রিজার্ভ আবারও ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে : চাপের মুখে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য by আহসান হাবীব রাসেল

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত দুই মাসের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্যভুক্ত দেশগুলোর আমদানি ব্যয় মেটানোর পর রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসেও রিজার্ভ ২২ মাস পর ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে ৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার আয় হ্রাস ও প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় করাতে না পারায় রিজার্ভের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যও পড়েছে চাপের মুখে।


বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের আমদানি ব্যয় বাবদ আকু’র সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে ৮২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়লেও রফতানি আয়, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণ প্রত্যাশা অনুযায়ী না পাওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসছে। রিজার্ভ কমে আসায় টাকার বিপরীতে তরতর করে বাড়ছে ডলারের দাম। তাছাড়া ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে
দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮১৪ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ১ হাজার ১৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে
৩০৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে সার্বিক ব্যালেন্সে জুলাই-আগস্টে ৮৯ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত থাকলেও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা কমে ঘাটতিতে পরিণত হয়েছে। ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতি এখন এক ধরনের সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে। পাইপলাইনে থাকা সত্ত্বেও নিজেদের দুর্বলতার কারণে সরকার বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় করাতে পারছে না। রেমিট্যান্স আয়েও তেমন কোনো সুখবর নেই। বিশ্ব মন্দার প্রভাবে রফতানির প্রবৃদ্ধিও কমে আসছে। ফলে দেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, এ চাপ প্রশমনে জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমাতে হবে। সরকার আমদানির পরিমাণ কমাতেও চেষ্টা করতে পারে। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ক্রমেই কমে আসছে। গতকাল মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৭৬ টাকা ৩৯ পয়সা। গত ২৯ অক্টোবর ডলারের দাম ছিল ৭৬ টাকা ১৬ পয়সা। ১৫ অক্টোবর ছিল ৭৫ টাকা। আর গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডলারের দাম ছিল ৭৪ টাকা। এভাবে প্রতিনিয়তই যেন তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। ২০০৮ সালের ২ মার্চে ডলারের দাম ছিল ৬৮ টাকা ৫৮ পয়সা। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১ শতাংশ। এরপর থেকে বর্তমান সময়ে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের পতন হয়েছে ৮ শতাংশের ওপর।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যে পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে তাতে এ মুহূর্তে যদি বিদেশ থেকে বর্ধিত পরিমাণে ঋণ না আসে তবে রিজার্ভ চরম হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনা কঠিন। যেহেতু রফতানি ও রেমিট্যান্স আয় বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। তাই বিশ্ব অর্থনীতিতে চলতি মন্দায় বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোর ওপর বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাবে এরই মধ্যে দেশের রফতানি খাতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৪৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। চলতি ২০১১-২০১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রফতানি আয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছে প্রায় ৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগস্টে রফতানি আয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৭৬ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার। সবমিলিয়ে প্রথম তিনমাসে দেশে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।
রফতানি আয়ের পাশাপাশি দেশের রেমিট্যান্স আয়েও তেমন কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ১০৪ কোটি ডলার। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের রেমিট্যান্স আয়ের লক্ষ্যমাত্রা (১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার) পূরণের জন্য অবশিষ্ট মাসগুলোতে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হতে হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। যা বর্তমান বিশ্বমন্দা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থায় অর্জন করা অনেকটাই কষ্টকর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেছে মাত্র ৭৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ পাইপলাইনে থাকলেও সরকার নিজেদের অযোগ্যতার কারণে তা ছাড় করাতে পারছে না। তাছাড়া পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় বৈদেশিক ঋণ সামনে বৃদ্ধি পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন তারা। সেজন্য বৈদেশিক অর্থায়নের কাজে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে বলে মনে করছেন দাতা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা।

No comments

Powered by Blogger.