হরতাল-আদালতপাড়াতেই যত উত্তেজনা
পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ছাড়া নগরীর কোথাও গতকাল বিএনপির ডাকা হরতালের তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। ঢাকা বিভক্তির প্রতিবাদে সকাল-সন্ধ্যার এই হরতালের প্রতি জোটের শরিক দল জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটসহ সমমনা দলগুলো পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করলেও কোথাও তাদের দেখা যায়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আদালতপাড়ায় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের ঘটনা
ঘটে। সদ্য বিদায়ী ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে সেখান থেকে পুলিশ আটক করলেও এক ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়। পরে তিনি গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। আদালতপাড়ায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে পিকেটাররা।
এ ছাড়া নগরীর কয়েকটি স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি ও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ। কার্যালয়ের সামনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা চেয়ারে বসে হরতাল পালন করেন।
গতকালের হরতালে গ্রেপ্তার সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) থেকে বলা হয়েছে, ৩৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় আড়াই শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা নেতা-কর্মীর মুক্তির দাবিতে আজ সোমবার বিকেলে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন তিনি। ফখরুল দাবি করেন, সকাল-সন্ধ্যা হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে।
অবরুদ্ধ বিএনপির কার্যালয় : বরাবরের মতো এবারের হরতালেও সকাল থেকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকা নয়াপল্টন ছিল অবরুদ্ধ। হরতাল শুরুর ১ ঘণ্টা আগেই ভোর ৫টায় প্রায় ২০ প্লাটুন পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও এর আশপাশে অবস্থান নেয়। কার্যালয়ের মেইন গেটে পুলিশ চারস্তরবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণ করে অবরুদ্ধ করে রাখে। এবারের হরতালেও প্রস্তুত ছিল পুলিশের স্পেশাল অ্যারেস্ট ফোর্স। ফোর্সের ১৫ সদস্য দুটি দলে ভাগ হয়ে একটি দল নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে কাকরাইল মোড় এবং অন্য দলটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত টহল দেয়। কয়েক শ পুলিশ দিনভর কার্যালয়ের মূল গেটের সামনেই ঘেরাও করে রাখে বিএনপি নেতাদের। কাউকে সেখানে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেওয়া হয়নি। তবে সেখানে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি।
তবে কার্যালয়ের সামনে থেকে টাঙ্গাইলের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদসহ ৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। হরতাল শুরুর মিনিট ১৫ আগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি কাকরাইল মোড়ের উদ্দেশে কয়েক শ মিটার এগোলেই পুলিশ বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ও এস এম আশরাফুর রহমান, ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন ও নেত্রী তাহমিনা সুলতানা তন্ব্বীসহ ১৩ জন আহত হন। উপায়ান্তর না দেখে নেতা-কর্মীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন রিজভী আহমেদ। সকাল সোয়া ৭টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮টার দিকে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে অবস্থান নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, রিজভী আহমেদ, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিমউদ্দিন আলম, সহতথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, মোস্তাফিজুর রহমান, বেলাল হোসেনসহ ছাত্রদল, যুবদল ও মহিলা দলের ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী। এ সময় সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, 'ঢাকাবাসীর তথা গোটা বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে ঢাকা ভাগের প্রতিবাদে আমরা হরতাল পালন করছি। কিন্তু এই ফ্যাসিস্ট সরকার তার পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে।'
আদালতপাড়ায় সংঘর্ষ: সকাল সাড়ে ১০টায় ধোলাইখাল মোড়ে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। পুলিশের লাঠিপেটায় মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এখান থেকে শহীদুল ইসলাম নামের এক পিকেটারকে আটক করে পুলিশ। খোকার নেতৃত্বে মিছিলটি এরপর জংশন রোডের জজকোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পিকেটাররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। একটি ইট পুলিশের এসি রাজিবের মাথায় পড়লে তাঁর মাথা ফেটে যায়। পুলিশ লাঠিপেটা করে পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পিকেটাররা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের পর একটি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। জজকোর্টের সামনে প্রধান সড়কে যাত্রীবাহীসহ ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় ছাত্রলীগের একটি মিছিল জজকোর্টের ভেতরে ঢুকে পড়লে পুলিশ, বিএনপি ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ঘণ্টাব্যাপী এ অবস্থা চলতে থাকে। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার কক্ষে বসে থাকা সাদেক হোসেন খোকাকে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠায়। এ অবস্থায় বিভিন্ন দিক থেকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তখন রড ও লাঠি দিয়ে কে বা কারা তাঁর পায়ে আঘাত করে। রডের আঘাতে খোকার উরু রক্তাক্ত হয়। এ সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়। খোকাকে আটক করা হয়েছে_চারদিকে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে লালবাগ অঞ্চলের এসি রাজিব আল মাসুদ কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁকে গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের সময় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা যায়। আটকৃতরা হলেন মো. জাকির হোসেন, নূর ইসলাম খান, পাপ্পু এলাহি শান্ত, প্রদীপ কর্মকারসহ আরো দুজন।
হরতালের সমর্থনে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে মিছিল ও সমাবেশ করেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। মিছিল শেষে সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার প্রধান ফটকের কাছে প্রতিবাদ সমাবেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
বিএনপির সংসদ সদস্যদের মিছিলের চেষ্টা : সকাল ৯টার দিকে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ন্যাম ভবনের সামনে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সমবেত হয়ে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও আশিফা আশরাফী পাপিয়া মাটিতে পড়ে যান। এরপর পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যেই সংসদ সদস্যরা সেখানে সমাবেশ করেন। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পুলিশি ধাওয়ার মুখে সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মহাখালীর তিতুমীর কলেজ ছাত্রদল শাখার একটি মিছিল বের হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা যাত্রীবাহী বাসে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। অন্যদিকে তিতুমীর কলেজ শাখার ছাত্রলীগও হরতালের বিপক্ষে মিছিল করে। এ সময় হরতাল সমর্থনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়।
মতিঝিলের অফিসপাড়া : প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল মতিঝিলের পরিস্থিতি ছিল প্রায় স্বাভাবিক। সকাল থেকেই বিভিন্ন ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। শেয়ারবাজারের লেনদেনও স্বাভাবিক নিয়মেই সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়। তবে বিভিন্ন অফিসে লোকজনের উপস্থিতি কিছু কম ছিল। সকালের দিকে যান চালাচল অনেক কম ছিল। তবে রিকশা চলাচল ছিল স্বাভাবিক। বিকেলের দিকে যানবাহন চলাচল কিছুটা বাড়ে। মতিঝিল এলাকায় হরতালের সমর্থনে কোনো মিছিল হয়নি। হরতালের বিপক্ষেও কোনো মিছিল দেখা যায়নি। মতিঝিল থানার এএসআই নজরুল ইসলাম বলেন, এ এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
মিনিবাস চলাচল করেছে : রাজধানীর কয়েকটি রুটে মিনিবাস চলাচল করতে দেখা গেছে। ঢিলেঢালা হরতাল পালিত হয়েছে। রিকশার দখলে ছিল রাস্তাঘাট। প্রধান সড়কে দোকানপাট খোলা না থাকলেও নগরীর অলি-গলির ভেতরের দোকানপাট খোলা ছিল। সব ব্যাংকের ফটক বন্ধ করে লেনদেন চালাতে দেখা গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সামনে ছিল পুলিশি টহল। তবে গ্রাহক ছিল কম। সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে নির্ধারিত কার্যক্রম হয়েছে। দর্শনার্থী ছিল বেশ কম। সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী থেকে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাস দুপুরের পর ছেড়ে যায়। রেল ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সদরঘাট থেকে ঠিকভাবেই লঞ্চ চলাচল করেছে। পণ্যও ওঠানো-নামানো করেছে।
আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, হরতালের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান খলিল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করেছে। এতে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। তাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। যারা অন্যায়ভাবে পুলিশের গাড়ি ও জনসাধারণের মালামাল ক্ষতি করেছে, তাদের ধোলাই দেওয়া হয়েছে।' তবে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
এ ছাড়া নগরীর কয়েকটি স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি ও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ। কার্যালয়ের সামনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা চেয়ারে বসে হরতাল পালন করেন।
গতকালের হরতালে গ্রেপ্তার সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) থেকে বলা হয়েছে, ৩৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় আড়াই শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা নেতা-কর্মীর মুক্তির দাবিতে আজ সোমবার বিকেলে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন তিনি। ফখরুল দাবি করেন, সকাল-সন্ধ্যা হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে।
অবরুদ্ধ বিএনপির কার্যালয় : বরাবরের মতো এবারের হরতালেও সকাল থেকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকা নয়াপল্টন ছিল অবরুদ্ধ। হরতাল শুরুর ১ ঘণ্টা আগেই ভোর ৫টায় প্রায় ২০ প্লাটুন পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও এর আশপাশে অবস্থান নেয়। কার্যালয়ের মেইন গেটে পুলিশ চারস্তরবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণ করে অবরুদ্ধ করে রাখে। এবারের হরতালেও প্রস্তুত ছিল পুলিশের স্পেশাল অ্যারেস্ট ফোর্স। ফোর্সের ১৫ সদস্য দুটি দলে ভাগ হয়ে একটি দল নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে কাকরাইল মোড় এবং অন্য দলটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত টহল দেয়। কয়েক শ পুলিশ দিনভর কার্যালয়ের মূল গেটের সামনেই ঘেরাও করে রাখে বিএনপি নেতাদের। কাউকে সেখানে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেওয়া হয়নি। তবে সেখানে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি।
তবে কার্যালয়ের সামনে থেকে টাঙ্গাইলের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদসহ ৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। হরতাল শুরুর মিনিট ১৫ আগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি কাকরাইল মোড়ের উদ্দেশে কয়েক শ মিটার এগোলেই পুলিশ বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ও এস এম আশরাফুর রহমান, ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন ও নেত্রী তাহমিনা সুলতানা তন্ব্বীসহ ১৩ জন আহত হন। উপায়ান্তর না দেখে নেতা-কর্মীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন রিজভী আহমেদ। সকাল সোয়া ৭টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮টার দিকে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে অবস্থান নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, রিজভী আহমেদ, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিমউদ্দিন আলম, সহতথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, মোস্তাফিজুর রহমান, বেলাল হোসেনসহ ছাত্রদল, যুবদল ও মহিলা দলের ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী। এ সময় সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, 'ঢাকাবাসীর তথা গোটা বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে ঢাকা ভাগের প্রতিবাদে আমরা হরতাল পালন করছি। কিন্তু এই ফ্যাসিস্ট সরকার তার পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে।'
আদালতপাড়ায় সংঘর্ষ: সকাল সাড়ে ১০টায় ধোলাইখাল মোড়ে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। পুলিশের লাঠিপেটায় মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এখান থেকে শহীদুল ইসলাম নামের এক পিকেটারকে আটক করে পুলিশ। খোকার নেতৃত্বে মিছিলটি এরপর জংশন রোডের জজকোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পিকেটাররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। একটি ইট পুলিশের এসি রাজিবের মাথায় পড়লে তাঁর মাথা ফেটে যায়। পুলিশ লাঠিপেটা করে পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পিকেটাররা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের পর একটি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। জজকোর্টের সামনে প্রধান সড়কে যাত্রীবাহীসহ ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় ছাত্রলীগের একটি মিছিল জজকোর্টের ভেতরে ঢুকে পড়লে পুলিশ, বিএনপি ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ঘণ্টাব্যাপী এ অবস্থা চলতে থাকে। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার কক্ষে বসে থাকা সাদেক হোসেন খোকাকে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠায়। এ অবস্থায় বিভিন্ন দিক থেকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তখন রড ও লাঠি দিয়ে কে বা কারা তাঁর পায়ে আঘাত করে। রডের আঘাতে খোকার উরু রক্তাক্ত হয়। এ সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়। খোকাকে আটক করা হয়েছে_চারদিকে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে লালবাগ অঞ্চলের এসি রাজিব আল মাসুদ কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁকে গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের সময় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা যায়। আটকৃতরা হলেন মো. জাকির হোসেন, নূর ইসলাম খান, পাপ্পু এলাহি শান্ত, প্রদীপ কর্মকারসহ আরো দুজন।
হরতালের সমর্থনে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে মিছিল ও সমাবেশ করেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। মিছিল শেষে সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার প্রধান ফটকের কাছে প্রতিবাদ সমাবেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
বিএনপির সংসদ সদস্যদের মিছিলের চেষ্টা : সকাল ৯টার দিকে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ন্যাম ভবনের সামনে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সমবেত হয়ে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও আশিফা আশরাফী পাপিয়া মাটিতে পড়ে যান। এরপর পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যেই সংসদ সদস্যরা সেখানে সমাবেশ করেন। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পুলিশি ধাওয়ার মুখে সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মহাখালীর তিতুমীর কলেজ ছাত্রদল শাখার একটি মিছিল বের হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা যাত্রীবাহী বাসে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। অন্যদিকে তিতুমীর কলেজ শাখার ছাত্রলীগও হরতালের বিপক্ষে মিছিল করে। এ সময় হরতাল সমর্থনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়।
মতিঝিলের অফিসপাড়া : প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল মতিঝিলের পরিস্থিতি ছিল প্রায় স্বাভাবিক। সকাল থেকেই বিভিন্ন ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। শেয়ারবাজারের লেনদেনও স্বাভাবিক নিয়মেই সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়। তবে বিভিন্ন অফিসে লোকজনের উপস্থিতি কিছু কম ছিল। সকালের দিকে যান চালাচল অনেক কম ছিল। তবে রিকশা চলাচল ছিল স্বাভাবিক। বিকেলের দিকে যানবাহন চলাচল কিছুটা বাড়ে। মতিঝিল এলাকায় হরতালের সমর্থনে কোনো মিছিল হয়নি। হরতালের বিপক্ষেও কোনো মিছিল দেখা যায়নি। মতিঝিল থানার এএসআই নজরুল ইসলাম বলেন, এ এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
মিনিবাস চলাচল করেছে : রাজধানীর কয়েকটি রুটে মিনিবাস চলাচল করতে দেখা গেছে। ঢিলেঢালা হরতাল পালিত হয়েছে। রিকশার দখলে ছিল রাস্তাঘাট। প্রধান সড়কে দোকানপাট খোলা না থাকলেও নগরীর অলি-গলির ভেতরের দোকানপাট খোলা ছিল। সব ব্যাংকের ফটক বন্ধ করে লেনদেন চালাতে দেখা গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সামনে ছিল পুলিশি টহল। তবে গ্রাহক ছিল কম। সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে নির্ধারিত কার্যক্রম হয়েছে। দর্শনার্থী ছিল বেশ কম। সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী থেকে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাস দুপুরের পর ছেড়ে যায়। রেল ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সদরঘাট থেকে ঠিকভাবেই লঞ্চ চলাচল করেছে। পণ্যও ওঠানো-নামানো করেছে।
আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, হরতালের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান খলিল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করেছে। এতে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। তাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। যারা অন্যায়ভাবে পুলিশের গাড়ি ও জনসাধারণের মালামাল ক্ষতি করেছে, তাদের ধোলাই দেওয়া হয়েছে।' তবে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
No comments