প্রধানমন্ত্রীর ১৪ প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন করেননি আবুল by পার্থ সারথি দাস
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতায়াতের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ কমাতে ৯ জেলার মানুষকে ১৪টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত প্রায় দেড় বছরে এসব জেলা সফরের সময় তিনি ওই সব প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্যে ১৩টিই ছিল রেলপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি। নতুন রেলপথ নির্মাণ, রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত ও ট্রেন চালু করার এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নীরব। তাই শিগগিরই ওই সব জেলার মানুষের দুর্ভোগ কাটছে না। বরং জনদুর্ভোগ আরো প্রকট হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলতি মাসে তৈরি করা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিলের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ১৪টি প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, মেহেরপুর ও সিরাজগঞ্জ সফর করেন।
জানতে চাইলে যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত সভা হচ্ছে। প্রক্রিয়াগত বিভিন্ন কারণে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সময় লাগবে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজান জানান, রেলওয়ের ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের কারণে নতুন ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম: গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে কালুরঘাটে নতুন কর্ণফুলী রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী। এই সেতু নির্মাণের জন্য এখনো কোনো বিনিয়োগপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি চালাচালি চলছে এখনো। একই সফরে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বেহাল সড়কপথের কারণে রেলপথে যাত্রীদের চাপ বাড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করলে এই রুটে প্রয়োজনীয় ট্রেন পরিচালনা করে বাড়তি যাত্রী পরিবহন সম্ভব।
রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে বর্তমানে ডাবল লাইন আছে ১২৪ কিলোমিটার। নির্মাণ করতে হবে আরো ১৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন বসানোর প্রকল্পটি সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। অস্বচ্ছতার আশঙ্কায় গত ২২ মে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণপ্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস প্রত্যাহার করেছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কঙ্বাজার হয়ে মিয়ানমারের গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের অগ্রগতিও কম।
ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যোগাযোগমন্ত্রীর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এম আলী আশরাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের ক্ষেত্রে সড়কের তুলনায় রেলপথে চাপ বাড়ছে বেশি। ১০ দিন আগে গিয়েও ট্রেনের জন্য টিকিট পাওয়া যায় না। মহাসড়কের চার লেন প্রকল্প কবে বাস্তবায়ন হবে জানি না। রেলের ডাবল লাইন নির্মাণেও তেমন তৎপর নয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।'
আলী আশরাফ বলেন, 'আড়াই বছরে এই অবস্থা হলে, পাঁচ বছর পর কী জবাব দেবেন যোগাযোগমন্ত্রী?'
নারায়ণগঞ্জ: ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস ও ঢাকা উড়াল সড়ক চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে তিনি এ প্রতিশ্রুতি দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে কমিউটার ট্রেন চালু হয়নি। অবশ্য নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে চলছে তুরাগ নামের একটি কমিউটার ট্রেন। কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ডিইএমইউ (ডিজেল ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিটস) ক্রয় প্রক্রিয়ায় কোনো গতি নেই। ১০ সেট ডিইএমইউ সংগ্রহ প্রকল্প চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন হয়। তা বাতিল করে আরো নতুন প্রকল্প পাঠানো হয়। কিন্তু সেগুলো পড়ে আছে পরিকল্পনা কমিশনে।
অন্যদিকে ২০ সেট ডিইএমইউ সংগ্রহের প্রকল্পটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন হলেও বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। এ কারণে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে ঢাকার কমিউটার ট্রেন চালু হচ্ছে না। জয়দেবপুর-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটেও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না আরো কমিউটার ট্রেন।
নাগরিক সংগঠন নারায়ণগঞ্জবাসীর যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক উদ্দিন ইউসুফ পাপ্পু বলেন, 'শিল্প এলাকা নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিক উন্মোচন করবে কমিউটার ট্রেন। আমরা দ্রুত এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাইছি।'
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজান বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে বর্তমানে ১১ জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। প্রয়োজন থাকলেও নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন রুটে কমিউটার ট্রেন এই মুহূর্তে বাড়ানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ের সহকারী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ১১ জোড়া ট্রেন হচ্ছে মেইল ট্রেন। কমিউটার হলে এগুলোর ভাড়া বাড়াতে হবে।
অন্যদিকে, যানজট নিরসনের জন্য সেতু বিভাগের অধীনে ঢাকা উড়াল সড়ক প্রকল্পের কাজ গত ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমি ব্যবহার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় এ প্রকল্পও থমকে আছে।
নেত্রকোনা: গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা সফরে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটে আন্তনগর ট্রেন সার্ভিস চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ঢাকা-ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ রুটের গৌরীপুর থেকে মোহনগঞ্জ অংশে আন্তনগর ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী। কোচ সংকটের কারণে রেলওয়ে বিভিন্ন রুটে এখন নিয়মিত ট্রেন চালাতে পারছে না। মেরামতের জন্য ২০০টি মিটারগেজ কোচ চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানায় রয়েছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত।
মোহনগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান মাহবুবুন-নবী শেখ বলেন, 'ব্রিটিশ আমল থেকেই মোহনগঞ্জে ট্রেন চলাচল করছে। সুনামগঞ্জসহ আশপাশের বহু যাত্রী এখান থেকে ট্রেন ধরে যাতায়াত করে ময়মনসিংহসহ অন্যান্য স্থানে। এই রুটে আগে পাঁচটি ট্রেন ছিল। এখন মাত্র দুটি ট্রেন চলছে। কোনো আন্তনগর ট্রেন চালু হয়নি। অথচ এই আন্তনগর ট্রেনের জন্য আমরা বছরের পর বছর দাবি জানিয়ে আসছি।'
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: গত বছরের ২৩ জুলাই সাতক্ষীরা সফরকালে যশোরের নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১১০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ছয় মাস পর গত ১১ জানুয়ারি উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। বিশেষজ্ঞরা পরিবেশ রক্ষা করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় মেহেরুন্নেছা রেলস্টেশনটি চালুর দাবি জানান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, জনবল সংকটের কারণে ২০০৬ সালের ১৯ মে থেকে স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্টেশনটি চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তা এখনো চালু হয়নি।
চলতি বছরের ৫ মার্চ খুলনা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মংলা বন্দর-বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা-সাতক্ষীরা রেললাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। রেলওয়ে বিভাগ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ এবং খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন হলে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা এখনো আটকে আছে। প্রকল্পের কাগজপত্র যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে চালাচালি করা হচ্ছে। একই সফরে প্রধানমন্ত্রী খুলনা রেলস্টেশন আধুনিকায়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঘুরছে বাস্তবায়নের অগ্রগতি।
ওই সফরে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি প্রতিশ্রুতি ছিল ঢাকা-বাগেরহাট-মংলা রেল সার্ভিস চালুর বিষয়ে। খুলনা-মংলা, ঢাকা-বাগেরহাট ও বাগেরহাট-মংলা রেল সার্ভিস চালুর জন্য টুঙ্গীপাড়া থেকে ফকিরহাট পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এটি সেখানেই পড়ে আছে।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর রেললাইন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া চলতি বছর ৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে গিয়ে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের রায়পুর পর্যন্ত আন্তনগর ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। এ দুটি প্রতিশ্রুতি নিয়েও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নীরব।
জানতে চাইলে যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত সভা হচ্ছে। প্রক্রিয়াগত বিভিন্ন কারণে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সময় লাগবে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজান জানান, রেলওয়ের ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের কারণে নতুন ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম: গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে কালুরঘাটে নতুন কর্ণফুলী রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী। এই সেতু নির্মাণের জন্য এখনো কোনো বিনিয়োগপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি চালাচালি চলছে এখনো। একই সফরে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বেহাল সড়কপথের কারণে রেলপথে যাত্রীদের চাপ বাড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করলে এই রুটে প্রয়োজনীয় ট্রেন পরিচালনা করে বাড়তি যাত্রী পরিবহন সম্ভব।
রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে বর্তমানে ডাবল লাইন আছে ১২৪ কিলোমিটার। নির্মাণ করতে হবে আরো ১৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন বসানোর প্রকল্পটি সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। অস্বচ্ছতার আশঙ্কায় গত ২২ মে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণপ্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস প্রত্যাহার করেছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কঙ্বাজার হয়ে মিয়ানমারের গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের অগ্রগতিও কম।
ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যোগাযোগমন্ত্রীর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এম আলী আশরাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের ক্ষেত্রে সড়কের তুলনায় রেলপথে চাপ বাড়ছে বেশি। ১০ দিন আগে গিয়েও ট্রেনের জন্য টিকিট পাওয়া যায় না। মহাসড়কের চার লেন প্রকল্প কবে বাস্তবায়ন হবে জানি না। রেলের ডাবল লাইন নির্মাণেও তেমন তৎপর নয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।'
আলী আশরাফ বলেন, 'আড়াই বছরে এই অবস্থা হলে, পাঁচ বছর পর কী জবাব দেবেন যোগাযোগমন্ত্রী?'
নারায়ণগঞ্জ: ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস ও ঢাকা উড়াল সড়ক চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে তিনি এ প্রতিশ্রুতি দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে কমিউটার ট্রেন চালু হয়নি। অবশ্য নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে চলছে তুরাগ নামের একটি কমিউটার ট্রেন। কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ডিইএমইউ (ডিজেল ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিটস) ক্রয় প্রক্রিয়ায় কোনো গতি নেই। ১০ সেট ডিইএমইউ সংগ্রহ প্রকল্প চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন হয়। তা বাতিল করে আরো নতুন প্রকল্প পাঠানো হয়। কিন্তু সেগুলো পড়ে আছে পরিকল্পনা কমিশনে।
অন্যদিকে ২০ সেট ডিইএমইউ সংগ্রহের প্রকল্পটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন হলেও বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। এ কারণে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে ঢাকার কমিউটার ট্রেন চালু হচ্ছে না। জয়দেবপুর-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটেও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না আরো কমিউটার ট্রেন।
নাগরিক সংগঠন নারায়ণগঞ্জবাসীর যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক উদ্দিন ইউসুফ পাপ্পু বলেন, 'শিল্প এলাকা নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিক উন্মোচন করবে কমিউটার ট্রেন। আমরা দ্রুত এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাইছি।'
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. শাহজান বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে বর্তমানে ১১ জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। প্রয়োজন থাকলেও নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন রুটে কমিউটার ট্রেন এই মুহূর্তে বাড়ানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ের সহকারী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ১১ জোড়া ট্রেন হচ্ছে মেইল ট্রেন। কমিউটার হলে এগুলোর ভাড়া বাড়াতে হবে।
অন্যদিকে, যানজট নিরসনের জন্য সেতু বিভাগের অধীনে ঢাকা উড়াল সড়ক প্রকল্পের কাজ গত ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমি ব্যবহার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় এ প্রকল্পও থমকে আছে।
নেত্রকোনা: গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা সফরে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটে আন্তনগর ট্রেন সার্ভিস চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ঢাকা-ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ রুটের গৌরীপুর থেকে মোহনগঞ্জ অংশে আন্তনগর ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী। কোচ সংকটের কারণে রেলওয়ে বিভিন্ন রুটে এখন নিয়মিত ট্রেন চালাতে পারছে না। মেরামতের জন্য ২০০টি মিটারগেজ কোচ চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানায় রয়েছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত।
মোহনগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান মাহবুবুন-নবী শেখ বলেন, 'ব্রিটিশ আমল থেকেই মোহনগঞ্জে ট্রেন চলাচল করছে। সুনামগঞ্জসহ আশপাশের বহু যাত্রী এখান থেকে ট্রেন ধরে যাতায়াত করে ময়মনসিংহসহ অন্যান্য স্থানে। এই রুটে আগে পাঁচটি ট্রেন ছিল। এখন মাত্র দুটি ট্রেন চলছে। কোনো আন্তনগর ট্রেন চালু হয়নি। অথচ এই আন্তনগর ট্রেনের জন্য আমরা বছরের পর বছর দাবি জানিয়ে আসছি।'
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: গত বছরের ২৩ জুলাই সাতক্ষীরা সফরকালে যশোরের নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১১০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ছয় মাস পর গত ১১ জানুয়ারি উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। বিশেষজ্ঞরা পরিবেশ রক্ষা করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় মেহেরুন্নেছা রেলস্টেশনটি চালুর দাবি জানান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, জনবল সংকটের কারণে ২০০৬ সালের ১৯ মে থেকে স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্টেশনটি চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তা এখনো চালু হয়নি।
চলতি বছরের ৫ মার্চ খুলনা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মংলা বন্দর-বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা-সাতক্ষীরা রেললাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। রেলওয়ে বিভাগ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ এবং খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন হলে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা এখনো আটকে আছে। প্রকল্পের কাগজপত্র যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে চালাচালি করা হচ্ছে। একই সফরে প্রধানমন্ত্রী খুলনা রেলস্টেশন আধুনিকায়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঘুরছে বাস্তবায়নের অগ্রগতি।
ওই সফরে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি প্রতিশ্রুতি ছিল ঢাকা-বাগেরহাট-মংলা রেল সার্ভিস চালুর বিষয়ে। খুলনা-মংলা, ঢাকা-বাগেরহাট ও বাগেরহাট-মংলা রেল সার্ভিস চালুর জন্য টুঙ্গীপাড়া থেকে ফকিরহাট পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এটি সেখানেই পড়ে আছে।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর রেললাইন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া চলতি বছর ৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে গিয়ে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের রায়পুর পর্যন্ত আন্তনগর ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। এ দুটি প্রতিশ্রুতি নিয়েও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নীরব।
No comments