চারদিক-কচুয়ার মনসামুড়া by ইয়াসমীন রীমা

বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়া ফসলের মাঠের শরীর কেটে জায়গা করে নিয়েছে ছোট একটি ঝিল। এর পাশেই ত্রিভুজ আকৃতির গভীর জঙ্গল। রহস্যময় নির্জন নৈঃশব্দ্যের আচ্ছাদনে পথ আগলে রাখা সজীবতা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধকর সবুজ গালিচার পরশমোড়া জঙ্গল, ফসলের মাঠ আর ঝিলের ত্রিবেণীসঙ্গম।


শুধু বাঁশগাছ দিয়ে মোড়া প্রকৃতির পরশমাখা একটি টিলা। কুমিল্লা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে কচুয়া উপজেলার কচুয়া-সাচার মহাসড়কসংলগ্ন দোয়টি বড় ব্রিজ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে মেঘদাইর-ভূঁইয়ারা-দহুয়ি গ্রামের মধ্যমাঠের সুন্দরী খালের পূর্ব পাড় ‘মনসামুড়া’ নামে পরিচিত। এই সৌন্দর্যে নেই কোনো মাদকতা, আছে লাবণ্য। টিলার ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, ঝিলের স্নিগ্ধ জল তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। আর প্রবেশপথেই পাকা দেয়ালে গাঁথা একটি দানবাক্স। ভেতরে ভঙ্গুর একটি মূর্তি। বাঁশপাতায় মুড়ে আছে তার শরীরের খানিকটা অংশ। অরণ্যের গহিনতায় আশপাশে গ্রামের কোনো চিহ্ন নেই; মানুষের স্পন্দন নেই, পাখির কোলাহলও নেই। হঠাৎ হঠাৎ উড়াল দিয়ে যায় যাযাবর পাখির ঝাঁক। ক্লান্ত দু-একটা দল হয়তো এখানে-ওখানে বসে, নিজেদের মধ্যে আলাপ করে, খান খান করে দেয় চারপাশের গম্ভীরতা ও নির্জনতা। কথিত আছে, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে সাপের দেবি মনসা কোনো এক সময় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এই স্থানে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তিনি যে ভেলায় চড়ে ভ্রমণ করেছিলেন, তারই খানিকটা অংশ ঝিলের পাড়ে আটকে থাকে এবং সেই থেকে যাওয়া অংশ থেকেই বাঁশগাছগুলো জন্মাতে শুরু করে। গড়ে ওঠে একটি টিলা। এলাকাবাসী প্রথমে বুঝতে না পেরে ওই টিলা থেকে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য বাঁশ কেটে নিত। কিন্তু পরেই দেখা যেত, রাতে বা পরদিন ওই ব্যক্তি সাপের কামড়ে অথবা নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মারা গেছে। এরপর আর কেউই ওই টিলা থেকে বাঁশ কাটেনি বরং হিন্দু সম্প্রদায় এর রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। মনসাপূজা ছাড়াও এই টিলায় বিভিন্ন পূজাপার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। তবে শ্রাবণের শেষে প্রতিবছর মনসাপূজা হয়। গ্রামবাসীর ধারণা, প্রতিটি বাঁশগাছই একেকটি জীবন্ত সাপ। তাই দিনের বেলায় মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েও ওরা শান্ত থাকে, যতক্ষণ ওদের কেউ আঘাত না করে। আঘাত করলে বা অন্যমনস্কভাবে কেউ বাঁশের পাতা ছিঁড়ে নিলেও রাতে জঙ্গলের গভীর থেকে এক করুণ আর্তনাদ ভেসে আসে।
গ্রামের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ক্ষীরোদ চন্দ্র মিস্ত্রি পার্শ্ববর্তী গ্রামের ইয়াসিন নামের এক ওঝার প্রত্যক্ষদর্শনের কথা জানান। তিনি একবার বাজি ধরলেন, মনসামুড়া থেকে সাপ বের করবেনই। বাজি মোতাবেক পরদিন সকালে গিয়ে বীণ বাজাতে শুরু করলেন। ঠিক দুপুরে হঠাৎ মনসামুড়ার মাটি ভেদ করে পাঁচ মাথাওয়ালা কথিত সূর্যমুখী নামের একটি সাপ বের হয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু আক্রমণ করতে না পেরে আবার সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে চলে যায়। ইয়াসিন ওঝা ওই দিন প্রাণে রক্ষা পেলেও এক সপ্তাহ পরই সাপের কামড়ে মারা যান। ইয়াসিন ওঝাকে বগির মা নামের এক নারী ওঝা বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
এলাকায় এখনো মানুষের এ-মুখ থেকে ও-মুখে ফিরছে, ২০০৮ সালে দোয়টি গ্রামের ডাক্তারবাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ্মীপূজায় নাকি খানিকটা ত্রুটি ছিল। তাই বাড়িতে একসঙ্গে ১১টি সাপের আগমন ঘটে। ডাক্তারবাড়ির তপন মজুমদার সাপগুলো মেরে ফেলতে সক্ষম হলেও দুটি সাপ পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তপন মজুমদারের মেয়ে শুক্লাকে স্কুলে যাওয়ার পথে সেই দুটি সাপ আক্রমণ করে। শুক্লা সেই যাত্রায় সাপের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেলেও পরে স্বপ্নদ্রষ্টা হয় যে মনসাদেবীর পূজা দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। শুক্লা স্বপ্নানুযায়ী পূজার কার্যাদি সম্পন্ন করলে স্কুলপথে সাপ আর তাকে তাড়া করেনি।
বর্তমানে মন্দিরের নির্মাণকাজের সুবিধার্থে টিলার ১৩টি বাঁশের মুড়ার ভেতর চারটি মুড়া কেটে ফেলা হয়েছে। বাঁশের মুড়াগুলো লাগোয়া জমির কোনো ক্ষতিসাধন করে না। ১৯৯৮ সালের বন্যায় এ অঞ্চল পানিতে ডুবে গেলেও টিলাটি ডোবেনি। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে বিরাট মেলার আয়োজন হয় এখানে; হয় বাৎসরিক মনসাদেবীর পূজা। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলমান ভক্ত আসে মানত অর্পণ করতে।
গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ জলিল বেপারীর মতে, ‘আমরা এই জঙ্গলের রহস্য বুঝি না। মা মনসার কল্যাণময় রূপও দেখেছি, আবার তাঁর অগ্নিমূর্তিও দেখেছি।’ একটি বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ফেঁসে আছে সারাটি গ্রাম। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই তাদের বিপদ-আপদের অবসান, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে এই মনসামুড়ায় ভোগ দেয়। কেউ ফল পায়, কেউ পায় না। তবু অরণ্যের ফাঁদে পড়া এই টিলা তাদের মনের গভীরতায় অস্পষ্ট অবস্থান।

No comments

Powered by Blogger.