স্মরণ-শহীদ জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি by ইনাম আহমদ চৌধুরী
শহীদ জিয়ার শাহাদাত দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে যে কথাটি সর্বাগ্রে মনে আসে তা হচ্ছে, একজন সফল ও স্মরণ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অল্প সময়েই তাঁর প্রতিষ্ঠা। নতুন স্বাধীনতা পাওয়া দরিদ্র ও অনগ্রসর একটি দেশ, যা ছিল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান—তাতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে,
একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্থাপন করে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করে উন্নয়নের রাজপথে চলমান করিয়ে দেওয়ার বিরল কৃতিত্বের বিতর্কাতীত অধিকারী শহীদ জিয়াউর রহমান। ভাবলে অবাক হতে হয়, রাজনীতিতে সেই সময় অনভিজ্ঞ এক তরুণ কর্মকর্তা কী অদম্য সাহস, অপরাজেয় মনোবল এবং অসীম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতির দিকনির্দেশনা স্থির করে দেন। ঘোষণা-উত্তর স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে সফল সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখসমরে অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আবার সফল মুক্তিসংগ্রাম-উত্তরকালে মধ্য-সত্তরের চরম অস্থির এক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে কান্ডারি হয়ে জাতিকে বিপর্যয়ের মুখ থেকে রক্ষা করেন এবং সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে জাতির অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেন।
জিয়ার নেতৃত্বের প্রথম দিকেই ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার কৃতিত্ব ও সম্ভাবনা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতে গিয়ে এক ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরেন, ‘Your position is already assured in the annals and the history of your country as a brave freedom fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh.’ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর জুনের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট আয়োজিত এক শোকসভায় তদানীন্তন কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার শ্রীধাত রামফাল যথার্থ উক্তি করেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে শুধু যে একদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নয়, এই উন্নয়নকামী দেশকে সার্বিক উন্নয়নের রাজপথে পরিচালিত করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সার্কের মাধ্যমে ঐক্যবন্ধনে গ্রথিত করা তাঁর এক স্বপ্ন। তাঁর অকালমৃত্যুতে তাঁর দেশ এক নিপুণ সংগঠক ও সফল রাষ্ট্রনায়ককে শুধু হারাল না, দক্ষিণ এশিয়া হারাল এক দূরদর্শী ও স্বাপ্নিক, উন্নয়নশীল জগৎ হারাল এক মহান নেতা, কমনওয়েলথ হারাল সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী আস্থা সৃষ্টিকারী এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বকে।’
জিয়ার স্মৃতিতর্পণ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন জেদ্দার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) অপারেশনসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট। ব্যাংকের পঞ্চাশোর্ধ্ব সদস্যদেশের মধ্যে একটি দেশ আফ্রিকার মালি। কর্তব্য নিবন্ধনে গিয়েছিলাম রাজধানী বামাকো। অনুসঙ্গী ছিলেন ব্যাংকের দু-তিনজন কর্মকর্তা। মনে পড়ছে যাঁর মধ্যে ছিলেন তরুণ অর্থনীতি-বিশ্লেষক আবদুল্লাহ গুল, বর্তমানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, যিনি গত বছর রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা এসেছিলেন। মালির সরকারি নেতাদের সঙ্গে ব্যাংকের সহায়তা পাওয়া কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা-অন্তে দেশের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট কোনারে বললেন, ‘জেনে খুশি হলাম, আপনি বাংলাদেশের। ওই দেশের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। উন্নয়নকামী দেশগুলোর অগ্রগতির জন্য তিনি এক উল্লেখযোগ্য নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর তিরোধানে এলডিসি দেশগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তারা হারিয়েছে এক অন্যতম যোগ্য নেতা।’
অবাক বিস্ময়ে শুনছিলাম এক প্রয়াত প্রেসিডেন্টের প্রতি আরেক দেশের এক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের শোকাপ্লুত শ্রদ্ধা নিবেদন। বহু বছর ব্যবধানে এক বহু দূর দেশে। প্রেসিডেন্ট কোনারে আরও বললেন, ‘তাঁর স্মৃতিতে রাজধানীর একটি প্রধান সড়কের নামকরণ করেছি আমরা। ইচ্ছে করলে আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন।’ তাঁরই নির্দেশনায় প্রটোকলের কর্মকর্তা সমভিব্যাহারে গিয়ে দেখলাম, শহরের প্রশস্ততম রাজপথ কিং ফাহদ সরণির অব্যবহিত পরেই এভিনিউ জিয়াউর রহমান। দুদিকে বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে প্রসারিত দীর্ঘ প্রশস্ত রাজপথ। মনে পড়ল, তুরস্কে দেখেছিলাম জিয়ার স্মরণে আরেকটি সরণি। জান্নাতবাসী জিয়া ওই সেদিন ওই সুদূরে ভ্রমণকারী এক বাঙালির হূদয় গর্বে ভরে দিয়েছিলেন। গিনির প্রেসিডেন্ট সি কো তুরে, ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত, ভুটানের রাজা ওয়াংচুক—আরও বহু এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের কাছে শুনেছি বহু বছরের ব্যবধানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া সম্পর্কে শোক ও শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রশস্তি। রাষ্ট্রাচারের প্রয়োজনতাড়িত গতানুগতিক উক্তি নয়, অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত আবেগঘন শ্রদ্ধা নিবেদন। সবার মনে, দেশে ও বিদেশে ক্ষমতাধরদের মধ্যে ও সাধারণ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া যে এক পরম সম্মানের আসন চিরকালের জন্য দখল করে আছেন, তা কিসের জন্য? কিসের জোরে? এর মধ্যে তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, নেই রাষ্ট্রাচারের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ, নেই দ্বিপক্ষীয় প্রশস্তি বিনিময়ের রীতিনীতি। এর কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিগৃহীত, বঞ্চিত ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যবন্ধন সৃষ্টি করে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়। ‘সার্ক’-এর সৃষ্টি, আল আকসা কমিটির আলোচনা, এলডিসি দেশগুলোর স্বার্থরক্ষা—এসব বিষয়ে তাঁর নেতৃস্থানীয় বলিষ্ঠ অগ্রণী ভূমিকা পালন। আরও রয়েছে দেশের মধ্যে জাতির বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধান, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, দুরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি ব্যক্তিগত জীবনে প্রশ্নাতীতভাবে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ—এসব ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার অবিস্মরণীয় ভূমিকা ও নেতৃত্ব, তাঁর অনমনীয় মনোবল, সৎ, সাধু ও নিঃস্বার্থ আচার-ব্যবহার, তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-পরিকল্পনা, তাঁর অতুলনীয় আপসহীন দেশপ্রেম, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক বিভ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত জাতিকে যেন তিনি একটি জীয়নকাঠির মায়াবি ছোঁয়ায় আত্মবিশ্বাসী, প্রাণবন্ত ও সক্রিয় করে তুলেছিলেন।
বর্তমানে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, রাজনৈতিক স্বার্থজনিত কারণে ক্ষমতায় আরোহণের প্রক্রিয়া নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তাঁর চরিত্র হরণের অসাধু কিন্তু নিষ্ফল প্রচেষ্টা হচ্ছে। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ৭ নভেম্বরের বর্ণনা দিয়েছেন (বাংলাদেশ: এ লিগ্যাসি অব ব্লাড, অনুবাদ পৃ. ১২২) এভাবে, ‘উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাংক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার এই ট্যাংক দেখে লোকজন ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে ট্যাংকের সৈনিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে। চার দিন ধরে তারা মনে করেছিল যে, খালেদ মোশাররফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। সর্বত্রই জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে তারা রাতভর স্লোগান দিতে থাকে—বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনগণ আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিল সত্যিই এক স্মরণীয় রাত।’
এই অভ্যুত্থানকারী সৈনিক-জনতাই বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে। এর আগে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের জারি করা আইনের ধারাবাহিকতায় খালেদ মোশাররফ প্রশাসনে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচারপতি সায়েম দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর। সেনাপ্রধান জিয়া তখন খালেদের হাতে বন্দী। ১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও সিএমএলের দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সায়েম। এ ঘটনাগুলোতে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে জিয়া ‘ক্যু’ করে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি দেশে সামরিক শাসন জারি করেননি। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশে একদলীয় শাসন এবং সামরিক আইন কোনোটিরই প্রবর্তক জিয়া ছিলেন না, ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। জিয়া পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরই প্রবর্তন করেন।
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে তাঁর নীতিনির্দেশক কথাগুলো (যা তাঁর তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিশের মাধ্যমে ১৯৮১ সালে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়) স্মরণ করি, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এ দেশের আপামর জনগণের অন্তরে চিরজাগরূক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশপ্রেমিকদের হূদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্ব উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এতে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী, যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপযোগী বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্বজাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
‘...আমাদের মূল লক্ষ্য তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।...একথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা হবে অত্যন্ত বাস্তব প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।’
আজকের এই অনিশ্চয়তার দিনে জাতির জন্য আশা উদ্দীপক অনুপ্রেরণার বাণী আর কী হতে পারে?
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
জিয়ার নেতৃত্বের প্রথম দিকেই ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার কৃতিত্ব ও সম্ভাবনা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতে গিয়ে এক ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরেন, ‘Your position is already assured in the annals and the history of your country as a brave freedom fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh.’ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর জুনের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট আয়োজিত এক শোকসভায় তদানীন্তন কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার শ্রীধাত রামফাল যথার্থ উক্তি করেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে শুধু যে একদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নয়, এই উন্নয়নকামী দেশকে সার্বিক উন্নয়নের রাজপথে পরিচালিত করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সার্কের মাধ্যমে ঐক্যবন্ধনে গ্রথিত করা তাঁর এক স্বপ্ন। তাঁর অকালমৃত্যুতে তাঁর দেশ এক নিপুণ সংগঠক ও সফল রাষ্ট্রনায়ককে শুধু হারাল না, দক্ষিণ এশিয়া হারাল এক দূরদর্শী ও স্বাপ্নিক, উন্নয়নশীল জগৎ হারাল এক মহান নেতা, কমনওয়েলথ হারাল সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী আস্থা সৃষ্টিকারী এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বকে।’
জিয়ার স্মৃতিতর্পণ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন জেদ্দার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) অপারেশনসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট। ব্যাংকের পঞ্চাশোর্ধ্ব সদস্যদেশের মধ্যে একটি দেশ আফ্রিকার মালি। কর্তব্য নিবন্ধনে গিয়েছিলাম রাজধানী বামাকো। অনুসঙ্গী ছিলেন ব্যাংকের দু-তিনজন কর্মকর্তা। মনে পড়ছে যাঁর মধ্যে ছিলেন তরুণ অর্থনীতি-বিশ্লেষক আবদুল্লাহ গুল, বর্তমানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, যিনি গত বছর রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা এসেছিলেন। মালির সরকারি নেতাদের সঙ্গে ব্যাংকের সহায়তা পাওয়া কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা-অন্তে দেশের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট কোনারে বললেন, ‘জেনে খুশি হলাম, আপনি বাংলাদেশের। ওই দেশের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। উন্নয়নকামী দেশগুলোর অগ্রগতির জন্য তিনি এক উল্লেখযোগ্য নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর তিরোধানে এলডিসি দেশগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তারা হারিয়েছে এক অন্যতম যোগ্য নেতা।’
অবাক বিস্ময়ে শুনছিলাম এক প্রয়াত প্রেসিডেন্টের প্রতি আরেক দেশের এক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের শোকাপ্লুত শ্রদ্ধা নিবেদন। বহু বছর ব্যবধানে এক বহু দূর দেশে। প্রেসিডেন্ট কোনারে আরও বললেন, ‘তাঁর স্মৃতিতে রাজধানীর একটি প্রধান সড়কের নামকরণ করেছি আমরা। ইচ্ছে করলে আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন।’ তাঁরই নির্দেশনায় প্রটোকলের কর্মকর্তা সমভিব্যাহারে গিয়ে দেখলাম, শহরের প্রশস্ততম রাজপথ কিং ফাহদ সরণির অব্যবহিত পরেই এভিনিউ জিয়াউর রহমান। দুদিকে বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে প্রসারিত দীর্ঘ প্রশস্ত রাজপথ। মনে পড়ল, তুরস্কে দেখেছিলাম জিয়ার স্মরণে আরেকটি সরণি। জান্নাতবাসী জিয়া ওই সেদিন ওই সুদূরে ভ্রমণকারী এক বাঙালির হূদয় গর্বে ভরে দিয়েছিলেন। গিনির প্রেসিডেন্ট সি কো তুরে, ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত, ভুটানের রাজা ওয়াংচুক—আরও বহু এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের কাছে শুনেছি বহু বছরের ব্যবধানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া সম্পর্কে শোক ও শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রশস্তি। রাষ্ট্রাচারের প্রয়োজনতাড়িত গতানুগতিক উক্তি নয়, অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত আবেগঘন শ্রদ্ধা নিবেদন। সবার মনে, দেশে ও বিদেশে ক্ষমতাধরদের মধ্যে ও সাধারণ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া যে এক পরম সম্মানের আসন চিরকালের জন্য দখল করে আছেন, তা কিসের জন্য? কিসের জোরে? এর মধ্যে তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, নেই রাষ্ট্রাচারের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ, নেই দ্বিপক্ষীয় প্রশস্তি বিনিময়ের রীতিনীতি। এর কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিগৃহীত, বঞ্চিত ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যবন্ধন সৃষ্টি করে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়। ‘সার্ক’-এর সৃষ্টি, আল আকসা কমিটির আলোচনা, এলডিসি দেশগুলোর স্বার্থরক্ষা—এসব বিষয়ে তাঁর নেতৃস্থানীয় বলিষ্ঠ অগ্রণী ভূমিকা পালন। আরও রয়েছে দেশের মধ্যে জাতির বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধান, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, দুরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি ব্যক্তিগত জীবনে প্রশ্নাতীতভাবে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ—এসব ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার অবিস্মরণীয় ভূমিকা ও নেতৃত্ব, তাঁর অনমনীয় মনোবল, সৎ, সাধু ও নিঃস্বার্থ আচার-ব্যবহার, তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-পরিকল্পনা, তাঁর অতুলনীয় আপসহীন দেশপ্রেম, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক বিভ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত জাতিকে যেন তিনি একটি জীয়নকাঠির মায়াবি ছোঁয়ায় আত্মবিশ্বাসী, প্রাণবন্ত ও সক্রিয় করে তুলেছিলেন।
বর্তমানে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, রাজনৈতিক স্বার্থজনিত কারণে ক্ষমতায় আরোহণের প্রক্রিয়া নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তাঁর চরিত্র হরণের অসাধু কিন্তু নিষ্ফল প্রচেষ্টা হচ্ছে। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ৭ নভেম্বরের বর্ণনা দিয়েছেন (বাংলাদেশ: এ লিগ্যাসি অব ব্লাড, অনুবাদ পৃ. ১২২) এভাবে, ‘উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাংক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার এই ট্যাংক দেখে লোকজন ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে ট্যাংকের সৈনিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে। চার দিন ধরে তারা মনে করেছিল যে, খালেদ মোশাররফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। সর্বত্রই জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে তারা রাতভর স্লোগান দিতে থাকে—বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনগণ আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিল সত্যিই এক স্মরণীয় রাত।’
এই অভ্যুত্থানকারী সৈনিক-জনতাই বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে। এর আগে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের জারি করা আইনের ধারাবাহিকতায় খালেদ মোশাররফ প্রশাসনে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচারপতি সায়েম দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর। সেনাপ্রধান জিয়া তখন খালেদের হাতে বন্দী। ১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও সিএমএলের দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সায়েম। এ ঘটনাগুলোতে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে জিয়া ‘ক্যু’ করে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি দেশে সামরিক শাসন জারি করেননি। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশে একদলীয় শাসন এবং সামরিক আইন কোনোটিরই প্রবর্তক জিয়া ছিলেন না, ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। জিয়া পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরই প্রবর্তন করেন।
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে তাঁর নীতিনির্দেশক কথাগুলো (যা তাঁর তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিশের মাধ্যমে ১৯৮১ সালে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়) স্মরণ করি, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এ দেশের আপামর জনগণের অন্তরে চিরজাগরূক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশপ্রেমিকদের হূদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্ব উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এতে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী, যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপযোগী বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্বজাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
‘...আমাদের মূল লক্ষ্য তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।...একথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা হবে অত্যন্ত বাস্তব প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।’
আজকের এই অনিশ্চয়তার দিনে জাতির জন্য আশা উদ্দীপক অনুপ্রেরণার বাণী আর কী হতে পারে?
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
No comments