ভোট নিয়ে ভুতুড়ে কাণ্ড by বদিউল আলম মজুমদার
ঢাকার
দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কেন্দ্র দখল
করে সিল মারাসহ কারচুপির বহু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।
কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল পর্যালোচনার পর মনে হচ্ছে যে এসব নির্বাচনে ভোট
নিয়ে বাস্তবেই ব্যাপক ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি
করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচনের সঙ্গে ২০১০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের
তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
এবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ জন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন আ জ ম নাছির উিদ্দন, আর বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বিদায়ী মেয়র মনজুর আলম। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৬০০। ভোট পড়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৩ (৪৭.৯০ শতাংশ), যার মধ্যে বৈধ ৮ লাখ ২১ হাজার ৩৭১ এবং অবৈধ ৪৭ হাজার ২৯২ ভোট। মোট বৈধ ভোটে নাছির পেয়েছেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ (৫৭.৮৭ শতাংশ) এবং মনজুর আলম ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ (৩৭.১১ শতাংশ)। তবে একটি কেন্দ্রের (হালিশহর মেহের আফজল উচ্চবিদ্যালয়) ৩ হাজার ৬২৯টি ভোটের মধ্যে মনজুর আলম একটি ভোটও পাননি, যদিও ২০১০ সালের নির্বাচনে সেই কেন্দ্রে তিনি ৬১৬টি ভোট পেয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৭। ভোট পড়েছিল ৯ লাখ ২১ হাজার ৩৮৯ (৫৪.৬০ শতাংশ), যার মধ্যে বৈধ ভোট ছিল ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৫, অবৈধ ৩৫ হাজার ৫৪৪। মোট বৈধ ভোটের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিদায়ী মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ (৪৩.৩২ শতাংশ) এবং বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৮ (৫৪.১৫ শতাংশ) ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৭১৯টি ভোটকেন্দ্রে সার্বিক ভোট প্রদানের হার ৪৭.৯০ শতাংশ হলেও, ৩৩টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, যার মধ্যে ১০টি কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। একটি (আগ্রাবাদ তালেবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ছিল ৯৯ শতাংশ আরেকটি কেন্দ্রে ৯৮ শতাংশ এবং অন্য একটি কেন্দ্রে ৯৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে, ২০টি কেন্দ্রে ২০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে, এর মধ্যে একটি (নৌবাহিনী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) কেন্দ্রে মাত্র ৮.৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। যদিও ২০১০ সালের নির্বাচনে ৬৭৩টি কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার এবারের হার থেকে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি ছিল, কিন্তু আগের নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রেই এ হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট প্রদানের সঙ্গে অন্তত সাতটি পদক্ষেপ জড়িত: ১. ভোটার প্রথমে যান একজন কর্মকর্তার কাছে, যিনি ভোটার তালিকা দেখে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করেন। ভোটারের কাছে তাঁর ভোটার নম্বর থাকলে এ কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হয়। ২. এরপর আরেক ব্যক্তি ভোটারকে তিনটি ব্যালট পেপার দেন, ৩. ব্যালট বইয়ের মুড়িতে তাঁর স্বাক্ষর/টিপসই নেন, ৪. তাঁর আঙুলে কালির দাগ দেন, এবং ৫. তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য কালি লাগানো একটি সিল দেন। ৬. তারপর বুথে গিয়ে ব্যালট পেপারগুলোতে সিল মেরে ভোটার ভোট দেওয়ার কাজ সারেন এবং ৭. সেগুলো ভাঁজ করে বুথের বাইরে অবস্থিত ব্যালট বাক্সে ফেলেন। ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকলে এ কাজটিও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তঁাদের করণীয় সম্পন্ন করতে পারলে একজন ভোটারের, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের মতে, তিনটি ভোট প্রদানের জন্য সর্বনিম্ন তিন মিনিট সময় লাগবে। তাঁর মতে, নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত ও অনভিজ্ঞদের আরও বেশি সময় লাগবে।
গণমাধ্যমের সুবাদে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের সম্পর্কে প্রায় সব ভোটারই জেনেছেন, তাই কাকে তাঁরা ভোট দেবেন, তা-ও আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু কোন ওয়ার্ডে কারা কাউন্সিলর প্রার্থী, বিশেষ করে সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের সম্পর্কে অনেক ভোটারই জানতেন না। তাই দলীয় প্রতীকের অনুপস্থিতিতে এবং প্রার্থীদের সম্পর্কে না জানার কারণে অনেক ভোটারকেই ব্যালট পেপারে অন্তর্ভুক্ত সবগুলো নাম বিচার-বিবেচনা করে ভোট প্রদান করতে হয়েছে, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয়েছে। তাই ভোটারদের বহুবিধ ব্যাকগ্রাউন্ড, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে অনুমান করা যায় যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনটি ভোট দেওয়ার জন্য গড়ে প্রত্যেক ভোটারের অন্তত পাঁচ মিনিট সময় লেগেছিল।
সর্বনিম্ন তিন মিনিট ধরলে সর্বোচ্চ (৯৯ শতাংশ) ভোট গ্রহণের দাবিদার আগ্রাবাদ তালেবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয়টি বুথে আট ঘণ্টায় সর্বাধিক ৯৬০টি ভোট প্রদান করা সম্ভব ছিল। আর গড়ে পাঁচ মিনিট ধরলে মোট ৫৭৬টি ভোট দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ২ হাজার ৪৩৩টি। তিন মিনিট সময় ধরলেও এমন বিরাট পরিমাণের ভোট গ্রহণের জন্য আট ঘণ্টার তিন শিফটে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন ছিল! তাই এ ধরনের অস্বাভাবিক ভোট প্রদানের হার একমাত্র ভোটকেন্দ্র দখল এবং অবৈধ সিল মারার ক্ষেত্রেই সম্ভব।
এবারের চট্টগ্রামের ভোটের দিকে তাকালে একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ভোট প্রদানের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনজুর আলমের ভোট প্রাপ্তির হার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যে কেন্দ্রে, সেখানে মনজুর আলমের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৫৪.০১ শতাংশ; ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৯.৮ শতাংশ; এবং ৯০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হারের ক্ষেত্রে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৫.০১ শতাংশ। অন্যদিকে ১০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে নাছিরের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৩৬.৪২ শতাংশ; ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৫.৩২ শতাংশ; এবং ৯০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হারের ক্ষেত্রে তাঁর ভোটের হার ছিল ৭৭.০৭ শতাংশ।
অন্যভাবে বলতে গেলে, ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত কম, সেসব কেন্দ্রে মনজুর আলম জিতেছেন এবং ভোট প্রদানের হার যেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি, সেসব কেন্দ্রে নাছির জিতেছেন। এ প্রবণতার ফলে ভোট প্রদানের হার ৪৩ শতাংশ পার হওয়ার পর নাছিরের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ মনজুর আলমের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায়। আরও খোলাসা করে বলতে গেলে, ভোট প্রদানের হার ৪৩ শতাংশের নিচের সব কেন্দ্রে মনজুর আলম মোট ৯৯ হাজার ৭৭২ ভোট পান এবং নাছির মোট ৯৯ হাজার ৩৮৫ ভোট পান, আর এসব কেন্দ্রের প্রায় সবগুলোতেই মনজুর আলম জিতেছেন এবং এর বেশি ভোট প্রদানের হার সম্পন্ন সব কেন্দ্রেই নাছির জিতেছেন।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে নাছিরের জয়ের মূল উৎস হলো সেসব কেন্দ্র যেখানে ভোট প্রদানের হার ছিল উচ্চ এবং অস্বাভাবিক। আর আগের আলোচনা থেকে আমরা জানি যে যেসব কেন্দ্রে উচ্চ ও অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে, সেসব কেন্দ্রেই সিল মারার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে জোর করে সিল মারার ঘটনা এমন বিশৃঙ্খল ছিল যে সেখানে বাতিল ভোটের পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিমাণের ছিল। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কট্রলি প্রাণহরি মডেল সরকারি প্রাইমারি সেন্টারে চার হাজার ৩২২ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বৈধ ভোটের সংখ্যা ছিল বাতিল ভোটের চেয়েও কম এবং যথাক্রমে ১ হাজার ৮৬২ এবং ২ হাজার ৪৬০। এ যেন ভোট নিয়ে এক ভুতুড়ে কাণ্ড!
আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল-সমর্থিত নাছিরের জয়ের পেছনে ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মারার মতো কারচুপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যাপক অভিযোগও প্রকাশিত হয়েছে। আর এই অভিযোগে মনজুর আলম দুপুরের মধ্যেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে, ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে মনে করা হয়, এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। সে নির্বাচনে যে কেন্দ্রে ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে, সেখানে মনজুর আলমের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৬০.২৬ শতাংশ; ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৪.১৬ শতাংশ; এবং ৮০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হার সম্পন্ন কেন্দ্রে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৬১.৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে পরাজিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল সর্বনিম্ন ৩৪.৪৪ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৪৯.৪৮ শতাংশ। তাই ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভোট প্রদানের হারের ওপর কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ভর ছিল না। অর্থাৎ সেই নির্বাচনে জোর করে ব্যালটে সিল মারার মতো কারচুপি ঘটেনি, সে ধরনের কোনো অভিযোগও ওঠেনি এবং যে নির্বাচনের ফলাফল পরাজিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীও মেনে নিয়েছিলেন।
পরিশেষে, গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বহু মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন এগুলোর কোনোটি আমলে না নিয়েই তড়িঘড়ি করে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের, কমিশনের এ ব্যাপারে আর কিছুই করার থাকে না। এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলায় [৫বিএলসি(এডি)২০০০] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেন যে নির্বাচনের সময়ে কারচুপির খবর প্রকাশিত হলে কিংবা এ ব্যাপারে অভিযোগ করা হলে, তদন্ত সাপেক্ষে কমিশনের নির্বাচন বাতিলেরও ক্ষমতা রয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
এবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ জন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন আ জ ম নাছির উিদ্দন, আর বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বিদায়ী মেয়র মনজুর আলম। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৬০০। ভোট পড়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৩ (৪৭.৯০ শতাংশ), যার মধ্যে বৈধ ৮ লাখ ২১ হাজার ৩৭১ এবং অবৈধ ৪৭ হাজার ২৯২ ভোট। মোট বৈধ ভোটে নাছির পেয়েছেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ (৫৭.৮৭ শতাংশ) এবং মনজুর আলম ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ (৩৭.১১ শতাংশ)। তবে একটি কেন্দ্রের (হালিশহর মেহের আফজল উচ্চবিদ্যালয়) ৩ হাজার ৬২৯টি ভোটের মধ্যে মনজুর আলম একটি ভোটও পাননি, যদিও ২০১০ সালের নির্বাচনে সেই কেন্দ্রে তিনি ৬১৬টি ভোট পেয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৭। ভোট পড়েছিল ৯ লাখ ২১ হাজার ৩৮৯ (৫৪.৬০ শতাংশ), যার মধ্যে বৈধ ভোট ছিল ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৫, অবৈধ ৩৫ হাজার ৫৪৪। মোট বৈধ ভোটের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিদায়ী মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ (৪৩.৩২ শতাংশ) এবং বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৮ (৫৪.১৫ শতাংশ) ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৭১৯টি ভোটকেন্দ্রে সার্বিক ভোট প্রদানের হার ৪৭.৯০ শতাংশ হলেও, ৩৩টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, যার মধ্যে ১০টি কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। একটি (আগ্রাবাদ তালেবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ছিল ৯৯ শতাংশ আরেকটি কেন্দ্রে ৯৮ শতাংশ এবং অন্য একটি কেন্দ্রে ৯৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে, ২০টি কেন্দ্রে ২০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে, এর মধ্যে একটি (নৌবাহিনী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) কেন্দ্রে মাত্র ৮.৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। যদিও ২০১০ সালের নির্বাচনে ৬৭৩টি কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার এবারের হার থেকে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি ছিল, কিন্তু আগের নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রেই এ হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট প্রদানের সঙ্গে অন্তত সাতটি পদক্ষেপ জড়িত: ১. ভোটার প্রথমে যান একজন কর্মকর্তার কাছে, যিনি ভোটার তালিকা দেখে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করেন। ভোটারের কাছে তাঁর ভোটার নম্বর থাকলে এ কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হয়। ২. এরপর আরেক ব্যক্তি ভোটারকে তিনটি ব্যালট পেপার দেন, ৩. ব্যালট বইয়ের মুড়িতে তাঁর স্বাক্ষর/টিপসই নেন, ৪. তাঁর আঙুলে কালির দাগ দেন, এবং ৫. তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য কালি লাগানো একটি সিল দেন। ৬. তারপর বুথে গিয়ে ব্যালট পেপারগুলোতে সিল মেরে ভোটার ভোট দেওয়ার কাজ সারেন এবং ৭. সেগুলো ভাঁজ করে বুথের বাইরে অবস্থিত ব্যালট বাক্সে ফেলেন। ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকলে এ কাজটিও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তঁাদের করণীয় সম্পন্ন করতে পারলে একজন ভোটারের, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের মতে, তিনটি ভোট প্রদানের জন্য সর্বনিম্ন তিন মিনিট সময় লাগবে। তাঁর মতে, নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত ও অনভিজ্ঞদের আরও বেশি সময় লাগবে।
গণমাধ্যমের সুবাদে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের সম্পর্কে প্রায় সব ভোটারই জেনেছেন, তাই কাকে তাঁরা ভোট দেবেন, তা-ও আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু কোন ওয়ার্ডে কারা কাউন্সিলর প্রার্থী, বিশেষ করে সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের সম্পর্কে অনেক ভোটারই জানতেন না। তাই দলীয় প্রতীকের অনুপস্থিতিতে এবং প্রার্থীদের সম্পর্কে না জানার কারণে অনেক ভোটারকেই ব্যালট পেপারে অন্তর্ভুক্ত সবগুলো নাম বিচার-বিবেচনা করে ভোট প্রদান করতে হয়েছে, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয়েছে। তাই ভোটারদের বহুবিধ ব্যাকগ্রাউন্ড, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে অনুমান করা যায় যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনটি ভোট দেওয়ার জন্য গড়ে প্রত্যেক ভোটারের অন্তত পাঁচ মিনিট সময় লেগেছিল।
সর্বনিম্ন তিন মিনিট ধরলে সর্বোচ্চ (৯৯ শতাংশ) ভোট গ্রহণের দাবিদার আগ্রাবাদ তালেবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয়টি বুথে আট ঘণ্টায় সর্বাধিক ৯৬০টি ভোট প্রদান করা সম্ভব ছিল। আর গড়ে পাঁচ মিনিট ধরলে মোট ৫৭৬টি ভোট দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ২ হাজার ৪৩৩টি। তিন মিনিট সময় ধরলেও এমন বিরাট পরিমাণের ভোট গ্রহণের জন্য আট ঘণ্টার তিন শিফটে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন ছিল! তাই এ ধরনের অস্বাভাবিক ভোট প্রদানের হার একমাত্র ভোটকেন্দ্র দখল এবং অবৈধ সিল মারার ক্ষেত্রেই সম্ভব।
এবারের চট্টগ্রামের ভোটের দিকে তাকালে একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ভোট প্রদানের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনজুর আলমের ভোট প্রাপ্তির হার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যে কেন্দ্রে, সেখানে মনজুর আলমের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৫৪.০১ শতাংশ; ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৯.৮ শতাংশ; এবং ৯০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হারের ক্ষেত্রে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৫.০১ শতাংশ। অন্যদিকে ১০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে নাছিরের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৩৬.৪২ শতাংশ; ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৫.৩২ শতাংশ; এবং ৯০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হারের ক্ষেত্রে তাঁর ভোটের হার ছিল ৭৭.০৭ শতাংশ।
অন্যভাবে বলতে গেলে, ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত কম, সেসব কেন্দ্রে মনজুর আলম জিতেছেন এবং ভোট প্রদানের হার যেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি, সেসব কেন্দ্রে নাছির জিতেছেন। এ প্রবণতার ফলে ভোট প্রদানের হার ৪৩ শতাংশ পার হওয়ার পর নাছিরের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ মনজুর আলমের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায়। আরও খোলাসা করে বলতে গেলে, ভোট প্রদানের হার ৪৩ শতাংশের নিচের সব কেন্দ্রে মনজুর আলম মোট ৯৯ হাজার ৭৭২ ভোট পান এবং নাছির মোট ৯৯ হাজার ৩৮৫ ভোট পান, আর এসব কেন্দ্রের প্রায় সবগুলোতেই মনজুর আলম জিতেছেন এবং এর বেশি ভোট প্রদানের হার সম্পন্ন সব কেন্দ্রেই নাছির জিতেছেন।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে নাছিরের জয়ের মূল উৎস হলো সেসব কেন্দ্র যেখানে ভোট প্রদানের হার ছিল উচ্চ এবং অস্বাভাবিক। আর আগের আলোচনা থেকে আমরা জানি যে যেসব কেন্দ্রে উচ্চ ও অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে, সেসব কেন্দ্রেই সিল মারার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে জোর করে সিল মারার ঘটনা এমন বিশৃঙ্খল ছিল যে সেখানে বাতিল ভোটের পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিমাণের ছিল। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কট্রলি প্রাণহরি মডেল সরকারি প্রাইমারি সেন্টারে চার হাজার ৩২২ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বৈধ ভোটের সংখ্যা ছিল বাতিল ভোটের চেয়েও কম এবং যথাক্রমে ১ হাজার ৮৬২ এবং ২ হাজার ৪৬০। এ যেন ভোট নিয়ে এক ভুতুড়ে কাণ্ড!
আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল-সমর্থিত নাছিরের জয়ের পেছনে ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মারার মতো কারচুপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যাপক অভিযোগও প্রকাশিত হয়েছে। আর এই অভিযোগে মনজুর আলম দুপুরের মধ্যেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে, ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে মনে করা হয়, এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। সে নির্বাচনে যে কেন্দ্রে ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে, সেখানে মনজুর আলমের প্রাপ্ত বৈধ ভোটের হার ছিল ৬০.২৬ শতাংশ; ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার যেসব কেন্দ্রে, সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৪.১৬ শতাংশ; এবং ৮০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদানের হার সম্পন্ন কেন্দ্রে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৬১.৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে পরাজিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল সর্বনিম্ন ৩৪.৪৪ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৪৯.৪৮ শতাংশ। তাই ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভোট প্রদানের হারের ওপর কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ভর ছিল না। অর্থাৎ সেই নির্বাচনে জোর করে ব্যালটে সিল মারার মতো কারচুপি ঘটেনি, সে ধরনের কোনো অভিযোগও ওঠেনি এবং যে নির্বাচনের ফলাফল পরাজিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীও মেনে নিয়েছিলেন।
পরিশেষে, গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বহু মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন এগুলোর কোনোটি আমলে না নিয়েই তড়িঘড়ি করে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের, কমিশনের এ ব্যাপারে আর কিছুই করার থাকে না। এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলায় [৫বিএলসি(এডি)২০০০] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেন যে নির্বাচনের সময়ে কারচুপির খবর প্রকাশিত হলে কিংবা এ ব্যাপারে অভিযোগ করা হলে, তদন্ত সাপেক্ষে কমিশনের নির্বাচন বাতিলেরও ক্ষমতা রয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments