মনের আলোয় বিদ্যা বিলান তিনি by উজ্জ্বল মেহেদী
বাড়ির উঠানে শিশুদের পড়াচ্ছেন সঞ্জু ঠাকুর (বাঁয়ে)। মাঝেমধ্যে তাঁকে সহায়তা করেন মেয়ে মৌসুমী চক্রবর্তী l ছবি: আনিস মাহমুদ |
কে
বলবে তিনি চোখে দেখেন না! পথ চলেন একা একা, ঘর থেকে বের হয়ে বাজার-সদাই
পর্যন্ত করেন, পথে পরিচিত কেউ কথা বললে ঠিকঠাক চিনেও ফেলেন। কিন্তু সঞ্জিত
চক্রবর্তীর আসল সাফল্য অন্য জায়গায়—তাঁর পেশায়। নিজ বাড়ির উঠানে তিনি
শিশু-কিশোরদের পড়াচ্ছেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে!
নয়নে অচল কিন্তু মননে সচল সঞ্জিত চক্রবর্তীর বাস হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। ৬৮ বছর বয়সী মানুষটি সব প্রতিবন্ধকতা জয়ের জীবন্ত এক উদাহরণ। এলাকার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ডাকেন ‘সঞ্জু ঠাকুর’ বলে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সঞ্জু ঠাকুর জন্মান্ধ নন। ১৯৬৮ সালে শ্রীমঙ্গলের আহিদউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়ার সময় চোখে সমস্যা দেখা দেয়। রাতে পড়তে পারতেন না। দুটো পরীক্ষা দিয়ে আর চালিয়ে যেতেই পারলেন না। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে পড়েন।
চোখের আলো হারিয়ে যাওয়ায় প্রথাগত বৈষয়িক সাফল্য যার অধরা থেকে গেল সেই সঞ্জিত কিন্তু নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে করে থেমে যাননি। জ্ঞানের আলো ছড়ানোকে করে নিলেন জীবনের ব্রত। সেই পথে চলেই আজ তিনি বহু মানুষের মন জয় করা এক মহৎহৃদয় ব্যক্তিত্ব।
সংগ্রামের জীবন: সঞ্জিতের সংগ্রাম শুরু শৈশবেই। বাবা সুধীর চক্রবর্তী চাকরি করতেন ঢাকার একটি পাটকলে। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় দুর্বৃত্তের হামলায় তিনি নিহত হন। তখন সঞ্জিতের বয়স মাত্র আট মাস। মা সুনীতি চক্রবর্তী ছেলেকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলের মাধবপাশায় এক মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে পড়াশোনা শুরু হয় সঞ্জিতের। একদিন মাধ্যমিকের সময় হয়ে এলেও চোখের সমস্যার জন্য পরীক্ষা দিতে পারলেন না। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে শিক্ষক বানাবেন। তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন সঞ্জিত। ওই পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েই শ্রীমঙ্গলের হুগলিছড়া চা-বাগানের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি নিলেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছর চাকরি করেন সেখানে। একপর্যায়ে রাতের অন্ধত্ব দিনেও তাঁর চোখে ভর করলে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন।
‘সঞ্জিত অন্ধ। ওর জীবন অচল। একা চলতে পারবে না, তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে চলো...’ মুক্তিযুদ্ধ শেষে এমন কথা বলে সঞ্জিতের দুই কাকা সপরিবারে ভারত যাওয়ার সময় তাঁদেরও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা সুনীতি চক্রবর্তী রাজি হননি। চা-বাগানের চাকরি ছেড়ে মাকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে সঞ্জিত গেলেন শায়েস্তাগঞ্জের গঙ্গানগর গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে।
শিক্ষাযাত্রার শুরু: গঙ্গানগরে আত্মীয় বাড়িতে থাকার সময় ভাবছিলেন কী করবেন। এ ভাবনার মধ্যেই সেই বাড়ির এক কাকাতো ভাইকে পড়াতে শুরু করলেন। বছর শেষে দেখা গেল, সে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। গঙ্গানগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। সেই থেকে শুরু। ওই আত্মীয়র বাড়িতে থেকে গিয়েই ছাত্রছাত্রী পড়াতে থাকলেন সঞ্জিত। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। ধীরে ধীরে সবার কাছে ‘সঞ্জু ঠাকুর’ নামে পরিচিত হয়ে উঠলেন তিনি। ক্রমে বাড়তে থাকল তাঁর কাছে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
‘সঞ্জু ঠাকুর’ পরিচিতির সুবাদে একসময় নামমাত্র মূল্য দিয়ে লস্করপুর জমিদার বাড়ির উত্তরসূরিদের কাছ থেকে একটু জমি পেলেন সঞ্জিত। সেই জমিতে একদিন বাড়ি করলেন। বিয়ে করে সংসারও পাতা হলো একসময়।
টিনশেড ঘরের সামনের উঠোনে ১৯৮০ সাল থেকে নিয়মিত ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছেন সঞ্জিত। আগে থেকে বেতন ধার্য করেন না তিনি। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা সংগতিমতো বেতন দেন। তা হতে পারে মাসে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সন্তান ভালো ফল করলে কোনো কোনো অভিভাবক খুশি হয়ে বাড়তি কিছুও দেন। গড়ে দুই থেকে তিনটি পালায় ২৪ জনকে পড়ান সঞ্জু ঠাকুর। এ থেকে মাসে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে চলে সংসার।
মা সুনীতি চক্রবর্তী মারা গেছেন ২০০১ সালে। স্ত্রী শুক্লা চক্রবর্তী ও দুই মেয়ে নিয়ে সঞ্জু ঠাকুরের পরিবার। স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা স্ত্রী শুক্লার। ‘মানুষটা চোখে দেখেন না। তা জেনেও সংসার পেতেছি। এতটা বছর তাঁর সঙ্গে আছি। চোখে না দেখেও মানুষ চাইলে যে অনেক কিছুই পারে—এ মানুষটার সঙ্গে না থাকলে তা হয়তো বিশ্বাসই করতাম না’, বলছিলেন শুক্লা।
সরেজমিনে একদিন: শায়েস্তাগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক লাগোয়া গঙ্গানগরের প্রবেশমুখেই সঞ্জু ঠাকুরের বাড়ি। সকাল, দুপুর ও বিকেল—এ তিন বেলা তাঁর বাড়ির উঠোন যেন উন্মুক্ত এক পাঠশালা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। বৃষ্টির মৌসুম ছাড়া উঠানেই চলে পাঠদান। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকেও ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে।
সম্প্রতি একদিন সঞ্জু ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বিকেলের পালায় পড়তে এসেছে ১২ জন। উঠানে মাদুর পেতে শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই বসল। ঘর থেকে সঞ্জু ঠাকুর বের হলেন বসার একটি পিঁড়ি নিয়ে। শুরু হলো পাঠের কাজ। সঞ্জু ঠাকুর তাঁর শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে পড়া আগে শোনেন, তারপর পড়ান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়ান তিনি। মাঝেমধ্যে মেয়ে এইচএসসি পাস মৌসুমী তাঁকে সহায়তা করেন।
প্রতিষ্ঠিত হওয়া শিক্ষার্থীরা: শৈশব-কৈশোরে সঞ্জু ঠাকুরের কাছে পড়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেই হয়েছেন ব্যাংকার, শিক্ষক বা পুলিশের কর্মকর্তা। খোঁজ করতে পাওয়া গেল তাঁর প্রথমদিকের ছাত্র সমীরণ চক্রবর্তীকে। শায়েস্তাগঞ্জের শ্রীকোটা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক তিনি। সমীরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘ছোটবেলায় যখন পড়তাম, তখন মনে হতো তিনি আসলে দেখতে পান। বড় হওয়ার পর বুঝেছি, তাঁর চোখে আলো নেই।’ মৌলভীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালেক মিয়াও সঞ্জু ঠাকুরের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে যে কয়েকজন শিক্ষকের কথা মনে আছে, সঞ্জু স্যার তাঁদের অন্যতম। সব বিষয়ে তিনি দক্ষ। তবে অঙ্কে সবচেয়ে বেশি দক্ষ।’
গুণমুগ্ধদের কথা: সঞ্জু ঠাকুরের প্রসঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জের জহুর চান বিবি মহিলা কলেজের প্রভাষক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তাঁকে দেখে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার দীক্ষা পায় শিক্ষার্থীরা। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্থানীয় অভিভাবকদের কাছে এক ভরসার নাম সঞ্জু ঠাকুর।’
এ কৃতী শিক্ষকের একনিষ্ঠ পাঠদান আর অতিসাধারণ জীবনযাপন দেখে আপ্লুত হবিগঞ্জ ও সিলেটের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শুধু শুনেছিলাম, চোখে না দেখতে পাওয়া একজন মানুষ ছাত্রছাত্রী পড়ান। শ্রদ্ধা জানাতে কিছু ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে দেখি, একটি জীর্ণ টিনের ঘর। বর্ষা এলে চালের ফুটো দিয়ে ঘরে পানি পড়ে। বাইরে মাটিতে চটের বস্তা ফেলে শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে পড়ে। এভাবে চলছে ৩৫ বছর ধরে! মনে হলো, তাঁর হাতে ফুল নয়, কিছু অর্থসহায়তা দিলে অন্তত ঘরটা সংস্কার হবে। আমি সরকারিভাবে ২৫ হাজার টাকার অর্থসহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
নিজে যা বলেন: সঞ্জু ঠাকুর বলেন, ‘আমি তো জীবন পাড়ি দেওয়া মানুষ। সবই হইছে আমার মনের জোরে। যেভাবে আছি, ঠিক এইভাবে চললেই আমার অইব। আমার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েটারে (মৌসুমী) আমি নিজে পড়াইছি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নিয়া গেছি। আমার অনেক ছাত্রছাত্রী এখন প্রতিষ্ঠিত, চাকরি-বাকরি করছে। কিন্তু মেয়ের একটা চাকরি জোটে নাই। তার একটা চাকরি হইলে বড় খুশি হইতাম!’
নয়নে অচল কিন্তু মননে সচল সঞ্জিত চক্রবর্তীর বাস হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। ৬৮ বছর বয়সী মানুষটি সব প্রতিবন্ধকতা জয়ের জীবন্ত এক উদাহরণ। এলাকার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ডাকেন ‘সঞ্জু ঠাকুর’ বলে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সঞ্জু ঠাকুর জন্মান্ধ নন। ১৯৬৮ সালে শ্রীমঙ্গলের আহিদউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়ার সময় চোখে সমস্যা দেখা দেয়। রাতে পড়তে পারতেন না। দুটো পরীক্ষা দিয়ে আর চালিয়ে যেতেই পারলেন না। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে পড়েন।
চোখের আলো হারিয়ে যাওয়ায় প্রথাগত বৈষয়িক সাফল্য যার অধরা থেকে গেল সেই সঞ্জিত কিন্তু নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে করে থেমে যাননি। জ্ঞানের আলো ছড়ানোকে করে নিলেন জীবনের ব্রত। সেই পথে চলেই আজ তিনি বহু মানুষের মন জয় করা এক মহৎহৃদয় ব্যক্তিত্ব।
সংগ্রামের জীবন: সঞ্জিতের সংগ্রাম শুরু শৈশবেই। বাবা সুধীর চক্রবর্তী চাকরি করতেন ঢাকার একটি পাটকলে। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় দুর্বৃত্তের হামলায় তিনি নিহত হন। তখন সঞ্জিতের বয়স মাত্র আট মাস। মা সুনীতি চক্রবর্তী ছেলেকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলের মাধবপাশায় এক মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে পড়াশোনা শুরু হয় সঞ্জিতের। একদিন মাধ্যমিকের সময় হয়ে এলেও চোখের সমস্যার জন্য পরীক্ষা দিতে পারলেন না। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে শিক্ষক বানাবেন। তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন সঞ্জিত। ওই পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েই শ্রীমঙ্গলের হুগলিছড়া চা-বাগানের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি নিলেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছর চাকরি করেন সেখানে। একপর্যায়ে রাতের অন্ধত্ব দিনেও তাঁর চোখে ভর করলে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন।
‘সঞ্জিত অন্ধ। ওর জীবন অচল। একা চলতে পারবে না, তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে চলো...’ মুক্তিযুদ্ধ শেষে এমন কথা বলে সঞ্জিতের দুই কাকা সপরিবারে ভারত যাওয়ার সময় তাঁদেরও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা সুনীতি চক্রবর্তী রাজি হননি। চা-বাগানের চাকরি ছেড়ে মাকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে সঞ্জিত গেলেন শায়েস্তাগঞ্জের গঙ্গানগর গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে।
শিক্ষাযাত্রার শুরু: গঙ্গানগরে আত্মীয় বাড়িতে থাকার সময় ভাবছিলেন কী করবেন। এ ভাবনার মধ্যেই সেই বাড়ির এক কাকাতো ভাইকে পড়াতে শুরু করলেন। বছর শেষে দেখা গেল, সে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। গঙ্গানগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। সেই থেকে শুরু। ওই আত্মীয়র বাড়িতে থেকে গিয়েই ছাত্রছাত্রী পড়াতে থাকলেন সঞ্জিত। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। ধীরে ধীরে সবার কাছে ‘সঞ্জু ঠাকুর’ নামে পরিচিত হয়ে উঠলেন তিনি। ক্রমে বাড়তে থাকল তাঁর কাছে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
‘সঞ্জু ঠাকুর’ পরিচিতির সুবাদে একসময় নামমাত্র মূল্য দিয়ে লস্করপুর জমিদার বাড়ির উত্তরসূরিদের কাছ থেকে একটু জমি পেলেন সঞ্জিত। সেই জমিতে একদিন বাড়ি করলেন। বিয়ে করে সংসারও পাতা হলো একসময়।
টিনশেড ঘরের সামনের উঠোনে ১৯৮০ সাল থেকে নিয়মিত ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছেন সঞ্জিত। আগে থেকে বেতন ধার্য করেন না তিনি। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা সংগতিমতো বেতন দেন। তা হতে পারে মাসে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সন্তান ভালো ফল করলে কোনো কোনো অভিভাবক খুশি হয়ে বাড়তি কিছুও দেন। গড়ে দুই থেকে তিনটি পালায় ২৪ জনকে পড়ান সঞ্জু ঠাকুর। এ থেকে মাসে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে চলে সংসার।
মা সুনীতি চক্রবর্তী মারা গেছেন ২০০১ সালে। স্ত্রী শুক্লা চক্রবর্তী ও দুই মেয়ে নিয়ে সঞ্জু ঠাকুরের পরিবার। স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা স্ত্রী শুক্লার। ‘মানুষটা চোখে দেখেন না। তা জেনেও সংসার পেতেছি। এতটা বছর তাঁর সঙ্গে আছি। চোখে না দেখেও মানুষ চাইলে যে অনেক কিছুই পারে—এ মানুষটার সঙ্গে না থাকলে তা হয়তো বিশ্বাসই করতাম না’, বলছিলেন শুক্লা।
সরেজমিনে একদিন: শায়েস্তাগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক লাগোয়া গঙ্গানগরের প্রবেশমুখেই সঞ্জু ঠাকুরের বাড়ি। সকাল, দুপুর ও বিকেল—এ তিন বেলা তাঁর বাড়ির উঠোন যেন উন্মুক্ত এক পাঠশালা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। বৃষ্টির মৌসুম ছাড়া উঠানেই চলে পাঠদান। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকেও ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে।
সম্প্রতি একদিন সঞ্জু ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বিকেলের পালায় পড়তে এসেছে ১২ জন। উঠানে মাদুর পেতে শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই বসল। ঘর থেকে সঞ্জু ঠাকুর বের হলেন বসার একটি পিঁড়ি নিয়ে। শুরু হলো পাঠের কাজ। সঞ্জু ঠাকুর তাঁর শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে পড়া আগে শোনেন, তারপর পড়ান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়ান তিনি। মাঝেমধ্যে মেয়ে এইচএসসি পাস মৌসুমী তাঁকে সহায়তা করেন।
প্রতিষ্ঠিত হওয়া শিক্ষার্থীরা: শৈশব-কৈশোরে সঞ্জু ঠাকুরের কাছে পড়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেই হয়েছেন ব্যাংকার, শিক্ষক বা পুলিশের কর্মকর্তা। খোঁজ করতে পাওয়া গেল তাঁর প্রথমদিকের ছাত্র সমীরণ চক্রবর্তীকে। শায়েস্তাগঞ্জের শ্রীকোটা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক তিনি। সমীরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘ছোটবেলায় যখন পড়তাম, তখন মনে হতো তিনি আসলে দেখতে পান। বড় হওয়ার পর বুঝেছি, তাঁর চোখে আলো নেই।’ মৌলভীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালেক মিয়াও সঞ্জু ঠাকুরের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে যে কয়েকজন শিক্ষকের কথা মনে আছে, সঞ্জু স্যার তাঁদের অন্যতম। সব বিষয়ে তিনি দক্ষ। তবে অঙ্কে সবচেয়ে বেশি দক্ষ।’
গুণমুগ্ধদের কথা: সঞ্জু ঠাকুরের প্রসঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জের জহুর চান বিবি মহিলা কলেজের প্রভাষক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তাঁকে দেখে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার দীক্ষা পায় শিক্ষার্থীরা। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্থানীয় অভিভাবকদের কাছে এক ভরসার নাম সঞ্জু ঠাকুর।’
এ কৃতী শিক্ষকের একনিষ্ঠ পাঠদান আর অতিসাধারণ জীবনযাপন দেখে আপ্লুত হবিগঞ্জ ও সিলেটের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শুধু শুনেছিলাম, চোখে না দেখতে পাওয়া একজন মানুষ ছাত্রছাত্রী পড়ান। শ্রদ্ধা জানাতে কিছু ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে দেখি, একটি জীর্ণ টিনের ঘর। বর্ষা এলে চালের ফুটো দিয়ে ঘরে পানি পড়ে। বাইরে মাটিতে চটের বস্তা ফেলে শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে পড়ে। এভাবে চলছে ৩৫ বছর ধরে! মনে হলো, তাঁর হাতে ফুল নয়, কিছু অর্থসহায়তা দিলে অন্তত ঘরটা সংস্কার হবে। আমি সরকারিভাবে ২৫ হাজার টাকার অর্থসহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
নিজে যা বলেন: সঞ্জু ঠাকুর বলেন, ‘আমি তো জীবন পাড়ি দেওয়া মানুষ। সবই হইছে আমার মনের জোরে। যেভাবে আছি, ঠিক এইভাবে চললেই আমার অইব। আমার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েটারে (মৌসুমী) আমি নিজে পড়াইছি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নিয়া গেছি। আমার অনেক ছাত্রছাত্রী এখন প্রতিষ্ঠিত, চাকরি-বাকরি করছে। কিন্তু মেয়ের একটা চাকরি জোটে নাই। তার একটা চাকরি হইলে বড় খুশি হইতাম!’
No comments