তোমরা কার বুক খালি করেছ by শামসুজ্জামান শামস

বার মায়ের বুক খালি হলো। বাবার কাঁধে চাপল ছেলের লাশ। আবার পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হলো। খুন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আবার ছাত্রলীগের কারণে কলঙ্কিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পিটিয়ে তিনতলা থেকে ছাত্রদের ফেলে দেওয়া, অস্ত্র নিয়ে মহড়া, সংঘর্ষ-বোমাবাজির ঘটনার পর এবার ছাত্রলীগের কর্মীরা পিটিয়ে মেরেছেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে। গত রোববার পরীক্ষা শেষে হল থেকে বের হলে তাঁকে তুলে নিয়ে যান
ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। পিটিয়ে আধমরা করে তাঁরাই জুবায়েরকে সাভারে হাসপাতালে ফেলে আসেন। সেখান থেকে নেওয়া হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। গতকাল সোমবার সকাল ছয়টায় তিনি মারা যান।
জুবায়ের আহমেদ ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র। গত রোববার তিনি স্নাতক চূড়ান্ত পর্বের শেষ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বাকি ছিল মৌখিক পরীক্ষা। কিন্তু জুবায়ের তো আর কথা বলবেন না। নিজের স্বপ্ন, পরিবারের স্বপ্ন—সবকিছুর ঊর্ধ্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
জুবায়েরের বাবা তোফায়েল আহমেদ নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে জুবায়ের ছোট। বড় ছেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট ছেলেকে হারিয়ে মা হাসিনা আহমেদ পাগলপ্রায়। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘...আমারে কইছে, মা এইবার পরীক্ষায় ভালো করলে একটা ল্যাপটপ কিন্যা দেতে অইবে। আমি কথা দেছেলাম, ল্যাপটপ কিন্যা দিমু। এ্যাহন কারে এইয়া কিন্যা দিমু। হেরা আমার বুকটা খালি কইরা দেছে।’ বলতে বলতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পাশে জুবায়েরের বাবা নির্বাক বসে ছিলেন। বৃদ্ধ নানা আবদুল লতিফ ডুকরে কাঁদছিলেন। বললেন, ‘তোরা কার বুকটা খালি কইল্লে...।’
জুবায়েরের মৃত্যুর খবর শুনে তাঁর সহপাঠীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা হত্যার সঙ্গে জড়িতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও গ্রেপ্তারের দাবিতে দিনভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাসহ প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে ছাত্রলীগের ‘উপাচার্য গ্রুপের’ নেতা-কর্মীরা তালা ভেঙে উপাচার্যকে বের করে নিয়ে আসেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ক্যাম্পাসে অবস্থিত ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের জন্য সরাসরি উপাচার্যকে দায়ী করেছেন।
উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির বের হওয়ার সময় বলেন, তাঁরা তিন ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেছেন। ঘটনা তদন্তে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মো. ফরহাদ হোসেনকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছেন। আশুলিয়া থানায় একটি মামলাও করা হচ্ছে বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন: প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও দর্শন বিভাগের একই ব্যাচের মো. রাশেদুল ইসলাম। সাভার থানার পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করেছে।
রাতে যোগাযোগ করা হলে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম বদরুল আলম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) বাদী হয়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া তিন ছাত্রকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। আশিককে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
যেভাবে ঘটনা: ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, জুবায়েরও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্থগিত কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলামের সমর্থক ছিলেন। অভিযোগ আছে, সেই সময় তিনি একবার সংগঠনের অন্য পক্ষের সমর্থক আশিককে (গতকাল গ্রেপ্তার) মারধর করেছিলেন। তবে গত দেড় বছর জুবায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি ক্যাম্পাসেও থাকতেন না। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে এসে ক্লাস করতেন। ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে শক্তিশালী হয়েছে স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আসগর আলী, শরিফুল ইসলাম এবং এস এম শামীম গ্রুপ। এই গ্রুপটিই কাম্পাসে ছাত্রলীগের ‘ভিসি গ্রুপ’ নামে পরিচিত। আশিক এই গ্রুপের প্রভাবশালী কর্মী। ধারণা করা হচ্ছে, দেড় বছর আগের ঘটনার শোধ নিতেই আশিক পরীক্ষার শেষ দিনে জুবায়েরকে মারার পরিকল্পনা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার পরীক্ষা শেষ হলে বিভাগের সামনে থেকে আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস, রাশেদুলসহ ছাত্রলীগের ১২-১৩ জন কর্মী জুবায়েরকে ধরে নির্মাণাধীন ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের পেছনে নিয়ে রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটান। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আশিক ও রাশেদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের পেছনের জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে নিয়ে জুবায়েরকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসেন। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন জানিয়ে চিকিৎসকের কাছে তাঁরা জুবায়েরের এক বন্ধুর ফোন নম্বরও দিয়ে আসেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকেরা জুবায়েরকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখেন। অবস্থার আরও অবনতি হলে রাত ১০টার দিকে তাঁকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই গতকাল ভোর ছয়টার দিকে মারা যান জুবায়ের।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা রোববার রাতে প্রথম আলোকে জানান, জুবায়েরের শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাঁর দুই পা ও ডান হাত ভাঙা ছিল।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে জুবায়েরের একটার পর একটা অঙ্গ কার্যকারিতা হারিয়েছে।
মর্গের সামনে সহপাঠীদের কান্না: গতকাল সকালে ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে জুবায়েরের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লাশ গ্রহণ করেন নিহত জুবায়েরের ভাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, জুবায়েরের সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। বিভিন্ন জায়গায় থেঁতলানো ও হাড় ভাঙা ছিল। মাথার খুলিও ভাঙা ছিল বলে জানায় মর্গ সূত্র।
শীত-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকালে মর্গে ভিড় করেন জুবায়েরের সহপাঠীরা। মর্গের সামনে তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে কেউ কেউ উপাচার্যের অপসারণ দাবি করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম অভিযোগ করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রলীগ মানেই ভিসি গ্রুপ। ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির প্রায় দেড় শ নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসেই যেতে পারেন না। ক্ষুব্ধ নির্ঝর সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি হয়তো ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের নামে গ্রুপের কথা শুনে থাকবেন। কিন্তু কখনো কি ছাত্রলীগ ভিসি গ্রুপের নাম শুনেছেন?’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ সুবিধা নিতে থাকেন, তাহলে সে ঘটনার ব্যর্থতার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই নিতে হবে। এত দিন কেন তারা কোনো ব্যবস্থা নিল না, সেই জবাব তাদেরই দিতে হবে।’
এই সব অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্য জানার জন্য তাঁর মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। গত রাতে সর্বশেষ তাঁর বাসায় ফোন করা হলেও কেউ তা ধরেননি।
উত্তপ্ত ক্যাম্পাস: জুবায়েরের মৃত্যুর খবর এলে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সকাল সাড়ে আটটার দিকে মীর মশাররফ হোসেন হলের ২১৩ নম্বর কক্ষ থেকে আশিকুল ইসলামকে আটক করে সাভার থানার পুলিশ।
সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভা বসে। সভা শেষে জরুরি সিন্ডিকেট সভা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা জড়িত শিক্ষার্থীদের আজীবন বহিষ্কার, প্রক্টরকে অব্যাহতি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার অপসারণের দাবি জানিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেলা ১১টা থেকে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
বেলা আড়াইটার দিকে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের তিনটি ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাসহ প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে ছাত্রলীগের নেতা আতিকুর রহমান ওরফে সকাল, আশরাফুজ্জামান ওরফে লিটনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শ খানেক কর্মী গিয়ে তালা ভেঙে উপাচার্যকে বের করে নিয়ে আসেন। এসময় তারা স্লোগান দেন, ‘ভিসি তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
বারবার কলঙ্কিত জাহাঙ্গীরনগর: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ বার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মারামারিতে জড়িয়েছেন। এতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ২০১০ সালের ৫ জুলাই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। এই কমিটির নেতারাই গতকাল উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, গত দেড় বছরের বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে মুক্তমঞ্চে ভাঙচুর, সংগঠনের প্রতিপক্ষের কর্মীদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যবহার, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা, সাংবাদিক মারধর, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ গতকাল তাঁদের বেধড়ক মারধরের শিকার হয়ে মারা যান জুবায়ের আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.