আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধ এবং বিএনপি by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
বেগম খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, আবার দিন এসেছে যখন একটি সরকারের পতন ঘটানো জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এবং তিনি ধরেই নিয়েছেন যে এই আন্দোলনে তাঁর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নেতৃত্ব দেবে। বিরোধীদলীয় নেত্রীর এই মনোভাব শুধু ভুলই নয়, আমাদের সবার জন্য ক্ষতিকরও বটে। ভুল এই জন্য যে বিএনপি এখনো এমন কোনো দৃঢ় অবস্থানে ফিরে আসেনি, যে অবস্থান থেকে সে দেশে একটি আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে অধ্যায়টি আমরা জাতি হিসেবে দেখেছি এবং যার মধ্য দিয়ে আমরা পার হয়েছি, তা এখনো বাঙালি জাতির জন্য একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেছে। এবং সেটা এই জন্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পরিচালিত সরকার সবচেয়ে অযোগ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন হিসেবে স্থান দখল করে আছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, বেগম জিয়া ও তাঁর দলীয় সহকর্মীরা বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছরেও এই সত্যটি স্বীকার করে নিতে পারেননি। আধুনিক জগতে প্রচুর উদাহরণ রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর নিজেদের পুনরায় আবিষ্কার করেছে আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে। একটি দেশের মানুষ কেন একটি দলকে পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচনের মাধ্যমে দেয় না তার অনেকগুলো কারণ থাকে। বিএনপির বেলায়ও ওই কারণগুলো ছিল। সেই কারণগুলো অবশ্যই দলীয় নেতারা এড়িয়ে গেছেন। তাঁরা বরাবরই জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে কোনো বিশেষ ষড়যন্ত্রমূলক উপায়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
যে দল, যেসব নেতা নিজেদের অতীতের ভুল স্বীকার করতে অক্ষম এবং এই সত্যটি মানতে রাজি নয় যে তাদের ভুল ও দুর্নীতির ফলেই আজ তাদের এই পরিণতি, সেই দল ও নেতৃত্ব কখনো কোনো আন্দালন গড়ে তুলতে পারে না। আর বিএনপির ইতিহাস কখনো আন্দোলনের কথা বলে না এবং স্বাভাবিক কারণেই। এই দলটি বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসকের ছত্রচ্ছায়ায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে সেই সত্তর দশকের শেষভাগে। যেমনটি গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানে আইয়ুব খানের অধীনে কনভেনশন মুসলিম লীগ। আপনি এখন হয়তো বলতে চাইবেন, বিএনপি আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনে কিন্তু মুখ্য ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগ ও দেশের অসাম্প্রদায়িক দলের। এসব দল মাঠে না থাকলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। অতএব, এখন যখন বিএনপির নেত্রী আন্দোলনের কথা বলেন, তখন আমাদের বিস্মিত হতে হয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দুঃখ পেতে হয় এই কারণে যে তিনি ও তাঁর দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই ভুলগুলো দিনের পর দিন করে গেছেন। যে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন তাঁদের দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে, সেই ভুল, সেই দুর্নীতির জন্য তাঁরা আজ পর্যন্ত অনুতপ্ত নয়। এবং নয় বলেই আমাদের ধরে নিতে হচ্ছে যে, যদি কোনো উপায়ে বিএনপি আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সেই একই ভুল একই দুর্নীতি আবার সে করে যাবে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি কখনো আন্দোলনের জন্ম দেয় না।
আর আন্দোলন তো সেই সরকারের বিরুদ্ধে হয়, যে সরকার নির্বাচনবহির্ভূত পন্থায় ক্ষমতা দখল করে নেয়। এ ধরনের আন্দোলনে আমরা নেমেছিলাম ষাটের দশকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এবং আশির দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, আবার আন্দোলন গড়ে ওঠে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেও, যখন সেই নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকে। সে ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনের পরপর। আর গোটা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আন্দোলনে নেমেছিল দেশের মানুষ শুধু এই কারণে যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে নিজেদের উন্নতি সাধনে ব্যস্ত ছিল। ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল না, ছিল তাঁর পুত্রের হাতেও। দেশে অগণিত খাম্বা দাঁড় করানো হয়। অগণিত মানুষ রাতারাতি ধনী শ্রেণীর সদস্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে দিনের পর দিন চলেছে গণগ্রেপ্তার। প্রত্যেক নাগরিককে অপমান করা হয়েছে। ২০০১-এর নির্বাচনের পরপর যে উল্লাসের সঙ্গে বিএনপির সমর্থকেরা বিরোধী দল ও দেশের সংখ্যালঘু মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাস কোনো সচেতন বাঙালি ভুলবে না। আরও ভুলবে না কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে বিচারপতি আজিজ দ্বারা একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। ওই যে ভুয়া ভোটার? সেই জালিয়াতি কে ভুলবে? দেশের সংবিধানে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলো বিএনপির নেতৃত্ব দ্বারাই ঘটানো হয়েছে। শুরু করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর বিগত বিএনপি আমলে চেষ্টা চালানো হয় কী করে সংবিধানে ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ সরিয়ে দিয়ে একটি মিথ্যা ও বিকৃত দলিলের অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়।
এসব কারণেই বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ পক্ষে নেমেছিল। আন্দোলন হয়েছিল। এখন আমরা ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা-সমর্থিত সরকারের যতই সমালোচনা করি না কেন, প্রকৃত সত্য হলো, যদি সেই জানুয়ারি ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে না সরানো হতো, বাংলাদেশে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতো। বর্তমানে বাঙালি জাতি যে খুব একটা ভালো সময় অতিবাহিত করছে সে কথা হলফ করে বলা যায় না। আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কথা বেশি বলেন, কাজ কম করেন। কিন্তু এই বর্তমান সরকার যে ১৯৭১-এর মূল্যবোধে বিশ্বাস করে এবং তার যে তৃণমূলে শিকড় রয়েছে, তার উদ্দেশ্য যে ভালো এবং দেশের জন্য কল্যাণকর, সেই সত্যকে আমরা অস্বীকার করব কেমন করে? আর দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি, যার কারণে সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে বা ওঠা প্রয়োজন।
কথা বাড়ানো উচিত হবে না। তবে বেগম জিয়া যুদ্ধপরাধীদের বিচার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের এখন মন্তব্য করতে হয়। তিনি সেই বিচার মেনে নিতে রাজি আছেন তবে সর্বপ্রথম, তাঁর ভাষায়, আওয়ামী লীগের ভেতরে যেসব যুদ্ধাপরাধী রয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি এ রকম মন্তব্য করতে পারেন না, বিশেষ করে যখন তাঁর নিজের দল ও সরকারের অভ্যন্তরে বাংলাদেশবিরোধী ব্যক্তিদের সংখ্যা প্রচুর ও প্রকাণ্ডভাবে আমরা দেখেছি। বাঙালি সেই দিন লজ্জিত হয়, যেদিন জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ ও দেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কোণঠাসা করার জন্য বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী তথাকথিত বামপন্থী ও ১৯৭১-এ পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর ডানপন্থী সমর্থকদের জায়গা করে দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া তাঁর আমলে এসব বাংলাদেশবিরোধী মানুষকে একেবারে বাংলাদেশ সরকারে মন্ত্রীর স্থান দিয়ে দিলেন। বিএনপির রাজনীতির ফলে আমরা বাঙালিরা পদে পদে অপমানিত হয়েছি। জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো একটি অসত্য ও ইতিহাসবিরোধী মতবাদ প্রচলনের মধ্য দিয়ে। এখন বেগম জিয়া বর্তমান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন, তারা যেন জাতিকে বিভক্ত না করে। অদ্ভুত সুন্দর কথা। আপনার অনুসারীরাই তো দেশকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিভক্ত করেছিলেন। এখন যে ইতিহাস, যে ঐতিহ্য আমরা পুনরায় ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি, তার উদ্দেশ্য একটাই—বাঙালি জাতিকে আবার আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বের এই মুহূর্তে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনা। রাজনৈতিক ক্রোধ ও অসত্যনির্ভর হলে শুধু নিজেদের বেলায়ই নয়, গোটা দেশে একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বিএনপি তো একাধিকবার ক্ষমতা ভোগ করেছে। তবে দলের নেতা-নেত্রীর আচার-আচরণ এমন হয় কেন? বেগম জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব নিরাপদ নয়। আপনাকে অবাক হতে হয়, নয়তো হেসে ফেলতে হয়। যে দল দেশ স্বাধীন করেছে, সেই দল দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেবে? এই কি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আচরণ? ক্ষমতায় থাকলে ভালো থাকবেন আর নির্বাচনে পরাজিত হলে দিশেহারা হয়ে যাবেন—এমনটি কেন হবে?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
যে দল, যেসব নেতা নিজেদের অতীতের ভুল স্বীকার করতে অক্ষম এবং এই সত্যটি মানতে রাজি নয় যে তাদের ভুল ও দুর্নীতির ফলেই আজ তাদের এই পরিণতি, সেই দল ও নেতৃত্ব কখনো কোনো আন্দালন গড়ে তুলতে পারে না। আর বিএনপির ইতিহাস কখনো আন্দোলনের কথা বলে না এবং স্বাভাবিক কারণেই। এই দলটি বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসকের ছত্রচ্ছায়ায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে সেই সত্তর দশকের শেষভাগে। যেমনটি গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানে আইয়ুব খানের অধীনে কনভেনশন মুসলিম লীগ। আপনি এখন হয়তো বলতে চাইবেন, বিএনপি আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনে কিন্তু মুখ্য ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগ ও দেশের অসাম্প্রদায়িক দলের। এসব দল মাঠে না থাকলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। অতএব, এখন যখন বিএনপির নেত্রী আন্দোলনের কথা বলেন, তখন আমাদের বিস্মিত হতে হয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দুঃখ পেতে হয় এই কারণে যে তিনি ও তাঁর দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই ভুলগুলো দিনের পর দিন করে গেছেন। যে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন তাঁদের দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে, সেই ভুল, সেই দুর্নীতির জন্য তাঁরা আজ পর্যন্ত অনুতপ্ত নয়। এবং নয় বলেই আমাদের ধরে নিতে হচ্ছে যে, যদি কোনো উপায়ে বিএনপি আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সেই একই ভুল একই দুর্নীতি আবার সে করে যাবে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি কখনো আন্দোলনের জন্ম দেয় না।
আর আন্দোলন তো সেই সরকারের বিরুদ্ধে হয়, যে সরকার নির্বাচনবহির্ভূত পন্থায় ক্ষমতা দখল করে নেয়। এ ধরনের আন্দোলনে আমরা নেমেছিলাম ষাটের দশকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এবং আশির দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, আবার আন্দোলন গড়ে ওঠে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেও, যখন সেই নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকে। সে ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনের পরপর। আর গোটা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আন্দোলনে নেমেছিল দেশের মানুষ শুধু এই কারণে যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে নিজেদের উন্নতি সাধনে ব্যস্ত ছিল। ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল না, ছিল তাঁর পুত্রের হাতেও। দেশে অগণিত খাম্বা দাঁড় করানো হয়। অগণিত মানুষ রাতারাতি ধনী শ্রেণীর সদস্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে দিনের পর দিন চলেছে গণগ্রেপ্তার। প্রত্যেক নাগরিককে অপমান করা হয়েছে। ২০০১-এর নির্বাচনের পরপর যে উল্লাসের সঙ্গে বিএনপির সমর্থকেরা বিরোধী দল ও দেশের সংখ্যালঘু মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাস কোনো সচেতন বাঙালি ভুলবে না। আরও ভুলবে না কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে বিচারপতি আজিজ দ্বারা একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। ওই যে ভুয়া ভোটার? সেই জালিয়াতি কে ভুলবে? দেশের সংবিধানে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলো বিএনপির নেতৃত্ব দ্বারাই ঘটানো হয়েছে। শুরু করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর বিগত বিএনপি আমলে চেষ্টা চালানো হয় কী করে সংবিধানে ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ সরিয়ে দিয়ে একটি মিথ্যা ও বিকৃত দলিলের অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়।
এসব কারণেই বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ পক্ষে নেমেছিল। আন্দোলন হয়েছিল। এখন আমরা ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা-সমর্থিত সরকারের যতই সমালোচনা করি না কেন, প্রকৃত সত্য হলো, যদি সেই জানুয়ারি ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে না সরানো হতো, বাংলাদেশে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতো। বর্তমানে বাঙালি জাতি যে খুব একটা ভালো সময় অতিবাহিত করছে সে কথা হলফ করে বলা যায় না। আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কথা বেশি বলেন, কাজ কম করেন। কিন্তু এই বর্তমান সরকার যে ১৯৭১-এর মূল্যবোধে বিশ্বাস করে এবং তার যে তৃণমূলে শিকড় রয়েছে, তার উদ্দেশ্য যে ভালো এবং দেশের জন্য কল্যাণকর, সেই সত্যকে আমরা অস্বীকার করব কেমন করে? আর দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি, যার কারণে সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে বা ওঠা প্রয়োজন।
কথা বাড়ানো উচিত হবে না। তবে বেগম জিয়া যুদ্ধপরাধীদের বিচার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের এখন মন্তব্য করতে হয়। তিনি সেই বিচার মেনে নিতে রাজি আছেন তবে সর্বপ্রথম, তাঁর ভাষায়, আওয়ামী লীগের ভেতরে যেসব যুদ্ধাপরাধী রয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি এ রকম মন্তব্য করতে পারেন না, বিশেষ করে যখন তাঁর নিজের দল ও সরকারের অভ্যন্তরে বাংলাদেশবিরোধী ব্যক্তিদের সংখ্যা প্রচুর ও প্রকাণ্ডভাবে আমরা দেখেছি। বাঙালি সেই দিন লজ্জিত হয়, যেদিন জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ ও দেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কোণঠাসা করার জন্য বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী তথাকথিত বামপন্থী ও ১৯৭১-এ পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর ডানপন্থী সমর্থকদের জায়গা করে দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া তাঁর আমলে এসব বাংলাদেশবিরোধী মানুষকে একেবারে বাংলাদেশ সরকারে মন্ত্রীর স্থান দিয়ে দিলেন। বিএনপির রাজনীতির ফলে আমরা বাঙালিরা পদে পদে অপমানিত হয়েছি। জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো একটি অসত্য ও ইতিহাসবিরোধী মতবাদ প্রচলনের মধ্য দিয়ে। এখন বেগম জিয়া বর্তমান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন, তারা যেন জাতিকে বিভক্ত না করে। অদ্ভুত সুন্দর কথা। আপনার অনুসারীরাই তো দেশকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিভক্ত করেছিলেন। এখন যে ইতিহাস, যে ঐতিহ্য আমরা পুনরায় ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি, তার উদ্দেশ্য একটাই—বাঙালি জাতিকে আবার আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বের এই মুহূর্তে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনা। রাজনৈতিক ক্রোধ ও অসত্যনির্ভর হলে শুধু নিজেদের বেলায়ই নয়, গোটা দেশে একটি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বিএনপি তো একাধিকবার ক্ষমতা ভোগ করেছে। তবে দলের নেতা-নেত্রীর আচার-আচরণ এমন হয় কেন? বেগম জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব নিরাপদ নয়। আপনাকে অবাক হতে হয়, নয়তো হেসে ফেলতে হয়। যে দল দেশ স্বাধীন করেছে, সেই দল দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেবে? এই কি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আচরণ? ক্ষমতায় থাকলে ভালো থাকবেন আর নির্বাচনে পরাজিত হলে দিশেহারা হয়ে যাবেন—এমনটি কেন হবে?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments