আমাদের সময়ের নায়ক by আনোয়ারুল হক
খন্দকার
মো. ফারুকের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের গল্প শুনে কেউ মনে করতে পারেন, তিনি যেন
এক রূপকথার নায়ক। কিন্তু না, তিনি বাস্তব জীবনেরই নায়ক। ১৫ বছরের কিশোর
অংশ নেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। টাঙ্গাইলের সখীপুরের কিছুটা পাহাড়ি ও
বনাঞ্চলের ঘাঁটি থেকে, বাসাইলের ঘরে ঘরে আত্মগোপনে থেকে অস্ত্র হাতে
ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। স্বাধীন দেশে করটিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে
হাতে তুলে নেন ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকা। অতঃপর ১৯৭৫ সালে প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আমি ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কেন জানি ১৯৭৬-এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় হয়নি। সে বছর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমরা দুজনই সহসাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে ছাত্র ইউনিয়নে তখন ভাটার টান। বিশেষ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের বিরাট সংগঠন স্বল্প সময়ের মধ্যে আহসানউল্লাহ হল ও তিতুমীর হল ছাড়া অন্য সব হলেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বুয়েটে জাসদপন্থী ছাত্রলীগের তখন শক্তিশালী সংগঠন ও জনপ্রিয়তা। নিজ হলে এবং আন্তহল সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় একাধিকবার অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত মুখ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে সচেষ্ট হন বুয়েটে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনকে পুনর্জীবিত করতে।
এর মধ্যে ১৯৭৯ সালে ইউকসু নির্বাচনের ঘোষণা আসে। সংগঠন শক্তির বিচারে আহসানউল্লাহ (উ.) হল ছাড়া অন্য কোনো হলে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে পূর্ণ প্যানেলে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে ইউকসুর প্যানেল শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় হয়। খন্দকার মো. ফারুক সহসভাপতি এবং ওই সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ ইশতিয়াক আহমেদ কারেনকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী করে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল ঘোষণা করা হয়। জাসদ ছাত্রলীগের ভরা জোয়ারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ইউকসুর সহসভাপতি পদে আমরা জয়লাভ করি। খন্দকার ফারুক সহসভাপতি নির্বাচিত হন। অবশ্য সাধারণ সম্পাদক পদে কারেনও বেশ ভালো ভোট পেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এক বছর পরে ১৯৮০ সালে আবার ইউকসুর নির্বাচন। খন্দকার ফারুককে কেন্দ্র করেই আমাদের প্যানেল। খন্দকার ফারুক আগের চেয়ে বেশি ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এবারও সংসদে জাসদ ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে আগের বছর থেকে হলগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের আসন বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১ সালে আবার নির্বাচন। এবার অবশ্য তিনি দাঁড়াতে চাননি। কিন্তু আমাদের মনে হলো এ কয়েক বছরে বুয়েটে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক শক্তি তিনি যতটা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন, তাতে তিনি নির্বাচন করলে এবার পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করা যাবে। হলোও তা-ই; ফারুক-মাহতাব প্যানেল জয়লাভ করল। ইউকসুতে বিজয় জাতীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়নের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে শক্তিশালী করল।
খন্দকার ফারুক শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর তৎপরতায় কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে প্রগতিশীল ভাবনার কর্মচারীরা নেতৃত্বে চলে আসেন। ওই সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার (পৌর কমিশনার) পদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)–সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিপিবির প্রার্থী প্রয়াত সাইফুদ্দীন মানিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের চেয়ে বেশি ভোট পান। এ নির্বাচনগুলোয় ওই এলাকায় তিনিই প্রধান ভূমিকা রাখেন।
এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হলো ছাত্র ইউনিয়নের সপ্তদশ জাতীয় সম্মেলন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি আরও বড় পরিসরে পা রাখলেন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় ও অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন নেতা সংগঠনের সভাপতি হওয়ায় এবং ওই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের যে টিম গড়ে ওঠে, তাদের প্রচেষ্টায় সাংগঠনিক শক্তি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৮২-৮৩ সালের সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের সূচনাপর্ব থেকেই সংগঠনের ভূমিকা, সভাপতি হিসেবে খন্দকার ফারুকের ভূমিকা, ছাত্র ইউনিয়নকে জাতীয়ভাবে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়। ’৭৫-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত বিচার করলে খন্দকার ফারুকের সভাপতিত্বের সময়টায় ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের বিস্তৃতি, জমায়েত-ক্ষমতা, লড়াই করার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল। ছাত্র আন্দোলনের ভাটার টানের সময়েও নবোদ্দীপনার স্রোত সৃষ্টির অন্যতম নায়ক তিনি। ছাত্রজীবন শেষে ক্ষেতমজুর আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসেবে, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক হিসেবে, ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের তরুণ নেতা হিসেবে সেই নায়কোচিত ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি সমর্থ হন।
পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেলেও বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ও পুরোনো সহকর্মীদের পাশে সব সময় ছিলেন। খন্দকার মো. ফারুক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের গর্বের ধন। শুধু তা–ই নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রতীক।
আনোয়ারুল হক: সাবেক ছাত্রনেতা।
আমি ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কেন জানি ১৯৭৬-এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় হয়নি। সে বছর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমরা দুজনই সহসাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে ছাত্র ইউনিয়নে তখন ভাটার টান। বিশেষ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের বিরাট সংগঠন স্বল্প সময়ের মধ্যে আহসানউল্লাহ হল ও তিতুমীর হল ছাড়া অন্য সব হলেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বুয়েটে জাসদপন্থী ছাত্রলীগের তখন শক্তিশালী সংগঠন ও জনপ্রিয়তা। নিজ হলে এবং আন্তহল সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় একাধিকবার অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত মুখ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে সচেষ্ট হন বুয়েটে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনকে পুনর্জীবিত করতে।
এর মধ্যে ১৯৭৯ সালে ইউকসু নির্বাচনের ঘোষণা আসে। সংগঠন শক্তির বিচারে আহসানউল্লাহ (উ.) হল ছাড়া অন্য কোনো হলে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে পূর্ণ প্যানেলে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে ইউকসুর প্যানেল শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় হয়। খন্দকার মো. ফারুক সহসভাপতি এবং ওই সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ ইশতিয়াক আহমেদ কারেনকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী করে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল ঘোষণা করা হয়। জাসদ ছাত্রলীগের ভরা জোয়ারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ইউকসুর সহসভাপতি পদে আমরা জয়লাভ করি। খন্দকার ফারুক সহসভাপতি নির্বাচিত হন। অবশ্য সাধারণ সম্পাদক পদে কারেনও বেশ ভালো ভোট পেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এক বছর পরে ১৯৮০ সালে আবার ইউকসুর নির্বাচন। খন্দকার ফারুককে কেন্দ্র করেই আমাদের প্যানেল। খন্দকার ফারুক আগের চেয়ে বেশি ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এবারও সংসদে জাসদ ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে আগের বছর থেকে হলগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের আসন বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১ সালে আবার নির্বাচন। এবার অবশ্য তিনি দাঁড়াতে চাননি। কিন্তু আমাদের মনে হলো এ কয়েক বছরে বুয়েটে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক শক্তি তিনি যতটা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন, তাতে তিনি নির্বাচন করলে এবার পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করা যাবে। হলোও তা-ই; ফারুক-মাহতাব প্যানেল জয়লাভ করল। ইউকসুতে বিজয় জাতীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়নের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে শক্তিশালী করল।
খন্দকার ফারুক শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর তৎপরতায় কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে প্রগতিশীল ভাবনার কর্মচারীরা নেতৃত্বে চলে আসেন। ওই সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার (পৌর কমিশনার) পদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)–সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিপিবির প্রার্থী প্রয়াত সাইফুদ্দীন মানিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের চেয়ে বেশি ভোট পান। এ নির্বাচনগুলোয় ওই এলাকায় তিনিই প্রধান ভূমিকা রাখেন।
এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হলো ছাত্র ইউনিয়নের সপ্তদশ জাতীয় সম্মেলন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি আরও বড় পরিসরে পা রাখলেন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় ও অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন নেতা সংগঠনের সভাপতি হওয়ায় এবং ওই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের যে টিম গড়ে ওঠে, তাদের প্রচেষ্টায় সাংগঠনিক শক্তি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৮২-৮৩ সালের সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের সূচনাপর্ব থেকেই সংগঠনের ভূমিকা, সভাপতি হিসেবে খন্দকার ফারুকের ভূমিকা, ছাত্র ইউনিয়নকে জাতীয়ভাবে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়। ’৭৫-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত বিচার করলে খন্দকার ফারুকের সভাপতিত্বের সময়টায় ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের বিস্তৃতি, জমায়েত-ক্ষমতা, লড়াই করার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল। ছাত্র আন্দোলনের ভাটার টানের সময়েও নবোদ্দীপনার স্রোত সৃষ্টির অন্যতম নায়ক তিনি। ছাত্রজীবন শেষে ক্ষেতমজুর আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসেবে, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক হিসেবে, ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের তরুণ নেতা হিসেবে সেই নায়কোচিত ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি সমর্থ হন।
পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেলেও বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ও পুরোনো সহকর্মীদের পাশে সব সময় ছিলেন। খন্দকার মো. ফারুক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের গর্বের ধন। শুধু তা–ই নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রতীক।
আনোয়ারুল হক: সাবেক ছাত্রনেতা।
No comments