ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি ভেঙে যাবে-আন্তর্জাতিক by আবু এন. এম. ওয়াহিদ

গ্রিসের সাম্প্রতিক ঋণ সমস্যা চলছে অনেকদিন ধরে। এটাকে সামাল দেওয়ার জন্য ইইউর (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন), বিশেষ করে ফ্রান্স-জার্মানির কসরতেরও কোনো কমতি নেই, কিন্তু তবু যেন এর কোনো হিল্লে হচ্ছে না। আর এরই জের ধরে আমেরিকাও সংক্রমিত হচ্ছে একই রোগে। রোগের আলামত কমছে না, বরং বাড়ছে সমানতালে দুই জায়গাতেই। দিন দিন সমস্যা জটিল হচ্ছে, গভীর হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে তার ডালপালা।


এর তাত্তি্বক এবং রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নিয়ে সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন ভূরি ভূরি লেখা বের হচ্ছে। নিজে অর্থনীতির ছাত্র, অর্থ সংক্রান্ত বিষয় কিছুটা হলেও বুঝি, কিন্তু সমস্যার রাজনৈতিক দিক অর্থাৎ ফ্রান্স-জার্মানির টানাহেঁচড়ার ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বিষয়টি একটু ভালো করে জানার জন্য কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। এ থেকে যা পেলাম, কৌতূহলী পাঠকদের সামনে সোজাসাপটা ভাষায় এ নিবন্ধের মাধ্যমে তাই তুলে ধরছি।
আমি যেটুকু বুঝেছি, শুরুতে সমস্যাটা এত বড় ও জটিল ছিল না। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সহজেই সম্ভব হতো। কিন্তু তখন সমস্যাটা কেউ আমলে নেয়নি। সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছেন। এখন ধরা খেয়েছেন তো সবাই এক সঙ্গে। কথায় আছে না, 'সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়'_ কথাটা ফলতে শুরু করেছে কাঁটায় কাঁটায়। গ্রিসের জাতীয় ঋণ গলা অবধি পার হয়ে মাথার ওপর উঠে গেছে। জিডিপির ১৮০ শতাংশ। ঋণের মূল পরিশোধ তো দূরের কথা, সুদ নিয়েই পড়েছে এখন টানাটানি। এ ছাড়াও যা দেখা যাচ্ছে, স্পেন, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ইতালিও লাইনে আছে। তাদের অবস্থাও তথৈবচ।
সমস্যাটা শুরু হয়েছে এভাবে_ যেসব ইউরোপিয়ান ব্যাংক এসব দেশকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে, তাদের ওপর তদারকি এবং নজরদারির যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। ব্যাংক লালবাতি জ্বালালে ক্ষুদ্র ও বড় আমানতকারীদের পুঁজি নিরাপত্তার জন্য 'ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স' কিংবা 'আমানত বীমা' চালু করা প্রয়োজন ছিল, সেটাও হয়নি। তার ওপর সমস্যা সৃষ্টি হলে সমাধানের জন্য প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে একটি মাঝারি আকারের স্ট্যান্ডবাই, 'ইমার্জেন্সি অ্যান্ড কনটিনজেন্সি ফান্ড' রাখা দরকার ছিল, তারও কিছু করা হয়নি। এসব ব্যবস্থা থাকলে, প্রথমত এ ধরনের সমস্যারই উদ্ভব হতো না।
এখন আর পেছনে ফেরার সময় নেই। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। সময়মতো আসল সমস্যার সমাধান না খুঁজে ইউরোপিয়ানরা দেখছি-দেখি করে দিন পার করেছে। এখন বুঝতে পারছেন সমাধানের জন্য ইসিবিকে (ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক) ইউরোবন্ড নিয়ে বড়ভাবে পুঁজি বাজারে নামা ছাড়া এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের কোনো সহজ উপায় নেই। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশে দেশে এ কৌশলের গ্রহণযোগ্যতা যত কঠিন, অর্থায়নের দিক থেকে এটা তার চেয়েও বেশি ব্যয়বহুল এবং বেদনাদায়ক। গ্রিস এবং দায়গ্রস্ত অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশে ঋণদানকারী ব্যাংকের একটি বড় অংশ ফরাসি। আর তাই জার্মানির প্রস্তাবিত সহজ সমাধানে ফ্রান্সের এত আপত্তি। জার্মানি প্রতিটি ঋণদানকারী ব্যাংককে বলছে, ঢালাওভাবে অর্ধেক ঋণের দায় মাফ (ইংরেজিতে যাকে বলে রাইট অফ) করে দিতে। ফরাসি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত বড় লোকসান গুনতে রাজি হচ্ছে না। পক্ষান্তরে ফরাসিরা দাবি করছে, ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে চাঁদা তুলে ইসিবিকে বড় আকারের ফান্ড নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত। এ ফান্ড দিয়ে ইসিবি ঋণগ্রস্ত দেশের ইস্যুকৃত নতুন বন্ড কিনতে থাকবে এবং ইসিবির কাছে বন্ড বিক্রির টাকা দিয়ে ভুক্তভোগী দেশগুলো ঋণ সামাল দেবে। এ নিয়ে ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে দেনদরবার ও টানাপড়েন চলছে অনেক দিন ধরে এবং এর কোনো সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
গ্রিসের ঋণ সমস্যায় ফ্রান্স বড়ভাবে জড়িয়ে পড়ায় সমস্যাটা ইদানীং রীতিমতো রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে। শুরুতে ২০০৭ সালে ইউরোপের এই বড় দুই শক্তিধর দেশ ও অর্থনীতির মধ্যে যে মিল-মহব্বত ছিল এখন আর তা দেখা যাচ্ছে না। সেদিন ফ্রান্সের এক সরকারি মুখপাত্র_ 'মিস ভ্যালেরি পেক্রিসে ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, 'ইসিবির দায়িত্ব শুধু মূদ্রা হিসেবে ইউরোকে স্থিতিশীলতা দেওয়াই নয়, বরং আরও বড় পরিসরে গোটা ইইউর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা।' একই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ফরাসি অর্থমন্ত্রী ফ্রাঁন্সো ব্যারোইন পরিষ্কার ভাষায় দাবি করেছেন, 'গ্রিক ঋণ সমস্যা সমাধানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বলে ইসিবি মাত্র অক্টোবর মাসেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন তা থেকে ইসিবির সরে আসার কোনো সুযোগ নেই।'
ফ্রান্সের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল রীতিমতো তিরস্কারের সুরে বলছেন, 'ইসিবি কেমন করে এত বড় কাজ করবে? তার তো তেমন কোনো ক্ষমতা নেই এবং কর্তৃত্বও নেই।' জার্মান সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান জিইটুং উল্ফ্যাঙ্গ ফ্র্যান্জ বলেছেন, 'ইসিবি যদি ইউরোপে আর কোনো সরকারি ঋণ কিনে তবে সেটা হবে সবচেয়ে মারাত্মক পাপ।' জার্মানি ভালো করেই জানে ফরাসি প্রস্তাবে রাজি হওয়ার মানেটা কী। এর অর্থ সবচেয়ে বড় বোঝাটা জার্মান করদাতাদেরই বইতে হবে। তাই জার্মানদের কথা, 'শেষ পর্যন্ত বইতে হলে বইব, তবে এত সহজে রাজি হবো কেন?'
গ্রিসের ঋণ সমস্যা সমাধানে ইসিবিকে টেনে আনার ব্যাপারে ফরাসিদের এত মরিয়া হয়ে ওঠার কারণটিও পরিষ্কার। ইসিবি যদি সমস্যা সমাধানে জোরেশোরে এগিয়ে না আসে, তা হলে ফ্রান্সের গোটা ব্যাংকিং সেক্টর দারুণভাবে দূর্বল হয়ে পড়বে এবং তার চেয়ে ভয়ের ব্যাপার, সব ফরাসি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং 'ট্রিপল এ'তে আর ধরে রাখা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ফ্রান্স-জার্মানির ক্রমাগত টানাপড়েনের ফলে অবস্থা এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, স্পেন, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ইতালির দেউলিয়া হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।' গ্রিসের কঠিন ঋণ সমস্যা এবং ফ্রান্স-জার্মানির ঠেলাঠেলিকে সামনে রেখে গোটা ইইউর ঐক্য একেবারে নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আঁচ করা যায় নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী সার্ক রাটের একটি মন্তব্য থেকে। কোনো এক ইউরোপিয়ান মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেদিন রাটে বলেছেন, 'যেসব দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজস্ব নীতি অনুসরণ করতে চায় না, তাদের সংস্থা থেকে বহিষ্কার করার একটি বন্দোবস্ত রাখা দরকার।' এদিকে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের নিজ রাজনৈতিক দল, ইইউ থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব পাস করে রেখেছে। অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে, ইউরোপের ঋণ সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে জরুরি ফ্রান্স-জার্মানির সমঝোতা। এটা যদি সম্ভব না হয়, তবে ইউরোপের ঋণ সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং ইইউর অস্তিত্ব নিয়ে পড়বে টানাটানি।

আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.