কিছুটা 'নিঃসঙ্গ' হলেও নির্ভার তাঁরা! by নোমান মোহাম্মদ

দুজনের যাত্রা কি কখনো নিঃসঙ্গ হয়? হয়। সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের যেমনটা হচ্ছে!ক্ষমতাবানরা চিরকালই নিঃসঙ্গ। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য অনেক সময় নিজেদের চারপাশে অদৃশ্য এক দেয়াল তাঁদের তুলতে হয়। সাকিব-তামিম কি সেই দেয়াল ইচ্ছাকৃতভাবে তুলেছিলেন, নাকি তা ছিল অনভিজ্ঞতার ফসল_এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে ঢের। জাতীয় দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়কের পদ থেকে তাঁদের সরানোর প্রেক্ষাপটও কারো অজানা নয়। তবে 'ক্ষমতা' চলে যাওয়ার পরও এই দুজন নিঃসঙ্গ।


আজ থেকে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে শুরু হতে যাওয়া সিরিজে তাঁরা '১০ জনের একজন' বটে। তবে অন্যদের সঙ্গে দুজনের পার্থক্যও স্পষ্ট। সাকিব-তামিমের এই নিরালা সফর যে নিজেদের ক্রিকেটার-সত্তাকে প্রমাণের। নেতৃত্বের মশাল হাতছাড়া হওয়ার পরও দায়বদ্ধতা প্রকাশের। এত বড় চ্যালেঞ্জ নেই আর কারো সামনে।
জাতীয় দলে ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকেই সাকিব-তামিম মানিকজোড়। মাঠের বাইরে গলায় গলায় দোস্তি। আর মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। সাকিব এ বছর উইজডেন ক্রিকেটারের বর্ষসেরা টেস্ট খেলোয়াড় হন তো পরেরবার তা হস্তান্তরিত তামিমের কাছে। একজন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একাই হারান, অন্যজন লর্ডসে করেন সেঞ্চুরি। এমন ঝলসানো পারফরম্যান্সে একসময় জাতীয় দলের অধিনায়ত্ব, সহ-অধিনায়কত্ব চলে এল সাকিব-তামিমের কাছে। যেন রাজযোটক! দলের সেরা দুই খেলোয়াড়, যাঁদের বোঝাপড়া দোতারার দুই তারের মতো, তাঁদের কাছেই সমর্পিত বাংলাদেশ ক্রিকেট। এবার নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পায়ের নিচের জমিনটা শক্ত হবে বাংলাদেশের! এমন আশায় যাঁরা বুক বেঁধেছিলেন, তাঁদের আশাভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। বিশ্বকাপের ৫৮ ও ৭৮-এর পরও আস্থা ছিল, তবে জিম্বাবুয়েতে গিয়ে সিরিজ হারের পর আর তাঁদের ওপর আস্থা রাখেনি বিসিবি। সাকিব-তামিমকে সরিয়ে জাতীয় দলের কাণ্ডারি করা হয় মুশফিকুর রহিমকে আর মাহমুদ উল্লাহকে দেওয়া হয় সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব। ব্যস! তাতেই আবার মিছিলের সাধারণ এক সদস্য হয়ে যান আগের দুজন।
জাতীয় দল ঘিরে অভিযোগের যত তির্যক আঙুল, তার প্রায় সবই ছিল সাকিব-তামিমের ওপর। অধিনায়কত্ব, সহ-অধিনায়কত্ব হারানোর পরও তাঁদের কণ্ঠে অভিন্ন সুর। সাকিব যেমনটা বলেছেন, 'অধিনায়ক না থাকায় বেশ নির্ভার লাগছে। নিজেকে নিয়ে অনেক ভাবতে পারছি।' তামিমও এটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ, 'বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। আবার তারা ভালো মনে করায় আমার কাছ থেকে সে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আমি এ নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন না। নিজের খেলার দিকেই আমার মনোযোগ।'
ওই 'নিজের খেলা'ই হলো আসল কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অধিনায়ক সাকিব কিংবা সহ-অধিনায়ক তামিমের চেয়ে অলরাউন্ডার সাকিব ও ব্যাটসম্যান তামিমকে বেশি প্রয়োজন। ঘোরলাগা একসময়ের রোলার কোস্টার রাইডে ক্যারিয়ারের একটি অধ্যায় পেরিয়ে এসেছেন তাঁরা। সেখানে অধিনায়ক হিসেবে ৯ টেস্টে ৩৮.২৩ গড়ে ৬৫০ এবং ৪৭ ওয়ানডেতে ৩৬.৯৭ গড়ে ১৪৭৯ রান সাকিবের। এ সময়ে টেস্টে ৩৯ এবং ওয়ানডেতে ৬৩ উইকেট তাঁর। আর সহ-অধিনায়ক হিসেবে তামিম ১৪ ওয়ানডেতে ৪১৩ রান করেছেন ২৯.৫০ গড়ে। আর একমাত্র টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে সংগ্রহ ৫৮। বাংলাদেশের ক্রিকেটার হিসেবে সাফল্য কম নয়, তবে নানা বিতর্কে ঝরা পাতার মতো ঝরে গেছে সাকিব-তামিমের ক্যারিয়ারের ওই অধ্যায়। আজ থেকে শুরু হচ্ছে নতুন পর্ব। সেখানে নিজেদের ব্যাট-বলকেই হাতিয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় তাঁদের।
কাল সিরিজের ট্রফি উন্মোচনের সময় মুশফিকের সঙ্গে বেশ মজা করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন সামি। শারীরিক উচ্চতার বৈসাদৃশ্য দূর করার জন্য নিজে হাঁটু ভাঁজ করে হয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়কের সমান। ট্রফি কেড়ে নেওয়ার ভঙ্গি করে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ফুটিয়েছেন হাসির ফোয়ারা। কিন্তু সাকিব-তামিমের প্রসঙ্গ আসতেই ভীষণ সিরিয়াস সামি, 'সাকিব তো মাত্র চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলে এল। সেখানকার অভিজ্ঞতা ও অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবে। আর সাকিব-তামিম দুজনই অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। নিজেদের ভূমিকাটা তারা ঠিকভাবে পালন করবে বলেই মনে হয়।' মুশফিকুর রহিম তাঁর অধিনায়ক হওয়ার প্রেক্ষাপট খুব ভালোভাবেই জানেন। তবে রিলে রেসের এই ব্যাটন পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে বাড়তি চাপ না নিয়ে ইতিবাচকতাই উঁকি মারছে তাঁর মনে, 'আসলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে আপনি অধিনায়ক হন আর না হন, প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ের ওপরই বিশাল চাপ থাকে। বেশির ভাগ সময় আমরা বোধহয় নেতিবাচক চিন্তাই করি। ইতিবাচক চিন্তা করলে অনেক সময় বাড়তি সুযোগও আসতে পারে।'
এই ইতিবাচক চিন্তাই এখন করতে চায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন। যে উপায়ে এবং যে প্রেক্ষাপটে অধিনায়কত্ব, সহ-অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে সাকিব-তামিমের, সেটি তাঁদের মনোপূত না হওয়ারই কথা। তাই তো এ কদিনের প্র্যাকটিসে অনেকের মাঝে থেকেও তাঁরা যেন একা, জনতার মাঝেও যেন কুটে মরছেন নির্জনতায়। সাকিব-তামিমের এই বোবা কান্নাই কি বাঙ্ময় হবে ব্যাটের ঝংকারে, বলের ঘূর্ণিতে? বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় লাভ কিন্তু সেখানেই!

No comments

Powered by Blogger.