রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হচ্ছে এলপি গ্যাসের লাইসেন্স-ব্যবসা নয়, ব্যাংক ঋণই টার্গেট

পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব না হওয়ায় পরিবেশবান্ধব এলপি গ্যাস সিলিন্ডার আকারে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন জনপ্রিয় জ্বালানি। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় এক লাখ টন এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, যার প্রায় ৮০ শতাংশই পূরণ করছে ছয়টি প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার এর মধ্যে আবার ২২টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়ায় এ খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব লাইসেন্সের একটি বড় অংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে।


লাইসেন্স পাওয়ার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ধরনা দিচ্ছে, মূল টার্গেট ব্যাংক ঋণ আদায়ের পর ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া। অনেকে আবার লাইসেন্স বিক্রির জন্য লোক খুঁজছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলপি গ্যাস খাতের এক শীর্ষ বিনিয়োগকারী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যে ২২টি কম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই এ খাতে ব্যবসা করতে পারবে না। কারণ এ খাতে ব্যবসায় তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান কম্পানিগুলোই ২০১২ সালের মধ্যে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী এলপি গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু ওই ২২টি কম্পানির একটি বড় অংশ ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের লক্ষ্যই থাকবে কিভাবে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা যায়। এ কারণে সরকারের ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ব্যাপারেও ভেবে দেখা উচিত।' এ প্রসঙ্গে ক্লিনহিটের জিএম (অপারেশন) সাঈদুল ইসলাম বলেন, 'আমার জানামতে যাঁরা লাইসেন্স পেয়েছেন তাঁদের অনেকেই এখন লাইসেন্স বিক্রি করার চেষ্টা করছেন।' তিনি আরো বলেন, 'এমন সব প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস সরবরাহের অনুমতি পেয়েছে, যেগুলোর ব্যবসার ধরনের সঙ্গে কোনোভাবেই এলপি গ্যাস খাতটি যায় না।' অনুসন্ধানে এ মন্তব্যের সত্যতা মিলেছে। অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্সের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব কম্পানির মধ্যে রয়েছে হাউজিং প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ইউরো পেট্রো প্রডাক্ট, এনজিজিএল গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, পারমিতা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস লিমিটেড। জরুরি অবস্থা চলাকালীন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্র্নীতির মামলা দায়েরকারী আজম জে চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান ইস্টকোস্ট গ্রুপ, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ রাজনীতির বিশিষ্ট নেতা মনোয়ার হাকিম আলীর ইনট্রাকো গ্রুপ, সানোয়ারা গ্রুপসহ ২২টি কম্পানিকে এলপি গ্যাস সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে অনেকে লাইসেন্স বিক্রি করার চেষ্টা করছেন।
পাইপলাইনের গ্যাসস্বল্পতার কারণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। এলপি গ্যাসের চাহিদা মেটানোর জন্য বর্তমানে দেশে ছয়টি প্রতিষ্ঠান ভোক্তাপর্যায়ে এলপি গ্যাস পেঁৗছে দিচ্ছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ছাড়া বাকি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস, টোটাল, ক্লিনহিট ও যমুনা। এর মধ্যে টোটাল ও ক্লিনহিট কম্পানি দুটি বিদেশি, বাকি দুটি বসুন্ধরা ও যমুনা দেশি কম্পানি। এ ছয়টি কম্পানি মিলে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার টন গ্যাস আমদানি করে থাকে; যার মধ্যে বিপিসি ২২ হাজার টন, টোটাল ১২ হাজার টন, ক্লিনহিট ১২ হাজার টন, যমুনা ৪ হাজার টন ও বসুন্ধরা ৩০ হাজার টন বাল্ক এলপি গাস আমদানি করে থাকে বিদেশ থেকে। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে দেশের সর্ববৃহৎ এলপি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা মংলায় মাসিক ৩০ হাজার টনের দ্বিতীয় ইউনিট চালু করতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে বসুন্ধরার বছরে উৎপাদন পেঁৗছবে ৬০ হাজার টনে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০১২ সালের মধ্যে আরো ৩০ হাজার টনের একটি ফিলিং স্টেশন চালু হবে। বসুন্ধরা সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি ৯০ হাজার টন একাই আমদানি করবে। পাশাপাশি দেশের সব বিভাগীয় শহরে এলপি ফিলিং স্টেশন স্থাপন করার কাজ হাতে নিয়েছে বসুন্ধরা। কম্পানির একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের মধ্যে দেশের জ্বালানি সংকট নিরসনে কম্পানি তার লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছবে।
দেশের জ্বালানি সংকট সমাধানে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাল্ক এলপি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোনাসের সঙ্গে চুক্তি করেছে। পেট্রোনাসের সঙ্গে চুক্তিমতে বসুন্ধরা বাল্ক এলপি গ্যাস মালয়েশিয়ার কাছ থেকে কিনবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কার্গো জাহাজও ক্রয় করেছে। বসুন্ধরার এলপি গ্যাসের হেড অব অপারেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা অন্যদের তুলনায় কম দামে এলপি গ্যাস ভোক্তাকে দিতে পারব এ কারণে যে, আমরা সরাসরি বাল্ক এলপি গ্যাস মালয়েশিয়া থেকে কিনে আনছি। অন্যদিকে আমাদের নিজেদের সিলিন্ডার তৈরির ফ্যাক্টরি রয়েছে।' বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ আশা করছে, অচিরেই অন্যদের চেয়ে কম দামে এলপি গ্যাস ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করতে পারবে।'
এলপি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, একটি রিফুয়েলিং গ্যাস স্টেশন নির্মাণ করতে হলে ১০০ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করতে হয়। এ কারণে কোনো বিনিয়োগকারী এ খাতে বিনিয়োগের আগে ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জেনেই বিনিয়োগে আসার কথা ভেবে থাকে। তবে চলতি মাসের প্রথম দিকে ২২টি কম্পানিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় এলপি গ্যাস সরবরাহের লাইসেন্স অনুমোদন দেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া এসব কম্পানির বেশির ভাগই বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় ওইসব কম্পানির ঋণ পাওয়ার ব্যাপারটিও অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
এ সম্পর্কে ক্লিনহিটের জিএম সাঈদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা ছয়টি কম্পানি এখন যে পরিমাণ এলপি গ্যাস আমদানি করে দেশের ক্রেতাদের দিচ্ছি, তা আমাদের ছয়টি কম্পানির উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। আমরা পুরোদমে উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশের এলপি গ্যাসের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি করতে পারব।'
বিদেশে রপ্তানি হবে বসুন্ধরা সিলিন্ডার
দেশে প্রতি মাসে ফাঁকা ৫০ হাজার নতুন এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের চাহিদা রয়েছে। এলপি গ্যাসের প্রধান বিষয় সিলিন্ডার। এলপি গ্যাসের এসব ফাঁকা সিলিন্ডার আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। বর্তমানে বসুন্ধরা প্রতি মাসে ৫০ হাজার সিলিন্ডার স্থানীয় বাজারে অন্যান্য এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কম্পানিকে সরবরাহ করছে। বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস খিজির আহমেদ বলেন, 'বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা ৫০ হাজার সিলিল্ডার তৈরি করছে। অথচ আমাদের ক্ষমতা রয়েছে এক লাখ সিলিন্ডার তৈরির। আমরা শিগগিরই এক লাখ সিলিন্ডার তৈরি করব। দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে মিয়ানমার, নেপাল, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরামসহ সাতকন্যা রাজ্যে সিলিন্ডার রপ্তানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।' এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ফাঁকা সিলিন্ডারের চাহিদা কয়েক বছরের মধ্যে আরো কমে যাবে। কারণ এই সিলিন্ডার একবার কেনা হয়ে গেলে বারবার পাল্টিয়ে গ্যাস নেওয়া যায়।'

No comments

Powered by Blogger.