চারদিক-কাঁকড়ার কারবার by আজাদুর রহমান
বনগামী বাসগুলো পদে পদে থামে না। চুনকুড়ির বাতা বয়ে মুন্সিগঞ্জ বাজার হলো এগুলোর শেষ স্টপেজ। নোনা ঘাট-মাঠ ফেলে পাল্লা দিয়ে বাসগুলো তাই ছুটতে থাকে দক্ষিণে। সাতক্ষীরা-দেবহাটা-কালীগঞ্জ, তারপর সুদূরের শ্যামনগর। মেইলের মতো চলতে চলতে বড় কোনো বাজারে গিয়ে জিরানোর বিরতি দেয় কেবল। যেমন পারুলিয়া বাজার।
পানবিড়ি থেকে রেডিও-ঘড়ির দোকানও আছে। নেমে গেলাম। দুই মিনিটের হাঁটাপথ। মাচার ওপর ‘এম-এল কাঁকড়া স্টোর’। নাকে আঁশটে গন্ধের হলকা নিয়ে চোখে চোখ রাখলাম। তাতেই শরিফুলের ভ্রূতে ভাঁজ পড়ল, ‘আপনে এনজিও থেকে এয়িছেন?’ খরচা করে কেউ নেহাত কাঁকড়া খুঁজতে পারুলিয়া পর্যন্ত আসতে পারে! এক দাগে বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। ‘না’ শুনে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তবে কী কত্তি এয়িলেন?’
আলাপ হয়ে গেল। আপনাতেই সুতো খুলে গল্পের নদী বয়ে চলল। তখন বয়স কতই আর! পাঁচ কি সাত। পাঞ্জাবি ধরে ছোট্ট শরিফুল বায়না করত। আমজাদ হোসেন ছেলেকে নিয়েই দোকান খুলতেন। কী বোকাই না ছিল ও! কাঁকড়াগুলো কুট্টুস করে আঙুলের চামড়া কেটে দিত, বুঝতেই পারত না। ছবিগুলো মনে আসতেই হো হো করে হেসে উঠলেন শরিফুল, ‘কাঁকড়া ঘাঁটতি ঘাঁটতি ওগা (ওদের) মতিগতি বুয়িলাম; এখন আর সে সুযোগ পায় না। কামড়ের আগেই জায়গামতো ওগা ধরি ফেলি। বুঝতি পারিনি যে একসময়তি ইতি (এটা) আমার রিজিক হবে।’
আবদার করায় শরিফুল খাঁচা খুলে দুটো কাঁকড়া তুলে টেবিলে রাখলেন। এমন জাম্বো সাইজ আগে দেখিনি। মতিগতি আদতেই অদ্ভুত। চোখজোড়া টলটলে নয়, ঘোলা-ঘোলা। দেখে বোকাসোকা মনে হয় বটে, কিন্তু সীমানার মধ্যে কেউ চলে এলে এরা ঠিক ঠিক টের পেয়ে যায়। তখন চোখ জোড়া অ্যান্টেনা হয়ে কোটর উগরে বেরিয়ে আসে। বোঁটা লাগানো পুতলিগুলো যেন সার্চলাইট। চট করে কাঁটাওয়ালা পায়ের ভাঁজ খুলে কাঁমড়ে দিতে চায়। নিয়মকানুন না জানলে বাঁচা মু্শকিল। শরিফুল অভিজ্ঞ হাতে খেলে যান কাঁকড়ার খেলা। পাশের ব্যবসায়ীরাও খেলা দেখতে আসেন। সুড়ুৎ করে মুখের পানের ঝোল টানেন শরিফুল; তারপর কায়দামতো একটা কাঁকড়ার তলপেটে আঙুল দেন, ‘এটে হলো মেইদে (মহিলা)। ওগা বডি দ্যাকপেন গোলমতো। এটটু ছোট, শ্যামলা। প্যাটে ডিম থাকে। সাগরে গোনমুখে (জোয়ামুখ) ওগা বাচ্চা ফোটে। অমাবস্যে-পূর্ণিতে ওরা মিলন করে।’
মর্জিমতো ফের বিপরীত লিঙ্গের কথা তোলেন, ‘দ্যাকেন, পুরুষগুলো সাইজে কিন্তুক বড় এবং রাঙা নঙের (রঙের)।’ এক ছোকরা কোত্থেকে আরও দুটো ঠ্যাংবাঁধা কাঁকড়া টেবিলে এনে ছেড়ে দেয়। খেলা জমে যায়। গল্প আর লাইনমতো চলতে পারে না। মুখ থেকে মুখে এলোমেলো হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করলাম, কাঁকড়া কত কেজি পর্যন্ত হতে পারে? অন্যমনস্ক শরিফুল খানিকক্ষণ হাতড়ে বেড়িয়ে বুদবুদ তুললেন, ‘তা তো কেজি পন্ত হয়। চলেন, আপনেকে দেখাই আনি।’ মতামতের তোয়াক্কা করলেন না। বললেন, ‘হাঁটেন।’
আমরা পিচ মাড়িয়ে ওপারে নেমে গেলাম। ঝুপড়ি দোকানের পর চান্দিনাবাজার। মরা কাঁকড়া পায়ের তলে পড়ে পচ করে থেঁতলে যায়। খেয়াল করার কথা নয়। পুরো চাতালেই আধাপচা কড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বোঁটকা পরিবেশ নতুন লোকের পক্ষে সহ্য করা একটু কঠিনই। ফড়িয়াদের বিকার নেই। দেদারছে বিড়ি টানছে, পরোটায় ডাল মেখে খাচ্ছে। ভিড় ঠেলে কোনায় গিয়ে দাঁড়াই। এক কারবারি এসে কথা যোগ করেন, ‘শোনেন, ম্যালা প্রকার কাঁকড়া আছে। কোন্টার কথা বলব। আমরা বেচি বারো গ্রেডের কাঁকড়া।’ সরে গিয়ে কাঁকড়ার খনি পাওয়া গেল। কজন ঝাঁকা থেকে কাঁকড়া গুনে দিচ্ছিল। শরিফুল কিছু একটা বলতে গেলেন। গণনাকারী মাথা তুলল না, ছন্দতোলা ঝাঁকুনিতে গুনতেই থাকল—একত-একত, দুইত-দুইত...।
ফিরতি পথে শরিফুল হাহাকার করে উঠলেন, ‘আহ্হা, আপ্নাকে তো চা খায়ানি হয়নি।’ দুটো স্পেশাল চা স্টল আছে পারুলিয়ায়। চা-ওয়ালারা দিনভর চুলা জ্বালিয়ে রাখে। জ্বাল দিতে দিতে চার থেকে এক ভাগে নামলে পর লালচে সরধরা দুধ ডাবুতে তুলে এরা কাপে ঢালে। শুধু ঘন দুধে চা এত সুস্বাদু হতে পারে! এরা আসলে লিকার, হিট, দুধ-চিনির গুণ-পরিমাণ বুঝে চা বানাতে শিখেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে সুদূরে চোখ রাখি। খাঁজকাটা পুকুর, পাথারিখেঁজুর ফেলে দিগন্তে গিয়ে মিল খেয়েছে মোলায়েম পাথার। আরও দূরে কাকশিয়ালি নদী আছে। জোয়ার-ভাটা হয়। তখন নাকি রূপ-অরূপের খেলা চলে। আনমনেই নগুরেদের কথা ভেবে আফসোস করে উঠি, ‘আহা, যদি তাঁরা এখানে আসত! মোজা খুলে পায়ের তালুতে একটু হাওয়া নিত! তেতো চোখজোড়া যদি জলপরানে চুবিয়ে নিত! আহা।’ নিরাময়ী দিগন্তে চেয়ে চেয়ে আমরা চায়ে শেষ চুমুক নামাই।
দোকানে গিয়ে শরিফুল অন্য কথা তুললেন, ‘বেচাকেনা শেষ হলি বাড়িত গি সাবান দি হাত ধুলে গন্ধ থাকে না। কাঁকড়া মুরে গেলে গন্ধটা বেশি লাগে।’ কাঁকড়া মরলে দুঃখ হয়? তিনি উদাসী গলা তুললেন, ‘আমি ওগা সোনার মতোনই দেখি। মুরে গেলে কষ্ট লাগে। টাকার জন্যি নয়। নাড়াচাড়া কত্তি কত্তি ইগে সাথেই আমার ইকটা কারবার হই গ্যাছে। ভালো না বাইস্যে তো গতি নাই। উগে সাতেই তো আমার জীবন।’
গল্পের কোনো বিষয় থাকে না। হাবিজাবি প্রশ্ন তুলে আলাপ করি। শরিফুল আমাকে বাসে তুলে দেন। তাঁর মাটিমুখো ছবিটা ছোট হয়ে আড়ালে পড়ে।
আর গাছালি পথ ধরে ছুটে চলে বনগামী বাস। কালীগঞ্জ হয়ে শ্যামনগর। বুনো বাতাসের ঢেউ লাগে। পথের পাশেই রেওয়াজ তুলে দেখা মিলছে কেওড়া, গরানের। বন পেতে দেরি নেই। হেলপার গলা চড়ায়—এ-এই মুন্সিগঞ্জ...মুন্সিগঞ্জ...।
আলাপ হয়ে গেল। আপনাতেই সুতো খুলে গল্পের নদী বয়ে চলল। তখন বয়স কতই আর! পাঁচ কি সাত। পাঞ্জাবি ধরে ছোট্ট শরিফুল বায়না করত। আমজাদ হোসেন ছেলেকে নিয়েই দোকান খুলতেন। কী বোকাই না ছিল ও! কাঁকড়াগুলো কুট্টুস করে আঙুলের চামড়া কেটে দিত, বুঝতেই পারত না। ছবিগুলো মনে আসতেই হো হো করে হেসে উঠলেন শরিফুল, ‘কাঁকড়া ঘাঁটতি ঘাঁটতি ওগা (ওদের) মতিগতি বুয়িলাম; এখন আর সে সুযোগ পায় না। কামড়ের আগেই জায়গামতো ওগা ধরি ফেলি। বুঝতি পারিনি যে একসময়তি ইতি (এটা) আমার রিজিক হবে।’
আবদার করায় শরিফুল খাঁচা খুলে দুটো কাঁকড়া তুলে টেবিলে রাখলেন। এমন জাম্বো সাইজ আগে দেখিনি। মতিগতি আদতেই অদ্ভুত। চোখজোড়া টলটলে নয়, ঘোলা-ঘোলা। দেখে বোকাসোকা মনে হয় বটে, কিন্তু সীমানার মধ্যে কেউ চলে এলে এরা ঠিক ঠিক টের পেয়ে যায়। তখন চোখ জোড়া অ্যান্টেনা হয়ে কোটর উগরে বেরিয়ে আসে। বোঁটা লাগানো পুতলিগুলো যেন সার্চলাইট। চট করে কাঁটাওয়ালা পায়ের ভাঁজ খুলে কাঁমড়ে দিতে চায়। নিয়মকানুন না জানলে বাঁচা মু্শকিল। শরিফুল অভিজ্ঞ হাতে খেলে যান কাঁকড়ার খেলা। পাশের ব্যবসায়ীরাও খেলা দেখতে আসেন। সুড়ুৎ করে মুখের পানের ঝোল টানেন শরিফুল; তারপর কায়দামতো একটা কাঁকড়ার তলপেটে আঙুল দেন, ‘এটে হলো মেইদে (মহিলা)। ওগা বডি দ্যাকপেন গোলমতো। এটটু ছোট, শ্যামলা। প্যাটে ডিম থাকে। সাগরে গোনমুখে (জোয়ামুখ) ওগা বাচ্চা ফোটে। অমাবস্যে-পূর্ণিতে ওরা মিলন করে।’
মর্জিমতো ফের বিপরীত লিঙ্গের কথা তোলেন, ‘দ্যাকেন, পুরুষগুলো সাইজে কিন্তুক বড় এবং রাঙা নঙের (রঙের)।’ এক ছোকরা কোত্থেকে আরও দুটো ঠ্যাংবাঁধা কাঁকড়া টেবিলে এনে ছেড়ে দেয়। খেলা জমে যায়। গল্প আর লাইনমতো চলতে পারে না। মুখ থেকে মুখে এলোমেলো হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করলাম, কাঁকড়া কত কেজি পর্যন্ত হতে পারে? অন্যমনস্ক শরিফুল খানিকক্ষণ হাতড়ে বেড়িয়ে বুদবুদ তুললেন, ‘তা তো কেজি পন্ত হয়। চলেন, আপনেকে দেখাই আনি।’ মতামতের তোয়াক্কা করলেন না। বললেন, ‘হাঁটেন।’
আমরা পিচ মাড়িয়ে ওপারে নেমে গেলাম। ঝুপড়ি দোকানের পর চান্দিনাবাজার। মরা কাঁকড়া পায়ের তলে পড়ে পচ করে থেঁতলে যায়। খেয়াল করার কথা নয়। পুরো চাতালেই আধাপচা কড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বোঁটকা পরিবেশ নতুন লোকের পক্ষে সহ্য করা একটু কঠিনই। ফড়িয়াদের বিকার নেই। দেদারছে বিড়ি টানছে, পরোটায় ডাল মেখে খাচ্ছে। ভিড় ঠেলে কোনায় গিয়ে দাঁড়াই। এক কারবারি এসে কথা যোগ করেন, ‘শোনেন, ম্যালা প্রকার কাঁকড়া আছে। কোন্টার কথা বলব। আমরা বেচি বারো গ্রেডের কাঁকড়া।’ সরে গিয়ে কাঁকড়ার খনি পাওয়া গেল। কজন ঝাঁকা থেকে কাঁকড়া গুনে দিচ্ছিল। শরিফুল কিছু একটা বলতে গেলেন। গণনাকারী মাথা তুলল না, ছন্দতোলা ঝাঁকুনিতে গুনতেই থাকল—একত-একত, দুইত-দুইত...।
ফিরতি পথে শরিফুল হাহাকার করে উঠলেন, ‘আহ্হা, আপ্নাকে তো চা খায়ানি হয়নি।’ দুটো স্পেশাল চা স্টল আছে পারুলিয়ায়। চা-ওয়ালারা দিনভর চুলা জ্বালিয়ে রাখে। জ্বাল দিতে দিতে চার থেকে এক ভাগে নামলে পর লালচে সরধরা দুধ ডাবুতে তুলে এরা কাপে ঢালে। শুধু ঘন দুধে চা এত সুস্বাদু হতে পারে! এরা আসলে লিকার, হিট, দুধ-চিনির গুণ-পরিমাণ বুঝে চা বানাতে শিখেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে সুদূরে চোখ রাখি। খাঁজকাটা পুকুর, পাথারিখেঁজুর ফেলে দিগন্তে গিয়ে মিল খেয়েছে মোলায়েম পাথার। আরও দূরে কাকশিয়ালি নদী আছে। জোয়ার-ভাটা হয়। তখন নাকি রূপ-অরূপের খেলা চলে। আনমনেই নগুরেদের কথা ভেবে আফসোস করে উঠি, ‘আহা, যদি তাঁরা এখানে আসত! মোজা খুলে পায়ের তালুতে একটু হাওয়া নিত! তেতো চোখজোড়া যদি জলপরানে চুবিয়ে নিত! আহা।’ নিরাময়ী দিগন্তে চেয়ে চেয়ে আমরা চায়ে শেষ চুমুক নামাই।
দোকানে গিয়ে শরিফুল অন্য কথা তুললেন, ‘বেচাকেনা শেষ হলি বাড়িত গি সাবান দি হাত ধুলে গন্ধ থাকে না। কাঁকড়া মুরে গেলে গন্ধটা বেশি লাগে।’ কাঁকড়া মরলে দুঃখ হয়? তিনি উদাসী গলা তুললেন, ‘আমি ওগা সোনার মতোনই দেখি। মুরে গেলে কষ্ট লাগে। টাকার জন্যি নয়। নাড়াচাড়া কত্তি কত্তি ইগে সাথেই আমার ইকটা কারবার হই গ্যাছে। ভালো না বাইস্যে তো গতি নাই। উগে সাতেই তো আমার জীবন।’
গল্পের কোনো বিষয় থাকে না। হাবিজাবি প্রশ্ন তুলে আলাপ করি। শরিফুল আমাকে বাসে তুলে দেন। তাঁর মাটিমুখো ছবিটা ছোট হয়ে আড়ালে পড়ে।
আর গাছালি পথ ধরে ছুটে চলে বনগামী বাস। কালীগঞ্জ হয়ে শ্যামনগর। বুনো বাতাসের ঢেউ লাগে। পথের পাশেই রেওয়াজ তুলে দেখা মিলছে কেওড়া, গরানের। বন পেতে দেরি নেই। হেলপার গলা চড়ায়—এ-এই মুন্সিগঞ্জ...মুন্সিগঞ্জ...।
No comments