অভিন্ন নদীতে একতরফা উদ্যোগ কেন?-টিপাইমুখ বাঁধ by আবু সাঈদ খান

বারও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুর। শুধু মণিপুর নয়, \\'সেভেন সিস্টার\\'খ্যাত অঞ্চলের অপর দুই রাজ্য আসাম ও মিজোরামের মানুষও ক্ষুব্ধ। রাজ্যগুলোর পরিবেশকর্মী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলগুলো টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় এই রাজ্যগুলোর ভূপ্রাকৃতিক সংহতি দুই দেশের মানুষকে একই প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছে।


বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে শুধু বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল নয় বরাক উপত্যকার ভারতীয় রাজ্যগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা বাঁধ নির্মাণে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন। ইংরেজি ড্যাম ও ব্যারাজ শব্দ দুটি বাংলা অনুবাদে বাঁধ। প্রশ্ন উঠছে, টিপাইমুখে কী হচ্ছে ড্যাম না ব্যারেজ, নাকি দুই-ই? টিপাইমুখের ভাটিতে ফুলারতলে ব্যারাজ হচ্ছে বলেও জানা যায়। বিশেষজ্ঞদের তর্কবিতর্ক থেকে স্পষ্ট যে, ড্যাম নির্মাণ করা হলে ক্ষতি এক রকম অবস্থা হবে, আর ব্যারাজ হলে অন্যরকম ক্ষতি হবে। আর বরাকে ড্যাম-ব্যারাজ দুটি হলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তর্কের খাতিরে যদি এ তথ্য মেনে নিই যে বরাকে শুধু ড্যাম হচ্ছে, তাহলে ক্ষতির মাত্রা কম হবে না। অতি সরল পাঠ হচ্ছে_ যে কোনো নদীতে বাঁধ দিলে নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে। পানিপ্রবাহ বিঘি্নত হলে প্রথম ক্ষতির শিকার হবে নদীকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য। আঘাত আসবে কৃষি ও কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপর। বাঁধ নির্মাণে বন্যা কমবে কি বাড়বে সে হিসাব পরে, কিন্তু বাঁধ যে জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও জনবসতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের নদী সুরমা ও কুশিয়ারার উৎসমুখ বরাক, তাই বরাকে বাঁধ দিলে নদী দুটির পানিপ্রবাহ কমে যাবে। দুই পাশের হাওরগুলো পর্যাপ্ত পানি পাবে না। ফলে কৃষি উৎপাদন হবে ব্যাহত। আবার যখন পানি ছাড়া হবে, তখন অসময়ে প্লাবনের সমূহ আশঙ্কা। ঋতু বদলে যাবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।
যে অঞ্চলে বাঁধ নির্মিত হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৬২ মিটারের বিশাল বাঁধে যে ভূপ্রাকৃতিক চাপ সৃষ্টি হবে তা বাড়িয়ে দিতে পারে ভূমিকম্পের আশঙ্কা। আর এ ধরনের যে কোনো বিপর্যয়ে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তলিয়ে যাবে মণিপুর ও বাংলাদেশের বৃহদাংশ। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ কতটা যৌক্তিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারত সরকার বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা মণিপুরের মত আমলে নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিরও তোয়াক্কা করছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুই দেশের অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের পদ্ধতি কী? উজানের দেশ ইচ্ছা করলেই কি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারসহ খেয়ালখুশিমতো পদক্ষেপ নিতে পারে? অতীতে উজানের দেশগুলো এমনটা মনে করত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুসারে উজানের দেশের সে সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে হয়, পারিপাশর্ি্বক প্রভাব বিবেচনায় আনতে হয়_ ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নিতে হয়। ভাটির দেশ রাজি না থাকলে এমন প্রকল্প গ্রহণের অধিকার উজানের দেশের থাকে না।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনে যে চুক্তি হয়, সেটির অনুচ্ছেদ ৯-এ বলা হয়েছে ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায্যতা এবং কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিকর নয়_ এমন নীতির ভিত্তিতে অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে উভয় সরকার একমত পোষণ করেছে। ভারত সরকার যদি গঙ্গা চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাহলে কি কোনোভাবে একতরফা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই হোক আর পানি প্রত্যাহারের প্রকল্পই হোক, নিতে পারে? উলি্লখিত অনুচ্ছেদে দুই দেশের জন্য ক্ষতিকর নয় (নো হার্ম) এমন বাঁধও এককভাবে করার এখতিয়ার নেই। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মতামত, তথ্যের আদান-প্রদান ও যৌথ সমীক্ষা বাঞ্ছনীয়। এ প্রকল্পের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি সম্পর্কিত। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের বায়োডাইভারসিটি কনভেনশন ১৯৯২ রয়েছে। এ কনভেনশনও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রকল্প অনুমোদন করে না।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক নদীর নৌচলাচল ভিন্ন পানি ব্যবহার বিষয়ক কনভেনশনের (convention on the law of the Non-Navigational uses of International water courses 1997) নীতিমালাও বিবেচনায় আনা জরুরি। যদি এ কনভেনশনে ভারত ও বাংলাদেশ কোনো পক্ষই স্বাক্ষর করেনি। ভারত স্বাক্ষর না করার কারণ বোধগম্য। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাক্ষর না করার কারণ বুঝতে পারি না। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য রক্ষাকবচ হতে পারত। তবে দুই দেশ স্বাক্ষর না করলেও এ কনভেনশনের মর্মবাণী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল\\' হিসেবেও পরিগণিত। কনভেনশনটির অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভূপ্রাকৃতিক ও মানুষের যাপিত জীবনের গুরুত্ব অধিকতর বিবেচনাযোগ্য। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশ ও মণিপুরের জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনোভাবেই এ ক্ষতি পোষানো যাবে না বা এর বিকল্প উপায় অবলম্বন করাও সম্ভব নয়। হাজার বছরের ঐতিহ্য ধ্বংস করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের আরও অনেক বিকল্প রয়েছে। এ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনস্বার্থই অগ্রাধিকারের দাবি রাখে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে তখন যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়, সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে অঙ্গীকার করেছেন যে, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ তারা নেবেন না। এ বছর ঢাকায় এসে মনমোহন সিং একই কথা বলেছেন। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, এটি মনমোহন সিংয়ের আন্তরিক অভিপ্রায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, টিপাইমুখ ক্ষতিকর না সহনীয়, তা ভারত এককভাবে নিরূপণ করতে পারে না। বাংলাদেশকে অন্ধকারে রেখে নতুন করে বাঁধ নির্মাণের চুক্তি হচ্ছে, যৌথ সমীক্ষার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। টিপাইমুখের ভাটিতে ফুলারতলে যে ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, সেটি আছে না বাতিল হয়েছে? এ ব্যাপারে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে না। ভারত একতরফাভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। শুধু বরাক নয়, ভারত ৫৪টি যৌথ নদীর কমপক্ষে ৪৭টিতে অসংখ্য বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছুই জানাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভারতের মনোভাব বড় ভাইসুলভ। যেন যা খুশি তাই করার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। আমাদের সরকার ভারতের আশ্বাসে বিশ্বাস করে বসে আছে। এমন আস্থা পোষণ করেছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের স্বার্থই শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে দেখা দিল। তিস্তা চুক্তি হিমাগারে চলে গেল কি-না সে প্রশ্ন উঠছে। এর আগে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে পানিসম্পদমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত আগে বাঁধ নির্মাণ করুক, তখন দেখা যাবে কী ক্ষতি হয়। এবার পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তাকে টেক্কা দিয়ে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের নিজস্ব ব্যাপার।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্তিও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই বন্ধুর সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায় না। জনৈক উপদেষ্টা প্রকাশ্যেই বলেছেন, ট্রানজিটের জন্য মাশুল চাওয়া অভদ্রতা। আমিও মনে করি, একাত্তরে ভারতের অবদানের জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। এর মানে এই নয় যে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বোঝাপড়া করা যাবে না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেই বোঝাপড়া করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হীনমন্যতাবোধ থাকলে তা পরিত্যাজ্য। পৃথিবীর বড় দেশের পাশে ছোট দেশ থাকে, তাই বলে ছোট কি উপেক্ষিত হবে? রিওগ্র্যান্ডি নদী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে বিরোধ হয়েছে। উজানের দেশ যুক্তরাষ্ট্র নদীটির ওপর মেক্সিকোর অধিকার মেনেই রেহাই পায়নি। নদীটির পানি দূষিত হয়ে পড়েছিল। সেই পানি মেক্সিকোর জন্য ক্ষতিকর বলে দেশটি প্রতিবাদ জানায়। এর প্রতিকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিশাল এক শোধনাগার নির্মাণ করে পানি বিশুদ্ধ করে দিতে হচ্ছে। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্তও আছে, অভিন্ন নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বিদ্যুৎ ভাগ করে নিচ্ছে।
অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য যে তথ্য দরকার, সেটি বাংলাদেশের কাছে নেই। বাংলাদেশ ভারতের তথ্যের ওপর ভরসা করছে। এটি বড় দুর্বলতার দিক। এ জন্য গবেষণাও প্রয়োজন। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদ জানান, বিএনপি পাশে থাকবে। কিন্তু এ ইস্যুতেও সরকার-বিরোধী দল একমত হয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারে এমন আলামত কি সত্যিই আছে?
নদীর সঙ্গে আমাদের জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তাই নদী বাঁচাতে, পানির ন্যায্য ভাগ আনতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পরিবেশকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বিশেষজ্ঞদের সমর্থন রয়েছে। উভয় দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী উপলব্ধি করছে, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নামলে শেষ বিচারে ভারতও রক্ষা পাবে না। তাই উভয় দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে এ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করে যেতে হবে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.