বাংলাদেশের শেয়ারবাজার : একটি সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়ন by ড. গাজী সালেহ উদ্দিন

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত শেয়ারবাজার সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার তিনি বোঝেন না এবং পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের শেয়ারবাজার নেই। তাঁর এই বক্তব্য যথাযথভাবে সত্য। তবে এর প্রকৃত কারণ জানতে হলে শুধু অর্থনীতির সূত্র দিয়ে বের করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-মননশীলতা, আকাঙ্ক্ষা বা সমাজতাত্ত্বিক সূত্র। পশ্চিমা ভাবধারার অর্থনৈতিক সূত্র দিয়ে


বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ তাড়িত হয় আবেগ দ্বারা। এটি যেমন রাজনীতিতে, তেমনি অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের বেশ কিছু বেকার তরুণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারকে প্রধান বা অন্যতম আয়ের উৎস-পেশা হিসেবে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যাদের মূল লক্ষ্য লাভ করা। সম্ভবত তারা দেখেছে, বাংলাদেশের যারা ধনী হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই এই ফটকা ব্যবসায় কোটিপতি হয়েছে। তাহলে তারা হতে পারবে না কেন? বাংলাদেশে বিভিন্ন কম্পানির শেয়ারবাজারে আসা, দাম ওঠানামা, বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তির বক্তব্য শুনে বোঝার চেষ্টা করি; তবে একটি বিষয় বুঝতে পেরেছি_একজন শেয়ারহোল্ডার যে কম্পানিরই শেয়ার কিনুক না কেন, তার দাম সব সময় উঠতে হবে, দাম ওঠানামার সঙ্গে কম্পানির Goodwill বা তার সম্পত্তি আছে কি না তা দেখতে নারাজ শেয়ারহোল্ডাররা। শেয়ারবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন খুশি শেয়ারহোল্ডাররা, আবার যখন নিম্নমুখী তখন অনশন, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, অনশন ইত্যাদি লেগে থাকে। গত ১৬ অক্টোবর জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিএনপির ড. মঈন খান শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ বর্তমান এই শেয়ারবাজার নিয়ে ভবিষ্যতে আরো রাজনীতি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেয়ারবাজার নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করেছেন এবং বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তবে ভবিষ্যৎ বলে দেবে এই বাজার স্থিতিশীল হবে কি না।
পত্রিকায় দেখেছি, সরকার তদন্ত কমিটি করেছে, কারা দায়ী তা নির্দিষ্ট করেছে। দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, কারো বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনো কোনো আইনজীবীর মতে, এই মামলা করে কিছুই করতে পারবে না, যেহেতু এই ধরনের ব্যবসা সরকার নিষিদ্ধ করেনি এবং এ ব্যাপারে কোনো নীতিমালা নেই। বেশ কিছুদিন ধরে পত্রিকায় দেখছি অর্থনীতিবিদ, জ্ঞানী-গুণীজন বলেছেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে। অর্থাৎ শেয়ার যখন বাজারে বেশি হবে, তখন শেয়ার কেনার বা দাম বাড়ার প্রবণতা কমে যাবে। অর্থাৎ কাম্যতার ক্রমিক হ্রাসের তত্ত্বটি এখানে কার্যকর হবে। কিন্তু এসব বিশেষজ্ঞের ধারণা কি শুধু কেনাবেচা? এখানে মানুষের মনস্তাত্তি্বক বিষয়টা কি কোনোভাবে আলোচনায় আসবে না? এসব পরিকল্পনা করতে গেলে শুধু অর্থনীতির মাপকাঠিতে বিচার করলে হবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে এ দেশের মানুষের চিন্তা-ধারণা বা সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি। ছোট একটি উদাহরণ দিই_আজকে ঢাকা যানজটের কারণে স্থবির হয়ে গেছে, দুই মাইল যেতে তাকে চার ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হয়। এর কারণ ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি কনভার্সনের অনুমোদন দেওয়া। যদি তখন শুধু পাবলিক গাড়িগুলোকে অনুমোদন দিত সরকার, তাহলে আমাদের এই বিশাল যানজটের অভিশাপে পড়তে হতো না। সাধারণভাবে আমাদের দেশে আইন বা উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ সামনে রেখে। কিন্তু ভবিষ্যতে এর ফল কী হবে তা চিন্তা বা ভাবার চেষ্টাও করা হয় না। এর ফলে পরবর্তী সময়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোয় একটি নতুন 'ঋণদাস' শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। শেয়ারবাজার সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি গভীর নয়, তবে আমি যেটুকু বুঝি তা হলো_দেশের উন্নয়নে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি সুযোগ করে দেওয়া, তার বিনিময়ে লাভের একটি অংশ শেয়ারহোল্ডাররা পাবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো_ক্রেতাদের লক্ষ্য লভ্যাংশের দিকে নয়, তারা কেনাবেচার লাভকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। শেয়ারের দাম কম হলে কিনবে, দাম বাড়লে বিক্রি করবে এবং এই সুযোগটা ফটকা ব্যবসায়ীরা নিচ্ছে, তারা বিভিন্ন উপায়ে শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। যখন তাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পেঁৗছবে, তখনই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা এই বেড়াজালের ফাঁকে আটকা পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষ ক্রমে লোভী হয়ে উঠছে। এই লোভ জন্ম নেওয়ার কারণ হলো, স্বাধীনতার আগে দু-একজন ছাড়া কেউ কোটিপতি ছিল না, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর থেকে হাজার হাজার পরিবার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে এবং যারা হয়েছে তারা বেশির ভাগ ছিল বিত্তহীন, বিভিন্ন কায়দায় তারা অগাধ টাকার মালিক হয়েছে। এবং এর মধ্যে বেশির ভাগ ব্যক্তি বিভিন্নভাবে সরকারের কর ফাঁকি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা, বিদ্যুৎ-গ্যাস চুরি, ঘুষ_অর্থাৎ এই ধনী হওয়ার পেছনে কোনো না কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত ছিল।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, শেয়ারহোল্ডাররা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। এই সময়কাল অন্তত এক বছর হতে হবে; সে Primary অথবা Secondary যে ধরনের শেয়ারই কিনুক না কেন। কারণ শেয়ার কেনার মূল লক্ষ্য হলো, ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ। Primary শেয়ারহোল্ডারদেরই প্রকৃত বিনিয়োগকারী হিসেবে ধরা হয়। Secondary হোল্ডাররা আসে ব্যবসা করতে। তাহলে দ্বিতীয় শর্ত থাকতে হবে, বছর শেষে ডিভিডেন্ড দেওয়া, যা ব্যাংকের সুদ থেকে বেশি হতে হবে। তৃতীয়ত, শিল্প মালিকরা নানা ধরনের গোঁজামিল হিসাব দিয়ে প্রকৃত লাভ গোপন করে, এর প্রতিকারের প্রকৃত ব্যবস্থা নিতে হবে।
চতুর্থত, কোনো কারণে কম্পানি লোকসান করলে বা লাভ না দিলে সরকারকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারও এ ব্যাপারে আগেই কম্পানির সঙ্গে ব্যবস্থা করে রাখবে। অনেকে এ ধরনের উদ্যোগকে শেয়ারবাজারের প্রচলিত রীতিনীতি-বিরুদ্ধ বলতে পারেন অথবা এও বলতে পারেন, বিশ্বব্যাপী যে নিয়ম প্রচলিত রয়েছে, তার সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি বা Mood of Production কোনো তত্ত্বের সঙ্গে মিলবে না_এটাকে বাংলাদেশি Mood of Production বলতে পারি। তেমনি শেয়ারবাজর নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তেমন একটি আইনের প্রয়োজন রয়েছে, যা শুধু অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বিচার করলে হবে না, তা দেখতে হবে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যই ক্ষুদ্র পুঁজিকে সংগঠিত করা প্রয়োজন। জুয়া খেলার জন্য নয়, এর জন্য প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন সংস্কার; তা না হলে সরকারকে অস্থিতিশীল করতে যেকোনো সময় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উদ্যোগ নিতে পারে। এসব জুয়াড়ির কাছে সরকার হয়ে পড়বে অসহায়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.