ইরান কি আক্রান্ত হতে যাচ্ছে? by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
অতি সম্প্রতি পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দুষ্ট রাষ্ট্রচক্র এবং ইরানের মধ্যকার উত্তেজনাকর সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বত্রই একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে : 'ইরান কি আক্রান্ত হতে যাচ্ছে?' কিছুদিন আগে ডেইলি মেইলের খবরে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছিল যে ক্রিসমাসের আগেই ইরান আক্রান্ত হতে পারে। জাতিসংঘ কর্তৃক ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রমাণ উপস্থাপন, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডার কঠোরতম অবরোধ আরোপ,
ইরানের আকাশসীমা থেকে ইরান কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বিমান ভূপাতিতকরণ, অবরোধের বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়ার দ্বিমত পোষণ এবং ইরান যুক্তরাজ্যের-কূটনৈতিক সম্পর্কের অকালমৃত্যু প্রভৃতি ইস্যু উত্থাপিত প্রশ্নটিকে বারবার বিশ্লেষণের টেবিলে নিয়ে আসছে। পররাষ্ট্রনীতির এ স্পর্শকাতর বিষয়ে হার্ভার্ডের গ্রাহাম কে এলিসনের যৌক্তিক কার্য-প্রণয়ন মডেল (National actor model) অনুসৃত হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতায় ইরান আক্রমণের ঝুঁকি পাশ্চাত্য কখনো নেবে না। যেকোনো যুদ্ধের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য যথেষ্ট যৌক্তিক প্রেক্ষাপট থাকতে হয়। নিকারাগুয়ায় গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, ইরাকে একনায়ক সাদ্দামের হঠকারী শাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের স্বাধীনতা রক্ষা, টুইন টাওয়ারে দুর্ধর্ষ হামলায় আল-কায়েদা ও তালেবানের জড়িত থাকার প্রেক্ষিত প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলো আক্রমণ করে মিলিয়ন মিলিয়ন নিরীহ অসহায় মানুষকে হত্যা করে রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। অতি সম্প্রতি ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণ দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে সর্বব্যাপী অগ্রহণযোগ্যতা ও ঘৃণা অর্জন করেছে। যুদ্ধের উদ্গাতা বুশ ও ব্লেয়ার স্বদেশের মাটিতে 'মিথ্যুক' এবং 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ইরাক ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সৈন্যরা যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং অত্যাচারের করুণ চিত্র অবলোকন করে সর্বগ্রাসী মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এ অবস্থা যুদ্ধ বাধানো বা যুদ্ধজয়ে প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি (psychological make-up) সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করেছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে ইরানের মতো সুশৃঙ্খল জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অচিন্তনীয়। এর জন্য দরকার ন্যাটো, পাশ্চাত্য এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ও আশীর্বাদ। কয়েক সপ্তাহ আগে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ওবামা ও নিকোলাসের মধ্যকার কথোপকথনের সূত্র ধরে লামঁদ পত্রিকা প্রকাশ করেছে যে পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর মিত্রতায় চিড় ধরেছে। ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় নিকোলাস তাঁকে বলেছেন, 'নেতানিয়াহু মিথ্যুক, আমি তাঁর সঙ্গে নেই।' ওবামাও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও মার্কিন রাজনীতিতে 'ইসরায়েল ফ্যাক্টর' ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'আপনি বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, তবে প্রতিদিনই তাঁকে আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। ওবামার এমন মন্তব্যে রিপাবলিক কংগ্রেসম্যান মাইকেল গ্রিসসহ অনেক রাজনীতিবিদ সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। আরব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চিরঞ্জীব মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে এমন টলটলায়মান আস্থার সংকট নিয়ে কখনো ইরান-পাশ্চাত্য যুদ্ধের কল্পনাও করা যায় না। তৃতীয়ত, যুদ্ধ ও শান্তির জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধবিরোধী অনড় অবস্থান মার্কিনিদের যুদ্ধদামামা স্তব্ধ করে দিতে যথেষ্ট। ইতিমধ্যেই এ ভেটো ক্ষমতাধর দেশ দুটি ইরানের ওপর অবরোধ আরোপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ১১/১১/১১-এর সুসংবাদময়তার সন্ধিক্ষণে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় কূটনৈতিক বৈঠকের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল_তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি যুদ্ধবাজ পাশ্চাত্যকে অবহিত করা। সেখানে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাংলি চীন-ইরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক লেনদেন দুই দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজন বলে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেন। ১১/১১/১১ তারিখে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের উপসচিব আলি বাকেরি ও রুশ প্রতিপক্ষ ইউভগেনি লুকইয়ানোভ এ চুক্তিতে স্বাক্ষরদান করে দুই দেশের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নে দৃপ্ত শপথ উচ্চারণ করেন।
চতুর্থত, বহির্বিশ্বে যেকোনো সামরিক নীতি ও যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণ মার্কিন রাজনীতিবিদরা একমত থাকেন_সাম্রাজ্যবাদের হীনস্বার্থ রক্ষায় সাম্রাজ্যবাদী বেহায়াদের এটাই চরিত্র। আগেই উল্লেখ করেছি, সম্ভাব্য ইরান আক্রমণের ব্যাপারে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো তো একমত নয়ই, অধিকন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও এ ব্যাপারে শতধাবিভক্ত, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিল আয়োজিত গত ১৩/১২ তারিখের ওয়াশিংটন বৈঠকে জিমি কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিগনিউ ব্রেজিনস্কি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি চরম বিপর্যয়কারী (disastrous) হতে পারে।' সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে। ওবামার উদ্ধার সাধন (bailout) কার্যক্রম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রতি ইউরো অঞ্চল ঋণ সংকট (Euro zone debt crisis) সংক্রান্ত সম্মেলন এবং ইউরো অঞ্চলের ঋণ সংকট নিরসনে চীন, রাশিয়া এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোকেও তহবিল সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হারমান ভ্যান রম্পু কর্তৃক উদাত্ত আহ্বান প্রভৃতি ঘটনা পাশ্চাত্য ও বিশ্ব অর্থনীতির করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে আছে। শিশুসহ প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের স্কন্ধে ঋণের ভাগ রয়েছে প্রায় ৪,৪৫,০০০ ডলারেরও বেশি। নিউ ইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট বিক্ষোভ 'অকুপাই ডিসি', 'অকুপাই সিডনি', 'অকুপাই ওয়াশিংটন' প্রভৃতি 'দখল করো' চেতনাদীপ্ত আন্দোলন পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বিপজ্জনক পরিণতি সত্ত্বেও ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। মটন হালপারি এবং অন্যরা আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির মডেল (bureaucratic politics model) উত্থাপন করেছেন, যেখানে আন্ত-আমলা বিতর্ক (intra-bureaucratic battle) তুঙ্গে ওঠে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন অংশ স্ব-স্ব স্বার্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে বাধ্য করতে চায়। দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্য ও অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক শীর্ষ ব্যক্তিরাও অনেক সময় এ অংশ দ্বারা মরণফাঁদে নিপতিত হয়। সিনিয়র ও জুনিয়র বুশ ছিলেন এমন এক ভুল পথে পা রাখা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যাঁরা ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের মাঝ দিয়ে দেশ ও বিশ্বে আমেরিকার সরকার ও জনগণকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছেন। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী রিপাবলিকান নিউট গিংরিচ ও মিট রমনি ইরান ও সিরিয়ায় গুপ্তহত্যা, নাশকতার মতো কদর্য কৌশল অবলম্বন করে ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের বিজয়ার্জনে ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, গত ৭/১২ তারিখে ওয়াশিংটনে রিপাবলিকান জিউইশ কোয়ালিশনের সম্মেলনে তাঁরা ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইরানি স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে বুশের অনুসারী রিপাবলিকান প্রার্থীরা তাঁদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ইরান আক্রান্ত হলে সে যুদ্ধ দ্রুতই ওই অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের এবং পৃথিবীর সব দেশ ও সব মানুষের জীবনকে সর্বাত্মক ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেবে। ব্রেজনস্কির সতর্কবাণী, 'ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে আমাদের জন্য এর পরিণতি বিপর্যয়কর হতে পারে। বিপর্যয়ের মাত্রা ভয়াবহ হতে পারে এবং তা বৈশ্বিক রূপও পরিগ্রহ করতে পারে। ৪/১২ তারিখে আমেরিকার গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ভূপাতিত করে ইরান তা আটক করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত না দেওয়ার দৃপ্ত ঘোষণা দিয়েছে। আহমাদিনেজাদ নিশ্চিত করেছেন, ড্রোন বিমান এবং অন্যান্য যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে ইরান। সম্ভাব্য সর্বাত্মক যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজে সম্ভব হবে না আমেরিকার জন্য। ওই অঞ্চলে অনিশ্চিত যুদ্ধ শুরু হলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এবং তাহলে এক নিরন্তর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে পাশ্চাত্যকে। ইসরায়েল হবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, আর মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে পাশ্চাত্যের চির আধিপত্য। এমন বিপদসঙ্কুল পথে যুক্তরাষ্ট্র পা রাখবে না, ইরান তাই আক্রান্তও হবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে ইরানের মতো সুশৃঙ্খল জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অচিন্তনীয়। এর জন্য দরকার ন্যাটো, পাশ্চাত্য এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ও আশীর্বাদ। কয়েক সপ্তাহ আগে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ওবামা ও নিকোলাসের মধ্যকার কথোপকথনের সূত্র ধরে লামঁদ পত্রিকা প্রকাশ করেছে যে পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর মিত্রতায় চিড় ধরেছে। ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় নিকোলাস তাঁকে বলেছেন, 'নেতানিয়াহু মিথ্যুক, আমি তাঁর সঙ্গে নেই।' ওবামাও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও মার্কিন রাজনীতিতে 'ইসরায়েল ফ্যাক্টর' ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'আপনি বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, তবে প্রতিদিনই তাঁকে আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। ওবামার এমন মন্তব্যে রিপাবলিক কংগ্রেসম্যান মাইকেল গ্রিসসহ অনেক রাজনীতিবিদ সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। আরব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চিরঞ্জীব মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে এমন টলটলায়মান আস্থার সংকট নিয়ে কখনো ইরান-পাশ্চাত্য যুদ্ধের কল্পনাও করা যায় না। তৃতীয়ত, যুদ্ধ ও শান্তির জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধবিরোধী অনড় অবস্থান মার্কিনিদের যুদ্ধদামামা স্তব্ধ করে দিতে যথেষ্ট। ইতিমধ্যেই এ ভেটো ক্ষমতাধর দেশ দুটি ইরানের ওপর অবরোধ আরোপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ১১/১১/১১-এর সুসংবাদময়তার সন্ধিক্ষণে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় কূটনৈতিক বৈঠকের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল_তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি যুদ্ধবাজ পাশ্চাত্যকে অবহিত করা। সেখানে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাংলি চীন-ইরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক লেনদেন দুই দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজন বলে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেন। ১১/১১/১১ তারিখে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের উপসচিব আলি বাকেরি ও রুশ প্রতিপক্ষ ইউভগেনি লুকইয়ানোভ এ চুক্তিতে স্বাক্ষরদান করে দুই দেশের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নে দৃপ্ত শপথ উচ্চারণ করেন।
চতুর্থত, বহির্বিশ্বে যেকোনো সামরিক নীতি ও যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণ মার্কিন রাজনীতিবিদরা একমত থাকেন_সাম্রাজ্যবাদের হীনস্বার্থ রক্ষায় সাম্রাজ্যবাদী বেহায়াদের এটাই চরিত্র। আগেই উল্লেখ করেছি, সম্ভাব্য ইরান আক্রমণের ব্যাপারে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো তো একমত নয়ই, অধিকন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও এ ব্যাপারে শতধাবিভক্ত, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিল আয়োজিত গত ১৩/১২ তারিখের ওয়াশিংটন বৈঠকে জিমি কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিগনিউ ব্রেজিনস্কি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি চরম বিপর্যয়কারী (disastrous) হতে পারে।' সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে। ওবামার উদ্ধার সাধন (bailout) কার্যক্রম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রতি ইউরো অঞ্চল ঋণ সংকট (Euro zone debt crisis) সংক্রান্ত সম্মেলন এবং ইউরো অঞ্চলের ঋণ সংকট নিরসনে চীন, রাশিয়া এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোকেও তহবিল সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হারমান ভ্যান রম্পু কর্তৃক উদাত্ত আহ্বান প্রভৃতি ঘটনা পাশ্চাত্য ও বিশ্ব অর্থনীতির করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে আছে। শিশুসহ প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের স্কন্ধে ঋণের ভাগ রয়েছে প্রায় ৪,৪৫,০০০ ডলারেরও বেশি। নিউ ইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট বিক্ষোভ 'অকুপাই ডিসি', 'অকুপাই সিডনি', 'অকুপাই ওয়াশিংটন' প্রভৃতি 'দখল করো' চেতনাদীপ্ত আন্দোলন পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বিপজ্জনক পরিণতি সত্ত্বেও ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। মটন হালপারি এবং অন্যরা আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির মডেল (bureaucratic politics model) উত্থাপন করেছেন, যেখানে আন্ত-আমলা বিতর্ক (intra-bureaucratic battle) তুঙ্গে ওঠে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন অংশ স্ব-স্ব স্বার্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে বাধ্য করতে চায়। দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্য ও অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক শীর্ষ ব্যক্তিরাও অনেক সময় এ অংশ দ্বারা মরণফাঁদে নিপতিত হয়। সিনিয়র ও জুনিয়র বুশ ছিলেন এমন এক ভুল পথে পা রাখা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যাঁরা ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের মাঝ দিয়ে দেশ ও বিশ্বে আমেরিকার সরকার ও জনগণকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছেন। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী রিপাবলিকান নিউট গিংরিচ ও মিট রমনি ইরান ও সিরিয়ায় গুপ্তহত্যা, নাশকতার মতো কদর্য কৌশল অবলম্বন করে ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের বিজয়ার্জনে ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, গত ৭/১২ তারিখে ওয়াশিংটনে রিপাবলিকান জিউইশ কোয়ালিশনের সম্মেলনে তাঁরা ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইরানি স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে বুশের অনুসারী রিপাবলিকান প্রার্থীরা তাঁদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ইরান আক্রান্ত হলে সে যুদ্ধ দ্রুতই ওই অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের এবং পৃথিবীর সব দেশ ও সব মানুষের জীবনকে সর্বাত্মক ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেবে। ব্রেজনস্কির সতর্কবাণী, 'ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে আমাদের জন্য এর পরিণতি বিপর্যয়কর হতে পারে। বিপর্যয়ের মাত্রা ভয়াবহ হতে পারে এবং তা বৈশ্বিক রূপও পরিগ্রহ করতে পারে। ৪/১২ তারিখে আমেরিকার গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ভূপাতিত করে ইরান তা আটক করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত না দেওয়ার দৃপ্ত ঘোষণা দিয়েছে। আহমাদিনেজাদ নিশ্চিত করেছেন, ড্রোন বিমান এবং অন্যান্য যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে ইরান। সম্ভাব্য সর্বাত্মক যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজে সম্ভব হবে না আমেরিকার জন্য। ওই অঞ্চলে অনিশ্চিত যুদ্ধ শুরু হলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এবং তাহলে এক নিরন্তর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে পাশ্চাত্যকে। ইসরায়েল হবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, আর মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে পাশ্চাত্যের চির আধিপত্য। এমন বিপদসঙ্কুল পথে যুক্তরাষ্ট্র পা রাখবে না, ইরান তাই আক্রান্তও হবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments