সাংবাদিকতা-বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের টাকা? by মশিউল আলম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি পাকিস্তানি টাকার খেলা চলে? প্রমাণ নেই। কিন্তু জনশ্রুতি, গুঞ্জন, জল্পনা-কল্পনা ইত্যাদি আছে। এ নিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ চলে। শুধু পাকিস্তানি টাকা কেন, এ দেশের রাজনীতিতে ভারতীয় টাকার খেলা নিয়েও চলে একই রকমের জল্পনা-কল্পনা, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।


সর্বশেষ জল্পনা-কল্পনা, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের ঝড় উঠেছে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) আর বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতা খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। উপলক্ষটি তৈরি হয়েছে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে।
গত ৩ মার্চ দুবাই থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক খালিজ টাইমস ‘অবশেষে আসগর খানের পিটিশনের শুনানি শুরু’ শিরোনামের একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির মূল বিষয় পাকিস্তানের আদালতে ১৯৯৬ সালে দায়ের করা একটি মামলার শুনানি। পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক এয়ার মার্শাল আসগর খানের করা ওই মামলার অভিযোগ, পাকিস্তানে ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বেনজির ভুট্টো ও তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মোট ১৪ কোটি রুপি দিয়েছিল।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চে সেই মামলার শুনানি নতুন করে শুরু হয়েছে। খালিজ টাইমস-এ ৩ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি মূলত সেই শুনানিকে কেন্দ্র করেই। তবে সেই প্রতিবেদনের একটি প্যারায় লেখা হয়, ‘অভিযোগক্রমে, আরও পাঁচ কোটি রুপি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের খালেদা জিয়াকে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে ভারত-পন্থী দল হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ী হতে সহযোগিতা করার জন্য (অ্যানাদার ৫০ মিলিয়ন রুপিজ ওয়াজ অ্যালেজডলি পেইড টু বাংলাদেশেস খালেদা জিয়া টু হেল্প হার ইন পোল্স্ অ্যাগেইনস্ট হাসিনা ওয়াজেদস আওয়ামী লীগ জেনারেলি পারসিভড বাই পাকিস্তানস সিকিউরিটি এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাজ প্রো-ইন্ডিয়ান)।’ আইএসআইএর সাবেক মহাপরিচালক আসাদ দুররানির স্বীকারোক্তির (‘বাই হিজ ঔন অ্যাডমশািন’) বরাত দিয়ে এই খবর জানিয়েছে খালিজ টাইমস।
খালিজ টাইমস-এর ওই প্রতিবেদনকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোয় ৪ মার্চ ‘১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদাকে পাঁচ কোটি রুপি দেয় আইএসআই!’ শিরোনামে এক কলামের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরির সময় প্রথম আলো থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে খালিজ টাইমস-এর খবরটি প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয় এবং তাঁর মন্তব্য প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনেই সংযুক্ত করা হয়। বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এটা মহা মিথ্যা। বিএনপি বিদেশিদের টাকায় চলা রাজনৈতিক দল নয়। এ খবর সম্পূর্ণ বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও অপপ্রচার।’ একই প্রতিবেদনে পাকিস্তানের দ্য নিউজ ও ডেইলি বিজনেস রেকর্ডার নামে দুটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, খালিজ টাইমসের পরিবেশিত তথ্যটি পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়নি। ৯ মার্চ প্রথম আলোয় আবারও ছাপা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য ‘আইএসআইএর টাকা কাল্পনিক গল্প: ফখরুল’ শিরোনামে। ১৭ মার্চ রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের সূত্রে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয় আরেকটি প্রতিবেদন, ‘বিএনপিকে তহবিল দেওয়ার কথা স্বীকার করলেন দুররানি’ শিরোনামে। বাসসের সূত্রে বাংলাদেশের অন্য পত্রপত্রিকা এবং ওয়েবসাইটগুলোতেও এ বিষয়ে একই ধরনের খবর পরিবেশিত হয়েছে। আবার ঢাকার দুটি দৈনিক আইএসআইএর সাবেক মহাপরিচালক আসাদ দুররানির সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছে, দুররানি খালিজ টাইমসের তথ্যটি অস্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বিএনপিকে আইএসআইএর টাকা দেওয়া সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো ভিত্তিহীন। এই সূত্রেও ২৪ মার্চ প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে ‘বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার তথ্য ভিত্তিহীন’ শিরোনামে খবর। বিবিসি বেতারকে দেওয়া আসাদ দুররানির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, ‘বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার খবর সম্পূর্ণ বানোয়াট’—এ বক্তব্যও ২৫ মার্চ প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। বিএনপির পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালিজ টাইমস-এর প্রতিবেদনের ওই তথ্যটির প্রতিবাদ জানিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন। সেই সংবাদও প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে ২৫ মার্চ। সর্বশেষ বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোয় যে প্রতিবাদ পাঠিয়েছেন, ২৬ মার্চ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় তা হুবহু প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসঙ্গ আইএসআইর টাকা: প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করেছে বিএনপি’ শিরোনামে।
খালিজ টাইমস-এ যখন প্রথম প্রতিবেদনটি ছাপা হয়, এবং তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে, স্বভাবতই ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয়। কারণ, সত্য হলে খবরটি বিরাট গুরুত্ব বহন করে; সত্য না হলেও আগ্রহব্যঞ্জক। কারণ আইএসআইএর সাবেক মহাপরিচালকের স্বীকারোক্তিকে তথ্যসূত্র উল্লেখ করে পত্রিকাটি খবর ছেপেছে—এটাই একটা খবর। সেই খবরকে ‘বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব—এটিও একটি খবর। এবং এই দুটি খবরই প্রথম আলোর ওই একই প্রতিবেদনে ছাপা হয়েছে। শুধু তাই নয়, খালিজ টাইমস-এর ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ‘দি ইকোনমিস্ট-এ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন হয়েছিল, এর পাল্টা হিসেবে টাকা দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।’ তিনি তাঁর এই অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করেননি। তবু প্রথম আলোর ওই একই প্রতিবেদনে তাঁর এই অভিযোগও ছাপা হয়েছে। কারণ, দেশের প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এই অভিযোগ তুলেছেন—এটিও একটি খবর।
খালিজ টাইমস-এর সূত্রে খবরটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ সোরগোল সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই খবরটি লুফে নিয়েছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নিন্দা-সমালোচনা করার এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে। বিএনপির নেতারা দৃঢ়কণ্ঠে এই খবরকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে চলেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, ‘ভারত থেকে বস্তা বস্তা টাকা এনেছে আওয়ামী লীগ’, ‘জনগণ জানে ভারতের টাকা কারা এনেছে’ ইত্যাদি। প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে বিএনপির সেসব বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ফিরে এল ব্রিটেনের মর্যাদাবান সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট-এ গত বছরের ৩০ জুলাই প্রকাশিত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে একটি মন্তব্যধর্মী বিশ্লেষণী নিবন্ধের কথা। ‘আলিঙ্গনযোগ্য তুমি’ (এমব্রেসেবল ইউ) শিরোনামের সেই নিবন্ধের প্রথম প্যারায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে—এই মন্তব্য করতে গিয়ে লেখা হয়, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকা আর পরামর্শের জোরে (‘ব্যাগস অব ইন্ডিয়ান ক্যাশ অ্যান্ড অ্যাডভাইস’)। কিন্তু এই অভিযোগের ভিত্তি কী, কোন সূত্রে এ কথা লেখা হয়েছে তা ওই নিবন্ধে বলা হয়নি। এমনকি ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতায় অনিশ্চিত বা অপ্রমাণিত তথ্য উল্লেখ করার সময় যে ‘অ্যালেজডিল’ (অভিযোগ আছে, বা শোনা যায়) শব্দটি ব্যবহারের চল আছে, ইকোনমিস্ট-এর ওই নিবন্ধে তাও ব্যবহার করা হয়নি। প্রথম আলো এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। কারণ লেখাটি ছিল একটি মন্তব্যধর্মী বিশ্লেষণী নিবন্ধ, কোনো সংবাদ প্রতিবেদন নয়। তাতে কোনো তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছিল না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইকোনমিস্ট-এর কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছিল, পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে সেই প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু দি ইকোনমিস্ট কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, বা দুঃখ প্রকাশ করেনি। সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে মন্তব্যধর্মী অনেক লেখালেখি হয়েছিল। বিএনপি এই ইস্যুটি বেশ ব্যবহার করেছিল। আওয়ামী লীগ ভারত থেকে বস্তা বস্তা টাকা নিয়েছে—এখনো তাঁরা এ কথা বলে চলেছেন ইকোনমিস্ট-এর ওই মন্তব্যের সূত্র ধরেই।
এক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অন্য সংবাদমাধ্যমে ব্যবহার করার চর্চা ইউরোপ-আমেরিকার সাংবাদিকতায়ও এখন বেশ প্রচলিত। সাংবাদিকতায় বিশুদ্ধপন্থীরা যদিও মনে করেন এটা ইতিবাচক নয়, তবু ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে এই প্রবণতা বাড়ছে (খালিজ টাইমস-এর সংবাদটি দ্রুত বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে পুনরুৎপাদিত হয়েছে ইন্টারনেটের কল্যাণেই)। এতে ভুল, বিভ্রান্তিকর তথ্য বা অর্ধসত্য অভিযোগ ইত্যাদি বার বার প্রচারের ঝুঁকিও বাড়ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-পাকিস্তানের অর্থযোগ, গোয়েন্দাবৃত্তি বা আশীর্বাদ-অভিশাপ নিয়ে যতই জল্পনাকল্পনা হোক না কেন, আইএসআইএর টাকার সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে যখন বিদেশি একটি পত্রিকা একটি খবর পরিবেশন করে, এবং তাতে আইএসআইএর সাবেক মহাপরিচালকের স্বীকারোক্তির বরাত দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ রকম ক্ষেত্রে তথ্যটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সতর্কভাবে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা আরও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ছিল। প্রথম আলো খবরটি খালিজ টাইমস-এর সূত্র উল্লেখ করেই প্রকাশ করেছে বটে, তবে বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ায় দায় প্রথম আলোর ওপরই বেশি বর্তায়। আবার, এতে যদি কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তা নিরসনের ক্ষেত্রে বিএনপির প্রতিবাদ, আসাদ দুররানি ও পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকৃতিমূলক বক্তব্যসহ যেসব প্রতিবেদন প্রথম আলো প্রকাশ করেছে, সেগুলোর গুরুত্বও কম নয়। তবে সবকিছুর পরও অধিকতর সতর্কতার গুরুত্বটিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের সর্বাধিক আস্থাভাজন ও সর্বোচ্চ প্রচারসংখ্যার দৈনিক প্রথম আলো ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও সতর্ক থাকবে।
মশিউল আলম: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.