ব্যবস্থাপনার কালান্তর-প্রয়োজন দক্ষতার নতুন শ্রেণীবিন্যাস by ইফতেখারুল ইসলাম
পর্ব-১ : ধ্বংসের মুখোমুখি? এক শতাব্দীরও বেশি কাল ধরে সারা পৃথিবীর মানুষ শিল্পায়ন যুগের ব্যবস্থাপনা-কারাগারে কাজ করছে এবং তাঁদের প্রাণশক্তি, সৃজনশীলতা ও সব মানবিক সম্ভাবনা প্রায় নিষ্ফলভাবে অপচয় করে গেছে। এ সময়কালে ব্যবস্থাপনা একটি শাস্ত্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি, চিরায়ত তো নয়ই। আজকের প্রয়োজন অতি জটিল, সংকট ব্যাপক এবং প্রযুক্তি, কৌশল ও ছোট ছোট মহাশক্তিধর যন্ত্রপাতি
বিস্ময়করভাবে নতুন। সুখের বিষয়, ব্যবস্থাপনার সব পুরনো কল-কব্জা এই নতুন যুগের অভূতপূর্ব ও সম্মিলিত চাপের নিচে পিষ্ট হচ্ছে এবং নতুন পথের সন্ধান করছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের মুখে প্রকট হয়ে উঠছে সারা পৃথিবীর ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা। ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগুলোর পুনরাবিষ্কার এবং পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে প্রায় ৩০ বছর ধরে যাঁরা বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন তাঁরা এই বাতিলযোগ্যতাকে বেশি করে অনুভব করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে আমূল বদলে যেতে দেখেছেন বিভিন্ন দিক থেকে। কোথাও কোথাও পরিবর্তনগুলো সূক্ষ্ম ও তাত্তি্বক, কোথাও আবার সময় ও পারিপাশ্বর্িক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কৌশলগত। বিশেষত তথ্যপ্রবাহ ও বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি প্রতিযোগিতার মান-স্তর ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে গেছে। এর ফলে বদলে গেছে ব্যবস্থাপনার দৈনন্দিন ভাবনা ও রীতি-পদ্ধতি। প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘটেছে অভাবনীয় ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিষয়টিকে সহজে বোঝার জন্য কয়েকটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। এখন থেকে ৩০ বছর আগে ব্যবস্থাপনায় একমুখী নির্দেশনার যে শৃঙ্খলা ছিল, এখন তা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এখনকার অনেক কর্মী একাধিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে বাধ্য এবং অভ্যস্ত। একজন ব্যবস্থাপক বৈদেশিক বাণিজ্যের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য অথবা প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কর্মকাণ্ড বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আগে যে ধরনের রচনা ও চিঠিপত্র লিখতেন তা আজ প্রায় বিলুপ্ত। দীর্ঘ পরিকল্পনা ও বড় প্রতিবেদনের আদান-প্রদানে যে ডাকব্যবস্থায় সপ্তাহ-মাসব্যাপী সময় প্রয়োজন হতো, তা আজ অনেকাংশে বাতিল। সংক্ষিপ্ত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য টেলেঙ্ ও তারবার্তা জাতীয় যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হতো, সেগুলো সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে জাদুঘরে স্থান খুঁজছে। কমে যাচ্ছে ওপর থেকে নিচের দিকে আদেশ-নির্দেশের প্রবাহ ও তাদের কার্যকারিতা। শংকরের সূচনাপর্বের উপন্যাসের চরিত্রের মতো সকালে টাই-রুমাল সহযোগে থ্রিপিস, স্যুট পরিহিত যে ব্যবস্থাপকদের দেখা যেত পেছনে পিয়নের হাতে সুদৃঢ় ব্রিফকেস ও ফাইলপত্র নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন অথবা বিকেলে সাদা টি-শার্টশোভিত হয়ে অভিজাত ক্লাবে টেনিস খেলছেন, তাঁরা আজ বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির মানুষ। এখনকার দিনে সারা পৃথিবীর, বিশেষত বেসরকারি সংস্থার অধিকাংশ কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপক একটি অথবা দুটি মাত্র ছোট যন্ত্রের অনুষঙ্গে বিশাল ও সার্বক্ষণিক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত থাকেন। বদলে গেছে তাঁদের জীবনযাত্রা, স্থান-কালের ধারণা ও কর্মপদ্ধতি। এর ভালো-মন্দ যা-ই থাকুক না কেন, তাঁদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবন ও বিনোদন ইত্যাদির মাঝে নিঃশব্দে এবং সুচারুভাবে মিশে গেছে কর্মজীবন। কর্মক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ বা শরীরচর্চাকেন্দ্র, যাতায়াতকালে ই-মেইল, শয়নকক্ষে সেরে নেওয়া দূরভাষ-সম্মেলন_এভাবে স্থান-কাল ও কাজ-অবকাশের সীমান্তগুলো অবলুপ্ত হয়েছে। পিয়ন, করণিক, উচ্চ-নিম্ন সহকারী, অফিস সহকারী, ব্যক্তিগত সহকারী, একান্ত সচিব ইত্যাদি বহু পদের অবলুপ্তি ঘটেছে অথবা দায়িত্ব ও কর্মবিবরণী সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে তাঁদের সার্বিক রূপান্তর ঘটেছে।
এত পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে পরিচালনা ও দিকনির্দেশনা দানের জন্য উপযুক্ত নতুন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কি আবিষ্কৃত হয়েছে? অতীতের ব্যবস্থাপকদের নিয়োগ অথবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে আভিজাত্য, যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠি ব্যবহৃত হতো তার বদলে আজ ভিন্ন, অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রায়োগিক মাপকাঠি প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে নতুনতর কিছু মাপকাঠি খুঁজে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেক কিছুই রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। আগে এসব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আভিজাত্য ও ইংরেজি-কথনের পারদর্শিতা প্রায় একক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকলেও আজ প্রায়োগিক কর্ম-কুশলতার মর্যাদা বেড়েছে। মনে রাখতে হবে, আজ যে যেখানেই কাজ করি না কেন, সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা টিকে আছি এবং যথাসম্ভব এগিয়ে চলেছি। বাংলাদেশে যে শ্রমিক শার্টের বোতাম লাগাচ্ছেন, তিনি হংকং অথবা তুরস্কের একজন শ্রমিকের তুলনায় কম মূল্যে এবং অন্তত সমান দক্ষতায় কাজটি করছেন। যে ফার্মাসিস্ট এ দেশে ওষুধ তৈরি করছেন, তিনি চীন অথবা ভারতের একজন ফার্মাসিস্টের সমকক্ষ কুশলতার সঙ্গে কাজ করছেন। যে নবীন কর্মী আজ নিজের, সহকর্মীর অথবা ঊর্ধ্বতন কারোর কাজে একটি ভালো বিশ্লেষণ যোগ করতে পারেন অথবা দ্রুত কোনো বার্তা প্রেরণ করে গ্রাহক, ক্রেতা অথবা কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন তাঁর মূল্য প্রতিষ্ঠানের কাছে অপরিসীম। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্ষুদ্র যন্ত্রটির প্রয়োগে তুলনামূলক দক্ষতা অনেক সময় ব্যক্তির আভিজাত্য, শিক্ষায়তনের মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ভাষা-জ্ঞান ইত্যাদির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট, ফলপ্রসূ ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সুতরাং তাঁদের বেতন-ভাতা ইত্যাদিও আগের তুলনায় বেড়েছে, যদিও এখনো তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। নিকট ভবিষ্যতে এই বৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হবে, কারণ প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার জন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা-জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখতে চাইবে। বলা বাহুল্য, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার আগে নিজের দেশে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরে যে দুস্তর বেতন-বৈষম্য রয়েছে, তার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার উপায় অন্বেষণ করতে হবে।
বিশেষত কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপকদের ক্ষেত্রে কাজের মূল্যায়ন ও বেতন-কাঠামো নির্ধারণের সনাতন পদ্ধতিগুলো ক্রমেই অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। নানাভাবে প্রকট হয়ে উঠছে প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা। যেমন_নতুন প্রযুক্তিজ্ঞান ও বিশেষ দক্ষতার সমন্বয়ে সমৃদ্ধ একজন নবীন কর্মীকে উপযুক্ত পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য প্রচলিত স্তর-কাঠামো ভাঙতে হয়, বেতন কাঠামোর নানাবিধ ব্যতিক্রম তৈরি করতে হয়। প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে দক্ষতার নতুন শ্রেণীবিন্যাস। কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কিছু কিছু কাজ করলেও পদমর্যাদা ও বেতন কাঠামো নির্ধারণের কোনো নতুন প্রক্রিয়া অন্তত গত দুই দশকে আবিষ্কৃত হয়নি।
ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি ত্বরান্বিত করার মতো বেশ কিছু প্রযুক্তি। কিন্তু সেগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার কি সর্বজনীন হয়েছে? ই-মেইলের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন-প্রক্রিয়া কি সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা বা আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে? বিশ্বব্যাপী সভা ও সম্মেলনগুলো তো এখনো সুদীর্ঘ এবং সুপ্তিদায়ক। কথামালা ও চিত্ররূপময় পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড দ্বারা আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা। এখনো তো নিয়ম_সুখী ব্যবস্থাপকরা নীতিমালা বা নিয়ম-পদ্ধতি-শৃঙ্খল তৈরি ও বাস্তবায়ন করতেই অধিকতর ব্যগ্র থাকেন।
একজন ব্যবস্থাপকের কাজের মূল্যায়নে শুধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকেই বস্তুনিষ্ঠ ও চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হবে নাকি তাঁর সমকক্ষ সহকর্মী এবং তাঁর নিজের অধীন কর্মীদের মতামতও নেওয়া উচিত হবে? ব্যবসায়ে অংশীদারিত্বের উত্তরাধিকার অর্থ কি ব্যবস্থাপনা-নেতৃত্বেরও উত্তরাধিকার? প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মধারা অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কি কেবল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও শুরু হবে নাকি নবীন কর্মীদের সৃজনোন্মুখতাকে অধিকতর স্বীকৃতি দেওয়া হবে? মেধা বিকাশ, উন্নত প্রশিক্ষণ ও উত্তরসূরি তৈরির প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উপায় কী? বহু দিন ধরে চর্চিত এ রকম অনেক বিষয়েই আজ অবধি কোনো উপসংহারে পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া রয়েছে আরো অনেক নতুন এবং অনালোচিত বিষয়। ব্যবস্থাপনার প্রচলিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগুলোর অনুপযুক্ততা এবং তাদের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
[চলবে]
লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক, একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা
বিশেষ করে প্রায় ৩০ বছর ধরে যাঁরা বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন তাঁরা এই বাতিলযোগ্যতাকে বেশি করে অনুভব করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে আমূল বদলে যেতে দেখেছেন বিভিন্ন দিক থেকে। কোথাও কোথাও পরিবর্তনগুলো সূক্ষ্ম ও তাত্তি্বক, কোথাও আবার সময় ও পারিপাশ্বর্িক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কৌশলগত। বিশেষত তথ্যপ্রবাহ ও বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি প্রতিযোগিতার মান-স্তর ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে গেছে। এর ফলে বদলে গেছে ব্যবস্থাপনার দৈনন্দিন ভাবনা ও রীতি-পদ্ধতি। প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘটেছে অভাবনীয় ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিষয়টিকে সহজে বোঝার জন্য কয়েকটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। এখন থেকে ৩০ বছর আগে ব্যবস্থাপনায় একমুখী নির্দেশনার যে শৃঙ্খলা ছিল, এখন তা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এখনকার অনেক কর্মী একাধিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে বাধ্য এবং অভ্যস্ত। একজন ব্যবস্থাপক বৈদেশিক বাণিজ্যের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য অথবা প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কর্মকাণ্ড বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আগে যে ধরনের রচনা ও চিঠিপত্র লিখতেন তা আজ প্রায় বিলুপ্ত। দীর্ঘ পরিকল্পনা ও বড় প্রতিবেদনের আদান-প্রদানে যে ডাকব্যবস্থায় সপ্তাহ-মাসব্যাপী সময় প্রয়োজন হতো, তা আজ অনেকাংশে বাতিল। সংক্ষিপ্ত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য টেলেঙ্ ও তারবার্তা জাতীয় যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হতো, সেগুলো সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে জাদুঘরে স্থান খুঁজছে। কমে যাচ্ছে ওপর থেকে নিচের দিকে আদেশ-নির্দেশের প্রবাহ ও তাদের কার্যকারিতা। শংকরের সূচনাপর্বের উপন্যাসের চরিত্রের মতো সকালে টাই-রুমাল সহযোগে থ্রিপিস, স্যুট পরিহিত যে ব্যবস্থাপকদের দেখা যেত পেছনে পিয়নের হাতে সুদৃঢ় ব্রিফকেস ও ফাইলপত্র নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন অথবা বিকেলে সাদা টি-শার্টশোভিত হয়ে অভিজাত ক্লাবে টেনিস খেলছেন, তাঁরা আজ বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির মানুষ। এখনকার দিনে সারা পৃথিবীর, বিশেষত বেসরকারি সংস্থার অধিকাংশ কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপক একটি অথবা দুটি মাত্র ছোট যন্ত্রের অনুষঙ্গে বিশাল ও সার্বক্ষণিক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত থাকেন। বদলে গেছে তাঁদের জীবনযাত্রা, স্থান-কালের ধারণা ও কর্মপদ্ধতি। এর ভালো-মন্দ যা-ই থাকুক না কেন, তাঁদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবন ও বিনোদন ইত্যাদির মাঝে নিঃশব্দে এবং সুচারুভাবে মিশে গেছে কর্মজীবন। কর্মক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ বা শরীরচর্চাকেন্দ্র, যাতায়াতকালে ই-মেইল, শয়নকক্ষে সেরে নেওয়া দূরভাষ-সম্মেলন_এভাবে স্থান-কাল ও কাজ-অবকাশের সীমান্তগুলো অবলুপ্ত হয়েছে। পিয়ন, করণিক, উচ্চ-নিম্ন সহকারী, অফিস সহকারী, ব্যক্তিগত সহকারী, একান্ত সচিব ইত্যাদি বহু পদের অবলুপ্তি ঘটেছে অথবা দায়িত্ব ও কর্মবিবরণী সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে তাঁদের সার্বিক রূপান্তর ঘটেছে।
এত পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে পরিচালনা ও দিকনির্দেশনা দানের জন্য উপযুক্ত নতুন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কি আবিষ্কৃত হয়েছে? অতীতের ব্যবস্থাপকদের নিয়োগ অথবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে আভিজাত্য, যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠি ব্যবহৃত হতো তার বদলে আজ ভিন্ন, অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রায়োগিক মাপকাঠি প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে নতুনতর কিছু মাপকাঠি খুঁজে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেক কিছুই রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। আগে এসব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আভিজাত্য ও ইংরেজি-কথনের পারদর্শিতা প্রায় একক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকলেও আজ প্রায়োগিক কর্ম-কুশলতার মর্যাদা বেড়েছে। মনে রাখতে হবে, আজ যে যেখানেই কাজ করি না কেন, সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা টিকে আছি এবং যথাসম্ভব এগিয়ে চলেছি। বাংলাদেশে যে শ্রমিক শার্টের বোতাম লাগাচ্ছেন, তিনি হংকং অথবা তুরস্কের একজন শ্রমিকের তুলনায় কম মূল্যে এবং অন্তত সমান দক্ষতায় কাজটি করছেন। যে ফার্মাসিস্ট এ দেশে ওষুধ তৈরি করছেন, তিনি চীন অথবা ভারতের একজন ফার্মাসিস্টের সমকক্ষ কুশলতার সঙ্গে কাজ করছেন। যে নবীন কর্মী আজ নিজের, সহকর্মীর অথবা ঊর্ধ্বতন কারোর কাজে একটি ভালো বিশ্লেষণ যোগ করতে পারেন অথবা দ্রুত কোনো বার্তা প্রেরণ করে গ্রাহক, ক্রেতা অথবা কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন তাঁর মূল্য প্রতিষ্ঠানের কাছে অপরিসীম। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্ষুদ্র যন্ত্রটির প্রয়োগে তুলনামূলক দক্ষতা অনেক সময় ব্যক্তির আভিজাত্য, শিক্ষায়তনের মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ভাষা-জ্ঞান ইত্যাদির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট, ফলপ্রসূ ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সুতরাং তাঁদের বেতন-ভাতা ইত্যাদিও আগের তুলনায় বেড়েছে, যদিও এখনো তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। নিকট ভবিষ্যতে এই বৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হবে, কারণ প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার জন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা-জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখতে চাইবে। বলা বাহুল্য, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার আগে নিজের দেশে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরে যে দুস্তর বেতন-বৈষম্য রয়েছে, তার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার উপায় অন্বেষণ করতে হবে।
বিশেষত কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপকদের ক্ষেত্রে কাজের মূল্যায়ন ও বেতন-কাঠামো নির্ধারণের সনাতন পদ্ধতিগুলো ক্রমেই অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। নানাভাবে প্রকট হয়ে উঠছে প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা। যেমন_নতুন প্রযুক্তিজ্ঞান ও বিশেষ দক্ষতার সমন্বয়ে সমৃদ্ধ একজন নবীন কর্মীকে উপযুক্ত পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য প্রচলিত স্তর-কাঠামো ভাঙতে হয়, বেতন কাঠামোর নানাবিধ ব্যতিক্রম তৈরি করতে হয়। প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে দক্ষতার নতুন শ্রেণীবিন্যাস। কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কিছু কিছু কাজ করলেও পদমর্যাদা ও বেতন কাঠামো নির্ধারণের কোনো নতুন প্রক্রিয়া অন্তত গত দুই দশকে আবিষ্কৃত হয়নি।
ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি ত্বরান্বিত করার মতো বেশ কিছু প্রযুক্তি। কিন্তু সেগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার কি সর্বজনীন হয়েছে? ই-মেইলের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন-প্রক্রিয়া কি সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা বা আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে? বিশ্বব্যাপী সভা ও সম্মেলনগুলো তো এখনো সুদীর্ঘ এবং সুপ্তিদায়ক। কথামালা ও চিত্ররূপময় পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড দ্বারা আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা। এখনো তো নিয়ম_সুখী ব্যবস্থাপকরা নীতিমালা বা নিয়ম-পদ্ধতি-শৃঙ্খল তৈরি ও বাস্তবায়ন করতেই অধিকতর ব্যগ্র থাকেন।
একজন ব্যবস্থাপকের কাজের মূল্যায়নে শুধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকেই বস্তুনিষ্ঠ ও চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হবে নাকি তাঁর সমকক্ষ সহকর্মী এবং তাঁর নিজের অধীন কর্মীদের মতামতও নেওয়া উচিত হবে? ব্যবসায়ে অংশীদারিত্বের উত্তরাধিকার অর্থ কি ব্যবস্থাপনা-নেতৃত্বেরও উত্তরাধিকার? প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মধারা অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কি কেবল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও শুরু হবে নাকি নবীন কর্মীদের সৃজনোন্মুখতাকে অধিকতর স্বীকৃতি দেওয়া হবে? মেধা বিকাশ, উন্নত প্রশিক্ষণ ও উত্তরসূরি তৈরির প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উপায় কী? বহু দিন ধরে চর্চিত এ রকম অনেক বিষয়েই আজ অবধি কোনো উপসংহারে পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া রয়েছে আরো অনেক নতুন এবং অনালোচিত বিষয়। ব্যবস্থাপনার প্রচলিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগুলোর অনুপযুক্ততা এবং তাদের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
[চলবে]
লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক, একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা
No comments