বাবা-মায়ের হৃদয়হীনতাই কেড়ে নিল হৃদিতাকে by পারভেজ খান
তোমরা মরো না কেন? মরতে পারো না? কেমন বাবা-মা তোমরা? আগে তোমরা মরো, নইলে ভালো হও।' সহপাঠী বান্ধবী হারানোর প্রতিক্রিয়ায় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই বলল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক ছাত্রী। গত রবিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিরোধের কারণে পৃথক থাকা বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে তারই সহপাঠী সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী হিদান মেহজাবিন হৃদিতা। গতকাল সোমবার সকালে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় বেশ কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে। সকালের শিফটের স্কুল শেষে বাসায় ফিরছিল তারা। হৃদিতাও ছিল সকালের শিফটের ছাত্রী। দিবা শিফটেরও অনেকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
তবে তারা হৃদিতাকে তেমন একটা চিনত না। কিন্তু পরশু টেলিভিশন দেখে আর কালকের পত্রিকা পড়ে সবাই জেনে গেছে, তারা হারাল একজন সহপাঠীকে। তাদের ভাষায়, এটা বড় বেশি কষ্টের। একজন তো এভাবেই বলল, 'আংকেল, এই কষ্ট তো আপনারা বুঝবেন না। আপনারা বড়। আপনারা একজন আরেকজনের সঙ্গে মেশেন স্বার্থ নিয়ে। পরিবারেও আপনারা নিজেদের স্বাথ খোঁজেন। নিজেদের বড় করে দেখেন। আপনাদের সম্পর্কে স্বার্থ জড়িত থাকে, কিন্তু আমাদের সম্পর্কে স্বার্থ নাই। তাই এই কষ্ট যে কী, তা আপনারা বুঝবেন না।'
গৃহপরিচারিকার হাত ধরে রিকশায় উঠতে যাচ্ছিল এক ছাত্রী। কান্নায় দুই চোখ ফুলে গেছে ওর। জানা গেল, হৃদিতার সহপাঠী আর খুবই কাছের ছিল সে। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। তার কান্নাজড়ানো উচ্চ স্বরে আশপাশের অনেকেই ছুটে আসেন। ওর কথায় উপস্থিত অনেক অভিভাবকের চোখে পানি চলে আসে।
স্কুল ব্যাগটি রিকশার ওপর ছুড়ে দিয়ে মেয়েটি বলতে থাকে, 'তোমরা মরো না কেন? তোমরা মরতে পারো না? তোমরা কি নির্লজ্জ? কেমন বাবা-মা তোমরা? শুধুই নিজেদের স্বার্থটাকে বড় করে দেখো! তোমরা নিজেদের বিরোধের ঝাল মেটাও আমাদের ওপর। নিজেরা ঝগড়া করে হৃদিতার বাবা-মা আলাদা থাকত। এটা কি শুধুই ওদের নিজস্ব ব্যাপার? পরিবারের আর কোনো সদস্য বা সন্তানের কথা কি একবারও মাথায় আসে না? হৃদিতা কোন অপরাধে আলদা থাকবে? তার কী অপরাধ? সে কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে? বাবার সঙ্গে সে কেন টেলিফোনে কথা বলতে পারবে না? এই অধিকারটুকুও কি ওর নাই? নাই যদি থাকবে তবে জন্মের পর গলাটিপে মেরে ফেলেনি কেন? আমরা কি তোমাদের কাছে খেলার পুতুল? তোমরা আমাদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবা, এ অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে?'....কাঁদতে কাঁদতে একনাগাড়ে কথাগুলো বলার পর থেমে গেল মেয়েটি। পরে আস্তে করে বলল, 'স্যরি'।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রথমে রাজি হলেন না। বললেন, "কী লাভ এগুলো লিখে? লেখালেখি তো কম হচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী হচ্ছে? অনেক গোলটেবিল সেমিনার হয়েছে, হচ্ছে। কালের কণ্ঠ পত্রিকায়ও ঢাউস একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল_'আর নয় আত্মহত্যা'। তাতে কী হয়েছে? এরপর কি আর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি ?"
প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পরে কথায় কথায় অনেক কথাই বললেন তিনি। অনুরোধ করলেন নাম প্রকাশ না করতে।
তিনি বললেন, মেয়েদের স্কুল বলে কথা। লেখাপড়ার বাইরেও মেয়েদের সঙ্গে অনেক কথা হয় তাঁদের। অনেক ছাত্রীকেই আদর করতে গেলে দেখা যায়, ওরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। খবর নিয়ে জানা যায়, কর্ম সময়ের বাইরেও তাদের বাবা-মা নিজেদের এত বেশি ব্যস্ত রাখেন যে সন্তানদের আদর করার সময়টুকুও পান না। আর সন্তানরা সব সময়ই আদর আর ভালোবাসার কাঙাল। দাম্পত্য বিরোধ আছে অনেক পরিববারেই। এসব পরিবার থেকে আসা ছাত্রীরা একটু আদর-স্নেহ পেলেই শিক্ষকদের কাছে খুলে বলে তাদের সেসব কষ্টের কথা। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে তারা।
হৃদিতা প্রসঙ্গে এই শিক্ষিকা বলেন, 'প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে ভুগত মেয়েটা। কিন্তু কাউকে খুব একটা টের পেতে দিত না। সহকর্মীর মেয়ে হওয়ায় ওর প্রতি মায়া যেন আরেকটু বেশি হতো। কখনো স্কুলে দেখা হলে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাস করতাম, কেমন আছিস? আমার শরীরে মাথা এলিয়ে দিত সে। যেন আরেকটু আদর চাইত। দেখতাম, চোখ ছলছল করে উঠত ওর। তখন বুঝতে পারিনি যে মেয়েটা ওর পরিবারের ভালোবাসা থেকে এতটা বঞ্চিত। এখন খুবই খারাপ লাগছে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে, কেন মেয়েটাকে আরো বেশি আদর করিনি। বেশি আদর পেলে সে হয়তো তার কষ্টের কথা শেয়ার করত। এতে আমিও তাকে কাউন্সেলিং করতে পারতাম। আর এ কারণে তাকে হয়তোবা এভাবে হারাতেও হতো না।' শিক্ষিকা আরো বললেন, 'এ ঘটনার জন্য মূলত ওর বাবা-মা দুজনই দায়ী। আসলে সন্তানদের নিয়ে সব বাবা-মায়েরই আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত।'
স্কুলের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি এর চেয়ে বড় শোক আর কিছু হতে পারে না। একজন অবুঝ শিশুর এভাবে, এই বয়সে বিদায় কখনোই স্বাভাবিক মস্তিষ্কে মেনে নেওয়া যায় না।'
স্কুলের আরেক শিক্ষিকা কানিজ ফাতেমা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, হৃদিতার মা ফাতেমা তাঁর সহকর্মী। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ঘটনার দিন তিনি স্কুলেও এসেছিলেন। প্রতিদিন হৃদিতাকে সঙ্গে আনতেন। কিন্তু ওইদিন কোনো কারণে তাকে বাসায় রেখে আসেন। ফাতেমা থাকতেন তাঁর বাবার বাসার দোতলায়। হৃদিতার নানি থাকতেন তিন তলায়। ওই দিন ফাতেমা মেয়ে হৃদিতাকে দোতলায় ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে আসেন। অবশ্য তিন তলায় নানির কাছেও চাবি থাকত। এরপর সকালে খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান।
এ ঘটনার জন্য দাম্পত্য বিরোধকে দায়ী করে তিনি বলেন, মেয়েটা এতটাই অভাগী যে মৃত্যুর পরও বাবার স্পর্শ পেল না। তার কবরেও মাটি দিতে আসেনি বাবা। তিনি নাকি আরেকটি বিয়েও করেছেন। এ ধরনের বাবার শাস্তি হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মোহাম্মদপুরের টিক্কাপড়ায় নানার বাসায় থাকত হৃদিতা। পরিবারের একাধিক সূত্র জানায়, বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা নিয়ে ঘটনার আগের রাতে এবং ওই দিন সকালেও মায়ের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় হৃদিতার। কেউ কেউ বলেন, তাকে মারধরও করা হতো। ফাতেমা চাইতেন না, হৃদিতা তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুুক। আর হৃদিতা চাইত তার বাবা-মা আবার এক হয়ে যাক। একমাত্র সন্তান ছিল সে। প্রায়ই এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তর্ক করত সে।
এ ঘটনায় পাগলপ্রায় হৃদিতার মা ফাতেমা সুলতানা চৌধুরী ঘটনার দিন মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ওকে মারধর করা হতো না। বড় আদরের ছিল সে। তার দিকে তাকিয়েই তো তিনি স্বামী থেকে পৃথক থাকতেন। তবে তিনি চাইতেন না হৃদিতা তার নষ্ট চরিত্রের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি এটা চেয়েছিলেন। এ ধরনের একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে সন্তান রেখে যে পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে, সে কখনোই সন্তানের মঙ্গল চাইতে পারে না। এ মৃত্যুর জন্য তিনি তাঁর স্বামীকেই দায়ী করেন।
ওই দিন হৃদিতাকে স্কুলে না নিয়ে যাওয়া আর ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, রবিবার আসলে ওর তেমন প্রয়োজনীয় ক্লাস ছিল না। তা ছাড়া সকালে ওর তৈরি হতেও দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিছুটা অসুস্থও ছিল সে। এ কারণেই ওকে বাসায় রেখে আসা হয়। বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হয় মূলত নিরাপত্তার কারণে।
গতকাল হৃদিতার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃদিতাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বইছে কান্নার রোল। তার নানা ও নানি অনেকটা নির্বাক।
হৃদিতার নানা সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওদের ১৭ বছরের সংসারের ফসল ছিল হৃদিতা। কিন্তু জামাতা আলিমুজ্জামান লোভী প্রকৃতির। তাকে অনেকবার টাকা দেওয়া হয়েছে। হৃদিতার মা স্বর্ণালংকার বিক্রি করেও টাকা দিয়েছে। কিন্তু তার চাওয়ার শেষ ছিল না। এগুলো নিয়েই দাম্পত্য বিরোধ। ওরা আগে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে থাকত। পৃথক হওয়ার পর এখানে এসে ওঠে।
তিনি আরো বলেন, হৃদিতা মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত চেয়েছে তার বাবা-মা মিলে যাক। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। বাবা ওকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু হৃদিতার একটাই কথা, সে ভিন্ন হয়ে কারো কাছে থাকবে না। এটা নিয়েও বাবা তাকে টেলিফোনে কয়েক দিন ধরে বকাবকি করে আসছিল। এ কারণে হৃদিতা তাঁদের আগেও বলেছিল, এ রকম চলতে থাকলে সে নিজেই দুনিয়া থেকে চলে যাবে, তবুও বাবা-মা ছাড়া থাকবে না। এটিই তাঁর আদরের নাতিনির এভাবে চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ বলে মনে করেন তিনি।
হৃদিতার বাবা হোমিও চিকিৎসক আলিমুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, হৃদিতার মৃত্যুর জন্য ওর মায়ের একগুঁয়েমি আর মিথ্যা ধারণাই দায়ী। মায়ের স্বেচ্ছাচারিতা আর অবহেলার জন্যই মেয়েটা এভাবে চলে গেছে। তিনি আর বিয়ে করেননি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। মিথ্যা মামলা করে তাঁকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে, আর এ কারণেই তিনি হৃদিতার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন না বলে জানান।
গৃহপরিচারিকার হাত ধরে রিকশায় উঠতে যাচ্ছিল এক ছাত্রী। কান্নায় দুই চোখ ফুলে গেছে ওর। জানা গেল, হৃদিতার সহপাঠী আর খুবই কাছের ছিল সে। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। তার কান্নাজড়ানো উচ্চ স্বরে আশপাশের অনেকেই ছুটে আসেন। ওর কথায় উপস্থিত অনেক অভিভাবকের চোখে পানি চলে আসে।
স্কুল ব্যাগটি রিকশার ওপর ছুড়ে দিয়ে মেয়েটি বলতে থাকে, 'তোমরা মরো না কেন? তোমরা মরতে পারো না? তোমরা কি নির্লজ্জ? কেমন বাবা-মা তোমরা? শুধুই নিজেদের স্বার্থটাকে বড় করে দেখো! তোমরা নিজেদের বিরোধের ঝাল মেটাও আমাদের ওপর। নিজেরা ঝগড়া করে হৃদিতার বাবা-মা আলাদা থাকত। এটা কি শুধুই ওদের নিজস্ব ব্যাপার? পরিবারের আর কোনো সদস্য বা সন্তানের কথা কি একবারও মাথায় আসে না? হৃদিতা কোন অপরাধে আলদা থাকবে? তার কী অপরাধ? সে কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে? বাবার সঙ্গে সে কেন টেলিফোনে কথা বলতে পারবে না? এই অধিকারটুকুও কি ওর নাই? নাই যদি থাকবে তবে জন্মের পর গলাটিপে মেরে ফেলেনি কেন? আমরা কি তোমাদের কাছে খেলার পুতুল? তোমরা আমাদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবা, এ অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে?'....কাঁদতে কাঁদতে একনাগাড়ে কথাগুলো বলার পর থেমে গেল মেয়েটি। পরে আস্তে করে বলল, 'স্যরি'।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রথমে রাজি হলেন না। বললেন, "কী লাভ এগুলো লিখে? লেখালেখি তো কম হচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী হচ্ছে? অনেক গোলটেবিল সেমিনার হয়েছে, হচ্ছে। কালের কণ্ঠ পত্রিকায়ও ঢাউস একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল_'আর নয় আত্মহত্যা'। তাতে কী হয়েছে? এরপর কি আর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি ?"
প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পরে কথায় কথায় অনেক কথাই বললেন তিনি। অনুরোধ করলেন নাম প্রকাশ না করতে।
তিনি বললেন, মেয়েদের স্কুল বলে কথা। লেখাপড়ার বাইরেও মেয়েদের সঙ্গে অনেক কথা হয় তাঁদের। অনেক ছাত্রীকেই আদর করতে গেলে দেখা যায়, ওরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। খবর নিয়ে জানা যায়, কর্ম সময়ের বাইরেও তাদের বাবা-মা নিজেদের এত বেশি ব্যস্ত রাখেন যে সন্তানদের আদর করার সময়টুকুও পান না। আর সন্তানরা সব সময়ই আদর আর ভালোবাসার কাঙাল। দাম্পত্য বিরোধ আছে অনেক পরিববারেই। এসব পরিবার থেকে আসা ছাত্রীরা একটু আদর-স্নেহ পেলেই শিক্ষকদের কাছে খুলে বলে তাদের সেসব কষ্টের কথা। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে তারা।
হৃদিতা প্রসঙ্গে এই শিক্ষিকা বলেন, 'প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে ভুগত মেয়েটা। কিন্তু কাউকে খুব একটা টের পেতে দিত না। সহকর্মীর মেয়ে হওয়ায় ওর প্রতি মায়া যেন আরেকটু বেশি হতো। কখনো স্কুলে দেখা হলে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাস করতাম, কেমন আছিস? আমার শরীরে মাথা এলিয়ে দিত সে। যেন আরেকটু আদর চাইত। দেখতাম, চোখ ছলছল করে উঠত ওর। তখন বুঝতে পারিনি যে মেয়েটা ওর পরিবারের ভালোবাসা থেকে এতটা বঞ্চিত। এখন খুবই খারাপ লাগছে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে, কেন মেয়েটাকে আরো বেশি আদর করিনি। বেশি আদর পেলে সে হয়তো তার কষ্টের কথা শেয়ার করত। এতে আমিও তাকে কাউন্সেলিং করতে পারতাম। আর এ কারণে তাকে হয়তোবা এভাবে হারাতেও হতো না।' শিক্ষিকা আরো বললেন, 'এ ঘটনার জন্য মূলত ওর বাবা-মা দুজনই দায়ী। আসলে সন্তানদের নিয়ে সব বাবা-মায়েরই আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত।'
স্কুলের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি এর চেয়ে বড় শোক আর কিছু হতে পারে না। একজন অবুঝ শিশুর এভাবে, এই বয়সে বিদায় কখনোই স্বাভাবিক মস্তিষ্কে মেনে নেওয়া যায় না।'
স্কুলের আরেক শিক্ষিকা কানিজ ফাতেমা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, হৃদিতার মা ফাতেমা তাঁর সহকর্মী। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ঘটনার দিন তিনি স্কুলেও এসেছিলেন। প্রতিদিন হৃদিতাকে সঙ্গে আনতেন। কিন্তু ওইদিন কোনো কারণে তাকে বাসায় রেখে আসেন। ফাতেমা থাকতেন তাঁর বাবার বাসার দোতলায়। হৃদিতার নানি থাকতেন তিন তলায়। ওই দিন ফাতেমা মেয়ে হৃদিতাকে দোতলায় ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে আসেন। অবশ্য তিন তলায় নানির কাছেও চাবি থাকত। এরপর সকালে খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান।
এ ঘটনার জন্য দাম্পত্য বিরোধকে দায়ী করে তিনি বলেন, মেয়েটা এতটাই অভাগী যে মৃত্যুর পরও বাবার স্পর্শ পেল না। তার কবরেও মাটি দিতে আসেনি বাবা। তিনি নাকি আরেকটি বিয়েও করেছেন। এ ধরনের বাবার শাস্তি হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মোহাম্মদপুরের টিক্কাপড়ায় নানার বাসায় থাকত হৃদিতা। পরিবারের একাধিক সূত্র জানায়, বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা নিয়ে ঘটনার আগের রাতে এবং ওই দিন সকালেও মায়ের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় হৃদিতার। কেউ কেউ বলেন, তাকে মারধরও করা হতো। ফাতেমা চাইতেন না, হৃদিতা তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুুক। আর হৃদিতা চাইত তার বাবা-মা আবার এক হয়ে যাক। একমাত্র সন্তান ছিল সে। প্রায়ই এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তর্ক করত সে।
এ ঘটনায় পাগলপ্রায় হৃদিতার মা ফাতেমা সুলতানা চৌধুরী ঘটনার দিন মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ওকে মারধর করা হতো না। বড় আদরের ছিল সে। তার দিকে তাকিয়েই তো তিনি স্বামী থেকে পৃথক থাকতেন। তবে তিনি চাইতেন না হৃদিতা তার নষ্ট চরিত্রের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি এটা চেয়েছিলেন। এ ধরনের একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে সন্তান রেখে যে পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে, সে কখনোই সন্তানের মঙ্গল চাইতে পারে না। এ মৃত্যুর জন্য তিনি তাঁর স্বামীকেই দায়ী করেন।
ওই দিন হৃদিতাকে স্কুলে না নিয়ে যাওয়া আর ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, রবিবার আসলে ওর তেমন প্রয়োজনীয় ক্লাস ছিল না। তা ছাড়া সকালে ওর তৈরি হতেও দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিছুটা অসুস্থও ছিল সে। এ কারণেই ওকে বাসায় রেখে আসা হয়। বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হয় মূলত নিরাপত্তার কারণে।
গতকাল হৃদিতার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃদিতাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বইছে কান্নার রোল। তার নানা ও নানি অনেকটা নির্বাক।
হৃদিতার নানা সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওদের ১৭ বছরের সংসারের ফসল ছিল হৃদিতা। কিন্তু জামাতা আলিমুজ্জামান লোভী প্রকৃতির। তাকে অনেকবার টাকা দেওয়া হয়েছে। হৃদিতার মা স্বর্ণালংকার বিক্রি করেও টাকা দিয়েছে। কিন্তু তার চাওয়ার শেষ ছিল না। এগুলো নিয়েই দাম্পত্য বিরোধ। ওরা আগে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে থাকত। পৃথক হওয়ার পর এখানে এসে ওঠে।
তিনি আরো বলেন, হৃদিতা মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত চেয়েছে তার বাবা-মা মিলে যাক। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। বাবা ওকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু হৃদিতার একটাই কথা, সে ভিন্ন হয়ে কারো কাছে থাকবে না। এটা নিয়েও বাবা তাকে টেলিফোনে কয়েক দিন ধরে বকাবকি করে আসছিল। এ কারণে হৃদিতা তাঁদের আগেও বলেছিল, এ রকম চলতে থাকলে সে নিজেই দুনিয়া থেকে চলে যাবে, তবুও বাবা-মা ছাড়া থাকবে না। এটিই তাঁর আদরের নাতিনির এভাবে চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ বলে মনে করেন তিনি।
হৃদিতার বাবা হোমিও চিকিৎসক আলিমুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, হৃদিতার মৃত্যুর জন্য ওর মায়ের একগুঁয়েমি আর মিথ্যা ধারণাই দায়ী। মায়ের স্বেচ্ছাচারিতা আর অবহেলার জন্যই মেয়েটা এভাবে চলে গেছে। তিনি আর বিয়ে করেননি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। মিথ্যা মামলা করে তাঁকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে, আর এ কারণেই তিনি হৃদিতার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন না বলে জানান।
No comments