পরমাণু যুগের ৭০ বছর : বিপর্যয়ের শঙ্কা অব্যাহত by জোসেফ ম্যাঙ্গানো ও জ্যানেট ডি. শেরম্যান
আজ
৬ আগস্ট। ৪০ বছর আগে এ দিনে ‘লিট্ল বয়’ নামের আণবিক বোমা নিয়ে বোমারু
বিমান ‘এনোলা গে’ উড়ে গিয়েছিল জাপানের হিরোশিমা নগরীতে। সেদিন সেখানে যে
ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল, এমন ভয়াবহ ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি কোনো দিন। এই
বোমাবর্ষণ চিরদিনের জন্য ইতিহাস বদলে দিয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই
যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভীতিকর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
এই প্রতিযোগিতা ছিল আরো শক্তিশালী আণবিক বা পরমাণু অস্ত্রের
পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ক্রমবর্ধমান হারে এ ধরনের মারণান্ত্র মজুদ করার জন্য।
পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মধ্যে যে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ চলেছিল, তার একটা বড় দিক
ছিল পারমাণবিক প্রতিযোগিতা। বিষয়টি এই প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছিল : পৃথিবী
নামের গ্রহটিতে জীবনের অস্তিত্ব থাকবে কি? পরীক্ষা করা হলো চার শতাধিক
পরমাণু বোমা এবং এর জের ধরে হাজার হাজার মারণাস্ত্র তৈরি করা হলো।
সঙ্কটের অতল গহ্বর সৃষ্টি হলো ১৯৬২ সালে ‘কিউবা মিসাইল’কে কেন্দ্র করে। তখন মার্কিন ও সোভিয়েত, দু’পক্ষেই সামরিক ও সরকারি উপদেষ্টাদের বেশির ভাগই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং রুশ প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ায় যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়। অন্যথায়, যুদ্ধ বেধে গেলে সর্বব্যাপী পারমাণবিক বিপর্যয় এমন তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ ঘটাত, যাতে সব জীবনেরই অবসান ঘটে যেত।
যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে ১৯৪৬ ও ’৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। তখন যে দূষণ ঘটেছিল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা আজো শেষ হয়নি। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ইউরেনিয়ামসংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়েছে। নবজাতক এবং কম বয়সী শিশুদের ওপর এর ফলাফল বিপর্যয়কর।
পারমাণবিক দুর্যোগের লাগাম টেনে ধরার জন্য বড় বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভূ-উপরিস্থিত কিংবা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার উভয় ধরনের কোনোটাই এখন আর হয় না। নিরস্ত্রীকরণের আওতায় হাজার হাজার মারণাস্ত্র করা হয়েছে ধ্বংস। তবে এসব কিছু সত্ত্বেও পরমাণুই পৃথিবীর বুকে প্রাণের প্রতি সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হয়ে রয়েছে। আজো বিশ্বজুড়ে ১৬ হাজার পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন অবস্থায় আছে। এর সাথে আছে এই অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা। হিরোশিমার ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা রাখে এসব অস্ত্র। আটটি রাষ্ট্র পারমাণবিক সমরাস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। আরো কয়েকটি দেশ নিজেরা পরমাণু বোমা বানানোর খায়েশ পোষণ করছে।
কিন্তু, ৭০ বছর আগে যা ঘটেছিল, তার ধারাবাহিকতায় যা হচ্ছে, তা পরমাণু বোমার সম্ভাব্য হুমকির বাইরেও বিপদের কারণ সৃষ্টি করছে। পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া এই গ্রহটিকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন, বিচূর্ণকরণ, সমৃদ্ধকরণ, বিশুদ্ধকরণ, সজ্জিতকরণ- এ সবকিছুই বোমা বানাতে দরকার। এতে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে, সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে দূষণের বিস্তার ঘটছে। এ ধরনের বড় প্লান্টের এলাকায়, যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ওক রিজ টিএন এবং সাভান্নাহ রিভারে মানুষের বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ, বিপুল পরিমাণ পরমাণুবর্জ্য। এর একাংশ ভূমিতে অনুপ্রবেশ করছে। বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত ব্যয়বহুল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়েও সম্ভব হচ্ছে না এসব অত্যধিক বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সামাল দেয়া।
পরমাণু যুগের একটি বড় বিষয় হলো, বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যদিও তা এখন থেমে আছে। পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের স্থানটির কাছাকাছি যারা ছিলেন, তারাই এর সবচেয়ে মর্মান্তিক শিকার। এই বিস্ফোরণস্থলের পাশে যেসব সৈন্য সম্ভাব্য যুদ্ধের মহড়ায় অংশ নিয়েছে, তাদের দেহ মারাত্মকভাবে হয়েছে সংক্রমিত। তারা পরে ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমেরিকার নেভাদায় সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও একই ভাগ্যবরণ করেছে। সেখানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষাস্থলের কাছের বাসিন্দাদের নিয়তিও অভিন্ন।
পরমাণু বোমার পরীক্ষাকালে ব্যাঙের ছাতার আকৃতির বিশাল মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মেঘ বাতাসের প্রবাহে হাজার হাজার মাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণকারী শতাধিক রাসায়নিক পদার্থের এই বিষাক্ত মিশ্রণের অস্তিত্ব ১৯৪৫ সালের (হিরোশিমার ঘটনা) আগে ছিল না। এই মিশ্রণ পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে মানুষ, পশুপাখি ও উদ্ভিদকে বিপন্ন করে তুলেছে। ১৯৬৩ সালের পরে ভূ-উপরিস্থিত পারমাণবিক পরীক্ষা হয়েছে কমই। তবে দীর্ঘ দিন এর জের টানতে হয়েছে। যাদের বয়স বর্তমানে ৪৫ বছরের বেশি, বিশেষ করে ‘বেবি বুম’ প্রজন্ম ছিল বিপদের মুখে। ‘বেবি বুম’ মানে, যারা পারমাণবিক পরীক্ষার সময়ে মাতৃগর্ভে ভ্রুণ, নবজাতক, কিংবা শিশুর পর্যায়ে ছিল। তেজস্ক্রিয়তা ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। তাই পরবর্তী প্রজন্মগুলো ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে পেয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ‘জিন’।
‘হিরোশিমা’র বর্তমান তাৎপর্য প্রকৃতপক্ষে শুধু বোমার মধ্যে সীমিত নয়। ‘ঠাণ্ডা’ যুদ্ধের পরিস্থিতি খুবই গরম হয়ে ওঠার পর পরমাণুকে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি। এর দ্বারা ইউরেনিয়াম পরমাণুকে বিভাজনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতেও হুবহু একই বিভাজন প্রক্রিয়া অবলম্বনের প্রয়োজন পড়ে।
পৃথিবীজুড়ে চার শতাধিক পরমাণুবিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো পরিবেশের জন্য ডেকে এনেছে বিপর্যয়। অতীতে ক্ষুদ্র পরীক্ষাচুল্লিতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার ব্যাপারে সতর্কতা দেখা যায়নি। এ দিকে, বৈদ্যুতিক পরমাণুশক্তি উৎপাদন থেকেছে অব্যাহত। একসময় বড় বড় অঘটন ঘটতে থাকে। যেমন- থ্রি মাইল আইল্যান্ড (১৯৭৯), চেরনোবিল (১৯৮৬) এবং ফুকুশিমার (২০১১) দুর্ঘটনা। ফুকুশিমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটছে। এটা হতে পারে ইতিহাসের সর্বাধিক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
উত্তাপে গলে যাওয়া ছাড়াও পারমাণবিক চুল্লি থেকে ক্রমেই নির্গত হয়েছে শতাধিক তেজস্ক্রিয় রাসায়নিকের মিশ্রণের একাংশ। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণে যে বিশাল মেঘ সঞ্চারিত হয়ে থাকে, এতেও ওইসব তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি দেখা গেছে। বিদ্যুৎ চুল্লির আশপাশে বসবাসকারী মানুষের দেহে এসব বিষাক্ত পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাদ্যের মধ্য দিয়ে অনুপ্রবেশ করে। এ যাবৎ বৈজ্ঞানিক জার্নালের ৬০টিরও বেশি নিবন্ধে এসব এলাকার শিশুদের মাঝে ক্যান্সারের ব্যাপক প্রকোপের বিষয় প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছে।
পরমাণু বিদ্যুতের আরেকটি বিরাট ক্ষতির দিক হলো, বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। চুল্লি থেকে নির্গমনের আগে এটা সংগ্রহ করা হয়েছিল। হাজার হাজার বছরেও এই বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব নিঃশেষ হবে না। পরমাণু বর্জ্যরে নিরাপদ সংরক্ষণের ব্যাপারে স্থায়ী কোনো সমাধান আজো নির্দেশ করা যায়নি। অথচ কয়েক দশক আগেই এই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এখন প্রতিটি পরমাণু প্রকল্পে বিরাট বিরাট জলাশয়ে বেশির ভাগ বর্জ্য জমিয়ে রাখা হয়। এই পানি অবিরাম শীতল রাখা অপরিহার্য। কারিগরি ব্যর্থতা, মানবিক ত্রুটি কিংবা নাশকতার কারণে এই পানি ঠাণ্ডা না থাকলে বর্জ্য গলে বিপদ ঘটাবে।
পরমাণু যুগের ইতিহাস বিষাদময়। আজো এ বিষাদ কাটেনি। বহু বছর আগে বোতল থেকে যে দৈত্যকে বের হতে দেয়া হয়েছিল, সেটি এখনো বোতলে ঢোকেনি। মানবজাতিকে আরো বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যে মহাবিপদের জন্ম দিয়েছে, তার মোকাবিলায় চাই অব্যাহত সতর্কতা।
লেখক : জোসেফ ম্যাঙ্গানো ও জ্যানেট শেরম্যান Radiation and Public Health Projeet-এর নির্বাহী পরিচালক ও গবেষণা উপদেষ্টা
ভাষান্তর- মীযানুল করীম
সঙ্কটের অতল গহ্বর সৃষ্টি হলো ১৯৬২ সালে ‘কিউবা মিসাইল’কে কেন্দ্র করে। তখন মার্কিন ও সোভিয়েত, দু’পক্ষেই সামরিক ও সরকারি উপদেষ্টাদের বেশির ভাগই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং রুশ প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ায় যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়। অন্যথায়, যুদ্ধ বেধে গেলে সর্বব্যাপী পারমাণবিক বিপর্যয় এমন তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ ঘটাত, যাতে সব জীবনেরই অবসান ঘটে যেত।
যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে ১৯৪৬ ও ’৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। তখন যে দূষণ ঘটেছিল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা আজো শেষ হয়নি। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ইউরেনিয়ামসংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়েছে। নবজাতক এবং কম বয়সী শিশুদের ওপর এর ফলাফল বিপর্যয়কর।
পারমাণবিক দুর্যোগের লাগাম টেনে ধরার জন্য বড় বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভূ-উপরিস্থিত কিংবা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার উভয় ধরনের কোনোটাই এখন আর হয় না। নিরস্ত্রীকরণের আওতায় হাজার হাজার মারণাস্ত্র করা হয়েছে ধ্বংস। তবে এসব কিছু সত্ত্বেও পরমাণুই পৃথিবীর বুকে প্রাণের প্রতি সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হয়ে রয়েছে। আজো বিশ্বজুড়ে ১৬ হাজার পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন অবস্থায় আছে। এর সাথে আছে এই অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা। হিরোশিমার ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা রাখে এসব অস্ত্র। আটটি রাষ্ট্র পারমাণবিক সমরাস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। আরো কয়েকটি দেশ নিজেরা পরমাণু বোমা বানানোর খায়েশ পোষণ করছে।
কিন্তু, ৭০ বছর আগে যা ঘটেছিল, তার ধারাবাহিকতায় যা হচ্ছে, তা পরমাণু বোমার সম্ভাব্য হুমকির বাইরেও বিপদের কারণ সৃষ্টি করছে। পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া এই গ্রহটিকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন, বিচূর্ণকরণ, সমৃদ্ধকরণ, বিশুদ্ধকরণ, সজ্জিতকরণ- এ সবকিছুই বোমা বানাতে দরকার। এতে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে, সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে দূষণের বিস্তার ঘটছে। এ ধরনের বড় প্লান্টের এলাকায়, যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ওক রিজ টিএন এবং সাভান্নাহ রিভারে মানুষের বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ, বিপুল পরিমাণ পরমাণুবর্জ্য। এর একাংশ ভূমিতে অনুপ্রবেশ করছে। বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত ব্যয়বহুল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়েও সম্ভব হচ্ছে না এসব অত্যধিক বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সামাল দেয়া।
পরমাণু যুগের একটি বড় বিষয় হলো, বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যদিও তা এখন থেমে আছে। পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের স্থানটির কাছাকাছি যারা ছিলেন, তারাই এর সবচেয়ে মর্মান্তিক শিকার। এই বিস্ফোরণস্থলের পাশে যেসব সৈন্য সম্ভাব্য যুদ্ধের মহড়ায় অংশ নিয়েছে, তাদের দেহ মারাত্মকভাবে হয়েছে সংক্রমিত। তারা পরে ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমেরিকার নেভাদায় সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও একই ভাগ্যবরণ করেছে। সেখানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষাস্থলের কাছের বাসিন্দাদের নিয়তিও অভিন্ন।
পরমাণু বোমার পরীক্ষাকালে ব্যাঙের ছাতার আকৃতির বিশাল মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মেঘ বাতাসের প্রবাহে হাজার হাজার মাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণকারী শতাধিক রাসায়নিক পদার্থের এই বিষাক্ত মিশ্রণের অস্তিত্ব ১৯৪৫ সালের (হিরোশিমার ঘটনা) আগে ছিল না। এই মিশ্রণ পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে মানুষ, পশুপাখি ও উদ্ভিদকে বিপন্ন করে তুলেছে। ১৯৬৩ সালের পরে ভূ-উপরিস্থিত পারমাণবিক পরীক্ষা হয়েছে কমই। তবে দীর্ঘ দিন এর জের টানতে হয়েছে। যাদের বয়স বর্তমানে ৪৫ বছরের বেশি, বিশেষ করে ‘বেবি বুম’ প্রজন্ম ছিল বিপদের মুখে। ‘বেবি বুম’ মানে, যারা পারমাণবিক পরীক্ষার সময়ে মাতৃগর্ভে ভ্রুণ, নবজাতক, কিংবা শিশুর পর্যায়ে ছিল। তেজস্ক্রিয়তা ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। তাই পরবর্তী প্রজন্মগুলো ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে পেয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ‘জিন’।
‘হিরোশিমা’র বর্তমান তাৎপর্য প্রকৃতপক্ষে শুধু বোমার মধ্যে সীমিত নয়। ‘ঠাণ্ডা’ যুদ্ধের পরিস্থিতি খুবই গরম হয়ে ওঠার পর পরমাণুকে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি। এর দ্বারা ইউরেনিয়াম পরমাণুকে বিভাজনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতেও হুবহু একই বিভাজন প্রক্রিয়া অবলম্বনের প্রয়োজন পড়ে।
পৃথিবীজুড়ে চার শতাধিক পরমাণুবিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো পরিবেশের জন্য ডেকে এনেছে বিপর্যয়। অতীতে ক্ষুদ্র পরীক্ষাচুল্লিতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার ব্যাপারে সতর্কতা দেখা যায়নি। এ দিকে, বৈদ্যুতিক পরমাণুশক্তি উৎপাদন থেকেছে অব্যাহত। একসময় বড় বড় অঘটন ঘটতে থাকে। যেমন- থ্রি মাইল আইল্যান্ড (১৯৭৯), চেরনোবিল (১৯৮৬) এবং ফুকুশিমার (২০১১) দুর্ঘটনা। ফুকুশিমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটছে। এটা হতে পারে ইতিহাসের সর্বাধিক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
উত্তাপে গলে যাওয়া ছাড়াও পারমাণবিক চুল্লি থেকে ক্রমেই নির্গত হয়েছে শতাধিক তেজস্ক্রিয় রাসায়নিকের মিশ্রণের একাংশ। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণে যে বিশাল মেঘ সঞ্চারিত হয়ে থাকে, এতেও ওইসব তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি দেখা গেছে। বিদ্যুৎ চুল্লির আশপাশে বসবাসকারী মানুষের দেহে এসব বিষাক্ত পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাদ্যের মধ্য দিয়ে অনুপ্রবেশ করে। এ যাবৎ বৈজ্ঞানিক জার্নালের ৬০টিরও বেশি নিবন্ধে এসব এলাকার শিশুদের মাঝে ক্যান্সারের ব্যাপক প্রকোপের বিষয় প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছে।
পরমাণু বিদ্যুতের আরেকটি বিরাট ক্ষতির দিক হলো, বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। চুল্লি থেকে নির্গমনের আগে এটা সংগ্রহ করা হয়েছিল। হাজার হাজার বছরেও এই বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব নিঃশেষ হবে না। পরমাণু বর্জ্যরে নিরাপদ সংরক্ষণের ব্যাপারে স্থায়ী কোনো সমাধান আজো নির্দেশ করা যায়নি। অথচ কয়েক দশক আগেই এই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এখন প্রতিটি পরমাণু প্রকল্পে বিরাট বিরাট জলাশয়ে বেশির ভাগ বর্জ্য জমিয়ে রাখা হয়। এই পানি অবিরাম শীতল রাখা অপরিহার্য। কারিগরি ব্যর্থতা, মানবিক ত্রুটি কিংবা নাশকতার কারণে এই পানি ঠাণ্ডা না থাকলে বর্জ্য গলে বিপদ ঘটাবে।
পরমাণু যুগের ইতিহাস বিষাদময়। আজো এ বিষাদ কাটেনি। বহু বছর আগে বোতল থেকে যে দৈত্যকে বের হতে দেয়া হয়েছিল, সেটি এখনো বোতলে ঢোকেনি। মানবজাতিকে আরো বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যে মহাবিপদের জন্ম দিয়েছে, তার মোকাবিলায় চাই অব্যাহত সতর্কতা।
লেখক : জোসেফ ম্যাঙ্গানো ও জ্যানেট শেরম্যান Radiation and Public Health Projeet-এর নির্বাহী পরিচালক ও গবেষণা উপদেষ্টা
ভাষান্তর- মীযানুল করীম
No comments