জমকালো টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে অন্ধকারে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের অবস্থা যেন সেই পরীক্ষার আগের রাতে চোখে অন্ধকার দেখা ছাত্রের মতো! সারা বছর পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। অথচ পরীক্ষা দিতেই হবে। সিলেবাস আর গাইড বই ঘাঁটাঘাঁটি করে নির্দিষ্ট কয়েকটি উত্তর জেনে যদি কোনোরকমে বৈতরণী পার হওয়া যায়। আজ মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের একমাত্র টোয়েন্টি টোয়েন্টির আগে সাফল্যের সহজ শর্তই খুঁজতে হচ্ছে বাংলাদেশ দলকে।'এমসিকিউ'র যুগে অবশ্য বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর জেনে পাস করা কঠিন। কম ওভারের ম্যাচ ছোট দলের জন্য বেশি মানানসই_সে ধারণাও উড়ে গেছে আইপিএলের জোর হাওয়ায়।


এখন টোয়েন্টি টোয়েন্টিতেও অভিজ্ঞতার জয়জয়কার। যে অভিজ্ঞতা প্রস্তুতির হাত ধরে চলে। সামর্থ্যের কথা বাদ দিন, এ অভিজ্ঞতাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অর্ধেক বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে অভিষেকের পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টোয়েন্টি টোয়েন্টি খেলেছে মাত্র ১৬টি। অন্যদিকে একই সময়কালে ক্যারিবীয়রা এ ফরম্যাটের ম্যাচ খেলেছে দ্বিগুণ, ৩২টি। সঙ্গে আইপিএল এবং অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ খেলার অভিজ্ঞতায় মুশফিকুর রহিমের চেয়ে আরো বড় ব্যবধানে এগিয়ে ড্যারেন সামির দল। ভাবা যায়, দেশের মাটিতে ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকের পর আজ মাত্র দ্বিতীয় টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামছে বাংলাদেশ!
গতকাল ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠানে দৈহিক উচ্চতা নিয়ে নির্মল রসিকতা করেছেন ড্যারেন সামি। অনেকটা নিচু হয়ে মুশফিকুরের সঙ্গে একই সমতলে তাঁর ফ্রেমবন্দি হওয়ার চেষ্টা নিখাদ বন্ধুসুলভ রসিকতা। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়কত্বের শুরুটাই হচ্ছে টোয়েন্টি টোয়েন্টির মতো অজানা ক্রিকেট দিয়ে_এ দুর্ভাগ্যের কথা কি আর আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে পারেন মুশফিকুর! তবে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, 'আমার মনে হয়ে টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে আমরা ওরকম শক্তিশালী দল না।' এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় দলের নতুন অধিনায়ক, 'যদি দেখে থাকেন, আইপিএল কিংবা বিগ ব্যাশ জাতীয় টুর্নামেন্টে আমাদের খুব কম খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পায়। সেখানে আমরা দেশের মাটিতে শেষ টোয়েন্টি টোয়েন্টি খেলেছি ২০০৬ সালে। গত ১০ বছর টেস্ট খেলেও আমরা প্রত্যাশিত মানে পেঁৗছাতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ বছরে আমরা পর্যাপ্ত টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই না। টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে সে ঘাটতিটা আরো বেশি। ম্যাচ প্র্যাকটিস খুব দরকার। না খেললে নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে বুঝব কী করে? অভিজ্ঞতা থাকলে আমরা অবশ্যই ভালো করতে পারতাম।'
পর্যাপ্ত টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ না খেলাকে অন্যতম প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন সদ্যই আইপিএল খেলে আসা সাকিব আল হাসানও। তবে টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে অভিজ্ঞতম এ বাংলাদেশি ক্রিকেটারের ধারণা, 'পাওয়ার হিটিংয়ে আমরা দুর্বল। এটাও টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থতার আরেকটি কারণ।' ২০ ওভারের ক্রিকেটে তুলে মারার একটা দাবি আছে। সে দাবি পূরণের মতো ক্রিকেটার বাংলাদেশ দলে খুব বেশি নেই। বিশেষ করে গত এক-দেড় বছরে ওয়ানডে সাফল্য এলেও স্লগ ওভারে ব্যাটিং ব্যর্থতা আড়াল করতে পারেনি বাংলাদেশ। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে তো এখনো বাংলাদেশের জন্য অসমাপ্ত 'পাজল'ই হয়ে আছে! তাই টোয়েন্টি টোয়েন্টির প্রথম বল থেকে আক্রমণে যেতে গিয়ে উল্টো উইকেট খুইয়ে বসছে বাংলাদেশ। যা দেখেশুনে পাওয়ার হিটিং চিন্তা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার অনুরোধ শিষ্যদের করেছেন জাতীয় দলের কোচ স্টুয়ার্ট ল, 'আমি চাই ছেলেরা স্মার্ট ক্রিকেট খেলুক।' হতে পারে যে বাংলাদেশকে দেখেই তাঁর মনে হয়েছে, 'টোয়েন্টি টোয়েন্টি মানেই চার-ছক্কা না। সঠিক ক্রিকেট খেলেও জেতার পথ তৈরি করা যায়। আমার মনে হয় এটা ব্যাটসম্যানদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। জোরে বল মারলেই হলো না। গ্যাপে খেলতে হবে। স্মার্ট ক্রিকেট যাকে বলে। ওয়ানডেতেও তাই। ফিল্ডিংটা হতে হবে বিশ্বমানের। বোলিংয়ে সঠিক বৈচিত্র্য থাকতে হবে। প্রস্তুতি ম্যাচগুলোয় এভাবে খেলার চেষ্টা হয়েছে। খেলোয়াড়রা সাড়াও দিচ্ছে।'
তবে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ব্যর্থতার পেছনে অভিজ্ঞতার ঘাটতির কথা বলেছেন স্টুয়ার্ট লও। তবে এক রাতের ব্যবধানে তো আর কিছু করার নেই। আগামী বছর শ্রীলঙ্কায় টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে। যে আসরের প্রস্তুতির একটা পরিকল্পনা তিনি ঠিকও করে ফেলেছেন, 'টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে এক বছরও বাকি নেই। তার আগে টোয়েন্টি টোয়েন্টি কিভাবে খেলতে হয়, সে ধারণা নেওয়া জরুরি। পাঁচ বছরে ১৬টা ম্যাচ দিয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই। তাই টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ আরো বেশি খেলার সুযোগ পেলে ভালো হয়। সেটা ত্রিদেশীয় সিরিজও হতে পারে। বিশ্বের বড় দলগুলোর বাইরে আয়ারল্যান্ড এবং হল্যান্ড টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ভালো খেলছে। বিশ্বকাপের আগে বড় দলের পাশাপাশি এদের সঙ্গে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে পারলে ভালো হবে।'
ক্রিকেটের ভালো-মন্দ বোঝার লোকের অভাব নেই বাংলাদেশে। কিন্তু সমস্যা হলো, উন্নতির জন্য বহুল আলোচিত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হয় না। তাই দুই মৌসুম পরই বন্ধ হয়ে যায় করপোরেট টোয়েন্টি টোয়েন্টি লিগ। এ ফরম্যাটের উপযোগী ক্রিকেটার তৈরির কোনো চেষ্টাও নেই। চর্চার অভাবে সবচেয়ে অর্থকরী এ ক্রিকেট নিয়ে তাই এখনো অন্ধকারে বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.