'ফুটবল আমাকে মানুষ চিনিয়েছে' by রানা হাসান
সক্রেটিস ব্রাসিলেইরো সাম্পাইয়ো ডি সুজা ভিইরা ডি ওলিভেইরাSocrates Brasileiro Sampaio de Souza Vieira de Oliveiraইংরেজি ৪৮ অক্ষর দিয়ে তৈরি নামের এই ভদ্রলোকের পরিচিতি জগৎজুড়ে। তবে এত বড় নামে তাকে চেনা লোকের সংখ্যা এ পৃথিবীতে হয়তো খুবই কম। সবার কাছেই তার পরিচিত প্রথম আট অক্ষর দিয়ে গড়া 'সক্রেটিস' নামেই। পেলে-পরবর্তী যুগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের কিংবদন্তিদের একজন হিসেবেই 'আজব চরিত্রে'র
সক্রেটিসের খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। মদ আর তামাক_ দুটোতেই প্রবল আসক্তির মাঝে থেকেও সক্রেটিস দেশের হয়ে খেলেছেন ৬০ ম্যাচ। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে রয়েছে দু'দুটি বিশ্বকাপ। এক আসরে আবার ব্রাজিলকে নেতৃত্বেও দিয়েছেন। আধুনিক ফুটবলে কোনো কোচ তার দলে এমন চরিত্রের ফুটবলার রাখা তো দূরের কথা, আশপাশে ভিড়তেও দিতেন না, এটা নিশ্চিত। অথচ, এমন বেপরোয়া জীবনযাপনের পর সক্রেটিস ব্রাজিল দলে খেলেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও খেলেছেন ফুটবল। প্রতিভার পরিচয় ছিল সেখানেও। মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের সর্বকালের তালিকায়ও উজ্জ্বল সক্রেটিসের নাম। আজকের কোচরাও সেই সক্রেটিসকে বিবেচনা করেন মধ্যমাঠে সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবেই। তাতে কী, মাত্র ৫৭ বছর বয়সেই সক্রেটিস এখন অতীত। রোববার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন টেনিস গ্রেট বিয়ন বর্গের মতো মাথায় হেডব্যান্ড পরে মাঠে নামা হলুদ জার্সি গায়ে সক্রেটিসের সব স্মৃতি। সুখ স্মৃতি।
নামের ব্যাপ্তিতে বিখ্যাত গ্রিক ধাঁচের প্রতিফলন থাকলেও সক্রেটিসের কোনো কাজে কখনোই ছিল না প্রাচীনতার ছাপ। মাঠের খেলাতেও তিনি ছিলেন না সনাতন পদ্ধতির। সব কিছুতেই ছিলেন চরম আধুনিক। তা সেটি বেশভুষা বা মাঠের খেলার ধরনেই হোক না কেন। মধ্য আশির দশকে ব্রাজিলের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসার মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রেটিসের যেমন ভূমিকা ছিল তেমনি ভক্ত ছিলেন কিউবার কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং আজন্ম বিপ্লবী চে গুয়েভারার বড় ভক্ত। সে সঙ্গে জন লেলনের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তিনি অনেকবার। এভাবেই জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। গত বছর জুলাইয়ে বিসিবিকে এক সাক্ষাৎকারে সক্রেটিস বলেছিলেন, 'জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিয়েছে, তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আমি একজন ফুটবলার। জনগণের অনেক কিছুই বলার ক্ষমতা নেই, সে কথাগুলো বলার জন্য তারা আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন।' জীবনের সেরা অর্জনটা যে ফুটবলের কারণেই, সেটি জানাতেও ভুল করেননি সক্রেটিস। বিসিবিকে দেওয়া সে সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ফুটবল আমাকে যা কিছু দিয়েছে তার মধ্যে সেরাটি হলো মানুষ চেনার ক্ষমতা। আমি বঞ্চিত ও সুবিধাভোগী দু'ধরনের লোকের সঙ্গেই মিশেছি। তাই আমাদের সমাজের সব কিছুই জানা আমার।
চিকিৎসক হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করলেও পেশাদার ফুটবলে নাম লেখাতে রাজি হননি তিনি ২৫ বছর পর্যন্ত। কারণ তখনও তার পড়ালেখার পর্ব শেষ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাই করেছেন। পড়ালেখা শেষ করে ১৯৮৯ পর্যন্ত খেলেছেন ফুটবল। এরপর বেছে নিয়েছেন চিকিৎসকের পেশা। ব্রাজিলের রিবারিও শহরে চালিয়ে গেছেন চিকিৎসাসেবা। চতুর্থ ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক হিসেবে ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলেও সে সময় ব্রাজিলকে বিশ্ব ফুটবলের এক নম্বর স্থানটিতে পেঁৗছে দিয়েছিলেন তিনিই। এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফ্রান্সের কাছে টাইব্রেকারে হেরে আসর থেকে ছিটকে পড়া দলেও ছিলেন সক্রেটিস। যাই হোক সাম্বা দেশের এ তারকা জীবনের প্রতি ছিলেন চরম উদাসীন। এর প্রভাব ছিল তার খেলার ধরনেও। এ কারণেই হয়তো শুধু ব্রাজিল নয়, বিশ্বজুড়েই সক্রেটিসের জন্য তৈরি হয়েছিল কোটি সমর্থকের এক বলয়।
এত কিছু করেও খোদ সক্রেটিস ছিলেন নিজের ওপর প্রচণ্ড আস্থাশীল। প্রমাণ শুনুন তার নিজেরই বর্ণনায়_ আমি যখন আমার ছেলের নাম রাখলাম ফিদেল, তখন আমার মা এসে শক্ত সামর্থ্যের অর্থ বোঝায় এমন একটি নাম আমার ছেলের জন্য রাখতে বললেন। জবাবে আমি মাকে বললাম, দেখ তুমি আমার জন্য কী করেছ? মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মা এ নিয়ে আমার সঙ্গে দুষুদ্বমি করেছেন। তখনও আমি মাকে বোঝাতে চেয়েছি, 'সক্রেটিস ব্রাসিলিইরো সাম্পায়ো ডি সৌজা ভিইরা ডি ওলিভিরা' এখন কিন্তু নিজেই একটি নাম।
No comments