বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৫২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। দেলোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক যুদ্ধে আহত হন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান বেশ সুবিধাজনক স্থানে। সেখানে আক্রমণ চালানো বেশ বিপজ্জনক। মুক্তিযোদ্ধাদেরই ক্ষয়ক্ষতি হবে বেশি। তার পরও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালেন।
তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলে আছেন দেলোয়ার হোসেন। সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ চালিয়েও তাঁরা ব্যর্থ হলেন। পাকিস্তানিদের আক্রমণে শহীদ ও আহত হলেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। এ ঘটনা চন্দ্রপুরের। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর।
চন্দ্রপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অন্তর্গত। কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেদিন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের বিবরণ আছে মেজর আইন উদ্দিনের (বীর প্রতীক, পরে মেজর জেনারেল) লেখায়।
মেজর আইন উদ্দিন লিখেছেন: ‘১৮ নভেম্বর তারিখে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার (জেনারেল) তুলে আমাকে বলেন যে তাঁরা যৌথভাবে চন্দ্রপুর লাটুমুড়া হিল আক্রমণ করবেন। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান করছিল।
‘তিনি (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুলে) পরিকল্পনা করলেন, কিন্তু সে পরিকল্পনা আমার মনঃপূত হলো না। কারণ, চন্দ্রপুর গ্রামের সঙ্গেই ছিল লাটুমুড়া হিল (পাহাড়)। চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে লাটুমুড়া হিল থেকে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের অতি সহজেই ঘায়েল করতে পারবে।
‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে হলো। বাংলাদেশ বাহিনীর কোম্পানি পরিচালনা করেন লেফটেন্যান্ট খন্দকার আবদুল আজিজ (বীর বিক্রম, প্রকৃত নাম খন্দকার আজিজুল ইসলাম)। পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করে।
‘এই আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরাই শহীদ হন বেশি। ভারতীয় বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর ও তিনজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ ৪৫ জন এবং মুক্তিবাহিনীর শহীদ হন ২২ জন। আমাদের কোম্পানি কমান্ডারও শহীদ হন। ২২ তারিখ রাতে চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে সারা রাত যুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যায়ে পেছনের দিকে চলে যায়। আমাদের যৌথ বাহিনী যুদ্ধ করে চন্দ্রপুর দখল করে নেয়, কিন্তু পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর দখল করে।’
চন্দ্রপুরে দেলোয়ার হোসেন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাঁর চোখের সামনে শহীদ হন কয়েকজন সহযোদ্ধা। তিনি নিজেও যুদ্ধে একপর্যায়ে আহত হন। আহত অবস্থায়ও যুদ্ধ চালিয়ে যান। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে ফিল্ড হাসপাতালে পাঠান।
দেলোয়ার হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরের গঙ্গাসাগর সাবসেক্টরে। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চন্দ্রপুর যুদ্ধের কয়েক দিন আগে কালাছড়া চা-বাগান আক্রমণেও তিনি অংশ নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য দেলোয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৬।
দেলোয়ার হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই চাকরি করেন। ১৯৯৩ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আইন পেশায় যোগ দেন। তখন তাঁর পদবি দিল নায়েব সুবেদার। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিনি মারা যান। দেলোয়ার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার নিলাখাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল হাই। মা রোকেয়া বেগম। স্ত্রী শাহানা বেগম। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: সাকিল আজাদ (দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
tৎৎashed@gmail.com
চন্দ্রপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অন্তর্গত। কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেদিন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের বিবরণ আছে মেজর আইন উদ্দিনের (বীর প্রতীক, পরে মেজর জেনারেল) লেখায়।
মেজর আইন উদ্দিন লিখেছেন: ‘১৮ নভেম্বর তারিখে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার (জেনারেল) তুলে আমাকে বলেন যে তাঁরা যৌথভাবে চন্দ্রপুর লাটুমুড়া হিল আক্রমণ করবেন। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান করছিল।
‘তিনি (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুলে) পরিকল্পনা করলেন, কিন্তু সে পরিকল্পনা আমার মনঃপূত হলো না। কারণ, চন্দ্রপুর গ্রামের সঙ্গেই ছিল লাটুমুড়া হিল (পাহাড়)। চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে লাটুমুড়া হিল থেকে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের অতি সহজেই ঘায়েল করতে পারবে।
‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে হলো। বাংলাদেশ বাহিনীর কোম্পানি পরিচালনা করেন লেফটেন্যান্ট খন্দকার আবদুল আজিজ (বীর বিক্রম, প্রকৃত নাম খন্দকার আজিজুল ইসলাম)। পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করে।
‘এই আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরাই শহীদ হন বেশি। ভারতীয় বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর ও তিনজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ ৪৫ জন এবং মুক্তিবাহিনীর শহীদ হন ২২ জন। আমাদের কোম্পানি কমান্ডারও শহীদ হন। ২২ তারিখ রাতে চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে সারা রাত যুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যায়ে পেছনের দিকে চলে যায়। আমাদের যৌথ বাহিনী যুদ্ধ করে চন্দ্রপুর দখল করে নেয়, কিন্তু পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর দখল করে।’
চন্দ্রপুরে দেলোয়ার হোসেন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাঁর চোখের সামনে শহীদ হন কয়েকজন সহযোদ্ধা। তিনি নিজেও যুদ্ধে একপর্যায়ে আহত হন। আহত অবস্থায়ও যুদ্ধ চালিয়ে যান। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে ফিল্ড হাসপাতালে পাঠান।
দেলোয়ার হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরের গঙ্গাসাগর সাবসেক্টরে। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চন্দ্রপুর যুদ্ধের কয়েক দিন আগে কালাছড়া চা-বাগান আক্রমণেও তিনি অংশ নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য দেলোয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৬।
দেলোয়ার হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই চাকরি করেন। ১৯৯৩ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আইন পেশায় যোগ দেন। তখন তাঁর পদবি দিল নায়েব সুবেদার। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিনি মারা যান। দেলোয়ার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার নিলাখাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল হাই। মা রোকেয়া বেগম। স্ত্রী শাহানা বেগম। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: সাকিল আজাদ (দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
tৎৎashed@gmail.com
No comments