নিত্যজাতম্-পাকিস্তান আরো জটিলতায় by মহসীন হাবিব
পাকিস্তান দেশটির জন্য দুঃখ হয়। অপূর্ব সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভূপ্রকৃতির দেশ পাকিস্তান। একদিকে পাহাড়, গিরিপথ, বন; অন্যদিকে মরুভূমি, সমুদ্র। সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতির একটি দেশ। কোয়েটার হান্না লেক অথবা মিরপুরের বাগসার লেকের মতো অসংখ্য লেক বা হ্রদ রয়েছে দেশটিতে। রয়েছে প্রাণের বৈচিত্র্য। শিল্প ও সংস্কৃতির গর্বর্ করার মতো বৈচিত্র্য। কথিত আছে, মহাবীর আলেকজান্ডারের একদল অনুসারী পাকিস্তানের সৌন্দর্য অবলোকন করে
সেখানে চিরতরে থেকে গিয়েছিল। পাকিস্তানে এখনো একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা নিজেদের আলেকজান্ডারের বংশধর বলে দাবি করে। অথচ ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর পেশিশক্তি ব্যবহারের প্রবণতা, উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সামন্তপ্রভুদের অদূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত, দুর্নীতি, মধ্যবিত্তের অন্ধ জাতীয়তাবোধ, সব শ্রেণীর নাগরিকের ধর্মীয় গোঁড়ামি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কুসংস্কার_সব মিলে দেশটিকে একটি নরককুণ্ডে পরিণত করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু নির্বাচনেও পাকিস্তান সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগী বন্ধু না খুঁজে তারা হাতিয়ার ব্যবহারের বন্ধু তৈরি করতে সচেষ্ট থেকেছে। ফলে আজ এমন এক অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে পরমাণু অস্ত্রের দেশ হয়েও পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন।
পঞ্চাশের দশকে, বিশেষ করে বাগদাদ চুক্তির (এই চুক্তির সদস্য ছিল ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও ব্রিটেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র) মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না বলে বরং স্বার্থের সম্পর্ক বলাই যুক্তিযুক্ত। এশিয়ায় 'মোস্ট অ্যালাইড অ্যালাই' বলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র যে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টে ঈর্ষণীয় মনে হয়েছে, তা আসলে ছিল দুই পক্ষেরই ধান্দাবাজি। আর সে কারণেই এ দুই দেশের কারো স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই সম্পর্কে সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানকে যে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধর্মভীরু পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ব্যবহার করা। শুধুই সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পাকিস্তান এ সাহায্য নিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ বের করতে চেয়েছে; যেমন_১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। অথচ যুদ্ধের ছয় বছর আগে ১৯৫৯ সালেই পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন পাকিস্তান প্রথমবারের মতো মনে করল, যুক্তরাষ্ট্রকে অন্ধ বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
আপাতদৃষ্টে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র 'বন্ধুত্ব'কে বিশ্ব যতটা ঘনিষ্ঠ মনে করেছে, তা কিন্তু ১৯৭১ সালেও দেখা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি দায় বোধ করলেও পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছাও তাদের ছিল না। তারা বারবার একটি বিষয় নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখবে তো? ভেতরের কথাটি হলো, সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে যাবে না তো? অন্যদিকে সপ্তম নৌবহর পাঠাই পাঠাই করেও পাকিস্তানকে মার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
একটি কথা বলে রাখা উচিত, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণের জন্য কিছু খাদ্য সাহায্য দিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মূল সাহায্য-সহযোগিতা ছিল সব সময় পাকিস্তানের মিলিটারিভিত্তিক। এই সম্পর্ককে আসলে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্ক বলাই যথাযথ। আর যুক্তরাষ্ট্রের বারবার পাকিস্তানের পেছন থেকে সরে যাওয়ার একটি ন্যায্য যুক্তিও আছে। পাকিস্তানকে যে সাহায্য তারা দিয়েছে, তার বেশির ভাগ খেয়ে ফেলেছে সামন্ত মানসিকতার সেনা কর্মকর্তারা। এসব কর্মকর্তার স্বপ্নই থাকে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি করা। যা হোক, এই তৃতীয় দফা প্রয়োজনের সময় পেছন থেকে সরে যাওয়ার বিষয়টি জুলফিকার আলী ভুট্টো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি একরকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। প্রথমে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, তারপর ওআইসি এবং সব শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু পাকিস্তানে স্টিল মিল তৈরি করেছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এমআই-৮ হেলিকপ্টার দিয়েছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টি অধিক মাত্রায় সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করে। পরিণামে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়ার ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র হয়ে ওঠে সুদূরপরাহত। তবে ভুট্টোও ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। তাঁর ক্ষমতালিপ্সা সর্বজনবিদিত।
কত কিছু পরিষ্কার! ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া সব সাহায্য বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান পরমাণু প্রকল্পের উসিলায়। ওই বছরই ইরানি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ঠিক এর কিছুদিন পর ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার 'ঘুষ' দেয়। ১৯৮৬ সালে আবার চার বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়। নামে-বেনামে পাকিস্তানে ঢুকতে থাকে ডলার আর অস্ত্রের চালান। উদ্দেশ্য আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়ন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও একটি ব্যবসা পেয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেঙে যায়। ১৯৯১ সালেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সব সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
এর পরের ঘটনা হয়ে ওঠে জটিলতর। এবার সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ। পাকিস্তানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের দেশ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছর একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাত মিলিয়ে রেখেছে। অথচ কেউ কাউকে বন্ধু মনে করেনি। পাকিস্তান পেয়েছে অস্ত্র আর কোটি কোটি ডলার। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অন্তত বিরত রাখতে পেরেছে আফগানিস্তানের তালেবান শাসকদের সরাসরি সমর্থনদান থেকে।
৫৫ শতাংশ মার্কিন নাগরিক পাকিস্তানকে শত্রুরাষ্ট্র বলে মনে করে। আর ৮০ শতাংশ পাকিস্তানি যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংস কামনা করে। এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তানে শাসক পরিবর্তন করে করে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিল বিশেষ প্রয়োজনে। এখন আফগানিস্তানের যুদ্ধ যত স্তিমিত হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ততটা বৈরী হয়ে উঠছে। বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ তালেবানদের মদদ দিয়ে আসছে। কথা মিথ্যা নয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী অংশ মৌলবাদী এলিমেন্ট। বহু তালেবান যোদ্ধা ও তালেবান নেতা পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়ে আছে। অনেকে পাকিস্তানে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে গেছে।
এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে প্রায়ই ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালিয়ে থাকে তালেবানদের লক্ষ্য করে, যা বিশ্বব্যাপী ড্রোন অ্যাটাক বলে পরিচিত। বিষয়টি নিয়ে জনগণ তো বটেই, পাকিস্তান সরকারও স্বস্তিতে ছিল না। এটি সরাসরি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত বলে মনে করছে তারা। এই ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান কী অবস্থান নেবে তা ঠিক করে উঠতে পারছিল না। কিন্তু গত সপ্তাহে ভয়ানক এক হামলায় পাকিস্তানের ২৪ জন সেনা নিহত হওয়ার পর দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সত্যি কথা কি, সরকারের এখন আর চুপ করে থাকার উপায় নেই। রসদ সরবরাহের লাইন বন্ধ করে দেওয়া, একটি এয়ারবেইস বন্ধ করে দেওয়া এবং সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। এর মধ্যে আরব সাগর থেকে রসদ সরবরাহের লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঠিক দুই মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রসদ ফুরিয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা পাকিস্তানকে রসদ সরবরাহ লাইন খুলে দেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারবেন। কারণ পাকিস্তান তার পথ খুলে না দিলে বিকল্প যে পথের কথা ভাবা হচ্ছে, তা এতটাই বন্ধুর যে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব।
এবার বিষয়গুলোর মীমাংসা এত সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাকিস্তানের বিষয়গুলো নির্ভর করছে যতটা না রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি সেনাবাহিনীর ওপর (অবশ্য পাকিস্তানে জাতীয় ইস্যুতে বরাবর তা-ই হয়ে থাকে। এটাই হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। সিদ্ধান্ত জনপ্রতিনিধিদের নয়, সেনাবাহিনীর!)। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, 'আমি মনে করি কোনো স্তরের কোনো কর্মকর্তার মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আপনারা কোনো হামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে যা হাতের কাছে আছে, তাই নিয়ে পাল্টা জবাব দেবেন। এ ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোনো পারমিশন নেওয়ার দরকার নেই। অতীতে আমরা শুধু নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছি এবং মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছি।'
সর্বশেষ ন্যাটো হামলায় পাকিস্তানের ২৪ জন সেনা মারা যাওয়ার পর এখন পাকিস্তানের অবস্থান শুধু পয়সা দিয়ে ঠাণ্ডা রাখার জায়গায় নেই। এ ঘটনা যে পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
mohshinhabib@yahoo.com
পঞ্চাশের দশকে, বিশেষ করে বাগদাদ চুক্তির (এই চুক্তির সদস্য ছিল ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও ব্রিটেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র) মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক না বলে বরং স্বার্থের সম্পর্ক বলাই যুক্তিযুক্ত। এশিয়ায় 'মোস্ট অ্যালাইড অ্যালাই' বলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র যে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টে ঈর্ষণীয় মনে হয়েছে, তা আসলে ছিল দুই পক্ষেরই ধান্দাবাজি। আর সে কারণেই এ দুই দেশের কারো স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই সম্পর্কে সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানকে যে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধর্মভীরু পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ব্যবহার করা। শুধুই সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পাকিস্তান এ সাহায্য নিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ বের করতে চেয়েছে; যেমন_১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। অথচ যুদ্ধের ছয় বছর আগে ১৯৫৯ সালেই পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন পাকিস্তান প্রথমবারের মতো মনে করল, যুক্তরাষ্ট্রকে অন্ধ বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
আপাতদৃষ্টে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র 'বন্ধুত্ব'কে বিশ্ব যতটা ঘনিষ্ঠ মনে করেছে, তা কিন্তু ১৯৭১ সালেও দেখা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি দায় বোধ করলেও পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছাও তাদের ছিল না। তারা বারবার একটি বিষয় নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখবে তো? ভেতরের কথাটি হলো, সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে যাবে না তো? অন্যদিকে সপ্তম নৌবহর পাঠাই পাঠাই করেও পাকিস্তানকে মার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
একটি কথা বলে রাখা উচিত, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণের জন্য কিছু খাদ্য সাহায্য দিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মূল সাহায্য-সহযোগিতা ছিল সব সময় পাকিস্তানের মিলিটারিভিত্তিক। এই সম্পর্ককে আসলে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্ক বলাই যথাযথ। আর যুক্তরাষ্ট্রের বারবার পাকিস্তানের পেছন থেকে সরে যাওয়ার একটি ন্যায্য যুক্তিও আছে। পাকিস্তানকে যে সাহায্য তারা দিয়েছে, তার বেশির ভাগ খেয়ে ফেলেছে সামন্ত মানসিকতার সেনা কর্মকর্তারা। এসব কর্মকর্তার স্বপ্নই থাকে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি করা। যা হোক, এই তৃতীয় দফা প্রয়োজনের সময় পেছন থেকে সরে যাওয়ার বিষয়টি জুলফিকার আলী ভুট্টো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি একরকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। প্রথমে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, তারপর ওআইসি এবং সব শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু পাকিস্তানে স্টিল মিল তৈরি করেছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এমআই-৮ হেলিকপ্টার দিয়েছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টি অধিক মাত্রায় সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করে। পরিণামে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়ার ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র হয়ে ওঠে সুদূরপরাহত। তবে ভুট্টোও ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। তাঁর ক্ষমতালিপ্সা সর্বজনবিদিত।
কত কিছু পরিষ্কার! ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া সব সাহায্য বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান পরমাণু প্রকল্পের উসিলায়। ওই বছরই ইরানি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ঠিক এর কিছুদিন পর ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার 'ঘুষ' দেয়। ১৯৮৬ সালে আবার চার বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়। নামে-বেনামে পাকিস্তানে ঢুকতে থাকে ডলার আর অস্ত্রের চালান। উদ্দেশ্য আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়ন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও একটি ব্যবসা পেয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেঙে যায়। ১৯৯১ সালেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সব সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
এর পরের ঘটনা হয়ে ওঠে জটিলতর। এবার সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ। পাকিস্তানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের দেশ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছর একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাত মিলিয়ে রেখেছে। অথচ কেউ কাউকে বন্ধু মনে করেনি। পাকিস্তান পেয়েছে অস্ত্র আর কোটি কোটি ডলার। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অন্তত বিরত রাখতে পেরেছে আফগানিস্তানের তালেবান শাসকদের সরাসরি সমর্থনদান থেকে।
৫৫ শতাংশ মার্কিন নাগরিক পাকিস্তানকে শত্রুরাষ্ট্র বলে মনে করে। আর ৮০ শতাংশ পাকিস্তানি যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংস কামনা করে। এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তানে শাসক পরিবর্তন করে করে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিল বিশেষ প্রয়োজনে। এখন আফগানিস্তানের যুদ্ধ যত স্তিমিত হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ততটা বৈরী হয়ে উঠছে। বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ তালেবানদের মদদ দিয়ে আসছে। কথা মিথ্যা নয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী অংশ মৌলবাদী এলিমেন্ট। বহু তালেবান যোদ্ধা ও তালেবান নেতা পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়ে আছে। অনেকে পাকিস্তানে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে গেছে।
এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে প্রায়ই ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালিয়ে থাকে তালেবানদের লক্ষ্য করে, যা বিশ্বব্যাপী ড্রোন অ্যাটাক বলে পরিচিত। বিষয়টি নিয়ে জনগণ তো বটেই, পাকিস্তান সরকারও স্বস্তিতে ছিল না। এটি সরাসরি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত বলে মনে করছে তারা। এই ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান কী অবস্থান নেবে তা ঠিক করে উঠতে পারছিল না। কিন্তু গত সপ্তাহে ভয়ানক এক হামলায় পাকিস্তানের ২৪ জন সেনা নিহত হওয়ার পর দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সত্যি কথা কি, সরকারের এখন আর চুপ করে থাকার উপায় নেই। রসদ সরবরাহের লাইন বন্ধ করে দেওয়া, একটি এয়ারবেইস বন্ধ করে দেওয়া এবং সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। এর মধ্যে আরব সাগর থেকে রসদ সরবরাহের লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঠিক দুই মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রসদ ফুরিয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা পাকিস্তানকে রসদ সরবরাহ লাইন খুলে দেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারবেন। কারণ পাকিস্তান তার পথ খুলে না দিলে বিকল্প যে পথের কথা ভাবা হচ্ছে, তা এতটাই বন্ধুর যে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব।
এবার বিষয়গুলোর মীমাংসা এত সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাকিস্তানের বিষয়গুলো নির্ভর করছে যতটা না রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি সেনাবাহিনীর ওপর (অবশ্য পাকিস্তানে জাতীয় ইস্যুতে বরাবর তা-ই হয়ে থাকে। এটাই হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। সিদ্ধান্ত জনপ্রতিনিধিদের নয়, সেনাবাহিনীর!)। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, 'আমি মনে করি কোনো স্তরের কোনো কর্মকর্তার মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আপনারা কোনো হামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে যা হাতের কাছে আছে, তাই নিয়ে পাল্টা জবাব দেবেন। এ ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোনো পারমিশন নেওয়ার দরকার নেই। অতীতে আমরা শুধু নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছি এবং মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছি।'
সর্বশেষ ন্যাটো হামলায় পাকিস্তানের ২৪ জন সেনা মারা যাওয়ার পর এখন পাকিস্তানের অবস্থান শুধু পয়সা দিয়ে ঠাণ্ডা রাখার জায়গায় নেই। এ ঘটনা যে পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
mohshinhabib@yahoo.com
No comments