নৈরাজ্য সৃষ্টি কাম্য নয়-কেন এই হরতাল?

৪ এপ্রিল আবার হরতাল ঘোষিত হয়েছে। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির নামে ডাকা এই হরতালের উদ্দেশ্য ‘কোরআনবিরোধী’ নারীনীতি, শিক্ষানীতি এবং ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় বাতিল করতে সরকারকে ‘বাধ্য করা’। ‘বাধ্য করা’ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই কমিটি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় রাজি নয়, তারা আগ্রহী বাধ্য করায়।


হরতাল তাদের কাছে কোনো গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নয়, বাধ্য করার কর্মসূচি। গত শুক্রবার বাধ্য করার ধরনটিও দেখা গেছে চট্টগ্রামে। সেখানে একই দাবিতে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি ব্যানারে বিক্ষোভের নামে ব্যাপক সহিংসতা করা হয়েছে। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির মতো তারাও কোনো ‘আলোচনায় রাজি নয়’। ওদিকে দেশের ওলামা-ইমামদের একটি অংশ দাবি করেছে, আলোচ্য নারীনীতিতে কোরআনবিরোধী কিছু নেই। সরকারও সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নারীনীতি কোনোভাবেই ইসলামবিরোধী নয়।
ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দল এবং একশ্রেণীর ধর্মতাত্ত্বিক অহরহ ইসলামকে নারী, শান্তি ও প্রগতির বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ফায়দা লুটে থাকেন। এই ধারার রাজনীতি পাকিস্তান আমল থেকেই জনগণের বিরুদ্ধে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। একাত্তরেও এই গোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতাবিরোধিতা, গণহত্যা সমর্থন, পাথর ছুড়ে হত্যাসহ যাবতীয় নিপীড়নের পক্ষে তাদের অবস্থান। জনগণের স্বার্থে কোনো আন্দোলন তাদের করতেও দেখা যায় না। এদের হরতাল তাই কার স্বার্থে?
বিদ্যমান নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বেলায় নারীদের সমানাধিকার দেওয়া হয়নি, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য-কর্মসংস্থান-বাজার-উপার্জন-ঋণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সমান উত্তরাধিকারের বদলে কেবল প্রাপ্ত সম্পদের ব্যবহারে নারীর অধিকারের কথাই বলা হয়েছে। এ অবস্থায় এটা স্পষ্ট, অসত্য অভিযোগ উত্থাপন করে রাজনীতির মাঠ গরম করাই হরতাল আহ্বানকারীদের উদ্দেশ্য। তাই আলোচনার পথে না গিয়ে ‘বাধ্য করা’র পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। এমনকি অধিকাংশ জনগণ তাদের বিপক্ষে থাকার ঘটনাতেও তারা বিচলিত নয়। তারা ফতোয়ার নামে নারীনির্যাতন চালিয়ে যেতে চায়। এদের ডাকা হরতালও সে কারণে কেবল প্রগতির বিরুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের মানুষের অধিকারেরও বিপক্ষে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পটভূমিতে তাদের হরতাল আহ্বানের পেছনে অন্য কারণ থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
কিছু রাজনৈতিক দল যখনই রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকে, তখনই তাদের মিত্র কিছু ধর্মবাদী গোষ্ঠী ‘ধর্ম গেল গেল’ বলে আকাশ-বাতাস গরম করে ফেলে। ধর্ম তাদের নীতি নয়, রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। এটা বুঝে দেশের অধিকাংশ ভোটার নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যানও করেন। রাজনীতিতে ডান-বাম বহু ধারাই থাকতে পারে, কিন্তু সবারই কয়েকটি বুনিয়াদি বিষয়ে একমত হওয়া প্রয়োজন যে, আইনের শাসন, মানুষের জীবন ও অধিকার এবং গণতন্ত্রকে হুমকিগ্রস্ত করে এমন কিছু কেউ করবে না। দ্বিতীয়ত, হঠকারী কর্মসূচি কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না। তাই নারীনীতি নিয়ে অহেতুক উত্তাপ না ছড়িয়ে আলোচনায় বসতে হবে। কোনোভাবেই হরতাল কাম্য নয়। অতএব আগামীকালের হরতাল প্রত্যাহার করা হোক।

No comments

Powered by Blogger.