যুক্তি তর্ক গল্প-নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা by আবুল মোমেন
নদী অববাহিকার এই দেশে নদী ও ভূমি দুটিই খুব জাগ্রত—নদীর খাতবদল আর ভূমির ভাঙা-গড়ার কথা কে না জানে। আমাদের রাজনীতিতেও এ অস্থিরতা ও পরিবর্তনশীলতার প্রতিফলনই ঘটে চলেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও এ অস্থিরতা কমেনি। পর পর দুটি নির্বাচনে এখনো একই দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি।
প্রতিবারই দেখছি সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যেই সমালোচকের কণ্ঠ বড় হয়ে উঠেছে।
অদলবদল অস্থিরতা যা-ই ঘটুক, মানুষের মনে কিন্তু নেতৃত্ব নিয়ে পূর্ণ সন্তুষ্টি নেই। বড় দল-ছোট দল সর্বত্র নেতৃত্বে যে স্থিতাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, তাকে অচলাবস্থাও বলা যায়। অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে গতিশীলতা তথা পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, সেখানে তার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায় না। দুই নেত্রীই নিজ নিজ দলের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। দলের অন্যদের অবস্থান ও ভূমিকা পালনের সুযোগ এবং কদর ও উত্থান সম্পূর্ণ নির্ভর করে নেত্রীর মূল্যায়নের ওপর। এভাবে দলীয় এবং সময় সময় সরকারের নেতৃত্ব একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে সংকুচিত, স্তিমিত হয়ে পড়ছে। হারাচ্ছে সৃজনশীলতা, বহুদর্শিতা ও কার্যকারিতা।
কথাটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
আমরা আমাদের কালে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি কর্মী থেকে দলীয় নেতা, আবার সে পর্যায় থেকে জাতীয় মহানায়ক হয়ে উঠতে। এমনকি সেখান থেকে একসময় তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নেতা হয়ে ওঠেন। তাঁর বিকাশ ও ভূমিকা পর্যালোচনা করলে একজন বড় মাপের নেতার করণীয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট ধারণা ও লক্ষ্য ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাই এ দেশের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সক্রিয় সংযোগ গড়ে ওঠে। তিনি বাঙালি অর্থনীতিবিদদের প্রণীত দুই অর্থনীতি তত্ত্বটি অনুধাবন করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে তাঁদের ভূমিকাকে রাজনীতিতে ধারণ করেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, রেহমান সোবহান প্রমুখ তাঁর চিন্তাজগৎকে প্রভাবিত করেন এবং রাজনীতিতে তিনি তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চিঠি লেখেন তাঁর ‘শক্ত কেন্দ্র কী ও কেন’ প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে বিতরণের অনুমতি চেয়ে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যোগ্য-দক্ষ মানুষদের চেনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁদের অনেককেই অভিভাবকের মতো সম্মানের আসন দিয়েছেন; বড় কথা হলো, তাঁদের দেশসেবার যোগ্যতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। একইভাবে তাঁরই নেতৃত্বে তাজউদ্দীন আহমদের মতো ধীমান দক্ষ নেতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। ষাটের দশকে, বিশেষত সত্তরের নির্বাচন থেকে একাত্তরের অসহযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দল ও দেশের মূল নির্বাহী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অনন্য ভূমিকা এ দেশের মানুষ কখনো ভুলবে না। তাঁর এই বিকাশ সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিনে যথাযথ স্থানে তুলে আনার ফলে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমরা দেখি ভিন্নমত ভিন্ন দল ছেড়ে অনেকেই আওয়ামী লীগে এসে যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ঐক্যের এই বিস্তারকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন। তখন সুবিধাবাদের জন্য দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি, ঘটেছিল আদর্শের বিস্তারের কারণে।
আমরা জানি, আগরতলা মামলা থেকে বেরোনোর পরে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বদলীয় যে বৈঠক হচ্ছিল, সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদের একটি দল তাঁকে তথ্য-উপাত্ত এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। এভাবে দলের বাইরেও তাঁর সিনিয়র, সমবয়সী ও জুনিয়রদের দেশ ও দশের জন্য সেবা দেওয়ার সুযোগ তিনি করে দিয়েছিলেন। দেশ গড়ার কাজটা সংকীর্ণভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যাপার রাখেননি। আর আওয়ামী লীগেও তিনি সংকীর্ণভাবে নিজের পছন্দের মানুষদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েননি।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আনিসুর রহমান একবার ঘরোয়া বৈঠকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির সূত্রপাত হয়েছে মুজিব-তাজউদ্দীন দূরত্ব তৈরি হওয়ার মাধ্যমে।
আমি আগেও লিখেছি আজও বলব, বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশ হিসেবে ঘুরে দাঁড়িয়ে যথার্থ লক্ষ্যে বিকশিত হওয়ার এটাই যেন শেষ সুযোগ। এ কাজের দায় ইতিহাস তুলে দিয়েছে শেখ হাসিনার কাঁধে। একদিক থেকে এটাকে বলা যায় ইতিহাসের ন্যায় প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়—পিতার আরব্ধ কাজ কন্যার ওপর বর্তাল। কাজটা ঠিকই হয়েছে।
শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, কাজটা কঠিন, এমনকি এও বলেছেন যে ছিয়ানব্বইয়ের পর এবার আরও কঠিন মনে হচ্ছে সরকার পরিচালনা। আমরাও বুঝি, দিনে দিনে এ কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। কীভাবে কঠিন হয়ে পড়ছে, সেটা বোঝা দরকার।
প্রথমেই বলব তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। তাঁর ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে, তাঁর জীবন অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে, সেটা আমরা জানি। ফলে তাঁকে নিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-সতর্কতা। এতে করে জনপ্রিয় জননায়কের সঙ্গে কর্মী, সমর্থক, সমমনাদের নিয়মিত সহজ সংযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতা জনপ্রিয় নেতার অনুকূলে না এলেও এর কোনো প্রতিকার আমাদের জানা নেই।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, পঁচাত্তরের পর থেকে সামরিক স্বৈরশাসকদের জবরদস্তিমূলক অপশাসনের ফলে রাজনীতি নানাভাবে দূষিত হয়েছে। অর্থ, ক্ষমতা, অস্ত্র—সবকিছুর অপব্যবহারের ধকল নিয়ে যে রাজনীতি দূষিত হয়েছে, তার কুশীলবেরা তো আর তা থেকে মুক্ত থাকেননি। তাই বলব, পরিস্থিতিটা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আমলের চেয়ে গুণগতভাবে ভিন্ন হয়ে পড়েছে। দলীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁকে বাছবিচার করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে হচ্ছে কি না, সেটাই বিচার্য বিষয়।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, স্বাধীনতার পর থেকে সমাজে সুবিধাবাদের চর্চা হয়েছে ব্যাপকভাবে। তদুপরি বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির রমরমার ফলে বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের মধ্যেও ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে সুবিধাবাদের প্রসার ঘটেছে। ফলে তাঁদের কাছ থেকে ষাটের দশকে যে স্পষ্ট, দৃঢ়, পরিচ্ছন্ন সহযোগিতা, পরামর্শ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, এখন সম্ভবত সে বাস্তবতা আর নেই। এ কারণে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে লেনদেনের সংস্কৃতি জোরদার হয়ে পড়েছে। আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ নিঃস্বার্থ সমর্থন পাওয়াও দুষ্কর আজ।
চতুর্থ একটি সমস্যাও সম্ভবত শেখ হাসিনার জন্য তৈরি ছিল। তাঁকে বিশেষ পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে হয়েছে, দেশের রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা নিতে হয়েছে। অধিকাংশ দলীয় নেতা ছিলেন পিতৃবন্ধু, পিতার সহকর্মী, অনুসারী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর পূর্বসূরি। আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রেও এ কথাই সত্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাঙালির স্বভাব অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে অভিভাবক ও মুরব্বির ভূমিকা নিয়ে অনেকেই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁর বিশেষ একান্ত শুভানুধ্যায়ী হতে চেয়েছেন অনেকে, আর এভাবে তাঁকে আপন আপন বলয়ে রাখতে চেয়েছেন এঁরা। শেখ হাসিনাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাস্তবতা অনুধাবন করতে হয়েছে। তাঁর জন্য এটা এক কঠিন এবং সময় সময় বিরক্তিকর অভিযাত্রা ছিল সন্দেহ নেই। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে তবু বলি, পথ চলতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে তাঁকে নিজের পথ নিজকে সৃষ্টি করে নিতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, এভাবে তিনি একটু বেশি একা হয়ে পড়লেন কি? একান্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত একটি বৃত্তের মধ্যে স্বস্তি বোধ করতে শুরু করছেন না তো? আমি ঠিক জানি না।
তবে একটু যেন মনে হয় নেতৃত্ব ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে, কিছুটা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় সিদ্ধান্তগুলো নানামুখী বিবেচনার পরিপক্বতার ছাপ বহন করছে না। প্রশ্ন ওঠে মনে, দেশের নানা ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রাখতে পারেন, তাঁদের কি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকছে, নাকি সরকার বড্ড আমলানির্ভর বড্ড অনুগত নেতানির্ভর হয়ে পড়ছে? সরকার ও সরকারি বলয়ের অনেকের কথায় তোষামোদের ভাষা ও সুর শোনা যাচ্ছে। আবার খুব সহজেই যোগ্য, দক্ষ, মানী লোকেরা বিশেষ সংগত কারণ ছাড়াই সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়ছেন। সরকার বা নেতৃত্ব কি ওভার রিঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ছেন? অরাজনৈতিক কিংবা অন্য রাজনৈতিক ভাবনার মানুষজন কি কাজের সুযোগ পাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী কি তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে সুপার প্রধানমন্ত্রী ও সুপার নেত্রী হয়ে পড়ছেন?
এর পরিণতি হবে সরকারের কাজকর্মে মন্থরতা এবং দলের গতিহীনতা। রাজনৈতিক শক্তি, সদিচ্ছা এবং কার্যক্রমের বাহন ও মঞ্চের অকার্যকরতা কিংবা ঊনকার্যকরতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। তাতে কথার ফুলঝুরি বাড়বে, সহিষ্ণুতা কমবে, অনুদারতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির হয়ে পড়বে।
আমাদের দেশে বিরোধিতার রাজনীতি চর্চা এক অর্থে খুব সহজ। এর প্রকাশ ঘটে ভাঙচুর করা, অচল করে দেওয়া এবং ভাড়াটে লোক দিয়ে সমাবেশ করার মাধ্যমে। এ কাজ রিকশাচালক, পোশাককর্মী যেমন পারে তেমনি রাজনৈতিক কর্মীর জন্যও সহজ কাজ। এ কাজের কোনো রাজনৈতিক প্রভাব নেই, যেটুকু আছে তা নেতিবাচক।
আজকে এ কথাগুলো আলোচনার উদ্দেশ্য হলো মানুষ কেবল বিরোধিতার রাজনীতিতে উৎসাহী নয়, আর তারা এই অসহিষ্ণুতা ও নেতিবাচক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এ বিষয়ে তাদের মতামত সুস্পষ্ট। মানুষ চায় অর্থনৈতিক উন্নতি, মর্যাদাসম্পন্ন জীবন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ শান্তিপূর্ণ জীবন। এর জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইতিহাস বিকৃতি রোধ, জঙ্গিবাদ দমনসহ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার পক্ষে জোরালো জনমত তৈরি হয়েছিল এ নির্বাচনের সময়। বলা যায়, এ লক্ষ্যে দেশে জাতীয় ঐক্য ও জাগরণ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ অনেকটা ঊনসত্তরের পরে সৃষ্ট গণজাগরণ, গণজোয়ার ও জাতীয় ঐক্যের মতোই ঘটনা। সেদিন বঙ্গবন্ধু যথাযথ নেতৃত্বের মাধ্যমে সূচিত জাগরণ ও ঐক্যের ফসল জাতির জন্য তুলে আনতে পেরেছিলেন।
আমাদের উদ্বেগ হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা পুনরায় সৃষ্ট এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন কি না। তিনি তা পারলেই বঙ্গবন্ধুর আরব্ধ কাজ, অর্থাৎ পিতার সূচিত কাজ কন্যার হাতে সমাপ্ত হবে। জাতি সেদিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এ নিয়ে সবার মনে উদ্বেগ আছে। কারণ, এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে দেশের সর্বনাশ হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
অদলবদল অস্থিরতা যা-ই ঘটুক, মানুষের মনে কিন্তু নেতৃত্ব নিয়ে পূর্ণ সন্তুষ্টি নেই। বড় দল-ছোট দল সর্বত্র নেতৃত্বে যে স্থিতাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, তাকে অচলাবস্থাও বলা যায়। অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে গতিশীলতা তথা পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, সেখানে তার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায় না। দুই নেত্রীই নিজ নিজ দলের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। দলের অন্যদের অবস্থান ও ভূমিকা পালনের সুযোগ এবং কদর ও উত্থান সম্পূর্ণ নির্ভর করে নেত্রীর মূল্যায়নের ওপর। এভাবে দলীয় এবং সময় সময় সরকারের নেতৃত্ব একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে সংকুচিত, স্তিমিত হয়ে পড়ছে। হারাচ্ছে সৃজনশীলতা, বহুদর্শিতা ও কার্যকারিতা।
কথাটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
আমরা আমাদের কালে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি কর্মী থেকে দলীয় নেতা, আবার সে পর্যায় থেকে জাতীয় মহানায়ক হয়ে উঠতে। এমনকি সেখান থেকে একসময় তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নেতা হয়ে ওঠেন। তাঁর বিকাশ ও ভূমিকা পর্যালোচনা করলে একজন বড় মাপের নেতার করণীয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট ধারণা ও লক্ষ্য ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাই এ দেশের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সক্রিয় সংযোগ গড়ে ওঠে। তিনি বাঙালি অর্থনীতিবিদদের প্রণীত দুই অর্থনীতি তত্ত্বটি অনুধাবন করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে তাঁদের ভূমিকাকে রাজনীতিতে ধারণ করেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, রেহমান সোবহান প্রমুখ তাঁর চিন্তাজগৎকে প্রভাবিত করেন এবং রাজনীতিতে তিনি তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চিঠি লেখেন তাঁর ‘শক্ত কেন্দ্র কী ও কেন’ প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে বিতরণের অনুমতি চেয়ে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যোগ্য-দক্ষ মানুষদের চেনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁদের অনেককেই অভিভাবকের মতো সম্মানের আসন দিয়েছেন; বড় কথা হলো, তাঁদের দেশসেবার যোগ্যতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। একইভাবে তাঁরই নেতৃত্বে তাজউদ্দীন আহমদের মতো ধীমান দক্ষ নেতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। ষাটের দশকে, বিশেষত সত্তরের নির্বাচন থেকে একাত্তরের অসহযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দল ও দেশের মূল নির্বাহী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অনন্য ভূমিকা এ দেশের মানুষ কখনো ভুলবে না। তাঁর এই বিকাশ সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিনে যথাযথ স্থানে তুলে আনার ফলে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমরা দেখি ভিন্নমত ভিন্ন দল ছেড়ে অনেকেই আওয়ামী লীগে এসে যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ঐক্যের এই বিস্তারকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন। তখন সুবিধাবাদের জন্য দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি, ঘটেছিল আদর্শের বিস্তারের কারণে।
আমরা জানি, আগরতলা মামলা থেকে বেরোনোর পরে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বদলীয় যে বৈঠক হচ্ছিল, সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদের একটি দল তাঁকে তথ্য-উপাত্ত এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। এভাবে দলের বাইরেও তাঁর সিনিয়র, সমবয়সী ও জুনিয়রদের দেশ ও দশের জন্য সেবা দেওয়ার সুযোগ তিনি করে দিয়েছিলেন। দেশ গড়ার কাজটা সংকীর্ণভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যাপার রাখেননি। আর আওয়ামী লীগেও তিনি সংকীর্ণভাবে নিজের পছন্দের মানুষদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েননি।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আনিসুর রহমান একবার ঘরোয়া বৈঠকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির সূত্রপাত হয়েছে মুজিব-তাজউদ্দীন দূরত্ব তৈরি হওয়ার মাধ্যমে।
আমি আগেও লিখেছি আজও বলব, বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশ হিসেবে ঘুরে দাঁড়িয়ে যথার্থ লক্ষ্যে বিকশিত হওয়ার এটাই যেন শেষ সুযোগ। এ কাজের দায় ইতিহাস তুলে দিয়েছে শেখ হাসিনার কাঁধে। একদিক থেকে এটাকে বলা যায় ইতিহাসের ন্যায় প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়—পিতার আরব্ধ কাজ কন্যার ওপর বর্তাল। কাজটা ঠিকই হয়েছে।
শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, কাজটা কঠিন, এমনকি এও বলেছেন যে ছিয়ানব্বইয়ের পর এবার আরও কঠিন মনে হচ্ছে সরকার পরিচালনা। আমরাও বুঝি, দিনে দিনে এ কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। কীভাবে কঠিন হয়ে পড়ছে, সেটা বোঝা দরকার।
প্রথমেই বলব তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। তাঁর ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে, তাঁর জীবন অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে, সেটা আমরা জানি। ফলে তাঁকে নিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-সতর্কতা। এতে করে জনপ্রিয় জননায়কের সঙ্গে কর্মী, সমর্থক, সমমনাদের নিয়মিত সহজ সংযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতা জনপ্রিয় নেতার অনুকূলে না এলেও এর কোনো প্রতিকার আমাদের জানা নেই।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, পঁচাত্তরের পর থেকে সামরিক স্বৈরশাসকদের জবরদস্তিমূলক অপশাসনের ফলে রাজনীতি নানাভাবে দূষিত হয়েছে। অর্থ, ক্ষমতা, অস্ত্র—সবকিছুর অপব্যবহারের ধকল নিয়ে যে রাজনীতি দূষিত হয়েছে, তার কুশীলবেরা তো আর তা থেকে মুক্ত থাকেননি। তাই বলব, পরিস্থিতিটা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আমলের চেয়ে গুণগতভাবে ভিন্ন হয়ে পড়েছে। দলীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁকে বাছবিচার করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে হচ্ছে কি না, সেটাই বিচার্য বিষয়।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, স্বাধীনতার পর থেকে সমাজে সুবিধাবাদের চর্চা হয়েছে ব্যাপকভাবে। তদুপরি বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির রমরমার ফলে বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের মধ্যেও ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে সুবিধাবাদের প্রসার ঘটেছে। ফলে তাঁদের কাছ থেকে ষাটের দশকে যে স্পষ্ট, দৃঢ়, পরিচ্ছন্ন সহযোগিতা, পরামর্শ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, এখন সম্ভবত সে বাস্তবতা আর নেই। এ কারণে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে লেনদেনের সংস্কৃতি জোরদার হয়ে পড়েছে। আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ নিঃস্বার্থ সমর্থন পাওয়াও দুষ্কর আজ।
চতুর্থ একটি সমস্যাও সম্ভবত শেখ হাসিনার জন্য তৈরি ছিল। তাঁকে বিশেষ পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে হয়েছে, দেশের রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা নিতে হয়েছে। অধিকাংশ দলীয় নেতা ছিলেন পিতৃবন্ধু, পিতার সহকর্মী, অনুসারী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর পূর্বসূরি। আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রেও এ কথাই সত্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাঙালির স্বভাব অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে অভিভাবক ও মুরব্বির ভূমিকা নিয়ে অনেকেই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁর বিশেষ একান্ত শুভানুধ্যায়ী হতে চেয়েছেন অনেকে, আর এভাবে তাঁকে আপন আপন বলয়ে রাখতে চেয়েছেন এঁরা। শেখ হাসিনাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাস্তবতা অনুধাবন করতে হয়েছে। তাঁর জন্য এটা এক কঠিন এবং সময় সময় বিরক্তিকর অভিযাত্রা ছিল সন্দেহ নেই। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে তবু বলি, পথ চলতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে তাঁকে নিজের পথ নিজকে সৃষ্টি করে নিতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, এভাবে তিনি একটু বেশি একা হয়ে পড়লেন কি? একান্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত একটি বৃত্তের মধ্যে স্বস্তি বোধ করতে শুরু করছেন না তো? আমি ঠিক জানি না।
তবে একটু যেন মনে হয় নেতৃত্ব ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে, কিছুটা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় সিদ্ধান্তগুলো নানামুখী বিবেচনার পরিপক্বতার ছাপ বহন করছে না। প্রশ্ন ওঠে মনে, দেশের নানা ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রাখতে পারেন, তাঁদের কি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকছে, নাকি সরকার বড্ড আমলানির্ভর বড্ড অনুগত নেতানির্ভর হয়ে পড়ছে? সরকার ও সরকারি বলয়ের অনেকের কথায় তোষামোদের ভাষা ও সুর শোনা যাচ্ছে। আবার খুব সহজেই যোগ্য, দক্ষ, মানী লোকেরা বিশেষ সংগত কারণ ছাড়াই সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়ছেন। সরকার বা নেতৃত্ব কি ওভার রিঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ছেন? অরাজনৈতিক কিংবা অন্য রাজনৈতিক ভাবনার মানুষজন কি কাজের সুযোগ পাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী কি তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে সুপার প্রধানমন্ত্রী ও সুপার নেত্রী হয়ে পড়ছেন?
এর পরিণতি হবে সরকারের কাজকর্মে মন্থরতা এবং দলের গতিহীনতা। রাজনৈতিক শক্তি, সদিচ্ছা এবং কার্যক্রমের বাহন ও মঞ্চের অকার্যকরতা কিংবা ঊনকার্যকরতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। তাতে কথার ফুলঝুরি বাড়বে, সহিষ্ণুতা কমবে, অনুদারতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির হয়ে পড়বে।
আমাদের দেশে বিরোধিতার রাজনীতি চর্চা এক অর্থে খুব সহজ। এর প্রকাশ ঘটে ভাঙচুর করা, অচল করে দেওয়া এবং ভাড়াটে লোক দিয়ে সমাবেশ করার মাধ্যমে। এ কাজ রিকশাচালক, পোশাককর্মী যেমন পারে তেমনি রাজনৈতিক কর্মীর জন্যও সহজ কাজ। এ কাজের কোনো রাজনৈতিক প্রভাব নেই, যেটুকু আছে তা নেতিবাচক।
আজকে এ কথাগুলো আলোচনার উদ্দেশ্য হলো মানুষ কেবল বিরোধিতার রাজনীতিতে উৎসাহী নয়, আর তারা এই অসহিষ্ণুতা ও নেতিবাচক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এ বিষয়ে তাদের মতামত সুস্পষ্ট। মানুষ চায় অর্থনৈতিক উন্নতি, মর্যাদাসম্পন্ন জীবন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ শান্তিপূর্ণ জীবন। এর জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইতিহাস বিকৃতি রোধ, জঙ্গিবাদ দমনসহ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার পক্ষে জোরালো জনমত তৈরি হয়েছিল এ নির্বাচনের সময়। বলা যায়, এ লক্ষ্যে দেশে জাতীয় ঐক্য ও জাগরণ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ অনেকটা ঊনসত্তরের পরে সৃষ্ট গণজাগরণ, গণজোয়ার ও জাতীয় ঐক্যের মতোই ঘটনা। সেদিন বঙ্গবন্ধু যথাযথ নেতৃত্বের মাধ্যমে সূচিত জাগরণ ও ঐক্যের ফসল জাতির জন্য তুলে আনতে পেরেছিলেন।
আমাদের উদ্বেগ হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা পুনরায় সৃষ্ট এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন কি না। তিনি তা পারলেই বঙ্গবন্ধুর আরব্ধ কাজ, অর্থাৎ পিতার সূচিত কাজ কন্যার হাতে সমাপ্ত হবে। জাতি সেদিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এ নিয়ে সবার মনে উদ্বেগ আছে। কারণ, এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে দেশের সর্বনাশ হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments