আওয়ামী লীগ শোচনীয় দশায় নরসিংদীতে-এক মামলায় খোকনের জামিন

রসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন হত্যা মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে ১২ জনই তাঁর দলের লোক। প্রধান আসামি জেলার আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই। মেয়রের পরিবারের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মন্ত্রী রাজুর হাত থাকার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে, 'কান টানলে মাথা আসবে, তাই তাঁকে মামলায় আসামি করা হয়নি।' এসব কারণে স্বভাবতই নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের এখন শোচনীয় অবস্থা। স্থানীয় এক নেতা বলছেন, 'এই মুহূর্তে সরকারের ওপর মহল নীরব ভূমিকা পালন করলে নিজের পায়েই কুড়াল মারা হবে।'


লোকমানের পরিবারের করা হত্যা মামলায় অন্য দুই আসামি বিএনপির নেতা। এ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে এই দলটিও। মেয়র হত্যাকাণ্ডের পর পরই গ্রেপ্তারকৃত জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে অব্যাহতি পেলেও দুটি ভাঙচুরের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সার্কিট হাউস ভাঙচুর মামলায় গতকাল তিনি জামিন পেলেও রেলস্টেশন ভাঙচুর মামলায় জেলহাজতে রয়েছেন। এ নিয়ে জেলার রাজনীতির পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
জনপ্রিয়তার কারণে দলীয় ও বিরোধী দলের চক্রান্তে লোকমানকে প্রাণ হারাতে হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগের পরই নরসিংদীতে আলোচনায় এসেছে বড় দুই দলের কোন্দলের রাজনীতি। দুই দলেই রয়েছে দলীয় ও ক্ষমতার কোন্দল। এ কারণে বেশ কয়েকজন নেতাকে এর আগে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমান্ডকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে সুশীলসমাজ।
লোকমান হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ১৪ জনকে আসামি করে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রী রাজুর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজউদ্দিন ভুঁইয়া, কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন মোবা, শহর যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ও জেলা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিয়া মো. মঞ্জুরসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ১২ জন। অপর দুই আসামি হচ্ছেন নরসিংদী শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম (খায়রুল কবির খোকনের ডান হাত বলে পরিচিত) ও সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দাবিদার তারেক আহমেদ।
লোকমান হত্যা মামলার পর জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে দলীয় কার্যালয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কিছুটা ক্লিন ইমেজের যাঁরা, তাঁরা সবাই সন্ত্রস্ত, মুখ খুলতে চাইছেন না। মামলার আসামিদের নিয়ে নরসিংদীবাসী ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও শিবপুর উপজেলার চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান (ফটিক মাস্টার) কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নরসিংদীর পৌর মেয়র অল্প বয়সে তাঁর যোগ্যতার কারণে গণমানুষের নেতা হয়েছিলেন। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করায় আমরা মর্মাহত, শোকার্ত। নিহতের পরিবার যাদের আসামি করেছে তাদের ১২ জনই আওয়ামী লীগের নেতা। এই অবস্থায় জেলা আওয়ামী লীগ যে কত বেকায়দায় আছে, কতটা শোচনীয় দশায় আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।' তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে সরকারের ওপর মহল নীরব ভূমিকা পালন করলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা হবে।'
দলের নেতাদের লোকমান হত্যার আসামি করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভুঁইয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা বলে তিনি 'এই ঘটনা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না' জানিয়ে সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁর পরিবার থেকে। জেলা আওয়ামী লীগ এই মামলার বিষয়ে একমত নয়। তাই এর প্রভাব দলীয় রাজনীতিতে পড়বে না।
নরসিংদীর শিবপুর থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক মোহন কালের কণ্ঠকে বলেন, মেয়র লোকমান ছিলেন নরসিংদীর আওয়ামী লীগের সম্পদ, তিনি মারা যাওয়ায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, এটা পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়। দলীয় নেতাদের মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবার যাকে সন্দেহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত খুনিদের বের করবে। তবে তিনি স্বীকার করেন, এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিছু অস্থিরতা কাজ করছে।
নরসিংদী সদর থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, 'নরসিংদী আওয়ামী লীগে বড় ধরনের কোন্দল না থাকলেও মতবিরোধ ছিল। এমন একটি ঘটনা ঘটবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। নরসিংদীবাসী অনেক কষ্ট পেয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিছু অস্থিরতা কাজ করলেও ধীরে ধীরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।' তিনি বলেন 'মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু আমার জানামতে একজন ভদ্রলোক। আমি মনে করি তিনি এটা ঘটাতে পারেন না।' বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তাঁর কথা, 'আমরা স্থানীয় নেতারা, জেলার সাংসদরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। তবে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'
তরোয়া এলাকার যুবলীগকর্মী আল-আমিন বলেন, নরসিংদীর আওয়ামী রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছে। লোকমান হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে নরসিংদীর রাজনীতি আগামীতে আরো অস্থির হয়ে উঠবে। দলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাচ্ছে, ভালো মানুষ দলে জড়িত হবে না।
লোকমানের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, জেলা আওয়ামী লীগের আগামী সম্মেলনে মন্ত্রীর ভাই বাচ্চু সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে জোর তৎপরতা চালিয়েছিলেন। লোকমান হোসেনও ওই পদে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ওই সব কারণেই মন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীরা লোকমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। মামলায় মন্ত্রীকে না জড়ালেও তাঁর ভাইকে আসামি করা হয়েছে। এখন কান টানলেই মাথা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে বিএনপির সমর্থকরা জানান, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সংস্কারের কথা বলে দল থেকে বহিষ্কার হন। সেই থেকে বিএনপির রাজনীতিতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে চলছে কার্যক্রম। সেই অস্থিরতা তিন-চার বছরেও শেষ হয়নি। লোকমান হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করায় এখন বিএনপির রাজনীতিতেও চলছে অস্থিরতা। নরসিংদী জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সুলতানউদ্দিন মোল্লা বলেন, খায়রুল কবির খোকনকে আটক করায় নরসিংদীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি বলেন 'নেতা-কর্মীদের আশ্রয়স্থল হয় দল কিন্তু মেয়র লোকমানের বাড়িটি ছিল সর্বসাধারণের দলীয় অফিস। সব শ্রেণীর মানুষের ভিড় থাকত। নরসিংদীতে হত্যার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, ক্লিন ইমেজের রাজনীতির চর্চা করতে হবে।'
আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সমর্থক, চক্রধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মৃধা বলেন, মান্নান ভঁূইয়া বিএনপি থেকে বহিষ্কারের পর থেকে নরসিংদীর বিএনপিতে অস্থির, অরাজকতা কাজ করছে। মেয়র লোকমান হত্যার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হতাশ।
আদালত চত্বরে খোকনের স্ত্রী শিরীন সুলতানা বলেন, 'লোকমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার স্বামীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়েছে। দেশবাসী জানে, ঘটনার সময় খোকন ঢাকায় ছিলেন এবং লোকমানকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। শুধু রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য সরকারের মদদে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছে।' নরসিংদী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, 'লোকমান হত্যার ৯ দিন পার হয়ে গেল। পুলিশ এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। যেটি পেরেছে, তা হলো বিএনপি নেতা খোকনকে একাধিক মামলার আসামি করা। আগামী রবিবার রেলওয়ে স্টেশন ভাঙচুরের মামলার জামিন নিয়ে খোকনকে আমরা মুক্ত করব। এর ব্যতিক্রম হলে লাগাতার আন্দোলনে যাব।'
বড় দুই দলের কোন্দলের রাজনীতি নরসিংদীবাসীর জন্য বিপদের কারণ উল্লেখ করে নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, যত দ্রুত দুই দলের কোন্দল নিরসন করা সম্ভব হবে ততই নরসিংদীবাসীর মঙ্গল হবে। কারণ মেয়র লোকমান হত্যার পর থেকেই অনেকে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমান্ডই পারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।

No comments

Powered by Blogger.