ভূগর্ভে কয়লা পুড়িয়ে গ্যাস উৎপাদন কতটা বাস্তবসম্মত by মুশফিকুর রহমান
দেশে বিদ্যুৎ-চাহিদা পূরণে কয়লা ব্যবহার অপরিহার্য—এ বিষয়টি দেরিতে হলেও এখন প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্নভাবে কয়লার চাহিদা পূরণের বিতর্ক শেষে বিশেষজ্ঞ মহলে এ সত্যও স্পষ্ট হয়েছে যে কয়লা আমদানি করে নিকট-ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে না। বিশেষত, বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য উৎপাদন ও সুলভে তা ব্যবহারকারীর জন্য সরবরাহ করতে হলে আমদানিনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ অদূর-ভবিষ্যতের স্বপ্ন হতে পারে মাত্র। প্রতি হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বছরে অন্তত তিন মিলিয়ন টন কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমদানির যে অবকাঠামো ও বন্দর সুবিধা দরকার, তা আমাদের দেশে নেই। এ সুবিধা প্রতিষ্ঠা করতে প্রচুর বিনিয়োগ ও সময় দরকার। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার নির্ধারিত মান ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ জরুরি। কয়লা আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে বেচাকেনা হয়, তাতে বিদ্যমান ক্রয়ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি বাধা হতে বাধ্য। দীর্ঘমেয়াদে (অন্তত পাঁচ বছর আগেই চাহিদার কয়লা কেনা) সরবরাহের ‘সাপ্লাই চেইন’ গড়তে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এ ছাড়া কয়লা নিজে নিজে জ্বলে বলে দীর্ঘ সময় ধরে তা স্তূপ করে রাখাও বিপদ।
মারাত্মক বিদ্যুৎ-সংকট সামাল দিতে ইতিমধ্যে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বেশ কিছু উচ্চ ভাড়া ও সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন-উপযোগী (পিকিং পাওয়ার প্লান্ট) নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি গ্যাসের সংকটে বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দ্বৈত জ্বালানিনির্ভর (ডুয়েল ফুয়েল) বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের চেষ্টা হচ্ছে এবং নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রধানত আমদানিনির্ভর তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গড়া হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারের ব্যয় বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও অব্যাহত হারে বাড়ছে। এ কারণে গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া জ্বালানির জন্য ভর্তুকির চাপ সরকারের জন্য সামলানো কঠিন। বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামাজনিত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাও এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে (প্রথম আলো ৪ মে ২০১০) যে লোডশেডিং মোকাবিলায় বর্ধিত হারে জেনারেটর ব্যবহারের কারণে দিনে পাঁচ কোটি টাকার ডিজেল তেল বেশি লাগছে। সরকার প্রতি ব্যারেল ডিজেল ৯৩ মার্কিন ডলার দরে আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে তা ভোক্তাসাধারণকে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গ্যাস-সংকটের কারণে সরকারি যানবাহন চালানোর জন্য সিএনজি থেকে আবার জ্বালানি তেল ব্যবহারে ফিরে যাওয়ার কথা হচ্ছে। এতে বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে কেবল তেল কিনতে।
এ পরিস্থিতি বিবেচনায় সুস্থ চিন্তার সব মানুষই দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রমাণিত মজুদ কয়লা দ্রুত উত্তোলন ও ব্যবহারের কথা বলছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ কেউ অব্যাহতভাবে কয়লা তোলার প্রক্রিয়াকে ক্লান্তিহীন বিতর্কের উপাদান করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভূগর্ভস্থ কয়লাখনি (অন্তত স্বল্প গভীরতার কয়লাক্ষেত্র বড়পুকুরিয়ায়) আর্থকারিগরি বিবেচনায় অকার্যকর হলেও উচ্চসুদে ধার করা টাকায় সেখানে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করতে এসব বিতর্কপ্রিয় গবেষকদের সমস্যা হয়নি। একই সঙ্গে তাঁরা দেশে ভূগর্ভস্থ কয়লাখনিই যে ‘উত্তম ও পরিবেশবান্ধব’ সে কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে এসেছেন। বলাই বাহুল্য, এ জাতীয় অনুসিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অতি পুরু স্তরের স্বল্প গভীরতার কয়লাক্ষেত্রের জন্য প্রয়োগযোগ্য কি না, তা নিয়ে গবেষণা ছাড়াই তা বলা হয়েছে। প্রায় দুই দশক জুড়ে ব্যয়বহুল, বেদনাদায়ক ও বাণিজ্যিকভাবে অসফল ‘পরীক্ষা’ শেষে এখন সবার কাছেই স্পষ্ট, বড়পুকুরিয়া বা অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের কয়লাক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির কয়লাখনি উপযুক্ত প্রযুক্তি নয়। এ প্রযুক্তি ইতিমধ্যে আকস্মিক প্লাবন, খনিতে নিয়ন্ত্রণহীন কয়লার দহন ও বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ, অতিরিক্ত তাপ ও ব্যাপকভাবে ভূপৃষ্ঠের অবনমন বা ভূমিধস ডেকে আনে। ফলে খনি ও এর সন্নিহিত এলাকায় কৃষিজমি ও লোকালয় স্থায়ীভাবে পরিত্যক্ত হয়; ব্যয় করতে হয় পরিবেশ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল অর্থ।
অর্থনৈতিক ও কারিগরি যুক্তির চেয়ে মানুষের আবেগ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যাঁরা কয়লা উত্তোলনের জন্য খনি নির্মাণের উপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন, তাঁরা এখন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও বাংলাদেশের বাস্তবতায় উপযোগিতা বিচার না করেই বেশ জোরেশোরে ভূগর্ভে কয়লা পুড়িয়ে দাহ্য গ্যাস তুলে আনার প্রযুক্তি বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন’-এর প্রযুক্তিকে দেশে প্রয়োগের জন্য বলতে শুরু করেছেন।
এ প্রযুক্তি মোটেই নতুন নয়, বরং ১৯১২ সাল থেকে রাশিয়া তার বিশাল ও বিচিত্র কয়লাক্ষেত্রগুলোর কোনো কোনো উত্তোলন-অযোগ্য অংশে ভূগর্ভে কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রযুক্তির গবেষণা শুরু করে। প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও এ প্রযুক্তি পরীক্ষামূলক ও পাইলট প্রকল্পের পর্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কেবল রাশিয়া নয়, আমেরিকা, ইউরোপের কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশেই পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেছে বা করছে। কেউ কেউ সীমিত পরিসরে ভূগর্ভে কয়লা গ্যাসিফিকেশনের পাইলট প্রকল্প চালু অথবা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করছে। অনেক দেশ এ প্রযুক্তির প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে গবেষণার পর তা থেকে সরে এসেছে।
এখন উল্লেখ করার মতো পরীক্ষামূলক প্রকল্প ও সম্ভাব্যতা যাচাই করছে দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভারত ও কানাডা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাজুবা প্রকল্পটি, এটি কয়লা খনির পরিত্যক্ত অংশে ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। সফল হলে প্রকল্প বড় হবে। সেখানে কয়লার ভেতরে পাথুরে মিশ্রণ খনি পরিত্যাগে বাধ্য করেছিল। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তানে সোভিয়েত আমলে চালু হওয়া ‘আনগ্রেন’ ভূগর্ভস্থ কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প ১৯৫৯ সাল থেকে এখন সীমিত পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবেই রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার পরিত্যক্ত কয়লাক্ষেত্র চিনচিলায় ১৯৯৯ সালে শুরু করা পরীক্ষামূলক ভূগর্ভস্থ কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প মাত্র ৩৫ হাজার টন কয়লা গ্যাসে পরিণত করার পর ২০০৩ সালে বন্ধ করা হয়েছে। ভারত, চীন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র কিছু পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছে অথবা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ করছে। এর মধ্যে চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া, ভারতের রাজস্থান, কানাডার আলবার্টা ও নোভা স্কটিয়ায় খনি প্রযুক্তিতে উত্তোলন-অযোগ্য কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা ভূগর্ভে পুড়িয়ে জ্বালানি-গ্যাস পাওয়ার পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বর্ধিত জ্বালানি চাহিদার চ্যালেঞ্জ মেটাতে সম্ভাব্য সব জ্বালানি উৎস থেকেই ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি পাওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ভূগর্ভে কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। দীর্ঘ গবেষণায় এখনো কেবল পরিত্যক্ত ভূতাত্ত্বিক কারণে ও প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতায় লাভজনকভাবে উত্তোলন-অযোগ্য কয়লাক্ষেত্রগুলোকেই ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্পের টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভূগর্ভে নিয়ন্ত্রিতভাবে কয়লার বিদ্যমান স্তর বা তার অংশকে বাইরে থেকে ড্রিলিং করে অক্সিজেন সরবরাহ করে জ্বালানো ও অপর একটি বা একাধিক ড্রিলিং কূপ দিয়ে দাহ্য গ্যাস ভূপৃষ্ঠে তুলে আনার এ প্রযুক্তিতে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই পটভূমিতে জ্বালানির জন্য আগ্রাসী এবং একই সঙ্গে ব্যাপক কয়লা সম্পদের অধিকারী দেশগুলো তাদের বিভিন্ন অধরা বা পরিত্যক্ত কয়লাক্ষেত্র বা তার কোনো অংশে পরীক্ষামূলকভাবে ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। পৃথিবীর কোনো দেশই তার বিদ্যমান বা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য কয়লাক্ষেত্রে পরীক্ষিত ও প্রচলিত কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি ছেড়ে ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্পে রূপান্তরের চেষ্টা করেনি। আগামী কয়েক দশক জুড়ে কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের যে প্রবণতা ও প্রাক্কলন, তাতে উন্মুক্ত ও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি দিয়েই কয়লা উত্তোলিত হবে এবং বেশি বেশি কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হবে।
বিকল্প জ্বালানি, অধিকতর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি আহরণ এবং সেই লক্ষ্যে প্রযুক্তি অনুসন্ধান প্রচেষ্টাও চলবে, তবে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে প্রচলিত জ্বালানি হিসেবে কয়লা তার শীর্ষ আসন থেকে সরছে না, বরং আরও জাঁকিয়ে বসছে। প্রধান কারণ কয়লার পর্যাপ্ততা, নির্ভরযোগ্যতা ও অন্য জ্বালানির তুলনায় কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক সস্তা।
স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়েই পৃথিবীর মানুষ বোঝে, কিছু পেতে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে ‘ট্রেড অফ’ বলে। আমরা নিরন্তর বিতর্ক করে যত বেশি সময়ক্ষেপণ করব, কয়লা উত্তোলন তত পিছিয়ে যাবে এবং জ্বালানি আমদানি ব্যবসা তত জমজমাট হবে। সেই সঙ্গে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে তত বেশি মূল্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিঘ্নিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। অবশ্য বিতর্কপ্রিয়দের তাতে সামান্যই আসে বা যায়।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।
মারাত্মক বিদ্যুৎ-সংকট সামাল দিতে ইতিমধ্যে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বেশ কিছু উচ্চ ভাড়া ও সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন-উপযোগী (পিকিং পাওয়ার প্লান্ট) নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি গ্যাসের সংকটে বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দ্বৈত জ্বালানিনির্ভর (ডুয়েল ফুয়েল) বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের চেষ্টা হচ্ছে এবং নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রধানত আমদানিনির্ভর তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গড়া হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারের ব্যয় বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও অব্যাহত হারে বাড়ছে। এ কারণে গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া জ্বালানির জন্য ভর্তুকির চাপ সরকারের জন্য সামলানো কঠিন। বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামাজনিত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাও এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে (প্রথম আলো ৪ মে ২০১০) যে লোডশেডিং মোকাবিলায় বর্ধিত হারে জেনারেটর ব্যবহারের কারণে দিনে পাঁচ কোটি টাকার ডিজেল তেল বেশি লাগছে। সরকার প্রতি ব্যারেল ডিজেল ৯৩ মার্কিন ডলার দরে আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে তা ভোক্তাসাধারণকে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গ্যাস-সংকটের কারণে সরকারি যানবাহন চালানোর জন্য সিএনজি থেকে আবার জ্বালানি তেল ব্যবহারে ফিরে যাওয়ার কথা হচ্ছে। এতে বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে কেবল তেল কিনতে।
এ পরিস্থিতি বিবেচনায় সুস্থ চিন্তার সব মানুষই দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রমাণিত মজুদ কয়লা দ্রুত উত্তোলন ও ব্যবহারের কথা বলছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ কেউ অব্যাহতভাবে কয়লা তোলার প্রক্রিয়াকে ক্লান্তিহীন বিতর্কের উপাদান করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভূগর্ভস্থ কয়লাখনি (অন্তত স্বল্প গভীরতার কয়লাক্ষেত্র বড়পুকুরিয়ায়) আর্থকারিগরি বিবেচনায় অকার্যকর হলেও উচ্চসুদে ধার করা টাকায় সেখানে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করতে এসব বিতর্কপ্রিয় গবেষকদের সমস্যা হয়নি। একই সঙ্গে তাঁরা দেশে ভূগর্ভস্থ কয়লাখনিই যে ‘উত্তম ও পরিবেশবান্ধব’ সে কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে এসেছেন। বলাই বাহুল্য, এ জাতীয় অনুসিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অতি পুরু স্তরের স্বল্প গভীরতার কয়লাক্ষেত্রের জন্য প্রয়োগযোগ্য কি না, তা নিয়ে গবেষণা ছাড়াই তা বলা হয়েছে। প্রায় দুই দশক জুড়ে ব্যয়বহুল, বেদনাদায়ক ও বাণিজ্যিকভাবে অসফল ‘পরীক্ষা’ শেষে এখন সবার কাছেই স্পষ্ট, বড়পুকুরিয়া বা অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের কয়লাক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির কয়লাখনি উপযুক্ত প্রযুক্তি নয়। এ প্রযুক্তি ইতিমধ্যে আকস্মিক প্লাবন, খনিতে নিয়ন্ত্রণহীন কয়লার দহন ও বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ, অতিরিক্ত তাপ ও ব্যাপকভাবে ভূপৃষ্ঠের অবনমন বা ভূমিধস ডেকে আনে। ফলে খনি ও এর সন্নিহিত এলাকায় কৃষিজমি ও লোকালয় স্থায়ীভাবে পরিত্যক্ত হয়; ব্যয় করতে হয় পরিবেশ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল অর্থ।
অর্থনৈতিক ও কারিগরি যুক্তির চেয়ে মানুষের আবেগ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যাঁরা কয়লা উত্তোলনের জন্য খনি নির্মাণের উপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন, তাঁরা এখন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও বাংলাদেশের বাস্তবতায় উপযোগিতা বিচার না করেই বেশ জোরেশোরে ভূগর্ভে কয়লা পুড়িয়ে দাহ্য গ্যাস তুলে আনার প্রযুক্তি বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন’-এর প্রযুক্তিকে দেশে প্রয়োগের জন্য বলতে শুরু করেছেন।
এ প্রযুক্তি মোটেই নতুন নয়, বরং ১৯১২ সাল থেকে রাশিয়া তার বিশাল ও বিচিত্র কয়লাক্ষেত্রগুলোর কোনো কোনো উত্তোলন-অযোগ্য অংশে ভূগর্ভে কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রযুক্তির গবেষণা শুরু করে। প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও এ প্রযুক্তি পরীক্ষামূলক ও পাইলট প্রকল্পের পর্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কেবল রাশিয়া নয়, আমেরিকা, ইউরোপের কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশেই পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেছে বা করছে। কেউ কেউ সীমিত পরিসরে ভূগর্ভে কয়লা গ্যাসিফিকেশনের পাইলট প্রকল্প চালু অথবা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করছে। অনেক দেশ এ প্রযুক্তির প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে গবেষণার পর তা থেকে সরে এসেছে।
এখন উল্লেখ করার মতো পরীক্ষামূলক প্রকল্প ও সম্ভাব্যতা যাচাই করছে দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভারত ও কানাডা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাজুবা প্রকল্পটি, এটি কয়লা খনির পরিত্যক্ত অংশে ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। সফল হলে প্রকল্প বড় হবে। সেখানে কয়লার ভেতরে পাথুরে মিশ্রণ খনি পরিত্যাগে বাধ্য করেছিল। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তানে সোভিয়েত আমলে চালু হওয়া ‘আনগ্রেন’ ভূগর্ভস্থ কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প ১৯৫৯ সাল থেকে এখন সীমিত পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবেই রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার পরিত্যক্ত কয়লাক্ষেত্র চিনচিলায় ১৯৯৯ সালে শুরু করা পরীক্ষামূলক ভূগর্ভস্থ কয়লার গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প মাত্র ৩৫ হাজার টন কয়লা গ্যাসে পরিণত করার পর ২০০৩ সালে বন্ধ করা হয়েছে। ভারত, চীন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র কিছু পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছে অথবা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ করছে। এর মধ্যে চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া, ভারতের রাজস্থান, কানাডার আলবার্টা ও নোভা স্কটিয়ায় খনি প্রযুক্তিতে উত্তোলন-অযোগ্য কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা ভূগর্ভে পুড়িয়ে জ্বালানি-গ্যাস পাওয়ার পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বর্ধিত জ্বালানি চাহিদার চ্যালেঞ্জ মেটাতে সম্ভাব্য সব জ্বালানি উৎস থেকেই ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি পাওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ভূগর্ভে কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। দীর্ঘ গবেষণায় এখনো কেবল পরিত্যক্ত ভূতাত্ত্বিক কারণে ও প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতায় লাভজনকভাবে উত্তোলন-অযোগ্য কয়লাক্ষেত্রগুলোকেই ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্পের টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভূগর্ভে নিয়ন্ত্রিতভাবে কয়লার বিদ্যমান স্তর বা তার অংশকে বাইরে থেকে ড্রিলিং করে অক্সিজেন সরবরাহ করে জ্বালানো ও অপর একটি বা একাধিক ড্রিলিং কূপ দিয়ে দাহ্য গ্যাস ভূপৃষ্ঠে তুলে আনার এ প্রযুক্তিতে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই পটভূমিতে জ্বালানির জন্য আগ্রাসী এবং একই সঙ্গে ব্যাপক কয়লা সম্পদের অধিকারী দেশগুলো তাদের বিভিন্ন অধরা বা পরিত্যক্ত কয়লাক্ষেত্র বা তার কোনো অংশে পরীক্ষামূলকভাবে ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। পৃথিবীর কোনো দেশই তার বিদ্যমান বা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য কয়লাক্ষেত্রে পরীক্ষিত ও প্রচলিত কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি ছেড়ে ভূগর্ভস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশন প্রকল্পে রূপান্তরের চেষ্টা করেনি। আগামী কয়েক দশক জুড়ে কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের যে প্রবণতা ও প্রাক্কলন, তাতে উন্মুক্ত ও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রযুক্তি দিয়েই কয়লা উত্তোলিত হবে এবং বেশি বেশি কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হবে।
বিকল্প জ্বালানি, অধিকতর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি আহরণ এবং সেই লক্ষ্যে প্রযুক্তি অনুসন্ধান প্রচেষ্টাও চলবে, তবে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে প্রচলিত জ্বালানি হিসেবে কয়লা তার শীর্ষ আসন থেকে সরছে না, বরং আরও জাঁকিয়ে বসছে। প্রধান কারণ কয়লার পর্যাপ্ততা, নির্ভরযোগ্যতা ও অন্য জ্বালানির তুলনায় কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক সস্তা।
স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়েই পৃথিবীর মানুষ বোঝে, কিছু পেতে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে ‘ট্রেড অফ’ বলে। আমরা নিরন্তর বিতর্ক করে যত বেশি সময়ক্ষেপণ করব, কয়লা উত্তোলন তত পিছিয়ে যাবে এবং জ্বালানি আমদানি ব্যবসা তত জমজমাট হবে। সেই সঙ্গে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে তত বেশি মূল্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে বিঘ্নিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। অবশ্য বিতর্কপ্রিয়দের তাতে সামান্যই আসে বা যায়।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।
No comments