গ্রিসের ঋণ সংকট: ঋণ পরিশোধের অনেক উপায় আছে by টমাস পিকেটি
টমাস পিকেটি |
জার্মানির ডাই সাইট পত্রিকাকে দেওয়া এক তেজস্বী সাক্ষাৎকারে বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরির লেখক টমাস পিকেটি
বলেছেন, ইউরোপের ঋণ পুনর্গঠন করতে সবার আলোচনায় বসা উচিত। গ্রিসের সঙ্গে
যে জবরদস্তি করা হয়েছে, তার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, ঋণ দেওয়া-নেওয়ার
ইতিহাসে অনেক বিপরীতধর্মী ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে প্রকাশিত হলো।
ডাই সাইট: গ্রিস কীভাবে এই ঋণসংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
টমাস পিকেটি: ইউরোপের সব ঋণ নিয়েই আমাদের আলোচনা করা উচিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও এমন আলোচনা হয়েছিল। শুধু গ্রিস নয়, ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশের ঋণও পুনর্গঠন করা উচিত, ব্যাপারটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এথেন্সের সঙ্গে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ছয় মাস সময় হারিয়েছি। ইউরো গ্রুপের ধারণা হচ্ছে, গ্রিস তাদের বাজেটের ৪ শতাংশ উদ্বৃত্ত অর্জন করে আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করবে। এ বিষয়টি এখনো আলোচনার টেবিলে আছে। সবাই মনে করছে, ২০১৫ সালে তারা ১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২ শতাংশ ও ২০১৭ সালে সাড়ে ৩ শতাংশ উদ্বৃত্ত অর্জন করবে। ব্যাপারটা একদমই হাস্যকর! এটা কখনো হবে না। তারপরও যে বিতর্কটা করা প্রয়োজন, সেটা আমরা বহুদিন ধরে স্থগিত করেই যাচ্ছি।
ডাই সাইট: বড় অঙ্কের ঋণ মওকুফ হলে কী হতে পারে?
টমাস পিকেটি: ঋণ যাতে আবার নতুন করে না বাড়ে সে লক্ষ্যে নতুন ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান দরকার হবে, যারা বাজেট ঘাটতির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করবে। যেমন ইউরোপীয় সংসদে বিভিন্ন দেশের সাংসদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বাজেট-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। ইউরোপের গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন করলে তা হবে নিদারুণ এক ভুল। জার্মানি এখন ঠিক সে কাজটিই করছে, তারা এখন পীড়াপীড়ি করছে, রাষ্ট্রগুলোকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যপীড়িত রাখা হোক।
ডাই সাইট: কিন্তু গ্রিসের কি ঋণ পরিশোধ করা উচিত নয়?
টমাস পিকেটি: আমি আমার বইয়ে আয় ও সম্পদের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছি, জাতির ইতিহাস বিষয়েও বলেছি। বইটি লেখার সময় যে বিষয়টি আমাকে ধাক্কা দিয়েছে তা হলো, জার্মানিই একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যারা তাদের ইতিহাসে কখনো বাহ্যিক ঋণ পরিশোধ করেনি। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—কোনোটির পরেও তারা সেটা করেনি। যদিও সে অন্য দেশগুলোকে নিয়মিতভাবে টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য করেছে। যেমন, ১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুসীয় যুদ্ধের পর তারা পরাজিত ফ্রান্সের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতি বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করেছিল, সেটা তারা আদায়ও করেছিল। ফলে ফরাসিদের বহুদিন ভুগতে হয়েছে। আসলে সার্বভৌম ঋণের ইতিহাসে নানা বিপরীতধর্মী ঘটনা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার কদাচিৎই মানা হয়।
ডাই সাইট: আপনি বলতে চাইছেন, যে দেশগুলো ঋণ পরিশোধ করে না, তারাই বিজয়ী হয়?
টমাস পিকেটি: জার্মানি আসলে ঠিক সে রকমই একটা দেশ। কিন্তু না, ইতিহাসে দেখা যায়, ঋণগ্রস্ত দেশগুলো দুভাবে সংকট থেকে বেরোতে পারে। একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৯ শতকে, নেপোলিয়নের সঙ্গে ব্যয়বহুল যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যা করেছিল। প্রক্রিয়া হিসেবে তা ছিল ধীরগতির, যে তরিকা এখন গ্রিসের জন্য বাতলানো হচ্ছে। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কঠোরভাবে বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করেছিল। এই তরিকা কাজ করলেও তা শেষ হতে অনেক সময় লেগেছিল। এই ঋণ পরিশোধ করতে ব্রিটিশরা ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের অর্থনীতির ২ থেকে ৩ শতাংশ ব্যয় করেছে। স্কুল ও শিক্ষার পেছনেও ব্রিটিশরা সে সময় এত ব্যয় করেনি। এটা হওয়া উচিত ছিল না, এখনো হওয়া উচিত নয়। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি খুবই দ্রুত গতির, জার্মানি ২০ শতকে তা প্রমাণ করেছে। মূলত এর তিনটি উপাদান আছে: মূল্যস্ফীতি, ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর বিশেষ করারোপ, ঋণ ছাড়।
ডাই সাইট: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, জার্মানির অর্থনীতিতে যে অলৌকিক কাণ্ড ঘটেছে, তার ভিত্তি ছিল সেই একই রকম ঋণ ছাড়, যেটা আজ গ্রিসকে দেওয়া হচ্ছে না?
টমাস পিকেটি: ঠিক তা-ই, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জার্মানির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল তার মোট দেশজ উৎপাদনের ২০০ শতাংশ। ১০ বছর পর দেখা গেল, সেই ঋণভারের ছিটেফোঁটা মাত্র আছে, মোট দেশজ উৎপাদনের ২০ শতাংশ। সেই একই সময়ে ফ্রান্সও একরকম চাতুরীর সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলা এনে এত দ্রুত ঋণ কমানো সম্ভব ছিল না, আজ যেটা গ্রিসের জন্য আমরা সুপারিশ করছি। ১৯৫৩ সালের লন্ডন ঋণ চুক্তির কথা ভাবুন, যেখানে জার্মানির বিদেশি ঋণের ৬০ শতাংশ বাতিল করা হয়েছিল, আর তার অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল।
ডাই সাইট: সেটা হওয়ার কারণ হচ্ছে, মানুষ বুঝতে পেরেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির কাছ থেকে যে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল, সে কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মানুষ সেবার জার্মানির পাপ মাফ করে দিতে চেয়েছিল!
টমাস পিকেটি: এর কোনো অর্থ হয় না। এর সঙ্গে নৈতিক স্বচ্ছতার সম্পর্ক নেই, এটা ছিল যৌক্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা বুঝতে পেরেছিল, গুরুতর সংকটের পর যে বিশাল ঋণভার সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর মানুষকে একসময় ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে, সঠিকভাবেই তারা এটা বুঝতে পেরেছিল। আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে দাবি করতে পারি না, তাদের মা-বাবারা যে ভুল করেছিলেন, তার জন্য তারা দশকের পর দশক ধরে মাশুল দিয়েই যাবে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত গ্রিক সরকার হিসাবে জালিয়াতি করেছে। কিন্তু এটা ছাড়া গ্রিসের নতুন প্রজন্মের আর কোনো দায় নেই, ঠিক যেমন ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের জার্মানদের দায় ছিল না। ইউরোপ প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল ঋণ মওকুফ ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ভিত্তিতে, চিরকাল ধরে শাস্তি ভোগের ভিত্তিতে নয়।
ডাই সাইট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সভ্যতা ভেঙে পড়েছিল, ইউরোপ যেন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তো ভিন্ন।
টমাস পিকেটি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির মিল নেই, এমন কথা বললে ভুল হবে। ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সংকটের কথা চিন্তা করুন। ওটা স্রেফ সংকট ছিল না। ওটা ছিল ১৯২৯ সালের পর সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকট। সে কারণে এই তুলনা করাটা সাজে। গ্রিসের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা একইভাবে সত্য: ২০০৯-১৫ সালের মধ্যে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমেছে। এটা ১৯২৯-৩৫ সালের জার্মানি ও ফ্রান্সের মন্দার সঙ্গে তুলনীয়। গ্রেট ব্রিটেনও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এটা নতুন সমস্যা নয়। আর ঋণ পরিশোধের অনেক উপায়ই আছে, একটি নয়। এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
টমাস পিকেটি: ফরাসি অর্থনীতিবিদ।
ডাই সাইট: গ্রিস কীভাবে এই ঋণসংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
টমাস পিকেটি: ইউরোপের সব ঋণ নিয়েই আমাদের আলোচনা করা উচিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও এমন আলোচনা হয়েছিল। শুধু গ্রিস নয়, ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশের ঋণও পুনর্গঠন করা উচিত, ব্যাপারটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এথেন্সের সঙ্গে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ছয় মাস সময় হারিয়েছি। ইউরো গ্রুপের ধারণা হচ্ছে, গ্রিস তাদের বাজেটের ৪ শতাংশ উদ্বৃত্ত অর্জন করে আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করবে। এ বিষয়টি এখনো আলোচনার টেবিলে আছে। সবাই মনে করছে, ২০১৫ সালে তারা ১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২ শতাংশ ও ২০১৭ সালে সাড়ে ৩ শতাংশ উদ্বৃত্ত অর্জন করবে। ব্যাপারটা একদমই হাস্যকর! এটা কখনো হবে না। তারপরও যে বিতর্কটা করা প্রয়োজন, সেটা আমরা বহুদিন ধরে স্থগিত করেই যাচ্ছি।
ডাই সাইট: বড় অঙ্কের ঋণ মওকুফ হলে কী হতে পারে?
টমাস পিকেটি: ঋণ যাতে আবার নতুন করে না বাড়ে সে লক্ষ্যে নতুন ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান দরকার হবে, যারা বাজেট ঘাটতির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করবে। যেমন ইউরোপীয় সংসদে বিভিন্ন দেশের সাংসদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বাজেট-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। ইউরোপের গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন করলে তা হবে নিদারুণ এক ভুল। জার্মানি এখন ঠিক সে কাজটিই করছে, তারা এখন পীড়াপীড়ি করছে, রাষ্ট্রগুলোকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যপীড়িত রাখা হোক।
ডাই সাইট: কিন্তু গ্রিসের কি ঋণ পরিশোধ করা উচিত নয়?
টমাস পিকেটি: আমি আমার বইয়ে আয় ও সম্পদের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছি, জাতির ইতিহাস বিষয়েও বলেছি। বইটি লেখার সময় যে বিষয়টি আমাকে ধাক্কা দিয়েছে তা হলো, জার্মানিই একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যারা তাদের ইতিহাসে কখনো বাহ্যিক ঋণ পরিশোধ করেনি। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—কোনোটির পরেও তারা সেটা করেনি। যদিও সে অন্য দেশগুলোকে নিয়মিতভাবে টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য করেছে। যেমন, ১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুসীয় যুদ্ধের পর তারা পরাজিত ফ্রান্সের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতি বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করেছিল, সেটা তারা আদায়ও করেছিল। ফলে ফরাসিদের বহুদিন ভুগতে হয়েছে। আসলে সার্বভৌম ঋণের ইতিহাসে নানা বিপরীতধর্মী ঘটনা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার কদাচিৎই মানা হয়।
ডাই সাইট: আপনি বলতে চাইছেন, যে দেশগুলো ঋণ পরিশোধ করে না, তারাই বিজয়ী হয়?
টমাস পিকেটি: জার্মানি আসলে ঠিক সে রকমই একটা দেশ। কিন্তু না, ইতিহাসে দেখা যায়, ঋণগ্রস্ত দেশগুলো দুভাবে সংকট থেকে বেরোতে পারে। একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৯ শতকে, নেপোলিয়নের সঙ্গে ব্যয়বহুল যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যা করেছিল। প্রক্রিয়া হিসেবে তা ছিল ধীরগতির, যে তরিকা এখন গ্রিসের জন্য বাতলানো হচ্ছে। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কঠোরভাবে বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করেছিল। এই তরিকা কাজ করলেও তা শেষ হতে অনেক সময় লেগেছিল। এই ঋণ পরিশোধ করতে ব্রিটিশরা ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের অর্থনীতির ২ থেকে ৩ শতাংশ ব্যয় করেছে। স্কুল ও শিক্ষার পেছনেও ব্রিটিশরা সে সময় এত ব্যয় করেনি। এটা হওয়া উচিত ছিল না, এখনো হওয়া উচিত নয়। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি খুবই দ্রুত গতির, জার্মানি ২০ শতকে তা প্রমাণ করেছে। মূলত এর তিনটি উপাদান আছে: মূল্যস্ফীতি, ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর বিশেষ করারোপ, ঋণ ছাড়।
ডাই সাইট: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, জার্মানির অর্থনীতিতে যে অলৌকিক কাণ্ড ঘটেছে, তার ভিত্তি ছিল সেই একই রকম ঋণ ছাড়, যেটা আজ গ্রিসকে দেওয়া হচ্ছে না?
টমাস পিকেটি: ঠিক তা-ই, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জার্মানির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল তার মোট দেশজ উৎপাদনের ২০০ শতাংশ। ১০ বছর পর দেখা গেল, সেই ঋণভারের ছিটেফোঁটা মাত্র আছে, মোট দেশজ উৎপাদনের ২০ শতাংশ। সেই একই সময়ে ফ্রান্সও একরকম চাতুরীর সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলা এনে এত দ্রুত ঋণ কমানো সম্ভব ছিল না, আজ যেটা গ্রিসের জন্য আমরা সুপারিশ করছি। ১৯৫৩ সালের লন্ডন ঋণ চুক্তির কথা ভাবুন, যেখানে জার্মানির বিদেশি ঋণের ৬০ শতাংশ বাতিল করা হয়েছিল, আর তার অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল।
ডাই সাইট: সেটা হওয়ার কারণ হচ্ছে, মানুষ বুঝতে পেরেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির কাছ থেকে যে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল, সে কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মানুষ সেবার জার্মানির পাপ মাফ করে দিতে চেয়েছিল!
টমাস পিকেটি: এর কোনো অর্থ হয় না। এর সঙ্গে নৈতিক স্বচ্ছতার সম্পর্ক নেই, এটা ছিল যৌক্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা বুঝতে পেরেছিল, গুরুতর সংকটের পর যে বিশাল ঋণভার সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর মানুষকে একসময় ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে, সঠিকভাবেই তারা এটা বুঝতে পেরেছিল। আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে দাবি করতে পারি না, তাদের মা-বাবারা যে ভুল করেছিলেন, তার জন্য তারা দশকের পর দশক ধরে মাশুল দিয়েই যাবে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত গ্রিক সরকার হিসাবে জালিয়াতি করেছে। কিন্তু এটা ছাড়া গ্রিসের নতুন প্রজন্মের আর কোনো দায় নেই, ঠিক যেমন ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের জার্মানদের দায় ছিল না। ইউরোপ প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল ঋণ মওকুফ ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ভিত্তিতে, চিরকাল ধরে শাস্তি ভোগের ভিত্তিতে নয়।
ডাই সাইট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সভ্যতা ভেঙে পড়েছিল, ইউরোপ যেন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তো ভিন্ন।
টমাস পিকেটি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির মিল নেই, এমন কথা বললে ভুল হবে। ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সংকটের কথা চিন্তা করুন। ওটা স্রেফ সংকট ছিল না। ওটা ছিল ১৯২৯ সালের পর সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকট। সে কারণে এই তুলনা করাটা সাজে। গ্রিসের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা একইভাবে সত্য: ২০০৯-১৫ সালের মধ্যে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমেছে। এটা ১৯২৯-৩৫ সালের জার্মানি ও ফ্রান্সের মন্দার সঙ্গে তুলনীয়। গ্রেট ব্রিটেনও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এটা নতুন সমস্যা নয়। আর ঋণ পরিশোধের অনেক উপায়ই আছে, একটি নয়। এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
টমাস পিকেটি: ফরাসি অর্থনীতিবিদ।
No comments