জামির-তাজুল-হাবিব বাহিনী-ওরা মানিকদী-মাটিকাটার ত্রাস, পুলিশও অসহায় by অমিতোষ পাল

জামির-তাজুল-হাবিব বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানার মানিকদী-মাটিকাটা এলাকার মানুষ। জমি দখল, দলিল জাল করে বিক্রি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে এই বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বাধা দিতে গেলেই প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। কখনো কখনো চালানো হয় গুলি। সাধারণ মানুষ, এমনকি সরকারি দলের লোকজনও জামির বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও তাদের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।


এ ব্যাপারে ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, বাহিনীর অন্যতম হোতা তাজুল ইসলামকে একাধিকবার আটক করার পরও সে জামিনে বেরিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্যান্টনমেন্ট থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন খোকা কালের কণ্ঠের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'ওদের অপকর্মের কথা যে বলব, আমার জীবনের নিরাপত্তা দেবে কে? এ জন্য চুপ করে থাকি।' 'অন্যায় সহ্য করাও তো অপরাধ' বলতেই তিনি বলেন, 'ওই গ্রুপের নাম জামির-হাবিব-তাজুল ইসলাম গং। তাদের প্রধান হলো জামির আলী। সে মানিকদী এলাকার মৃত আশরাফ আলীর ছেলে। আমার জানামতে তারা এই এলাকায় বিভিন্ন মানুষের আট-দশ বিঘা জমি দখল করেছে। এর মধ্যে কালসির এক জমি কেনা নিয়ে সামাদ ও খাজা নামের দুজনের মধ্যে বিতর্ক ছিল। সেই জমি দখল করে নিয়েছে জামির বাহিনী। বর্তমানে দুই বিঘা আয়তনের ওই জমির দাম ছয় কোটি টাকা। এ রকম অনেক জায়গা দখল করে জাল দলিল করে বিক্রি করে দিয়েছে জামির বাহিনী। আর দখল করতে না পারলে জমির মালিককে হুমকি দিয়ে জোর করে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করে নিচ্ছে।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী জানান, কিছুদিন আগে জোয়ারসাহারা মৌজার ৬০০ নম্বর দাগের একটি জায়গার জাল দলিল করে তিন কোটি সাত লাখ ৬২ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে জামির বাহিনী। গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে হওয়া ওই দলিলের নম্বর ৮০৪৭। তারিখ ২৫ আগস্ট, ২০১১। আরেক ভুক্তভোগী পূর্ব মানিকদীর বাসিন্দা মাহবুব আলম বলেন, 'জামির ছিল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আজগরের ডান হাত। কিছুদিন আগে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আজগর মারা যাওয়ার পর তার জায়গা নিয়েছে জামির আলী। সে মানিকদী চৌধুরী কুঞ্জের পাশে আমার দুই বিঘা জমি দখল করে নেয়। এরপর ওই জমিতে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে মালিকানা দাবি করে। প্রতিবাদ করলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এখন আমার ওই জমি ভুয়া দলিল করে বিক্রি করার চেষ্টা করছে। জামিরের ভয়ে ওই এলাকায় যেতে সাহস পাচ্ছি না। আমার একটি মাছের খামার ছিল। সেটাও তারা দখল করে নিয়েছে।'
মাহবুব আলম আরো বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসিকে গিয়ে সমস্যা বলেছিলাম। ওসি বললেন, 'আপনি আপনার জমিতে যান। পুলিশ সহযোগিতা করবে। কিন্তু যখনই যেতে চাইলাম, আমাকে গুলি করল। ভাগ্যগুণে প্রাণে বেঁচে গেছি। এখন জমিতে যে যাব, জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে?' তিনি জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্বাস উদ্দিনকেও গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল জামির বাহিনী। তিনিও প্রাণে বেঁচে গেছেন।
কাপড় ব্যবসায়ী ফেরদৌস কবির পল বলেন, 'পূর্ব মানিকদী বাড়ির আমানের জমি ও মাটিকাটার আরেকজনের জমি দখল করে যেভাবে তারা অনেক মানুষরে কান্দাইতেছে, একইভাবে আমারেও কান্দাইছে। জেলে থাকা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইব্রাহিম ও কিলার আব্বাসের সহায়তায় তারা এসব কুকর্ম করে যাচ্ছে।'
জামির বাহিনীর গুলির আঘাতে একটি কিডনি হারিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন ভুক্তভোগী কালের কণ্ঠকে নিজের নাম বলতেও সাহস পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, 'জামির এই এলাকার মূর্তিমান ত্রাস। তাজুল ইসলাম আর টেইলার হাবিবকে নিয়ে ভূমিদস্যুতা, মাদক ব্যবসা প্রভৃতি অপকর্ম করে চলছে। এসবের প্রতিবাদ করায় আমাকে গুলি করে। এতে আমার ডান পাশের কিডনিটি কেটে ফেলতে হয়েছে। একটি কিডনি নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।'
ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার বাসিন্দা ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন সম্পাদক বলেন, 'আমার বাসার পেছনে ওরা ফেনসিডিল ব্যবসা করত। মাদক ব্যবসা বন্ধের জন্য এলাকার লোকজন নিয়ে থানায় গেলাম। এর পরই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিল। পুলিশের হস্তক্ষেপে ফেনসিডিল ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পর ওরা ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেছে। জামির বাহিনীর শেল্টারে স্থানীয় পিকলু, দীপু, মানিক, শাহ আলম, সুরুজ দেদারসে ইয়াবা ব্যবসা করছে।'
এলাকাবাসী মনে করে, কয়েক বছরের মধ্যে এলাকায় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এর প্রতিটির সঙ্গেই জামির আলী বা তার বাহিনীর লোকজন জড়িত। চৌধুরী কুঞ্জের চার হত্যা, মনির হত্যা, ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগ নেতা ফারুক হত্যা, সম্প্রতি সংঘটিত শামিম হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা আছে। এসব হত্যা মামলায় তারাও আসামি। ভাড়াটে খুনি হিসেবেও তারা কাজ করে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন ভুক্তভোগী জানান, কিছুদিন আগে জামির আলীর বাড়ির সামনে সম্মিলিতভাবে কয়েকজন একটি বাড়ি তৈরি করছিল। জামির বাহিনী সেই বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। পরে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়।
আরেকজন বলেন, স্থানীয় শিক্ষক ইস্রাফিল ও আতিক নামের একজন নিরীহ ব্যক্তির জমি দখল করে নিয়ে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে জামির বাহিনী। ভুক্তভোগীরা কিছু টাকা পরিশোধ করলেও পুরো টাকা না দেওয়ায় এখনো ওই জমি জামির বাহিনী দখলে রেখেছে। একইভাবে মাদ্রাসাশিক্ষক নজরুল ইসলামের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে জামির বাহিনী।
আরেকজন ভুক্তভোগী জানান, জামির আলী ক্যান্টনমেন্ট থানার এক নম্বর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ সাতটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া কাফরুল থানায়ও একাধিক মামলা আছে। তাজুল ও হাবিবের নামেও একাধিক মামলা রয়েছে। আর বোমা মেরে ক্যান্টনমেন্ট থানা উড়িয়ে দেওয়ার হুমকির মামলায় হাবিব ওরফে টাক্কু হাবিব ওরফে টেইলার হাবিবের ছেলে মামুন এখন জেলে।
এসব বিষয়ে জামির আলী, তাজুল ইসলাম ও হাবিবের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন বলেন, 'ওদের পাওয়া মুশকিল। কখন কোন নম্বর ব্যবহার করে বুঝতে পারবেন না। ওই তিনটার মূল হোতা হলো তাজুল ইসলাম। তাকেও আমরা ধরার চেষ্টা করেছি। ওরা একাধিকবার আটকও হয়েছিল। কিন্তু পরে কিভাবে যেন জামিনে বেরিয়ে যায়।'

No comments

Powered by Blogger.