জয়াসুরিয়ার জন্য দুঃখ
এই বিশ্বকাপে সনাৎ জয়াসুরিয়াকে দেখে আমার যেমন কষ্ট হলো, সবার তা হওয়ার কথা নয়। বোলারদের তো একদমই নয়। বরং জয়াসুরিয়ার দুর্দশা দেখে তাঁদের খুব খুশি হওয়ার কথা। এই লোকটার হাতে কম তো নিগৃহীত হতে হয়নি!
গত পরশু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচটি সম্ভবত সনাৎ জয়াসুরিয়ার শেষ দেখে ফেলল, টেলিভিশনে নিশ্চয়ই তা দেখেছেন মাইক আথারটন। দেখে বিমল আনন্দ পেয়েছেন। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক, ইংল্যান্ডের জয়ে তো আনন্দ পাবেনই। তবে মাইক আথারটনের আনন্দ পাওয়ার আসল কারণ এটা নয়। ১৪ বছর ধরে পুড়তে থাকা একটা জ্বালা যে একটু জুড়াল জয়াসুরিয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কাও ডোবায়।
লিখতে লিখতে ফয়সালাবাদে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালটির পর আথারটনের মুখটা চোখে ভাসছে। প্রেসবক্সের উল্টো দিকে ড্রেসিংরুমের তিনতলার ছাদে প্রেস কনফারেন্স। আথারটনের সঙ্গে ম্যানেজার রে ইলিংওয়ার্থ। দুজনের চোখমুখে হতভম্ব ভাবটা তখনো কাটেনি। যেন একটু আগে যা হয়ে গেল, সেটি সত্যি না বাস্তব বুঝে উঠতে পারছেন না।
যে ছাদে প্রেস কনফারেন্সটা হচ্ছে, জয়াসুরিয়ার তিন ছক্কার একটা সেখানেই এসে পড়েছিল। ৪৪ বলে ৮২ রানের ইনিংসে চার ছিল আরও ১৩টি। অর্থাৎ ৮২ রানের ৭০-ই বাউন্ডারি থেকে। ভিন্ন একটা বিশ্বকাপে আরেকটি শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড খেলা হলো বলেই জয়াসুরিয়ার ওই ইনিংসটা একটু আলাদা করে বললাম। নইলে এমন ইনিংস তো ‘মাতারা হারিকেন’ সকাল-বিকেলও খেলেছেন। ওই ইনিংসটা আরও বেশি আছে আথারটনের ওই হতভম্ব প্রতিক্রিয়ায়। জয়াসুরিয়া-তাণ্ডবে হকচকিত হয়ে ত্রিশ গজে ফিল্ডার সংখ্যার বাধ্যবাধকতার যৌক্তিকতা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছিলেন তিনি।
ভিভ রিচার্ডসকে মাঠে নামতে দেখেই নাকি বোলারদের মুখ শুকিয়ে যেত। রিচার্ডসের ক্যারিশমা জয়াসুরিয়ার কখনোই ছিল না। কিন্তু বোলারদের শিরদাঁড়ায় ভয় ছড়িয়ে দেওয়ায় মাতারার বাঁ-হাতিও রিচার্ডসের চেয়ে খুব একটা কম যেতেন না। জয়াসুরিয়ার সোনার সময়টাতে ভারতকে অনেকবারই পুড়তে হয়েছে তাঁর ব্যাটের আগুনে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা পড়লেই নাকি জাভাগাল শ্রীনাথ বলতেন, ‘এই রে, আবার ওই টাক্কুটার সামনে পড়তে হবে!’
শ্রীনাথদের জন্য যতই আতঙ্ক হোক, দর্শকদের জন্য ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়া সব সময়ই বিনোদনের পসরা। সেই আনন্দ আমিও কম পাইনি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরপরই সিঙ্গাপুরে সিঙ্গার সিরিজ, যেটির নাম হওয়া উচিত আসলে ‘জয়াসুরিয়া সিরিজ’, সেটি কাভার করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই টুর্নামেন্টেই জয়াসুরিয়ার ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি, ৪৮ বলে সেঞ্চুরি। দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা কয়েক মাস পর শহীদ আফ্রিদি ভেঙে দিলেও হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা এখনো অমলিন।
টি-টোয়েন্টির জন্মের অনেক আগে টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং করেছেন। ‘স্লগার’ বলে যাঁরা উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের জবাব দিয়েছেন টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে। কিন্তু একটা জায়গায় যে খুব বড় একটা ভুল করে ফেললেন জয়াসুরিয়া। বয়সকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়ে। তার প্রতিফল—০-৩-৬-৫-০-১।
এসব কী? এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়াসুরিয়ার ছয় ইনিংস! একটা ওভারই বল করেছেন। তাতে দুই ছক্কাসহ ১৫ রান। অবসরে যাওয়ার আদর্শ সময় সম্পর্কে অমর একটা বাণী আছে—তখনই যাওয়া উচিত, যখন লোকে বলবে, কেন যাচ্ছ? জয়াসুরিয়া সেটি ভুলে গিয়ে ‘এখনো যাচ্ছ না কেন’ প্রশ্ন তুলে দিলেন।
জয়াসুরিয়াকে এমন ধুঁকতে দেখে আমার এত দুঃখ লাগার আসল কারণটা এখনো বলিইনি। এত সব কীর্তির পরও ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়া আমার কাছে মানুষ জয়াসুরিয়ার কাছে নিয়মিতই হেরে এসেছে। কত ক্রিকেটারকে দেখেছি, একটা-দুটি সিরিজে একটু সাফল্য পেয়েই চোখ উল্টে ফেলতে। সেখানে এই একজন, সেই ১৯৯৪ সালে প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলেন, এখনো তেমনি। তারকাসুলভ অহমিকা তাঁকে ছুঁতেই পারেনি কখনো। যত বার ইন্টারভিউ করেছি, এই প্রশ্নটা করেছিই। প্রতিবারই পেয়েছি একই উত্তর, ‘আই অ্যাম আ সিম্পল ম্যান। ক্রিকেটটা একটু ভালো খেলি, তাতে বাকি দশজনের চেয়ে এমন কিছু আলাদা হয়ে যাইনি।’
প্রমাণও পেয়েছি কম নয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সফরে একই হোটেলের একই ফ্লোরে আছি। ইন্টারভিউয়ের জন্য যে সময় দিয়েছিলেন, তখন হঠাৎই কী একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে বলে বেরিয়ে যেতে হলো জয়াসুরিয়াকে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘আমি আধঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসছি।’
জয়াসুরিয়া অন্য রকম জানার পরও আমি আশা করিনি, ঠিকই তিনি আধঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসবেন। অনুষ্ঠানের মাঝপথে চলে এসেছেন বলে আবার ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে। ইন্টারভিউ দিতে তাই চলে এলেন আমার রুমেই। অভিভূত আমি যতই এটা নিয়ে কথা বলতে চাই, জয়াসুরিয়া বলেন, ‘এটা এমন বড় কী! এত দিন ধরে আপনাকে চিনি, আপনার রুমে আসতে পারি না?’ আমি শুধু বলেছিলাম, ‘আপনি সনাৎ জয়াসুরিয়া বলেই পারেন।’
এই টি-টোয়েন্টিই যদি সনাৎ জয়াসুরিয়ার শেষ হয়, তা হলে দুঃখ একটা মনে থাকবেই। এমন বিদায় তাঁর প্রাপ্য ছিল না।
গত পরশু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচটি সম্ভবত সনাৎ জয়াসুরিয়ার শেষ দেখে ফেলল, টেলিভিশনে নিশ্চয়ই তা দেখেছেন মাইক আথারটন। দেখে বিমল আনন্দ পেয়েছেন। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক, ইংল্যান্ডের জয়ে তো আনন্দ পাবেনই। তবে মাইক আথারটনের আনন্দ পাওয়ার আসল কারণ এটা নয়। ১৪ বছর ধরে পুড়তে থাকা একটা জ্বালা যে একটু জুড়াল জয়াসুরিয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কাও ডোবায়।
লিখতে লিখতে ফয়সালাবাদে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালটির পর আথারটনের মুখটা চোখে ভাসছে। প্রেসবক্সের উল্টো দিকে ড্রেসিংরুমের তিনতলার ছাদে প্রেস কনফারেন্স। আথারটনের সঙ্গে ম্যানেজার রে ইলিংওয়ার্থ। দুজনের চোখমুখে হতভম্ব ভাবটা তখনো কাটেনি। যেন একটু আগে যা হয়ে গেল, সেটি সত্যি না বাস্তব বুঝে উঠতে পারছেন না।
যে ছাদে প্রেস কনফারেন্সটা হচ্ছে, জয়াসুরিয়ার তিন ছক্কার একটা সেখানেই এসে পড়েছিল। ৪৪ বলে ৮২ রানের ইনিংসে চার ছিল আরও ১৩টি। অর্থাৎ ৮২ রানের ৭০-ই বাউন্ডারি থেকে। ভিন্ন একটা বিশ্বকাপে আরেকটি শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড খেলা হলো বলেই জয়াসুরিয়ার ওই ইনিংসটা একটু আলাদা করে বললাম। নইলে এমন ইনিংস তো ‘মাতারা হারিকেন’ সকাল-বিকেলও খেলেছেন। ওই ইনিংসটা আরও বেশি আছে আথারটনের ওই হতভম্ব প্রতিক্রিয়ায়। জয়াসুরিয়া-তাণ্ডবে হকচকিত হয়ে ত্রিশ গজে ফিল্ডার সংখ্যার বাধ্যবাধকতার যৌক্তিকতা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছিলেন তিনি।
ভিভ রিচার্ডসকে মাঠে নামতে দেখেই নাকি বোলারদের মুখ শুকিয়ে যেত। রিচার্ডসের ক্যারিশমা জয়াসুরিয়ার কখনোই ছিল না। কিন্তু বোলারদের শিরদাঁড়ায় ভয় ছড়িয়ে দেওয়ায় মাতারার বাঁ-হাতিও রিচার্ডসের চেয়ে খুব একটা কম যেতেন না। জয়াসুরিয়ার সোনার সময়টাতে ভারতকে অনেকবারই পুড়তে হয়েছে তাঁর ব্যাটের আগুনে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা পড়লেই নাকি জাভাগাল শ্রীনাথ বলতেন, ‘এই রে, আবার ওই টাক্কুটার সামনে পড়তে হবে!’
শ্রীনাথদের জন্য যতই আতঙ্ক হোক, দর্শকদের জন্য ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়া সব সময়ই বিনোদনের পসরা। সেই আনন্দ আমিও কম পাইনি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরপরই সিঙ্গাপুরে সিঙ্গার সিরিজ, যেটির নাম হওয়া উচিত আসলে ‘জয়াসুরিয়া সিরিজ’, সেটি কাভার করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই টুর্নামেন্টেই জয়াসুরিয়ার ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি, ৪৮ বলে সেঞ্চুরি। দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা কয়েক মাস পর শহীদ আফ্রিদি ভেঙে দিলেও হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা এখনো অমলিন।
টি-টোয়েন্টির জন্মের অনেক আগে টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং করেছেন। ‘স্লগার’ বলে যাঁরা উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের জবাব দিয়েছেন টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে। কিন্তু একটা জায়গায় যে খুব বড় একটা ভুল করে ফেললেন জয়াসুরিয়া। বয়সকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়ে। তার প্রতিফল—০-৩-৬-৫-০-১।
এসব কী? এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়াসুরিয়ার ছয় ইনিংস! একটা ওভারই বল করেছেন। তাতে দুই ছক্কাসহ ১৫ রান। অবসরে যাওয়ার আদর্শ সময় সম্পর্কে অমর একটা বাণী আছে—তখনই যাওয়া উচিত, যখন লোকে বলবে, কেন যাচ্ছ? জয়াসুরিয়া সেটি ভুলে গিয়ে ‘এখনো যাচ্ছ না কেন’ প্রশ্ন তুলে দিলেন।
জয়াসুরিয়াকে এমন ধুঁকতে দেখে আমার এত দুঃখ লাগার আসল কারণটা এখনো বলিইনি। এত সব কীর্তির পরও ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়া আমার কাছে মানুষ জয়াসুরিয়ার কাছে নিয়মিতই হেরে এসেছে। কত ক্রিকেটারকে দেখেছি, একটা-দুটি সিরিজে একটু সাফল্য পেয়েই চোখ উল্টে ফেলতে। সেখানে এই একজন, সেই ১৯৯৪ সালে প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলেন, এখনো তেমনি। তারকাসুলভ অহমিকা তাঁকে ছুঁতেই পারেনি কখনো। যত বার ইন্টারভিউ করেছি, এই প্রশ্নটা করেছিই। প্রতিবারই পেয়েছি একই উত্তর, ‘আই অ্যাম আ সিম্পল ম্যান। ক্রিকেটটা একটু ভালো খেলি, তাতে বাকি দশজনের চেয়ে এমন কিছু আলাদা হয়ে যাইনি।’
প্রমাণও পেয়েছি কম নয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সফরে একই হোটেলের একই ফ্লোরে আছি। ইন্টারভিউয়ের জন্য যে সময় দিয়েছিলেন, তখন হঠাৎই কী একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে বলে বেরিয়ে যেতে হলো জয়াসুরিয়াকে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘আমি আধঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসছি।’
জয়াসুরিয়া অন্য রকম জানার পরও আমি আশা করিনি, ঠিকই তিনি আধঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসবেন। অনুষ্ঠানের মাঝপথে চলে এসেছেন বলে আবার ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে। ইন্টারভিউ দিতে তাই চলে এলেন আমার রুমেই। অভিভূত আমি যতই এটা নিয়ে কথা বলতে চাই, জয়াসুরিয়া বলেন, ‘এটা এমন বড় কী! এত দিন ধরে আপনাকে চিনি, আপনার রুমে আসতে পারি না?’ আমি শুধু বলেছিলাম, ‘আপনি সনাৎ জয়াসুরিয়া বলেই পারেন।’
এই টি-টোয়েন্টিই যদি সনাৎ জয়াসুরিয়ার শেষ হয়, তা হলে দুঃখ একটা মনে থাকবেই। এমন বিদায় তাঁর প্রাপ্য ছিল না।
No comments