‘নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও’ -বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে এক মায়ের চিঠি by ইকবাল আহমদ সরকার
একসময়
তাদের সবই ছিল। নানান পেশার মানুষ। কেউ ছিলেন সরকারি চাকুরে, কেউ
ব্যবসায়ী, কেউবা শিক্ষক। পরিবার নিয়ে সুখের জীবন ছিল তাদের। কিন্তু
শেষবেলায় এসে জীবন তাদের সঙ্গে হয়তো নিষ্ঠুর রসিকতাই করেছে। সব থেকেও যেন
তাদের কিছুই নেই। এখন তাদের ঠাঁই হয়েছে গাজীপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ির বয়স্ক
পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন
রয়েছেন ১৯৩ জন ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ। সেসব নিবাসীদের মনে স্বামী বা
স্ত্রী, সন্তান, স্বজনদের নিয়ে কতইনা ব্যথা আর আবেগ গড়াগড়ি খাচ্ছে। যদিও
অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল সার্ভিস, টিভি দেখার জন্য হলরুম, নারী ও
পুরুষদের জন্য আলাদা ডাইনিং রুম এবং মসজিদে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
এরপরও তাদের মন শুধুই কাঁদে স্বজনদের জন্য। কেউ প্রকাশ করছেন আর কেউ করছেন
না। জীবনের শেষ প্রান্তের অসহায় এসব মানুষের সঙ্গেই নিবাসের দেয়ালে ঝুলছে
সুখের সংসারে ঠাঁই না পাওয়া অসহায় এক মমতাময়ী মায়ের বেদনায় ভরা ছেলের প্রতি
আবেগের এক খোলা চিঠি।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন- ‘আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। বাবা... এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোন.... তার খবরা-খবর নিও। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো আমি ভালো আছি। আমি দোয়া করি, তোমাকে যেন আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোনো এক জ্যোস্নাভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে নিও। বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি এটাই কি আমার সেই খোকা!’ মায়ের প্রতি সন্তানের এই অবহেলার কারণ আর মমতায় ভরা ওই মায়ের ঠিকানা না জানা গেলেও হতভাগা অনেকের ঠিকানাই মিলেছে, যাদের ঠাঁই হয়েছে গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার খতিব জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
অনেক মা-বাবার জীবনের গল্প চাপা পড়েছে বৃদ্ধাশ্রমের গাছ-গাছালির ঝরা পাতার নিচে। শেষ জীবনের স্বপ্ন এখন চাপা দিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের দেয়ালের গাথুনির ভাঁজে ভাঁজে। তবে কেউ কেউ তুলে ধরছেন তাদের বুকের ভেতরে জমে থাকা ব্যথার কথাগুলো। আবার সবাই যে ছেলেমেয়ে বা স্বজনদের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে এখানে এসেছেন তেমনও নয়। সমাজের কারণে, পরিস্থিতির শিকার হয়েও এসেছেন কেউ কেউ। তাদেরই একজন ঝালকাঠির এম আলী। তিনি নিজের সহায় সম্পদ বিলিয়েছেন সমাজসেবার কাজে। তার মেয়ে ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে নিজের উপার্জন দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। আর ছেলে এমবিএ পাস করেছে। এম আলী ছেলেমেয়ে বা সংসারের লোকজনের জন্য নয়, ঘৃণ্য কিছু সমাজপতি নামধারী সমাজের লোকজনের জন্য বাড়ি ছেড়ে তিনি ঠাঁই নিয়েছেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পরিবারে অবাঞ্ছিত হয়ে অবহেলিত হয়ে অনেকে আছেন এই কেন্দ্রে। তাদেরই একজন ফরিদপুরের বাদশাহ মিয়া (৭০)। তিনি সৌদি আরব ছিলেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। স্ত্রীর নামেই বিদেশ থেকে পাঠাতেন টাকা-পয়সা। ঢাকার রামপুরায় স্ত্রী লালবানুর নামের জমিতে বাড়ি তৈরি করে সেই বাড়িতে তিনি এখন অপাংক্তেয়। শরীরের কর্মক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের অর্থে গড়া বাড়ি থেকে বাদশাহকে বের হয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে এই কেন্দ্রে। গাজীপুরের কারাগারে আটক ছিলেন জেমস ওয়াকার (৭০) নামের এক ভারতীয় নাগরিক। আইনি সহায়তার পর পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রায় দুই বছর আগে জেমস ওয়াকারকে নিয়ে আসেন কেন্দ্রে। আরও একজন বিদেশি নাগরিক কয়েক বছর এখানে থেকে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মের লোকজন মিলেমিশেই আছেন এখানে। নারী-পুরুষদের আলাদা নিবাস। স্বজন-সংসার, পরিবার, পরিজন নিয়ে তাদের মনে নানা কষ্ট থাকলেও কেন্দ্রে অনেকটা ভালই আছেন তারা। নারায়ণগঞ্জের বৃদ্ধ আনন্দ ব্যবসা করতেন। এক ছেলে ভারতে আছেন। স্ত্রী আর অপর ছেলে মারা যাওয়ার পর বাড়িঘর ছেড়ে চলে এসেছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অভিমান করেও আছেন কেউ কেউ। তাদেরই একজন শিক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে কুমিল্লার হুমায়ুন কবির। তিনি জানালেন, স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে ভালই আছেন। নামাজ রোজাও করছেন ঠিকমত। গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার শিল্পপতি খতিব জাহিদ মুকুল আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত হয়ে অবহেলিত, অসহায়, আশ্রয়হীন প্রবীণদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। প্রাথমিকভাবে উত্তরায় এর গোড়াপত্তন হলেও ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটি স্থানান্তর করা হয় গাজীপুরে। পরের বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মাদার তেরেসা। এ কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা ১২০০।
সরকারি-বেসরকারি, দেশি বা বিদেশি কোন ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই কেবল মাত্র নিজেদের গিভেন্সি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প গ্রুপের অর্থে পরিচালিত মানবসেবার বয়স্কদের এ প্রতিষ্ঠানকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে চান তারা। এ বিষয়ে বয়স্ক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, ছোটবেলায় আমার গ্রামে, বাড়ির আশপাশে প্রবীণদের প্রতি অবহেলা-অবজ্ঞার কিছু দৃশ্য আমাকে বড়ই পীড়া দিত। আর সেই বেদনাবোধ থেকে মনে মনে ভেবেছি, মহান সৃষ্টিকর্তা যদি আমাকে তৌফিক দেন তাহলে দেশের উপেক্ষিত-অবহেলিত বয়স্কদের জন্য কিছু করব। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যখন তৌফিক দিলেন তখনই আমি শৈশবের স্বপ্ন ও প্রেরণার কথা ভুলে না গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি গড়ে তুলি। এ কেন্দ্রকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করতে পরিকল্পিতভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই কেন্দ্রের নামে এখন প্রায় শত বিঘা জমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তাদের আবাসন, চিকিৎসা ও বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মাছের খামার, সবজি চাষ, ফলের বাগান, সামাজিক বনায়ন ইত্যাদি। এসবের আয় ছাড়াও বাকি ব্যয়ভার গিভেন্সি গ্রুপের আয় থেকে মেটানো হয়। তিনি আরও জানান, এই কেন্দ্রে শুধু যে অসহায়দের লালন পালন করা হয় তা কিন্তু নয়। অনেক সময় যেসব প্রবীণের ছেলেমেয়ে বা ঘনিষ্ঠজনরা রয়েছেন, তাদের আবারও পারিবারিক বন্ধনে ফিরিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করা হয়। স্বজনদের এবং বয়স্কদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভেঙে যাওয়া পারিবারিক সম্পর্ক আবারও দৃঢ় করে অনেককেই তাদের নিজস্ব ঠিকানায় তুলে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও কারাগারের অসহায় বৃদ্ধদের জন্যও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় বয়স্কদের জন্য অন্তত একটি করে প্রবীণ কল্যাণ ক্লাব করে দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন- ‘আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। বাবা... এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোন.... তার খবরা-খবর নিও। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো আমি ভালো আছি। আমি দোয়া করি, তোমাকে যেন আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোনো এক জ্যোস্নাভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে নিও। বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি এটাই কি আমার সেই খোকা!’ মায়ের প্রতি সন্তানের এই অবহেলার কারণ আর মমতায় ভরা ওই মায়ের ঠিকানা না জানা গেলেও হতভাগা অনেকের ঠিকানাই মিলেছে, যাদের ঠাঁই হয়েছে গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার খতিব জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
অনেক মা-বাবার জীবনের গল্প চাপা পড়েছে বৃদ্ধাশ্রমের গাছ-গাছালির ঝরা পাতার নিচে। শেষ জীবনের স্বপ্ন এখন চাপা দিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের দেয়ালের গাথুনির ভাঁজে ভাঁজে। তবে কেউ কেউ তুলে ধরছেন তাদের বুকের ভেতরে জমে থাকা ব্যথার কথাগুলো। আবার সবাই যে ছেলেমেয়ে বা স্বজনদের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে এখানে এসেছেন তেমনও নয়। সমাজের কারণে, পরিস্থিতির শিকার হয়েও এসেছেন কেউ কেউ। তাদেরই একজন ঝালকাঠির এম আলী। তিনি নিজের সহায় সম্পদ বিলিয়েছেন সমাজসেবার কাজে। তার মেয়ে ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে নিজের উপার্জন দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। আর ছেলে এমবিএ পাস করেছে। এম আলী ছেলেমেয়ে বা সংসারের লোকজনের জন্য নয়, ঘৃণ্য কিছু সমাজপতি নামধারী সমাজের লোকজনের জন্য বাড়ি ছেড়ে তিনি ঠাঁই নিয়েছেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পরিবারে অবাঞ্ছিত হয়ে অবহেলিত হয়ে অনেকে আছেন এই কেন্দ্রে। তাদেরই একজন ফরিদপুরের বাদশাহ মিয়া (৭০)। তিনি সৌদি আরব ছিলেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। স্ত্রীর নামেই বিদেশ থেকে পাঠাতেন টাকা-পয়সা। ঢাকার রামপুরায় স্ত্রী লালবানুর নামের জমিতে বাড়ি তৈরি করে সেই বাড়িতে তিনি এখন অপাংক্তেয়। শরীরের কর্মক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের অর্থে গড়া বাড়ি থেকে বাদশাহকে বের হয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে এই কেন্দ্রে। গাজীপুরের কারাগারে আটক ছিলেন জেমস ওয়াকার (৭০) নামের এক ভারতীয় নাগরিক। আইনি সহায়তার পর পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রায় দুই বছর আগে জেমস ওয়াকারকে নিয়ে আসেন কেন্দ্রে। আরও একজন বিদেশি নাগরিক কয়েক বছর এখানে থেকে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মের লোকজন মিলেমিশেই আছেন এখানে। নারী-পুরুষদের আলাদা নিবাস। স্বজন-সংসার, পরিবার, পরিজন নিয়ে তাদের মনে নানা কষ্ট থাকলেও কেন্দ্রে অনেকটা ভালই আছেন তারা। নারায়ণগঞ্জের বৃদ্ধ আনন্দ ব্যবসা করতেন। এক ছেলে ভারতে আছেন। স্ত্রী আর অপর ছেলে মারা যাওয়ার পর বাড়িঘর ছেড়ে চলে এসেছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অভিমান করেও আছেন কেউ কেউ। তাদেরই একজন শিক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে কুমিল্লার হুমায়ুন কবির। তিনি জানালেন, স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে ভালই আছেন। নামাজ রোজাও করছেন ঠিকমত। গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার শিল্পপতি খতিব জাহিদ মুকুল আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত হয়ে অবহেলিত, অসহায়, আশ্রয়হীন প্রবীণদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। প্রাথমিকভাবে উত্তরায় এর গোড়াপত্তন হলেও ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটি স্থানান্তর করা হয় গাজীপুরে। পরের বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মাদার তেরেসা। এ কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা ১২০০।
সরকারি-বেসরকারি, দেশি বা বিদেশি কোন ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই কেবল মাত্র নিজেদের গিভেন্সি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প গ্রুপের অর্থে পরিচালিত মানবসেবার বয়স্কদের এ প্রতিষ্ঠানকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে চান তারা। এ বিষয়ে বয়স্ক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, ছোটবেলায় আমার গ্রামে, বাড়ির আশপাশে প্রবীণদের প্রতি অবহেলা-অবজ্ঞার কিছু দৃশ্য আমাকে বড়ই পীড়া দিত। আর সেই বেদনাবোধ থেকে মনে মনে ভেবেছি, মহান সৃষ্টিকর্তা যদি আমাকে তৌফিক দেন তাহলে দেশের উপেক্ষিত-অবহেলিত বয়স্কদের জন্য কিছু করব। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যখন তৌফিক দিলেন তখনই আমি শৈশবের স্বপ্ন ও প্রেরণার কথা ভুলে না গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি গড়ে তুলি। এ কেন্দ্রকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করতে পরিকল্পিতভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই কেন্দ্রের নামে এখন প্রায় শত বিঘা জমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তাদের আবাসন, চিকিৎসা ও বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মাছের খামার, সবজি চাষ, ফলের বাগান, সামাজিক বনায়ন ইত্যাদি। এসবের আয় ছাড়াও বাকি ব্যয়ভার গিভেন্সি গ্রুপের আয় থেকে মেটানো হয়। তিনি আরও জানান, এই কেন্দ্রে শুধু যে অসহায়দের লালন পালন করা হয় তা কিন্তু নয়। অনেক সময় যেসব প্রবীণের ছেলেমেয়ে বা ঘনিষ্ঠজনরা রয়েছেন, তাদের আবারও পারিবারিক বন্ধনে ফিরিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করা হয়। স্বজনদের এবং বয়স্কদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভেঙে যাওয়া পারিবারিক সম্পর্ক আবারও দৃঢ় করে অনেককেই তাদের নিজস্ব ঠিকানায় তুলে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও কারাগারের অসহায় বৃদ্ধদের জন্যও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় বয়স্কদের জন্য অন্তত একটি করে প্রবীণ কল্যাণ ক্লাব করে দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার।
No comments