চিরতরুণের বিদায় by সৈয়দ মাহমুদ জামান

ভি না যাও ছোড়কার, দিল আভি ভরা নেহি...'। ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া 'হাম দোনো' ছবির গানটিই আজ বারবার মনে পড়ছে সবার। 'এখনই ছেড়ে যেও না, মন তো এখনো ভরেনি...'; কিন্তু এর পরও তাঁকে বেঁধে রাখা গেল না, তিনি চলে গেলেন। বিশ্বের অসংখ্য ভক্তকে ফেলে কখনো না ফেরার দেশে চলে গেছেন চিরতরুণ দেব আনন্দ। শনিবার গভীর রাতে লন্ডনের এক হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান সবার প্রিয় দেব সাব।


তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৮৮ বছর।সেপ্টেম্বর মাসে নিজের প্রযোজনা ও পরিচালনায় নির্মিত 'চার্জশিট' নামের ছবিটি মুক্তি দেওয়ার পর থেকেই হলিউড প্রজেক্ট 'সং অব লাইফ_আ মিউজিক্যাল লাভ স্টোরি'র কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যেহেতু পুরোপুরি মার্কিন প্রডাকশন এবং শুটিংও সেখানেই হবে, তাই যত দ্রুত সম্ভব কাজ গুছিয়ে আনতে চাইছিলেন। হয়তো সেই কাজের চাপেই গত একটা মাস প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ছেলে সুনীলের চাপাচাপিতে গত মাসের শেষ দিকে লন্ডনে যান চেকআপ করাতে। আর ফেরা হলো না।
১৯৪৬ সালে 'হাম এক হ্যায়' ছবির মধ্য দিয়ে ৬৫ বছরের এক বর্ণময় পথ চলা শুরু করেন দেব আনন্দ। ১৯৪৭ সালে যখন 'জিদ্দি' মুক্তি পেল, তত দিনে এক সুপারস্টার মহানায়কের জন্ম হয়ে গেছে। ঠিক দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রযোজনা সংস্থা 'নবকেতন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মস'। প্রযোজনা করেছেন ৩০টি ছবি, এর মধ্যে পরিচালনা ১৯টি। আর নিজের লেখা চিত্রনাট্য একটি। সেরা অভিনেতার ফিল্ম ফেয়ারসহ জীবনে যে কত পুরস্কার পেয়েছেন, এর হিসাব দিতে গেলে পুরো পৃষ্ঠাটাই শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে বিদেশি পুরস্কারেরও অভাব নেই। পেয়েছেন ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক পদ্মভূষণ। আর চলচ্চিত্রের সেরা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারটিও তাঁর হাতে উঠেছে ২০০১ সালে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই 'ভারতীয় তারকা' হিসেবে দেব আনন্দের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমে। ১৯৫৩ সালেই গ্রেগরি পেক শ্রীলঙ্কায় শুটিং করতে যাওয়ার পথে 'বিখ্যাত' দেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুম্বাইয়ে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। এরপর আরো কয়েকবারই তাঁদের দেখা হয়েছে। হলিউড তারকার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁদের দুজনের যোগাযোগ ছিল বলেই পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। ১৯৬৫ সালে 'গাইড' অস্কার মনোনয়ন পেলে দেব আনন্দের নাম হলিউডে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুরু করে। ছবির মার্কিন সংস্করণের সহপ্রযোজক নোবেলজয়ী লেখিকা পার্ল এস বাক দেবকে হলিউডের একটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন। কারণ তাঁর মতে, চরিত্রটি 'তেমন চ্যালেঞ্জিং' ছিল না।
গতকাল ভোরেই দেব আনন্দের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে আক্ষরিক অর্থেই শোকের ছায়া নেমে আসে বলিউডে। শোকবার্তা দেওয়ার জন্য বলিউড তারকারা বেছে নেন নিজ নিজ ব্লগিং সাইট।
অমিতাভ বচ্চন : মাত্র দেব সাবের খবরটি পেলাম। প্রথমেই মনে হয়েছে, ঈশ্বর, খবরটি যেন সত্যি না হয়। এমন প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে মৃত্যু কোনোভাবেই যায় না! মাত্র কদিন আগে এক প্রিমিয়ারে ওনার সঙ্গে কথা হয়েছে। বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছেন; কিন্তু সেই প্রাণচাঞ্চল্য এখনো কারো চেয়ে কম নেই। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা পূরণ করার সাধ্য কারো নেই, কখনো হবেও না। কখনো নিজের বিশ্বাস থেকে চ্যুত হননি তিনি।
অনুমপ খের : দেব সাব সম্পর্কে কী বলার আছে! সব সময়ই তিনি ছিলেন অধিনায়ক, সময়ের চেয়েও আধুনিক, সাহসী, মায়াবী এক জাদুকর, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া এক মহান ব্যক্তি। সর্বোপরি অসাধারণ এক মানুষ। তাঁর গানের মতোই তিনিও আমাদের জীবনে সব সময় গভীর এক দাগের জন্ম দিয়েছেন।
শাবানা আজমি : দেব সাব সব সময় নিজের মতো করে তাঁর জীবনকে সাজিয়েছেন, উপভোগ করেছেন। লাখো, কোটি ভক্ত সব সময় তাঁর অভাব বোধ করবে। তিনি চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর ছবির মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন সারা জীবন। তাঁর প্রাণবন্ত জীবনকে আমার সালাম।
মহেশ ভাট লিখেছেন, তিনি চলে গেলেন; কিন্তু ভক্তদের জন্য, আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর চির উজ্জ্বল সেই হাসি। আমি সেই তারকার স্মৃতিকে সালাম জানাই, যাঁর হাসিতে উজ্জ্বল হয়েছে বলিউড।
মধুর ভাণ্ডারকর : একেবারে ভেতর পর্যন্ত নড়ে উঠেছে খবরটি শুনে। বিশ্বাস করতে পারছি না, দেব সাব আর নেই। কেন যে কথাটা মেনে নিতে পারছি না! এই বয়সেও প্রাণবন্ত দেখেছি তাঁকে, সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না।
কুনাল কোহলি : তাঁর উদ্দীপনা, প্রাণচাঞ্চল্য, জীবন ও চলচ্চিত্রের প্রতি উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা সব সময় বেঁচে থাকবে তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে। আপনার জন্য ভালোবাসা, দেব সাব।
শাহরুখ খান : দেব সাবের এই অকালে চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ফাঁকা হয়ে গেল। আমরা হারিয়ে ফেললাম তাঁর জাদুকরী প্রাণচাঞ্চল্যকে।
অভিষেক বচ্চন : বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাবতেই পারি না ঘুম থেকে উঠে এমন একটা খবর শুনতে হবে! অভিনেতা ও মানুষ হিসেবে দেব সাব ছিলেন অসাধারণ।
দিব্য দত্ত : শেষ ছবির প্রিমিয়ারে ওনার সঙ্গে দেখা হয়। আমার পাশেই বসেছিলেন। সারাক্ষণ মুখে লেগেছিল সেই মন ভোলানো হাসি। কী প্রাণবন্ত! আত্মা শান্তি পাক, দেব সাব। আপনার সঙ্গে পরিচয়, কাজ করার অভিজ্ঞতা সারা জীবন আমাকে এগিয়ে রাখবে। আমার চিরতরুণ নায়ক। আপনাকে দারুণভাবে অনুভব করব, স্যার।
দিয়া মির্জা : আপনার আত্মা চিরশান্তি পাক_ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা, দেব সাব। বলিউড, মুম্বাই, ভারত কখনো আপনাকে ভুলবে না।
নীল নিতেন মুকেশ : মাত্র খবরটি পেলাম। ওনার বিরাট ভক্ত। তাঁর ছবি দেখেই বড় হয়েছি। আত্মা শান্তি পাক।
শ্রেয়া ঘোষাল বলেছেন, তাঁর ছবি এবং সেই ছবির গান ভারতের ছবির ইতিহাস হয়ে আছে, থাকবে। চলচ্চিত্রের প্রতি এমন আবেগ আর হয়তো পাওয়া যাবে না। আলোচিত মডেল পূনম পাণ্ডে বলেছেন, "জীবন অনেকটাই পোকার খেলার মতো। আপনার হাতে কী আছে সেটা বড় কথা নয়, আপনি তা দিয়ে কিভাবে খেলছেন, সেটাই দেখার বিষয়। দেব সাবও নিজের মতো করে জীবনকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বিদায় 'দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার'। আপনার আত্মা চিরশান্তি পাক, দেব আনন্দ।"
লেখক সালমান রুশদি টুইটারে লিখেছেন, 'তাঁর ছবি দেখে বড় হয়েছি। এমন একজন কিংবদন্তিকে বিদায় বলতে কষ্ট হচ্ছে।'

No comments

Powered by Blogger.