রেল পেলেন সুরঞ্জিত যোগাযোগ কাদের-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দায়িত্বে আবুল হোসেন

ন্ত্রিসভায় দুই নতুন মুখ যোগ হওয়ার ছয় দিন পর দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে। বহুল আলোচিত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। মন্ত্রণালয়টি ভেঙে রেলপথ মন্ত্রণালয় নামে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। এর দায়িত্ব পেয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভেঙে করা হয়েছে দুটি মন্ত্রণালয়। এর একটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের


দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেনকে। গতকাল রবিবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুসহ যোগাযোগের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। জোর গুঞ্জন ছিল, আবুল হোসেনকেই রেলমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁর ক্ষমতাই কর্তন করা হয়েছে। রেলওয়ে ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন। রেলওয়েকে আলাদা করার পর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এখন আছে সড়ক ও সেতু বিভাগ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে রেলওয়ে নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকলেও বাংলাদেশে এই প্রথম রেলওয়েকে মন্ত্রণালয় করা হয়েছে।
গতকাল রবিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয় ভেঙে নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করা-সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন দুটি মন্ত্রণালয় করার পর মন্ত্রণালয়ের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৪৪-এ।
গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের। গতকাল রাজধানীতে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলে নবগঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদের দায়িত্ব পাচ্ছেন_এমন প্রচারও ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এই দুই মন্ত্রণালয়ে কাকে দেওয়া হতে পারে সে ব্যাপারে রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। তবে রাতে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেনকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন প্রতিমন্ত্রী ড. ওয়াফেস ওসমান।
সরকারের আড়াই বছরে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বারবার আলোচিত হন। ঘুরেফিরে তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠে। গত আগস্টে মহাসড়কের অবকাঠামো ও যাতায়াতব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এলে আবারও তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠে। অনেকে প্রতিবাদস্বরূপ ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরই মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে অভিযোগ ওঠে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকার পড়ে বিপাকে। সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে নিজেদের অবস্থানও তুলে ধরে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সরকারের এই চিঠির বক্তব্য গ্রহণ করেনি। এ অবস্থায় সরকারে নির্বাচনী অঙ্গীকার পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে। অনেকেই ধারণা করেছেন, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হলেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এ কারণেই সরকার দুজনকে মন্ত্রী করার পর এবার নতুন মন্ত্রণালয় করেছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১৫২টি প্রকল্পের মধ্যে ৫০টি প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে সড়ক খাতেও বিশ্বব্যাংক কোনো অর্থায়ন করছে না। বর্তমানে দেশের প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের অনুপযোগী। সরকার বরাদ্দ দিলেও সেই অর্থ ব্যয় করতে পারছে না যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তার পরও অতিরিক্ত প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে। এই বিষয়গুলোর কারণে সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে সরকার নিজেই বিব্রত। এ ছাড়া জনমনেও সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যাপারে নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলেই রেলওয়েকে গুরুত্ব দিয়ে আলাদা বিভাগ করা হয়। বিভাগ করার বছরখানেক যেতে না যেতেই রেলওয়েকে মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। টানা লোকসান ও যাত্রীসেবার মান কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহল থেকে রেল নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয়ের দাবি ওঠে। একপর্যায়ে সরকার এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সরকারের আড়াই বছরেও এক কিলোমিটার রেলপথ বাড়েনি। একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ঝুলছে নানা প্রক্রিয়ায়। রেলওয়ের হিসাবে, বছরে রেল খাতে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। কিন্তু লোকসান থেকে সংস্থাটিকে টেনে তুলতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
গতকাল যখন রেল নিয়ে নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়, তখন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ছিলেন নিজ মন্ত্রণালয় থেকে দূরে। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতুর ফাটলকাজ পরিদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। গতকাল বিকেলে নতুন রেল মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে রেলসচিব ফজলে কবির তাঁর প্রতিক্রিয়ায় কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন মন্ত্রণালয় গঠনে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উচ্চপর্যায় থেকে।
এদিকে রেল নিয়ে নতুন মন্ত্রণালয় হলে রেল খাতের উন্নয়ন হবে কি না, এ নিয়ে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রেলওয়ের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন কিছু পদ সৃষ্টি হবে। কিছু আমলা সুবিধা নিতে পারবেন। কিন্তু রেলওয়ের কোনো উন্নয়ন হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের আড়াই বছরে রেলওয়ের জন্য নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপর। এত প্রকল্প এর আগে নেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই আছে কাগজপত্রে। যেমন ভারতীয় ১০০ কোটি ডলার ঋণের আওতায় নেওয়া ১২টি প্রকল্পে কোনো গতিই নেই। কয়েকটি প্রকল্পে ভারত সরকারের কাছ থেকে সম্মতি মিলেছে মাত্র। সর্বশেষ মংলা-খুলনা রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি হয়েছে প্রকল্প গ্রহণের প্রায় এক বছর পর। জানা গেছে, বৈদেশিক সাহায্যে বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত ২০টি প্রকল্পে ১১ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ফাঁদে। সব শেষ গত মে মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন রেলপথ স্থাপনের একটি অংশে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করেছে বিশ্বব্যাংক।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৯ বছর ধরে রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না। লোকসান ঠেকাতে এ জন্য নতুন ভাড়া নির্ধারণসংক্রান্ত প্রস্তাবনা বারবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত যাচ্ছে। দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। সড়ক পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ভোট কমে যাবে এমন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাড়ানো হয় না রেলের ভাড়া।
এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কী কারণে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না জানি না। তবে আমরা মনে করি, ভাড়া বাড়ানো উচিত।' রেলওয়ের এক কর্মকর্তা অবশ্য অভিযোগের সুরে বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই রেলের ভাড়া বাড়ছে না।
ট্রানজিট সামনে রেখে রেলওয়ের জন্য ৩২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু রেলের কর্মকর্তারা মনে করেন, যাত্রীসেবা বাড়ানোর জন্য রেলের ইঞ্জিন কেনা তার চেয়ে জরুরি।
সড়ক নিরাপত্তার অবস্থাও এখন করুণ। বিভিন্ন সূত্রমতে, দিনে কমপক্ষে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। যোগাযোগমন্ত্রীর অবহেলার কারণেই এ অবস্থা হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন। আরো অভিযোগ রয়েছে, তাঁর উদাসীনতায় বিআরটিএ পরিণত হয়েছে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে। পরিবহন সংগঠনগুলোর চাপে পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে ভুয়া লাইসেন্স।্#২৫৪৫;

No comments

Powered by Blogger.