানোর কাজ। এরপর সব জিনিস আর মালমসলা নিয়ে হাজির হন দোকানে। ছেলে স্কুল থেকে আসে বেলা ১১টায়। তারপর খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন পিঠা মামা।
গ্রামের কথা তাঁর সব সময়ই মনে পড়ে, যেখানে আছেন তাঁর বাকি সন্তান, সহধর্মিণী আর বৃদ্ধ মা। অবসর তাঁর মেলে না বললেই চলে। তার পরও সময় পেলেই ছুটে যান নাড়ির টানে। যান্ত্রিক শহরের ইটপাথর তাঁকে আর আটকে রাখতে পারে না। অবসরে কী করেন? পিঠা মামা বলেন, ‘অবসরই পাই না। তবে মঙ্গলবার নিউমার্কেট বন্ধ থাকে। তাই ওই দিন দোকান খুলি না। ঘরে বসেই বিশ্রাম নিই এই দিনটা।’
নিজের স্বপ্ন নিয়ে পিঠা মামা মোবারক বলেন, ‘নিজে তো পড়তে পারি নাই, তাই বাচ্চাগুলানরে ভালোভাবে পড়াশোনাটা করাতে চাই।’ আর একটা ভালো পিঠার দোকান দেওয়ার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক মোবারক মামার। সূর্য তখন মধ্যগগনে। পিঠা মামার সঙ্গে গল্পের ইতি টেনে উঠে পড়ি। কিন্তু পিঠা না খেয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না মোবারক মামা। ছোট্ট কড়াই থেকে ভাপ ওঠা গরম পিঠা তুলে কাগজের মধ্যে করে দিলেন তিনি। পিঠা খেতে খেতে এগিয়ে চলি, কিন্তু স্থির থাকেন মোবারক মামা। ঠিক তাঁর চার চাকাওয়ালা গাড়িটির মতো। যে চাকা শত চেষ্টা করলেও ঘোরে না। কিন্তু চালকের চেষ্টা থাকে নিরন্তর।
শারমিন নাহার
দোকানের সামনে এসে গরম পিঠার অর্ডার দিতেই মোবারক মামা বলেন, ‘খাড়ান, কেবল তো আইলেন, একটু জিরান।’ এরপর মাথায় গামছা বেঁধে পুরো মনোযোগটা দেন পিঠা বানানোর দিকে। তাই কথা বলার ফুরসত মেলা ভার। দাঁড়িয়ে থাকি মামার ব্যস্ততা কমার আশায়। এরই মধ্যে ‘পিঠা মামা’র বড় ছেলে জুয়েল স্কুল থেকে এসে হাত লাগিয়েছে কাজে। এবার খানিকটা দম ফেলার ফুরসত পেলেন মোহাম্মদ মোবারক।
বাড়ি তাঁর সিলেটের লালাবাগ গ্রামে। বাবাকে হারিয়েছেন খুব ছোটবেলায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় হওয়ায় সংসারের দায়িত্বটা চেপে যায় তাঁর কাঁধে। জীবিকার তাগিদে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় আসেন কাজের খোঁজে। প্রথমদিকে কিছুদিন ছোটখাটো ঠেকা কাজ করতেন। এরপর শুরু করেন পিঠার ব্যবসা। তা-ও প্রায় ২০-২২ বছর আগের কথা।
প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে পিঠা বিক্রি করলেও পাঁচ বছর হলো চারুকলার শাহনেওয়াজ হলের গেটে দোকানদারি করছেন। নিউমার্কেট ছাড়া শাহনেওয়াজ হল, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা তাঁর নিয়মিত খদ্দের। তাঁর কাছে পিঠা খেতে গেলে উপরি হিসেবে মিলবে কয়েক পদের চাটনি আর ভর্তা। কালিজিরা, সরষে আর চিংড়ির ভর্তা প্রতিদিনই তৈরি করেন তিনি। কারণ, গরম পিঠার সঙ্গে ঝাল ভর্তা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। তবে শীতের দিনে চিতই পিঠার সঙ্গে ভাপা পিঠাও বানান মোবারক মামা।
প্রশ্ন করি, অন্য কিছু না করে কেন পিঠা বানানো শুরু করলেন? পিঠা মামা বলেন, আসলে চিতই পিঠা ভেজাল ও মুক্তভাবে বানানো যায়, আবার খেয়েও সবাই তৃপ্তি পায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পিঠা বানান বলেও দাবি করেন তিনি। আজিমপুর কবরস্থানের পাশে আইয়ুব আলী কলোনিতে বড় ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। ছোট ছেলে, এক মেয়ে আর মাকে নিয়ে বউ থাকে দেশে।
সারা দিনের ব্যস্ততা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মোবারক মামা বলেন, ‘ফজরের আজান পড়লে ঘুম ভাঙে। তার পর থেকে দুই হাত আর জিরনি দেয় না (বিশ্রাম নেয় না)।’ আতপ চাল ধুয়ে গুঁড়া করতে নিয়ে যান নিউমার্কেটে। প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ কেজি চালের পিঠা বানান তিনি। চাল গুঁড়া করা শেষে শুরু হয় ভর্তা বানানোর কাজ। এরপর সব জিনিস আর মালমসলা নিয়ে হাজির হন দোকানে। ছেলে স্কুল থেকে আসে বেলা ১১টায়। তারপর খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন পিঠা মামা।
গ্রামের কথা তাঁর সব সময়ই মনে পড়ে, যেখানে আছেন তাঁর বাকি সন্তান, সহধর্মিণী আর বৃদ্ধ মা। অবসর তাঁর মেলে না বললেই চলে। তার পরও সময় পেলেই ছুটে যান নাড়ির টানে। যান্ত্রিক শহরের ইটপাথর তাঁকে আর আটকে রাখতে পারে না। অবসরে কী করেন? পিঠা মামা বলেন, ‘অবসরই পাই না। তবে মঙ্গলবার নিউমার্কেট বন্ধ থাকে। তাই ওই দিন দোকান খুলি না। ঘরে বসেই বিশ্রাম নিই এই দিনটা।’
নিজের স্বপ্ন নিয়ে পিঠা মামা মোবারক বলেন, ‘নিজে তো পড়তে পারি নাই, তাই বাচ্চাগুলানরে ভালোভাবে পড়াশোনাটা করাতে চাই।’ আর একটা ভালো পিঠার দোকান দেওয়ার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক মোবারক মামার। সূর্য তখন মধ্যগগনে। পিঠা মামার সঙ্গে গল্পের ইতি টেনে উঠে পড়ি। কিন্তু পিঠা না খেয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না মোবারক মামা। ছোট্ট কড়াই থেকে ভাপ ওঠা গরম পিঠা তুলে কাগজের মধ্যে করে দিলেন তিনি। পিঠা খেতে খেতে এগিয়ে চলি, কিন্তু স্থির থাকেন মোবারক মামা। ঠিক তাঁর চার চাকাওয়ালা গাড়িটির মতো। যে চাকা শত চেষ্টা করলেও ঘোরে না। কিন্তু চালকের চেষ্টা থাকে নিরন্তর।
শারমিন নাহার
No comments