শীতে হাফশার্ট গ্রীষ্মে ওভারকোট by কাফি কামাল
একের
পর এক ভুল চাল। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। রাজনীতিতে কখনও কখনও ভুলের
মাশুল দিতে হয় দীর্ঘকাল। সে মাশুলই যেন দিয়ে চলছে বিএনপি। রাজনীতিতে সবদিন
সমান যায় না- এ কথা সত্য। তবে দীর্ঘ আট বছর ধরে একইদিন যাচ্ছে বিএনপির।
কোথায় ভুল করেছে দলটি? কেনইবা ব্যর্থতার চোরাবালি থেকে বের হতে পারছে না।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল। ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক ধারাবাহিকের আজ ছাপা হলো পঞ্চম পর্ব-
ওয়ান ইলেভেনের বিশেষ সময়ের পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও জোটের চাপে শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বিশেষ করে জামায়াতের আগ্রহ ছিল বেশি। ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল অগোছালো। নির্বাচনের ফলাফলও ছিল ভূমিধস পরাজয়। ফলাফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ভোটের হিসাবে অনেকটাই অটুট ছিল জনসমর্থন। এছাড়া, দেশব্যাপী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবিশ্রান্ত সফরের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখে বিএনপি। সে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে বিএনপির তরফে বলা হয়েছিল, ‘একটি অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে একটি যেনতেনভাবে নির্বাচিত সরকার ভাল।’
কিন্তু খুব দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দিন দিন কঠোর হতে থাকে। এমনই সময়ে হঠাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। অন্যদিকে একদা নিজেদের আন্দোলনের ফসল ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি’ থেকে সরে আসার উদ্যোগ নেয় সরকার। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়টি সুরাহার দায়িত্ব সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় উচ্চ আদালতের রায়ে। সংসদের সংবিধান সংশোধন কমিটি ও সুধী সমাজের পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ পদ্ধতিটি বাতিল করেন। বিএনপির তরফে ইস্যুটির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দূরদর্শী প্রতিবাদ ও বিকল্প দাবির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি দলটি। বিপুল জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে রাজপথের কার্যকর আন্দোলন কিংবা বিকল্প পথে এগিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণে কোন সফলতা দেখাতে পারেনি বিএনপি।
আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির একটি দর্শন হচ্ছে মৌলিক ইস্যুতে আপসহীন মনোভাব ধরে রাখা। অতীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় এ আপসহীন মনোভাবের কারণেই সাংগঠনিকভাবে ভঙ্গুর ও অগোছালো বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল জনগণ। যা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশত্যাগ করতে অস্বীকৃতির আপসহীন মনোভাব বিএনপির রাজনীতিকে চাঙ্গা করে। নবম সংসদে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে- ওয়ান ইলেভেনের রাজনীতিহীনতা থেকে উত্তরণের বিজয় এসেছে বিএনপির হাত ধরেই। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এ আপসহীন মনোভাব থেকে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি নিয়েও মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা বিতর্ক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে গেলেও বিএনপি জোটের জেতার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যেত না। পাবলিক মুড সে রকমই ছিল।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বছর থেকেই কড়া আন্দোলনে যায় বিএনপি। বিশেষ করে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলনের বিস্তৃতি। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সিনিয়র নেতাদের নামে দায়ের করা হয় একের পর এক মামলা। এ সময় তৃণমূলের চাঙ্গা মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কার্যকর কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয় দলটি। সারা দেশে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলেও তার রেশ ছড়ায়নি রাজধানী ঢাকায়।
ঢাকার দুর্বলতা বহুকাল ঢাকা থাকার চরম খেসারত দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে বিএনপি। সাদেক হোসেন খোকার হাত থেকে কমিটি করার ভার মির্জা আব্বাসকে দেয়া হলেও কোন লাভ হয়নি। ঢাকায় কমিটিই করতে পারে না বিএনপি। ঢাকার এমন দুর্দশা দেখে সারা দেশে কর্র্মীদের মনোবল ভেঙেছে। বিএনপির আন্দোলন যে তীব্রতা পায়নি, সেখানে ঢাকার ঢাকা পড়া দুর্বলতা বিরাট কারণ। কিন্তু এনিয়ে কোন গবেষণা নেই, কোন মূল্যায়ন নেই। অবশ্য পুলিশি নির্যাতন ও মামলার ভয়ে সবাই ভীত। সারা দেশে নেতাদের পাইকারি গ্রেপ্তার শুরু হলে অচিরেই ভাটা পড়ে আন্দোলন। আর আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়টিকে কোন কোন সময় হাস্যকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছেন বিএনপির অনেক নেতা। সম্ভাব্য কড়া ও কঠোর আন্দোলন নিয়ে পরস্পরবিরোধী মনোভাব দেখা দেয় নেতাদের মধ্যে। এতে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। এরপর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণায় বিএনপি নেতাদের অপেক্ষা ছিল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার। ফলে কড়া আন্দোলনের হুমকি-ধামকি সরকারকে যেমন চাপে ফেলতে পারেনি, তেমনি উজ্জীবিত করতে পারেনি দলের তৃণমূলকে। কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির এ রহস্যময়তা রাজনৈতিক মহলে একটি প্রবাদের জন্ম দেয়।
বিএনপির আন্দোলন হচ্ছে, ‘শীতের হাফশার্ট আর গ্রীষ্মের ওভারকোট’। এ নিয়ে রীতিমতো কার্টুন ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। এভাবেই আন্দোলনের সময়-অসময় বিবেচনায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দিতে থাকে দলটি। বারবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব পিছু হটার কারণে আশাহত ও হতাশ হয়েছে তৃণমূল। অনেক ক্ষেত্রে কর্মসূচি প্রণয়ন ও ঘোষণার বিষয়গুলোতে অন্ধকারে ছিলেন শীর্ষ নেতারা। প্রশ্ন ওঠে, এ ধরনের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে যে প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন তা কি বিএনপির ছিল?
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আন্দোলন করলেও এখনও তার কোন বিকল্প সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে পারেনি বিএনপি। দেশের ইতিহাস বলে নেতারা ব্যর্থ হলে, তারা ভীরু হলে এগিয়ে আসে ছাত্ররা, ’৬৯ এবং ’৯০-এ তাই ঘটেছে। এবারে তা নেই। এবারে এসেছে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের শত নাগরিক। সেখানেও শত ছিল না। এক নাগরিক। প্রফেসর এমাজউদ্দীন সম্প্রতি বলেছেন, তিনি ঈদের আগেই ওই বিকল্প রূপরেখার খসড়া দেবেন। কিন্তু তার কোন খবর নেই। তিনি তা দিলেও তাতে বিএনপি চাঙ্গা হবে, সেটা ভাবা কঠিন।
দলটির পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে যে ফর্মুলা দেয়া হয়েছিল তাতে কোন দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ছিল না। এছাড়া, জনগণের সমস্যার চেয়ে ক্ষমতার পরিবর্তনকেন্দ্রিক কর্মসূচিই বেশি এসেছে দলটির তরফে। প্রো-অ্যাকটিভ রাজনীতির চেয়ে রি-অ্যাকটিভ রাজনীতির ঝোঁক বেড়েছে। ১৯৯০ থেকেই দেখা গেছে, বিরোধী দল কখনও শাসনগত ব্যর্থতা নিয়ে তেমন কোন কথা বলেন না। কারণ তারা ক্ষমতায় গিয়ে তেমন ধরনের শাসনই দেবেন। যেমন বিএনপি বলে না যে তারা ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগ কেমন হবে। বিচারক নিয়োগে নীতিমালা করবে। তারা পুলিশ সংস্কার করবে। মোবাইল কোর্ট বিলোপ করবে। এসব তারা করবে না। সেকারণেও বিএনপির আন্দোলনের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই। সরকারের শাসনগত নানা ব্যর্থতা নিয়ে বিএনপি ইস্যুভিত্তিক ছোটখাটো কর্মসূচি পালন করতে পারতো। জলাবদ্ধতায় মানুষ ডুবে মরছে। কিন্তু বিএনপির ওয়ার্ড কমিটিগুলো এবিষয়ে কোন কথা বলছে না। তারা চেয়ে থাকে কখন বড় ডাক আসবে। তাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এখনও কৌশল বদলাচ্ছেন না। তাদের কাছে বড় কর্মসূচির মানেই হলো হরতাল দেয়া, দেশ অচল করা। সরকার ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া। কেয়ারটেকারের অধীনে নতুন নির্বাচন আদায় করা। বিএনপিকে এই ভাষা বদলাতে হবে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে গেলে আর হরতাল, জ্বালাও পোড়াও করে আগের মতো যুৎ করতে পারবে না বলে অনেকেই মনে করেন।
বিএনপিকে অরাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক ও তার প্রতিবাদ জানাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে পরনির্ভর রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রাম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কখনও জামায়াতে ইসলামী, কখনও হেফাজতে ইসলাম, কখনও বিদেশী কূটনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করছে দলটি।
আন্দোলন ও বিপ্লব এক নয়। বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব দুটোই ঘটে আকস্মিক। বাংলাদেশে এর নজির থাকলেও গণআন্দোলন গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে। জনগণের ব্যাপকভিত্তিক সম্পৃক্ততায়। ১৯৫২ সালে পূর্ণতা পাওয়া ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে। যা ’৬৬, ’৬৮, ’৬৯ হয়ে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ছাত্র বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। এরপর ’৮৪, ’৮৫, ’৮৬, ’৮৭, ’৮৮ হয়ে নব্বইয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং এরশাদের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন শুরু করেছিল ১৯৯৩ সালে। মাগুরা ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এরপর ধীরে ধীরে তারা চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে সংসদ থেকে গণপদত্যাগ করেছিল। বিএনপি নেতারা এই বাস্তবতা বিবেচনায় নেননি যে, দলটির ইতিহাসে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানোর নজির নেই। সাম্প্রতিক আন্দোলনে ধারাবাহিকতা ছিল কেবল খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী গণসংযোগে। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণায় কখনও ধীর আবার কখনও ছিল তাড়াহুড়ো।
ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নামে দেশের আলেম-ওলামাদের একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম। রাজধানীর শাপলা চত্বরে বিশাল একটি সমাবেশ করে তারা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে পড়েছিল সরকার। যদিও এ প্ল্যাটফরমটির নেপথ্য শক্তির রেকর্ড হচ্ছে সর্বদা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝে চলার। হেফাজতে ইসলামের উত্থান এবং জনসম্পৃক্ততা দেখে তাদের আন্দোলনের ঢেউকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল বিএনপি। দলটির কিছু তাত্ত্বিক শীর্ষ নেতৃত্বকে এ ঢেউয়ের ভেতর দেখিয়েছিলেন সুনামির সম্ভাবনা। কিন্তু হেফাজতকে রুখে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের কৌশল, আন্তর্জাতিক মহলের মনোভাব ও হেফাজতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। অবশ্য বিএনপির একাংশ হেফাজতকে সমর্থন না দিতে সতর্ক করে দিলেও কোন কোন অতি উৎসাহী নেতা বেগম জিয়াকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। পল্টনের এক মঞ্চে এনিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাদানুবাদও ঘটে। যে সম্ভাবনার ভিত্তিতে হেফাজতের দাবির প্রতি বিএনপি সমর্থন দেয়, দ্রুত তা দলটির জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতিই ত্বরান্বিত করে। প্রকাশ্যে হেফাজতকে সমর্থন দিলেও তাদেরকেও কার্যকর সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয় দলটি। এমনকি খালেদা জিয়ার নির্দেশনা সত্ত্বেও মহানগর বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। এবারও বিএনপির ঢাকা মহানগর নেতৃত্বের ব্যর্থতার মোড়কে বন্দি হয় আন্দোলন।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে কড়া আন্দোলনে যায় বিএনপি। সারা দেশে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারকে এ ইস্যুতে কার্যকর আলোচনায় বসাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু তারা অনুমান করতে পারেনি যে, তাদের বয়কট মোকাবিলায় সরকারি দল কি করতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে কৌশলে ১৫৩ আসনে বিনাভোটে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে আনে সরকার।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে এক রহস্যময় কর্মসূচি আসে ২০ দলের তরফে। আন্দোলনের মুখে সারা দেশ যখন রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তৃণমূলে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই আসে সে সিদ্ধান্ত। ২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশের জোরালো আন্দোলনকে ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঢাকার দলীয় নেতৃত্ব সেজন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তাদের সামর্থ্যও ছিল না। আখেরে দেখা যায় সেটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। একদিকে সরকার প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে সেটা রুখে দেয় অন্যদিকে সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়। বাস্তবে দেখা যায়, ২৯শে ডিসেম্বর রাজধানীতে একজন বিএনপি নেতাও রাজপথে নামার সাহস দেখাননি। অন্যদিকে ১৪৭টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে কিংবা বিএনপির বর্জনে নিরুৎসাহিত হয়ে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেন। তবে ভোটারদের এ মনোভাবকে বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। আত্মগোপনে গিয়ে দল পরিচালনা শুরু করেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার এ সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আত্মগোপন কৌশল অনেকটাই আত্মঘাতী হয়েছে বিএনপির। কারণ নেতারা আত্মগোপনে গিয়েও গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। বরং তাদের এই মনোভাব কর্মীদের হতাশ, জবাবদিহি ও দায়িত্ববিমুখ করে তোলে।
২৯শে ডিসেম্বর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মতো ফের রহস্যময় সিদ্ধান্ত আসে দলটির তরফে। ২০ দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠক থেকে কর্মসূচি দু’দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণার ১ ঘণ্টার ব্যবধানে রহস্যময় সিদ্ধান্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে একদিকে সরকারকে তাদের নড়বড়ে অবস্থান শক্ত করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়, অন্যদিকে ভেঙে দেয়া হয় কর্মী-সমর্থকদের মনোবল। ওই আন্দোলন থামানোটা ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু কারা এবং কেন সে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটিয়েছিল, তাদের ব্যাপারে কোন কথা বা সাংগঠনিক উদ্যোগ নেননি তিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রথমদিকে আন্দোলনের জন্য শরিক দলের ওপর নির্ভর করা। এতে একদিকে বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় সরকারের সুবিধা হয়েছে অন্যদিকে বিএনপি কর্মীদের করে তুলেছে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সুবিধাবাদী।
সরকার খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করেছে সেটা যেমন ঠিক, তেমনি বিএনপির দেশের সর্বস্তরের মানুষকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পাবলিক পরীক্ষা, জাতীয় দিবস পালন কোন কিছুই গ্রাহ্য করা হয়নি। কিন্তু আন্দোলন বা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনা যতই হোক, মানুষ কতদিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকবে? ১৫৩ আসনে নির্বাচন করতে না পারা এবং ১৪৭ আসনে ভোটের শতকরা হার বিবেচনায় ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতকরণে সফল বিএনপি। কিন্তু আইনগতভাবে সেখানে অসহায় বিএনপি। সর্বোচ্চ আদালতে একটি ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্যও বুঝতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব। পঁচাত্তরের পরে প্রতিকূল অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইলে লাগাতার নির্বাচন বয়কট করতে পারতো, কিন্তু সেটা তারা করেনি। এক অর্থে বিএনপির অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে। তারা হেরেছে। এবং সে ফল নিয়ে তারা সংসদেও বসেছে।
ওয়ান ইলেভেনের বিশেষ সময়ের পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও জোটের চাপে শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বিশেষ করে জামায়াতের আগ্রহ ছিল বেশি। ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল অগোছালো। নির্বাচনের ফলাফলও ছিল ভূমিধস পরাজয়। ফলাফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ভোটের হিসাবে অনেকটাই অটুট ছিল জনসমর্থন। এছাড়া, দেশব্যাপী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবিশ্রান্ত সফরের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখে বিএনপি। সে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে বিএনপির তরফে বলা হয়েছিল, ‘একটি অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে একটি যেনতেনভাবে নির্বাচিত সরকার ভাল।’
কিন্তু খুব দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দিন দিন কঠোর হতে থাকে। এমনই সময়ে হঠাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। অন্যদিকে একদা নিজেদের আন্দোলনের ফসল ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি’ থেকে সরে আসার উদ্যোগ নেয় সরকার। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়টি সুরাহার দায়িত্ব সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় উচ্চ আদালতের রায়ে। সংসদের সংবিধান সংশোধন কমিটি ও সুধী সমাজের পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ পদ্ধতিটি বাতিল করেন। বিএনপির তরফে ইস্যুটির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব, পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দূরদর্শী প্রতিবাদ ও বিকল্প দাবির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি দলটি। বিপুল জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে রাজপথের কার্যকর আন্দোলন কিংবা বিকল্প পথে এগিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণে কোন সফলতা দেখাতে পারেনি বিএনপি।
আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির একটি দর্শন হচ্ছে মৌলিক ইস্যুতে আপসহীন মনোভাব ধরে রাখা। অতীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় এ আপসহীন মনোভাবের কারণেই সাংগঠনিকভাবে ভঙ্গুর ও অগোছালো বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল জনগণ। যা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশত্যাগ করতে অস্বীকৃতির আপসহীন মনোভাব বিএনপির রাজনীতিকে চাঙ্গা করে। নবম সংসদে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে- ওয়ান ইলেভেনের রাজনীতিহীনতা থেকে উত্তরণের বিজয় এসেছে বিএনপির হাত ধরেই। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এ আপসহীন মনোভাব থেকে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি নিয়েও মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা বিতর্ক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে গেলেও বিএনপি জোটের জেতার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যেত না। পাবলিক মুড সে রকমই ছিল।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বছর থেকেই কড়া আন্দোলনে যায় বিএনপি। বিশেষ করে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলনের বিস্তৃতি। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সিনিয়র নেতাদের নামে দায়ের করা হয় একের পর এক মামলা। এ সময় তৃণমূলের চাঙ্গা মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কার্যকর কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয় দলটি। সারা দেশে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলেও তার রেশ ছড়ায়নি রাজধানী ঢাকায়।
ঢাকার দুর্বলতা বহুকাল ঢাকা থাকার চরম খেসারত দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে বিএনপি। সাদেক হোসেন খোকার হাত থেকে কমিটি করার ভার মির্জা আব্বাসকে দেয়া হলেও কোন লাভ হয়নি। ঢাকায় কমিটিই করতে পারে না বিএনপি। ঢাকার এমন দুর্দশা দেখে সারা দেশে কর্র্মীদের মনোবল ভেঙেছে। বিএনপির আন্দোলন যে তীব্রতা পায়নি, সেখানে ঢাকার ঢাকা পড়া দুর্বলতা বিরাট কারণ। কিন্তু এনিয়ে কোন গবেষণা নেই, কোন মূল্যায়ন নেই। অবশ্য পুলিশি নির্যাতন ও মামলার ভয়ে সবাই ভীত। সারা দেশে নেতাদের পাইকারি গ্রেপ্তার শুরু হলে অচিরেই ভাটা পড়ে আন্দোলন। আর আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়টিকে কোন কোন সময় হাস্যকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছেন বিএনপির অনেক নেতা। সম্ভাব্য কড়া ও কঠোর আন্দোলন নিয়ে পরস্পরবিরোধী মনোভাব দেখা দেয় নেতাদের মধ্যে। এতে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। এরপর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণায় বিএনপি নেতাদের অপেক্ষা ছিল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার। ফলে কড়া আন্দোলনের হুমকি-ধামকি সরকারকে যেমন চাপে ফেলতে পারেনি, তেমনি উজ্জীবিত করতে পারেনি দলের তৃণমূলকে। কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির এ রহস্যময়তা রাজনৈতিক মহলে একটি প্রবাদের জন্ম দেয়।
বিএনপির আন্দোলন হচ্ছে, ‘শীতের হাফশার্ট আর গ্রীষ্মের ওভারকোট’। এ নিয়ে রীতিমতো কার্টুন ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। এভাবেই আন্দোলনের সময়-অসময় বিবেচনায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দিতে থাকে দলটি। বারবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব পিছু হটার কারণে আশাহত ও হতাশ হয়েছে তৃণমূল। অনেক ক্ষেত্রে কর্মসূচি প্রণয়ন ও ঘোষণার বিষয়গুলোতে অন্ধকারে ছিলেন শীর্ষ নেতারা। প্রশ্ন ওঠে, এ ধরনের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে যে প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন তা কি বিএনপির ছিল?
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আন্দোলন করলেও এখনও তার কোন বিকল্প সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে পারেনি বিএনপি। দেশের ইতিহাস বলে নেতারা ব্যর্থ হলে, তারা ভীরু হলে এগিয়ে আসে ছাত্ররা, ’৬৯ এবং ’৯০-এ তাই ঘটেছে। এবারে তা নেই। এবারে এসেছে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের শত নাগরিক। সেখানেও শত ছিল না। এক নাগরিক। প্রফেসর এমাজউদ্দীন সম্প্রতি বলেছেন, তিনি ঈদের আগেই ওই বিকল্প রূপরেখার খসড়া দেবেন। কিন্তু তার কোন খবর নেই। তিনি তা দিলেও তাতে বিএনপি চাঙ্গা হবে, সেটা ভাবা কঠিন।
দলটির পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে যে ফর্মুলা দেয়া হয়েছিল তাতে কোন দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ছিল না। এছাড়া, জনগণের সমস্যার চেয়ে ক্ষমতার পরিবর্তনকেন্দ্রিক কর্মসূচিই বেশি এসেছে দলটির তরফে। প্রো-অ্যাকটিভ রাজনীতির চেয়ে রি-অ্যাকটিভ রাজনীতির ঝোঁক বেড়েছে। ১৯৯০ থেকেই দেখা গেছে, বিরোধী দল কখনও শাসনগত ব্যর্থতা নিয়ে তেমন কোন কথা বলেন না। কারণ তারা ক্ষমতায় গিয়ে তেমন ধরনের শাসনই দেবেন। যেমন বিএনপি বলে না যে তারা ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগ কেমন হবে। বিচারক নিয়োগে নীতিমালা করবে। তারা পুলিশ সংস্কার করবে। মোবাইল কোর্ট বিলোপ করবে। এসব তারা করবে না। সেকারণেও বিএনপির আন্দোলনের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই। সরকারের শাসনগত নানা ব্যর্থতা নিয়ে বিএনপি ইস্যুভিত্তিক ছোটখাটো কর্মসূচি পালন করতে পারতো। জলাবদ্ধতায় মানুষ ডুবে মরছে। কিন্তু বিএনপির ওয়ার্ড কমিটিগুলো এবিষয়ে কোন কথা বলছে না। তারা চেয়ে থাকে কখন বড় ডাক আসবে। তাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এখনও কৌশল বদলাচ্ছেন না। তাদের কাছে বড় কর্মসূচির মানেই হলো হরতাল দেয়া, দেশ অচল করা। সরকার ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া। কেয়ারটেকারের অধীনে নতুন নির্বাচন আদায় করা। বিএনপিকে এই ভাষা বদলাতে হবে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে গেলে আর হরতাল, জ্বালাও পোড়াও করে আগের মতো যুৎ করতে পারবে না বলে অনেকেই মনে করেন।
বিএনপিকে অরাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক ও তার প্রতিবাদ জানাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে পরনির্ভর রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রাম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কখনও জামায়াতে ইসলামী, কখনও হেফাজতে ইসলাম, কখনও বিদেশী কূটনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করছে দলটি।
আন্দোলন ও বিপ্লব এক নয়। বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব দুটোই ঘটে আকস্মিক। বাংলাদেশে এর নজির থাকলেও গণআন্দোলন গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে। জনগণের ব্যাপকভিত্তিক সম্পৃক্ততায়। ১৯৫২ সালে পূর্ণতা পাওয়া ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভের মাধ্যমে। যা ’৬৬, ’৬৮, ’৬৯ হয়ে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ছাত্র বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। এরপর ’৮৪, ’৮৫, ’৮৬, ’৮৭, ’৮৮ হয়ে নব্বইয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং এরশাদের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন শুরু করেছিল ১৯৯৩ সালে। মাগুরা ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এরপর ধীরে ধীরে তারা চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে সংসদ থেকে গণপদত্যাগ করেছিল। বিএনপি নেতারা এই বাস্তবতা বিবেচনায় নেননি যে, দলটির ইতিহাসে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানোর নজির নেই। সাম্প্রতিক আন্দোলনে ধারাবাহিকতা ছিল কেবল খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী গণসংযোগে। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণায় কখনও ধীর আবার কখনও ছিল তাড়াহুড়ো।
ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নামে দেশের আলেম-ওলামাদের একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম। রাজধানীর শাপলা চত্বরে বিশাল একটি সমাবেশ করে তারা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে পড়েছিল সরকার। যদিও এ প্ল্যাটফরমটির নেপথ্য শক্তির রেকর্ড হচ্ছে সর্বদা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝে চলার। হেফাজতে ইসলামের উত্থান এবং জনসম্পৃক্ততা দেখে তাদের আন্দোলনের ঢেউকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল বিএনপি। দলটির কিছু তাত্ত্বিক শীর্ষ নেতৃত্বকে এ ঢেউয়ের ভেতর দেখিয়েছিলেন সুনামির সম্ভাবনা। কিন্তু হেফাজতকে রুখে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের কৌশল, আন্তর্জাতিক মহলের মনোভাব ও হেফাজতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। অবশ্য বিএনপির একাংশ হেফাজতকে সমর্থন না দিতে সতর্ক করে দিলেও কোন কোন অতি উৎসাহী নেতা বেগম জিয়াকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। পল্টনের এক মঞ্চে এনিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাদানুবাদও ঘটে। যে সম্ভাবনার ভিত্তিতে হেফাজতের দাবির প্রতি বিএনপি সমর্থন দেয়, দ্রুত তা দলটির জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতিই ত্বরান্বিত করে। প্রকাশ্যে হেফাজতকে সমর্থন দিলেও তাদেরকেও কার্যকর সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয় দলটি। এমনকি খালেদা জিয়ার নির্দেশনা সত্ত্বেও মহানগর বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। এবারও বিএনপির ঢাকা মহানগর নেতৃত্বের ব্যর্থতার মোড়কে বন্দি হয় আন্দোলন।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে কড়া আন্দোলনে যায় বিএনপি। সারা দেশে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারকে এ ইস্যুতে কার্যকর আলোচনায় বসাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু তারা অনুমান করতে পারেনি যে, তাদের বয়কট মোকাবিলায় সরকারি দল কি করতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে কৌশলে ১৫৩ আসনে বিনাভোটে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে আনে সরকার।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে এক রহস্যময় কর্মসূচি আসে ২০ দলের তরফে। আন্দোলনের মুখে সারা দেশ যখন রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তৃণমূলে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই আসে সে সিদ্ধান্ত। ২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশের জোরালো আন্দোলনকে ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঢাকার দলীয় নেতৃত্ব সেজন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তাদের সামর্থ্যও ছিল না। আখেরে দেখা যায় সেটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। একদিকে সরকার প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে সেটা রুখে দেয় অন্যদিকে সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়। বাস্তবে দেখা যায়, ২৯শে ডিসেম্বর রাজধানীতে একজন বিএনপি নেতাও রাজপথে নামার সাহস দেখাননি। অন্যদিকে ১৪৭টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে কিংবা বিএনপির বর্জনে নিরুৎসাহিত হয়ে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেন। তবে ভোটারদের এ মনোভাবকে বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। আত্মগোপনে গিয়ে দল পরিচালনা শুরু করেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার এ সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আত্মগোপন কৌশল অনেকটাই আত্মঘাতী হয়েছে বিএনপির। কারণ নেতারা আত্মগোপনে গিয়েও গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। বরং তাদের এই মনোভাব কর্মীদের হতাশ, জবাবদিহি ও দায়িত্ববিমুখ করে তোলে।
২৯শে ডিসেম্বর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মতো ফের রহস্যময় সিদ্ধান্ত আসে দলটির তরফে। ২০ দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠক থেকে কর্মসূচি দু’দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণার ১ ঘণ্টার ব্যবধানে রহস্যময় সিদ্ধান্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে একদিকে সরকারকে তাদের নড়বড়ে অবস্থান শক্ত করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়, অন্যদিকে ভেঙে দেয়া হয় কর্মী-সমর্থকদের মনোবল। ওই আন্দোলন থামানোটা ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু কারা এবং কেন সে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটিয়েছিল, তাদের ব্যাপারে কোন কথা বা সাংগঠনিক উদ্যোগ নেননি তিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রথমদিকে আন্দোলনের জন্য শরিক দলের ওপর নির্ভর করা। এতে একদিকে বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় সরকারের সুবিধা হয়েছে অন্যদিকে বিএনপি কর্মীদের করে তুলেছে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সুবিধাবাদী।
সরকার খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করেছে সেটা যেমন ঠিক, তেমনি বিএনপির দেশের সর্বস্তরের মানুষকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পাবলিক পরীক্ষা, জাতীয় দিবস পালন কোন কিছুই গ্রাহ্য করা হয়নি। কিন্তু আন্দোলন বা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনা যতই হোক, মানুষ কতদিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকবে? ১৫৩ আসনে নির্বাচন করতে না পারা এবং ১৪৭ আসনে ভোটের শতকরা হার বিবেচনায় ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতকরণে সফল বিএনপি। কিন্তু আইনগতভাবে সেখানে অসহায় বিএনপি। সর্বোচ্চ আদালতে একটি ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্যও বুঝতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব। পঁচাত্তরের পরে প্রতিকূল অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইলে লাগাতার নির্বাচন বয়কট করতে পারতো, কিন্তু সেটা তারা করেনি। এক অর্থে বিএনপির অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে। তারা হেরেছে। এবং সে ফল নিয়ে তারা সংসদেও বসেছে।
No comments