বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেটের প্রত্যাশা by মামুন রশীদ
যতই বলা হোক না কেন, বাজেট কিন্তু সামগ্রিকভাবে সম্পদ সৃষ্টি, সঞ্চয় বাড়ানো এবং প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা বা সম্পদের সুষম বণ্টনের মতো বিষয়গুলোর চূড়ান্ত সুরাহা করে না। তবে সরকারের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের দলিল মানে বাজেটের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, সুশাসন, জনপ্রশাসনের জবাবদিহি এবং কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধিমুখী অর্থনৈতিক উত্তরণের এই সময় কী করা উচিত? জবাব হবে, সুশাসন জোরদারকরণের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে সম্পদ সৃষ্টি এবং সম্পদের সমবণ্টন নিশ্চিত করা। তবে নীরবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠা মূল্যস্ফীতি রোধেও সাময়িক বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং দারিদ্র্য বিমোচনে থাকতে হবে সচল ও সজাগ দৃষ্টি। আমাদের উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গ্রহণ করলেই চলবে না, আমাদেরকে প্রয়োজনের নিরিখে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সঠিকভাবে এডিপি গ্রহণ করতে হবে। এর চেয়ে বড় কথা, ‘রণক্ষেত্রের পদক্ষেপের’ মতো অলঙ্ঘনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে; যাতে সময়মতো এডিপি বাস্তবায়িত হয়।
রাজস্ব বাজেটের ক্ষেত্রেও অবশ্যই সম্পদ সৃষ্টি এবং ব্যবসার জন্য নির্বিঘ্ন ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। আমরা অর্থনীতিতে ‘ভর্তুকি যুগের’ অবসান চাই। নেহাত যদি ভর্তুকি দিতেই হয়, তাহলে সেটা শুধু ব্যবসায়িকভাবে ঠেকায় পড়ে যাওয়া বা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থেই প্রয়োজন—এমন গোষ্ঠীকেই দিতে হবে। লোভী, স্বার্থান্বেষী ও সম্পদশালীরা যাতে কোনোভাবেই ভর্তুকি-সুবিধা নিতে না পারেন, সেদিকেও রাখতে হবে সতর্ক নজর। আমরা জোরালো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী চাই। তবে এ কর্মসূচির আওতায় দেওয়া সুবিধা যেন সত্যিকারের দুঃস্থ ও অসহায় মানুষেরাই পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ‘অদক্ষদের’ রক্ষা করতে গিয়ে যেন প্রতিযোগিতায় সক্ষম এবং দেশ-বিদেশের প্রকৃত উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। আমরা কোনোভাবেই আর অদক্ষ উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী এবং কর ফাঁকি দেন—এমন ধরনের উৎপাদকদের সহায়তা দেওয়ার জন্য কর অবকাশ-সুবিধা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতি নই।
দেশে কয়েক বছর ধরেই বাজেটে কালো টাকার মালিকদের তাঁদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা অর্থনীতিতে খুব একটা ভালো ফল বয়ে এনেছে—এমন দাবি করা যাবে না। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৫০ কোটি টাকা সাদা করার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু পাঁচ কোটি টাকা কর আদায় হয়েছে।
সম্প্রতি এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী স্বীকার করে বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিয়ে এখন পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে কেউই এতে সাড়া দেয়নি তেমন।’ অর্থাৎ অপ্রদর্শিত অর্থ অপ্রদর্শিতই থেকে গেছে। তাই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হলো, কালো টাকা সাদা করার প্রণোদনা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অবৈধ উপায়ে তথা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আইনগত বৈধতা দেওয়া উচিত নয়। এ সুযোগ দেওয়া হলে, যাঁরা বৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে সরকারকে ঠিকমতো কর দেন এবং যাঁরা কর দেন না, তাদের উভয়কে সমান সুযোগ দেওয়া হয়ে যায়, যা উচিত নয়। বরং বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার চেয়ে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়ের উৎস বন্ধ করা বেশি জরুরি।
আমরা করের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানোর পদক্ষেপ চাই। বর্তমান ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে করের আওতায় নিয়ে করের পরিধি বাড়ানো হয়। আগামী ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটেও এ ধরনের আরও অনেক ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় নিয়ে আসা উচিত এবং এটি খুব সহজেই সম্ভব বলে মনে করি। একটি উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যেমন, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস) যেখানে ৬২ হাজার কোম্পানি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন রয়েছে, সেখানে মাত্র ছয় হাজারটির আয়কর রিটার্ন দাখিলের রেকর্ড রয়েছে। ব্যাপকভাবে করের আওতা সম্প্রসারণে সরকার বাজেটে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে কর পরিশোধে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত হবে। বদৌলতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে আমরা আশা করি। অর্থনীতির যেসব খাতে পুঁজির সংবর্ধন হচ্ছে, সে খাতগুলোকে করের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। উদাহরণ হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আয় বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, আবাসন খাত, রপ্তানি, বাণিজ্যিক বা বৃহৎ কৃষি ইত্যাদি খাতে কর সম্প্রসারণের যুুক্তি ভেবে দেখা উচিত। দেশের প্রায় ২৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারীর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখেরই করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই বলে জানা যায়। যাঁদের টিআইএন আছে, শোনা যায় যে তাঁদের বেশির ভাগই ভুয়া। সম্পত্তি কেনা-বেচা এবং শুধু উল্লেখযোগ্য স্থানে ফ্ল্যাট বা জায়গা থাকার নিমিত্তে প্রতিদিনই প্রায় নতুন নতুন কোটিপতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁদের সেই সৃষ্ট সম্পদ সীমিত পর্যায়ে হলেও সাধারণ জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উচিত।
তবে শুধু করের আওতা বাড়ালেই হবে না, এর পাশাপাশি যাঁরা কর পরিশোধের ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু এ সম্পর্কে ভালো জানেন না বা হয়রানির ভয়ে পিছিয়ে থাকেন, তাঁদের সচেতন করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে তাঁরা কর পরিশোধে উৎসাহিত হবেন ধারণা করা যায়। কর পরিশোধের বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখাও জরুরি। প্রয়োজন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আকার, আয়তন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিরও। টিআইএন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মধ্যে সমম্বয়সাধনসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টিও ভাবতে হবে।
বাজেটের মূল প্রক্রিয়ায় একটি বাস্তবসম্মত বাজেট বাস্তবায়নের দিকটি অনেকটাই উপেক্ষিত থাকে। যথাযথ বাস্তবায়নের পথ সুগম করার সম্ভাব্য সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো এবং সেটার চারপাশে নিশ্ছিদ্র ব্যূহ তৈরি করা।
এডিপি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কারণ অনেক সময়ই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়ই বহু এডিপি নেওয়া হতো। আবার সময়মতো এডিপি বাস্তবায়নের হারও ছিল নগণ্য। সরকার এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। গত বছর এডিপি অনুমোদনের বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ‘নতুন এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থবছরের শুরু থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে এ জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে এবং সময়মতো অর্থ-ছাড়েরও ব্যবস্থা করা হবে।’ এডিপির আকাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
প্রবাসে অবস্থানরত নাগরিকেরা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে হারে দেশে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আসছেন, তা খুবই সন্তোষজনক। তাঁদের জন্য যদি যথোপযুক্ত সহায়তা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই দেশে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা যায়। এ ব্যাপারে অর্থাৎ প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বাড়াতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আমাদের বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে তাঁরা যাতে উপযুক্ত মজুরি বা পারিশ্রমিক পান, সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এ ক্ষেত্রে নতুন সুবিধা ও প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। দেশের কৃষি-গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো এবং প্রকৃত দুঃস্থদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করার বিষয়ে এত দিনে অনেক কথাই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যা বলার তা হচ্ছে, এক্ষেত্রে বাজেটীয় পদক্ষেপ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ইত্যাদির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়ে জোর দেওয়াও খুব জরুরি।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধিমুখী অর্থনৈতিক উত্তরণের এই সময় কী করা উচিত? জবাব হবে, সুশাসন জোরদারকরণের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে সম্পদ সৃষ্টি এবং সম্পদের সমবণ্টন নিশ্চিত করা। তবে নীরবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠা মূল্যস্ফীতি রোধেও সাময়িক বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং দারিদ্র্য বিমোচনে থাকতে হবে সচল ও সজাগ দৃষ্টি। আমাদের উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গ্রহণ করলেই চলবে না, আমাদেরকে প্রয়োজনের নিরিখে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সঠিকভাবে এডিপি গ্রহণ করতে হবে। এর চেয়ে বড় কথা, ‘রণক্ষেত্রের পদক্ষেপের’ মতো অলঙ্ঘনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে; যাতে সময়মতো এডিপি বাস্তবায়িত হয়।
রাজস্ব বাজেটের ক্ষেত্রেও অবশ্যই সম্পদ সৃষ্টি এবং ব্যবসার জন্য নির্বিঘ্ন ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। আমরা অর্থনীতিতে ‘ভর্তুকি যুগের’ অবসান চাই। নেহাত যদি ভর্তুকি দিতেই হয়, তাহলে সেটা শুধু ব্যবসায়িকভাবে ঠেকায় পড়ে যাওয়া বা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থেই প্রয়োজন—এমন গোষ্ঠীকেই দিতে হবে। লোভী, স্বার্থান্বেষী ও সম্পদশালীরা যাতে কোনোভাবেই ভর্তুকি-সুবিধা নিতে না পারেন, সেদিকেও রাখতে হবে সতর্ক নজর। আমরা জোরালো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী চাই। তবে এ কর্মসূচির আওতায় দেওয়া সুবিধা যেন সত্যিকারের দুঃস্থ ও অসহায় মানুষেরাই পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ‘অদক্ষদের’ রক্ষা করতে গিয়ে যেন প্রতিযোগিতায় সক্ষম এবং দেশ-বিদেশের প্রকৃত উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। আমরা কোনোভাবেই আর অদক্ষ উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী এবং কর ফাঁকি দেন—এমন ধরনের উৎপাদকদের সহায়তা দেওয়ার জন্য কর অবকাশ-সুবিধা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতি নই।
দেশে কয়েক বছর ধরেই বাজেটে কালো টাকার মালিকদের তাঁদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা অর্থনীতিতে খুব একটা ভালো ফল বয়ে এনেছে—এমন দাবি করা যাবে না। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৫০ কোটি টাকা সাদা করার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু পাঁচ কোটি টাকা কর আদায় হয়েছে।
সম্প্রতি এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী স্বীকার করে বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিয়ে এখন পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে কেউই এতে সাড়া দেয়নি তেমন।’ অর্থাৎ অপ্রদর্শিত অর্থ অপ্রদর্শিতই থেকে গেছে। তাই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হলো, কালো টাকা সাদা করার প্রণোদনা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অবৈধ উপায়ে তথা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আইনগত বৈধতা দেওয়া উচিত নয়। এ সুযোগ দেওয়া হলে, যাঁরা বৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে সরকারকে ঠিকমতো কর দেন এবং যাঁরা কর দেন না, তাদের উভয়কে সমান সুযোগ দেওয়া হয়ে যায়, যা উচিত নয়। বরং বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার চেয়ে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়ের উৎস বন্ধ করা বেশি জরুরি।
আমরা করের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানোর পদক্ষেপ চাই। বর্তমান ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে করের আওতায় নিয়ে করের পরিধি বাড়ানো হয়। আগামী ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটেও এ ধরনের আরও অনেক ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় নিয়ে আসা উচিত এবং এটি খুব সহজেই সম্ভব বলে মনে করি। একটি উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যেমন, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস) যেখানে ৬২ হাজার কোম্পানি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন রয়েছে, সেখানে মাত্র ছয় হাজারটির আয়কর রিটার্ন দাখিলের রেকর্ড রয়েছে। ব্যাপকভাবে করের আওতা সম্প্রসারণে সরকার বাজেটে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে কর পরিশোধে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত হবে। বদৌলতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে আমরা আশা করি। অর্থনীতির যেসব খাতে পুঁজির সংবর্ধন হচ্ছে, সে খাতগুলোকে করের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। উদাহরণ হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আয় বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, আবাসন খাত, রপ্তানি, বাণিজ্যিক বা বৃহৎ কৃষি ইত্যাদি খাতে কর সম্প্রসারণের যুুক্তি ভেবে দেখা উচিত। দেশের প্রায় ২৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারীর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখেরই করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই বলে জানা যায়। যাঁদের টিআইএন আছে, শোনা যায় যে তাঁদের বেশির ভাগই ভুয়া। সম্পত্তি কেনা-বেচা এবং শুধু উল্লেখযোগ্য স্থানে ফ্ল্যাট বা জায়গা থাকার নিমিত্তে প্রতিদিনই প্রায় নতুন নতুন কোটিপতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁদের সেই সৃষ্ট সম্পদ সীমিত পর্যায়ে হলেও সাধারণ জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উচিত।
তবে শুধু করের আওতা বাড়ালেই হবে না, এর পাশাপাশি যাঁরা কর পরিশোধের ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু এ সম্পর্কে ভালো জানেন না বা হয়রানির ভয়ে পিছিয়ে থাকেন, তাঁদের সচেতন করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে তাঁরা কর পরিশোধে উৎসাহিত হবেন ধারণা করা যায়। কর পরিশোধের বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখাও জরুরি। প্রয়োজন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আকার, আয়তন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিরও। টিআইএন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মধ্যে সমম্বয়সাধনসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টিও ভাবতে হবে।
বাজেটের মূল প্রক্রিয়ায় একটি বাস্তবসম্মত বাজেট বাস্তবায়নের দিকটি অনেকটাই উপেক্ষিত থাকে। যথাযথ বাস্তবায়নের পথ সুগম করার সম্ভাব্য সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো এবং সেটার চারপাশে নিশ্ছিদ্র ব্যূহ তৈরি করা।
এডিপি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কারণ অনেক সময়ই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়ই বহু এডিপি নেওয়া হতো। আবার সময়মতো এডিপি বাস্তবায়নের হারও ছিল নগণ্য। সরকার এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। গত বছর এডিপি অনুমোদনের বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ‘নতুন এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থবছরের শুরু থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে এ জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে এবং সময়মতো অর্থ-ছাড়েরও ব্যবস্থা করা হবে।’ এডিপির আকাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
প্রবাসে অবস্থানরত নাগরিকেরা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে হারে দেশে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আসছেন, তা খুবই সন্তোষজনক। তাঁদের জন্য যদি যথোপযুক্ত সহায়তা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই দেশে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা যায়। এ ব্যাপারে অর্থাৎ প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বাড়াতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আমাদের বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে তাঁরা যাতে উপযুক্ত মজুরি বা পারিশ্রমিক পান, সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এ ক্ষেত্রে নতুন সুবিধা ও প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। দেশের কৃষি-গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো এবং প্রকৃত দুঃস্থদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করার বিষয়ে এত দিনে অনেক কথাই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যা বলার তা হচ্ছে, এক্ষেত্রে বাজেটীয় পদক্ষেপ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ইত্যাদির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়ে জোর দেওয়াও খুব জরুরি।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments