বাজেট বক্তৃতারই সংস্কার প্রয়োজন by শওকত হোসেন
ব্রিটিশ
অর্থনীতিবিদ আরনেস্ট ফ্রেডারিক সুমাখার ১৯৭৩ সালে অর্থনীতি নিয়ে বিখ্যাত
একটি বই লিখেছিলেন, স্মল ইজ বিউটিফুল: আ স্টাডি অব ইকোনমিকস এজ ইফ পিপল
ম্যাটারড। তবে অর্থনীতিতে ‘ছোটই সুন্দর’—এই ধারণা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা যত
কথাই বলুন, ইংরেজি সাহিত্যের একসময়ের ছাত্র বলেই হয়তো আমাদের অর্থমন্ত্রী
শেক্সপিয়ারকেই বেশি মনে রেখেছেন। হ্যামলেট নাটকে রাজা ক্লডিয়াস সৎপুত্রের
বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতে পলোনিয়াসকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পলোনিয়াস
হ্যামলেটের খবর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্রেভিটি ইজ দ্য সউল অব উইট’। কিন্তু
আমাদের অর্থমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতায় মোটেই আগ্রহী নন।
৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বাজেট উপস্থাপন করলেন, তার মূল বক্তৃতা ৯০ পৃষ্ঠার। তবে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা নয়; ২০১১-১২ অর্থবছরের মূল বাজেট বক্তৃতা ছিল ১৪৮ পৃষ্ঠার, ২০১২-১৩ অর্থবছরেরটি ১২৩ পৃষ্ঠার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বক্তৃতা ছিল ১১৯ পৃষ্ঠার।
ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একসময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের সেই বাজেট বক্তৃতা শুনে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘দ্য শর্টেস্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার হ্যাজ ডেলিভারড দ্য লংগেস্ট বাজেট স্পিচ।’ একটু বড় বাজেট বক্তৃতা হলে আজকাল অনেকেই এ কথাটি ব্যবহার করেন। অর্থমন্ত্রীদের এসব দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শুনেই হয়তো অক্সফোর্ডের অধ্যাপক রবার্ট সার্ভিস বলেছিলেন, আপনি তখনই দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারবেন, যখন শ্রোতাদের পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। সংসদ অধিবেশন থেকে সরকারি দলের কারোরই পালানোর সুযোগ আসলেই নেই।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দেওয়া বাজেট বক্তৃতাটি ছিল দুই ঘণ্টা পাঁচ মিনিটের। আর বক্তৃতাটি ছিল ৪৪ পৃষ্ঠার। দীর্ঘ বক্তৃতার এর আগের রেকর্ডটি ছিল প্রণব মুখার্জির, তাঁর শেষ বাজেট ২০১২-১৩ অর্থবছরের, আর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৬। বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী উইলিয়াম গোল্ডস্টোন, ১৮৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল। ওই বক্তৃতাটি ছিল চার ঘণ্টা ৪৫ মিনিটব্যাপী। এর প্রায় পৌনে ২০০ বছর পর দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতাদাতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আমাদের অর্থমন্ত্রী স্থান পাবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
সংবাদপত্রকর্মী হিসেবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা পুরোটাই শুনতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, পুরো বক্তৃতা শোনাটা কষ্টকর। আকর্ষণীয় হলে দীর্ঘ বক্তৃতার শ্রোতা পাওয়া যায়। কিন্তু বাজেট বক্তৃতা আকর্ষণীয় করা সহজ নয়। এখন গুগল সব জানে। গুগলের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীদের বাজেট বক্তৃতা পাওয়া কঠিন নয়। বেশ কয়েকটি বাজেট বক্তৃতা পড়ে মনে হয়েছে, আমাদেরটাই কম আকর্ষণীয়। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয়, আমাদের বাজেট বক্তৃতার ধরনটি পাকিস্তানের মতোই।
এবারের বাজেট বক্তৃতায় অধ্যায় ১০টি, আর অনুচ্ছেদ আছে ২৩৩টি। এর মধ্যে ৩৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আছে ছয়টি অধ্যায়। এখানে মূলত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাজেট সংশোধনী ও নতুন বাজেট এবং সরকারের উন্নয়ন কৌশলের বর্ণনা রয়েছে।
এগুলো অবশ্যই প্রয়োজনীয়, পড়াটাও কষ্টকর নয়। অষ্টম অধ্যায়টি মূলত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সাফল্যের ফিরিস্তি। এ জন্য বরাদ্দ ১৪ পাতা। এরপরেই আছে সংস্কার ও সুশাসন নামে সাত পাতার একটি অধ্যায়। এ দুই অধ্যায় থেকে নতুন তথ্য পাওয়া গেল সামান্য কয়েকটি। এর মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা পাঁচ হাজার থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া গেল না। অরুণ জেটলি যেমনটি করেছেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী তা করলেই পারতেন। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এসব ফিরিস্তি অরুণ জেটলি পরিশিষ্টে রেখে দিয়েছেন। কারও আগ্রহ থাকলে সেখান থেকেই পড়ে নিতে পারবেন।
অথচ বাজেট বক্তৃতা আগে এত দীর্ঘ ছিল না। আগে বক্তৃতা দেওয়া হতো দুই পর্বে। রাজস্ব কার্যক্রম ছিল দ্বিতীয় পর্বের বক্তৃতার অংশ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যতিক্রমী সময়টা বাদ দিলে বাজেট বক্তৃতা এক পর্বে শেষ করার কাজটি শুরু করেছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী। বক্তৃতায় আরও একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে অর্থমন্ত্রীরা বাজেটে কবিতার অংশ ব্যবহার করতেন। থাকত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বা সাবেক কোনো রাষ্ট্রনায়কের কথা। এ ধারার প্রথম পরিবর্তন আনেন এম সাইফুর রহমান। ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রশংসার অংশবিশেষ বাজেটে স্থান পেতে শুরু করল। কবিতাকে ছুটি দিয়ে দাতাদের সার্টিফিকেটের কেন প্রয়োজন হয়েছিল, সেটি একটি প্রশ্ন।
বাজেটের আগের দিন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, তাঁর বাজেট দীর্ঘ, কারণ এখানে সবকিছু বিস্তারিত বলা থাকে। এবার দেখা যাক বিস্তারিত বাজেটের নমুনা। অর্থমন্ত্রী ৬২ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। খবর নিয়ে যা জানা গেল, বেতন অংশ এবার কার্যকর হচ্ছে আর ভাতার অংশ কার্যকর হবে পরের অর্থবছর থেকে। এ কথাটা পরিষ্কার বললেই হতো।
১৯৭৫ থেকে শুরু করে ২০০৮ পর্যন্ত বাজেট বক্তৃতাগুলোতে প্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য থাকত। কী কী পদ্ধতিতে কালোটাকা সাদা হবে, তার বিস্তারিত যেমন বলা হতো, তেমনি আগের দেওয়া সুযোগ কতজন নিয়েছেন এবং এই উদ্যোগ সফল হলো কি না, তারও বিবরণ থাকত। এখন হয় উল্টো। যেমন: ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ না করেই অর্থমন্ত্রী কালোটাকা সাদা করার বিধানটি আয়কর আইনে স্থায়ী করে দিয়েছিলেন, যা বাতিল করেছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর এবার ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকার মালিকদের আরও বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কিছুই উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী।
সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজটি হয়েছে চিনি নিয়ে। বাজেটে অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক সাড়ে চার হাজার থেকে বাড়িয়ে আট হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ বাজেট বক্তৃতায় এর উল্লেখ নেই।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বললেন, এ রকম কিছু তিনি বক্তৃতায় বলেননি। তাহলে কীভাবে এল? সে কথাটি ফাঁস করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনেই তিনি অর্থমন্ত্রীকে জানান, ‘স্যার, রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার বক্তৃতায় এটা রাখা হয়নি, তবে ছকে রয়ে গেছে।’ এই হচ্ছে আমাদের বাজেট বক্তৃতা। বাজেটে অনেক বেশি কথা বলা হয়, জরুরি অনেক কথাই বলা হয় না। আবার অনেক সময় বেশি কথা বলা হয় বলেই হয়তো আসল কথাটি হারিয়ে যায়।
অনেক দেশেই এখন বাজেটের মৌলিক প্রস্তাবগুলো আগেই প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর গ্রহণযোগ্য হলে তবেই তা বাজেটে স্থান পায়। আমাদের পথটা উল্টো। কাজটি শুরু করেছিলেন শাহ এম এস কিবরিয়া। এর পেছেনে রাজনীতি আছে বলেই ধারণা করা যায়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। অর্থমন্ত্রী জুনের প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট উপস্থাপন করেন। আর বাজেট পাসের দিন প্রধানমন্ত্রী কিছু প্রস্তাব সংশোধনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। আর অর্থমন্ত্রী তা মেনে নেন। এরপরেই পাস হয় বাজেট। এতে সরকার যে সাধারণ মানুষের কথা কতটা ভাবে, সেটি প্রমাণ করা যায়।
এই জনতুিষ্টমূলক কর্মকাণ্ডে সমস্যা হয় অন্যত্র। আজি হতে শতবর্ষ পরে না হলেও ১০ বছর পরও যদি কোনো গবেষক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে বাজেট বক্তৃতাগুলো পড়েন, তাহলে অনেকগুলো ভুল তথ্য পাবেন। কারণ, বক্তৃতায় লেখা অনেক প্রস্তাবই পরে বদলে গেছে। সে তথ্যটি কিন্তু ওয়েবসাইটে নেই। একটি উদাহরণ দিই। ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলা আছে—ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ ৮০ হাজারই থাকবে, কোনো পরিবর্তন হবে না। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বক্তৃতায় আছে, ওই করমুক্ত আয়ের সীমা এখন দুই লাখ টাকা। তাহলে সিদ্ধান্তটা বদলে গেল কবে? ২০১২ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আয়সীমা বাড়ানোসহ জনতুষ্টির এই কাজটি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে।
আমরা অনেক কিছুরই সংস্কার করতে বলি। এখন সময় এসেছে বাজেট বক্তৃতার সংস্কারের। কাজটি কি অর্থমন্ত্রী করবেন? তাহলে কি বাজেটে নতুন কিছুই নেই? আছে তো। এবারের বাজেট বক্তৃতার বইটির প্রচ্ছদ সবুজ, আগের সবগুলোই ছিল সাদা-কালো।
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বাজেট উপস্থাপন করলেন, তার মূল বক্তৃতা ৯০ পৃষ্ঠার। তবে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা নয়; ২০১১-১২ অর্থবছরের মূল বাজেট বক্তৃতা ছিল ১৪৮ পৃষ্ঠার, ২০১২-১৩ অর্থবছরেরটি ১২৩ পৃষ্ঠার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বক্তৃতা ছিল ১১৯ পৃষ্ঠার।
ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একসময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের সেই বাজেট বক্তৃতা শুনে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘দ্য শর্টেস্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার হ্যাজ ডেলিভারড দ্য লংগেস্ট বাজেট স্পিচ।’ একটু বড় বাজেট বক্তৃতা হলে আজকাল অনেকেই এ কথাটি ব্যবহার করেন। অর্থমন্ত্রীদের এসব দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শুনেই হয়তো অক্সফোর্ডের অধ্যাপক রবার্ট সার্ভিস বলেছিলেন, আপনি তখনই দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারবেন, যখন শ্রোতাদের পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। সংসদ অধিবেশন থেকে সরকারি দলের কারোরই পালানোর সুযোগ আসলেই নেই।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দেওয়া বাজেট বক্তৃতাটি ছিল দুই ঘণ্টা পাঁচ মিনিটের। আর বক্তৃতাটি ছিল ৪৪ পৃষ্ঠার। দীর্ঘ বক্তৃতার এর আগের রেকর্ডটি ছিল প্রণব মুখার্জির, তাঁর শেষ বাজেট ২০১২-১৩ অর্থবছরের, আর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৬। বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী উইলিয়াম গোল্ডস্টোন, ১৮৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল। ওই বক্তৃতাটি ছিল চার ঘণ্টা ৪৫ মিনিটব্যাপী। এর প্রায় পৌনে ২০০ বছর পর দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতাদাতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আমাদের অর্থমন্ত্রী স্থান পাবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
সংবাদপত্রকর্মী হিসেবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা পুরোটাই শুনতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, পুরো বক্তৃতা শোনাটা কষ্টকর। আকর্ষণীয় হলে দীর্ঘ বক্তৃতার শ্রোতা পাওয়া যায়। কিন্তু বাজেট বক্তৃতা আকর্ষণীয় করা সহজ নয়। এখন গুগল সব জানে। গুগলের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীদের বাজেট বক্তৃতা পাওয়া কঠিন নয়। বেশ কয়েকটি বাজেট বক্তৃতা পড়ে মনে হয়েছে, আমাদেরটাই কম আকর্ষণীয়। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয়, আমাদের বাজেট বক্তৃতার ধরনটি পাকিস্তানের মতোই।
এবারের বাজেট বক্তৃতায় অধ্যায় ১০টি, আর অনুচ্ছেদ আছে ২৩৩টি। এর মধ্যে ৩৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আছে ছয়টি অধ্যায়। এখানে মূলত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাজেট সংশোধনী ও নতুন বাজেট এবং সরকারের উন্নয়ন কৌশলের বর্ণনা রয়েছে।
এগুলো অবশ্যই প্রয়োজনীয়, পড়াটাও কষ্টকর নয়। অষ্টম অধ্যায়টি মূলত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সাফল্যের ফিরিস্তি। এ জন্য বরাদ্দ ১৪ পাতা। এরপরেই আছে সংস্কার ও সুশাসন নামে সাত পাতার একটি অধ্যায়। এ দুই অধ্যায় থেকে নতুন তথ্য পাওয়া গেল সামান্য কয়েকটি। এর মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা পাঁচ হাজার থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া গেল না। অরুণ জেটলি যেমনটি করেছেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী তা করলেই পারতেন। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এসব ফিরিস্তি অরুণ জেটলি পরিশিষ্টে রেখে দিয়েছেন। কারও আগ্রহ থাকলে সেখান থেকেই পড়ে নিতে পারবেন।
অথচ বাজেট বক্তৃতা আগে এত দীর্ঘ ছিল না। আগে বক্তৃতা দেওয়া হতো দুই পর্বে। রাজস্ব কার্যক্রম ছিল দ্বিতীয় পর্বের বক্তৃতার অংশ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যতিক্রমী সময়টা বাদ দিলে বাজেট বক্তৃতা এক পর্বে শেষ করার কাজটি শুরু করেছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী। বক্তৃতায় আরও একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে অর্থমন্ত্রীরা বাজেটে কবিতার অংশ ব্যবহার করতেন। থাকত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বা সাবেক কোনো রাষ্ট্রনায়কের কথা। এ ধারার প্রথম পরিবর্তন আনেন এম সাইফুর রহমান। ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রশংসার অংশবিশেষ বাজেটে স্থান পেতে শুরু করল। কবিতাকে ছুটি দিয়ে দাতাদের সার্টিফিকেটের কেন প্রয়োজন হয়েছিল, সেটি একটি প্রশ্ন।
বাজেটের আগের দিন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, তাঁর বাজেট দীর্ঘ, কারণ এখানে সবকিছু বিস্তারিত বলা থাকে। এবার দেখা যাক বিস্তারিত বাজেটের নমুনা। অর্থমন্ত্রী ৬২ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। খবর নিয়ে যা জানা গেল, বেতন অংশ এবার কার্যকর হচ্ছে আর ভাতার অংশ কার্যকর হবে পরের অর্থবছর থেকে। এ কথাটা পরিষ্কার বললেই হতো।
১৯৭৫ থেকে শুরু করে ২০০৮ পর্যন্ত বাজেট বক্তৃতাগুলোতে প্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য থাকত। কী কী পদ্ধতিতে কালোটাকা সাদা হবে, তার বিস্তারিত যেমন বলা হতো, তেমনি আগের দেওয়া সুযোগ কতজন নিয়েছেন এবং এই উদ্যোগ সফল হলো কি না, তারও বিবরণ থাকত। এখন হয় উল্টো। যেমন: ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ না করেই অর্থমন্ত্রী কালোটাকা সাদা করার বিধানটি আয়কর আইনে স্থায়ী করে দিয়েছিলেন, যা বাতিল করেছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর এবার ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকার মালিকদের আরও বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কিছুই উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী।
সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজটি হয়েছে চিনি নিয়ে। বাজেটে অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক সাড়ে চার হাজার থেকে বাড়িয়ে আট হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ বাজেট বক্তৃতায় এর উল্লেখ নেই।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বললেন, এ রকম কিছু তিনি বক্তৃতায় বলেননি। তাহলে কীভাবে এল? সে কথাটি ফাঁস করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনেই তিনি অর্থমন্ত্রীকে জানান, ‘স্যার, রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার বক্তৃতায় এটা রাখা হয়নি, তবে ছকে রয়ে গেছে।’ এই হচ্ছে আমাদের বাজেট বক্তৃতা। বাজেটে অনেক বেশি কথা বলা হয়, জরুরি অনেক কথাই বলা হয় না। আবার অনেক সময় বেশি কথা বলা হয় বলেই হয়তো আসল কথাটি হারিয়ে যায়।
অনেক দেশেই এখন বাজেটের মৌলিক প্রস্তাবগুলো আগেই প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর গ্রহণযোগ্য হলে তবেই তা বাজেটে স্থান পায়। আমাদের পথটা উল্টো। কাজটি শুরু করেছিলেন শাহ এম এস কিবরিয়া। এর পেছেনে রাজনীতি আছে বলেই ধারণা করা যায়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। অর্থমন্ত্রী জুনের প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট উপস্থাপন করেন। আর বাজেট পাসের দিন প্রধানমন্ত্রী কিছু প্রস্তাব সংশোধনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। আর অর্থমন্ত্রী তা মেনে নেন। এরপরেই পাস হয় বাজেট। এতে সরকার যে সাধারণ মানুষের কথা কতটা ভাবে, সেটি প্রমাণ করা যায়।
এই জনতুিষ্টমূলক কর্মকাণ্ডে সমস্যা হয় অন্যত্র। আজি হতে শতবর্ষ পরে না হলেও ১০ বছর পরও যদি কোনো গবেষক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে বাজেট বক্তৃতাগুলো পড়েন, তাহলে অনেকগুলো ভুল তথ্য পাবেন। কারণ, বক্তৃতায় লেখা অনেক প্রস্তাবই পরে বদলে গেছে। সে তথ্যটি কিন্তু ওয়েবসাইটে নেই। একটি উদাহরণ দিই। ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলা আছে—ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ ৮০ হাজারই থাকবে, কোনো পরিবর্তন হবে না। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বক্তৃতায় আছে, ওই করমুক্ত আয়ের সীমা এখন দুই লাখ টাকা। তাহলে সিদ্ধান্তটা বদলে গেল কবে? ২০১২ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আয়সীমা বাড়ানোসহ জনতুষ্টির এই কাজটি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে।
আমরা অনেক কিছুরই সংস্কার করতে বলি। এখন সময় এসেছে বাজেট বক্তৃতার সংস্কারের। কাজটি কি অর্থমন্ত্রী করবেন? তাহলে কি বাজেটে নতুন কিছুই নেই? আছে তো। এবারের বাজেট বক্তৃতার বইটির প্রচ্ছদ সবুজ, আগের সবগুলোই ছিল সাদা-কালো।
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
No comments