ক্রান্তিকালের কিছু কথা by এম আবদুল হাফিজ
যে
কোনো একটি দেশের টিকে থাকা ও অগ্রগতির জন্য অনেক পূর্বশর্ত থাকে। সেগুলোর
মধ্যে আমার দৃষ্টিতে অগ্রাধিকার পায় রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা, গ্রহণযোগ্য
আইনশৃঙ্খলা ও অনুভবযোগ্য নৈতিক মান। জানি না স্বাধীনতা অর্জনের পর
বাংলাদেশে আদৌ কি কোনো সময়ে এসবের সমাহার ঘটেছিল? অবশ্য স্বাধীনতাত্তোর
প্রতিটি শাসকচক্রের অনুমানে অন্তত তার আমলে তা ঘটেছিল এবং শাসকচক্রটি
যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়েছিল। ট্রাজেডি যে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব স্বয়ং তার অভেদ্যতায় বিশ্বাস করেছিলেন তার শাসনের এক বিপজ্জনক
চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে যখনো পর্যন্ত এ দেশকে ঘিরে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের
অবসান ঘটেনি। তাকে জীবন দিয়ে তার ভুল না হলেও অসতর্কতার মাশুল পরিশোধ করতে
হয়েছিল। অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, সেনা অসন্তোষ ও রক্তপাত পটভূমিকায় এক
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দৃশ্যপট দখলের মধ্য দিয়ে নাটকের আপাতত
পরিসমাপ্তি ঘটলেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একাধিক ডাইমেনশনযুক্ত হওয়া ছাড়াও তার
বিস্তৃতি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। সবাই ভাবতে শুরু করেন যে, বাংলাদেশের
তিনিই দাতা ও ভাগ্য বিধাতা। ক্ষমতার লাগাম সৃষ্টিতে ধারণ অমুক বা তমুক
ব্যক্তিরা গোষ্ঠীর কায়েমি অধিকার। এমন পরস্পরবিরোধী দাবির সহজ নিষ্পত্তি
নেই বলে এ দেশে স্থান করে নেয় শক্তির এক প্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তার
সঙ্গে যুক্ত হয় ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস এবং পেশিশক্তির প্রয়োগ।
এমনই এক প্রতিযোগিতা ও বিতর্কের ধারাবাহিকতায় জেনারেল মনজুরও খামোকা একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান করেন। ক্ষমতা, বৈভব এবং পদমর্যাদা যদি উদ্দেশ্য হয় তার মতো যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তা দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে যে কোথাও তা হাসিল করতে পারতেন এবং একটি ঈর্ষণীয় উচ্চতায় আরোহন করতে পারতেন। দূর এবং নিকটে থেকে আমি তাকে যেটুকু দেখেছি তা আমার মধ্যে এই বিশ্বাসের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। একাত্তরের শুরুতে আশা-নিরাশার দোলাচলে শিয়ালকোটে আমরা এক গুচ্ছ বাঙালি কর্মকর্তা। যতই দিন গড়াচ্ছিল বাড়ছিল উত্তেজনা। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, একুশ পিএসএ’র আন্ডার অফিসার, বিদেশের স্টাফ কলেজ থেকে সদ্য ফেরত মনজুর সামরিক পেশাই যার প্যাশন, তিনি তাদের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারেন। স্ত্রী-পরিবারসহ গ্যারিশনের প্রেসটিজিয়াস চাবিন্দা কলোনিতে তার নিবাস। কেউ অবাক হয়নি মনজুর যখন সামরিকভাবে বিবেচিত শিয়ালকোটে অবস্থিত ১৪ (প্যারা) ব্রিগেডের সম্ভবত সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিএস পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। রাজনীতিবিমুখ, ছাপোষা এবং মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই কর্মকর্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো দুঃসাহসিক পদক্ষেপের নায়ক ভাবা কঠিন ছিল।
ক্রান্তিকালের কিছু কথাপাকিস্তানের টপ ক্লাশের চক্ষু ছানাবড়া যখন আগস্টের এক ভোরে চারদিক থেকে ম্যাসেজ আসতে থাকল যে বিএস সাহেব কো মিলনেহি রহ্যা হ্যায়। অফিসে পৌঁছেই দেখলাম গোটা কতক চপারের ওড়াউড়ি। ঊর্ধ্বতন এক অফিসারের সঙ্গে এক পর্যায়ে মনজুরের বাংলোয় গেলাম যেখানে পূর্বেও বহুবার গিয়েছি। আমার সঙ্গী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বুঝলেন কিনা জানি না আমি মুহূর্তেই আচ করতে পারলাম যে বিহঙ্গ উড়াল দিয়েছে। পূর্বের রাতে তারই কমান্ডারের বিদেশ গমন উপলক্ষে নৈশভোজ দিয়েছিল। প্রচুর হৈহুল্লোড়ের মধ্যে দেশের তৎকালীন নাজুক অবস্থার কথা কারো মনে আসেনি। পূর্ব রাতের অনুষ্ঠানে ব্যবহƒত কোনো কিছুই গোছানো হয়নি। শুধু সব বাড়ি জুড়ে সবকিছু ছিমছাম পড়ে আছে। গ্যারেজে বিদেশ থেকে আনা গাড়ি, ওয়ারড্রোবে থরে থরে সাজানো শাড়ি অলংকার, যত্রতত্র পড়ে আছে মনজুরের শখের ইলেকট্রনিক সব সামগ্রী। শুধু গৃহের বাসিন্দারাই নেই। দুর্গম পথে সীমান্ত পার হওয়ার পথে মনজুরের সঙ্গী পুরো পরিবার-আর্দালী এবং মাত্র ক’মাসের নবজাতক।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পূর্বে ইতোমধ্যেই সেনাপ্রধান ছিলেন। যেহেতু তিনি ফুলটাইম রাজনীতিক হয়েই দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তিনি তার সেনাপ্রধানের পদটি তার প্রেসিডেন্সির রক্ষাকবচ হিসেবে রাখতে চাননি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেটি একটি প্রবণতা হিসেবে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও জেনারেল জিয়ার নজরে পড়েন তার কোনো গুণের জন্য নয়। জিয়া সম্ভবত ভেবেছিলেন যে এরশাদের মতো একজন সেনাপ্রধান থাকলে তার ক্ষমতায় তিনি সম্ভবত ভাগ বসাবেন না। কিন্তু তার অনুমান ভুল ছিল। এরশাদ সাহেব ক্ষমতার লোভ সংবরণ করেনি।
মঞ্জুর অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কারণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়ার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা। তবে সব অভ্যুত্থানই সফল হবে এমন কোনো কথা নেই। মনজুর এরশাদের পথ না আগলালেও মনজুরকে নিয়ে এরশাদের স্বস্তি ছিল না। জিয়া হত্যার তদন্ত কমিশনে আমি একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলাম। সে জন্যই আঁচ করা সম্ভব হয়েছিল যে মনজুরের হত্যাটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এখনো যদি মনজুর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয় এ দেশের এক ক্রান্তিকালের ক্ষমতাকে ঘিরে আবর্তিত অনেক বিষয়ই স্পষ্ট হওয়ার সুযোগ আছে। সুযোগ আছে দেশের রাজনীতিকে একটি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
এমনই এক প্রতিযোগিতা ও বিতর্কের ধারাবাহিকতায় জেনারেল মনজুরও খামোকা একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান করেন। ক্ষমতা, বৈভব এবং পদমর্যাদা যদি উদ্দেশ্য হয় তার মতো যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তা দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে যে কোথাও তা হাসিল করতে পারতেন এবং একটি ঈর্ষণীয় উচ্চতায় আরোহন করতে পারতেন। দূর এবং নিকটে থেকে আমি তাকে যেটুকু দেখেছি তা আমার মধ্যে এই বিশ্বাসের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। একাত্তরের শুরুতে আশা-নিরাশার দোলাচলে শিয়ালকোটে আমরা এক গুচ্ছ বাঙালি কর্মকর্তা। যতই দিন গড়াচ্ছিল বাড়ছিল উত্তেজনা। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, একুশ পিএসএ’র আন্ডার অফিসার, বিদেশের স্টাফ কলেজ থেকে সদ্য ফেরত মনজুর সামরিক পেশাই যার প্যাশন, তিনি তাদের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারেন। স্ত্রী-পরিবারসহ গ্যারিশনের প্রেসটিজিয়াস চাবিন্দা কলোনিতে তার নিবাস। কেউ অবাক হয়নি মনজুর যখন সামরিকভাবে বিবেচিত শিয়ালকোটে অবস্থিত ১৪ (প্যারা) ব্রিগেডের সম্ভবত সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিএস পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। রাজনীতিবিমুখ, ছাপোষা এবং মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই কর্মকর্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো দুঃসাহসিক পদক্ষেপের নায়ক ভাবা কঠিন ছিল।
ক্রান্তিকালের কিছু কথাপাকিস্তানের টপ ক্লাশের চক্ষু ছানাবড়া যখন আগস্টের এক ভোরে চারদিক থেকে ম্যাসেজ আসতে থাকল যে বিএস সাহেব কো মিলনেহি রহ্যা হ্যায়। অফিসে পৌঁছেই দেখলাম গোটা কতক চপারের ওড়াউড়ি। ঊর্ধ্বতন এক অফিসারের সঙ্গে এক পর্যায়ে মনজুরের বাংলোয় গেলাম যেখানে পূর্বেও বহুবার গিয়েছি। আমার সঙ্গী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বুঝলেন কিনা জানি না আমি মুহূর্তেই আচ করতে পারলাম যে বিহঙ্গ উড়াল দিয়েছে। পূর্বের রাতে তারই কমান্ডারের বিদেশ গমন উপলক্ষে নৈশভোজ দিয়েছিল। প্রচুর হৈহুল্লোড়ের মধ্যে দেশের তৎকালীন নাজুক অবস্থার কথা কারো মনে আসেনি। পূর্ব রাতের অনুষ্ঠানে ব্যবহƒত কোনো কিছুই গোছানো হয়নি। শুধু সব বাড়ি জুড়ে সবকিছু ছিমছাম পড়ে আছে। গ্যারেজে বিদেশ থেকে আনা গাড়ি, ওয়ারড্রোবে থরে থরে সাজানো শাড়ি অলংকার, যত্রতত্র পড়ে আছে মনজুরের শখের ইলেকট্রনিক সব সামগ্রী। শুধু গৃহের বাসিন্দারাই নেই। দুর্গম পথে সীমান্ত পার হওয়ার পথে মনজুরের সঙ্গী পুরো পরিবার-আর্দালী এবং মাত্র ক’মাসের নবজাতক।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পূর্বে ইতোমধ্যেই সেনাপ্রধান ছিলেন। যেহেতু তিনি ফুলটাইম রাজনীতিক হয়েই দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তিনি তার সেনাপ্রধানের পদটি তার প্রেসিডেন্সির রক্ষাকবচ হিসেবে রাখতে চাননি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেটি একটি প্রবণতা হিসেবে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও জেনারেল জিয়ার নজরে পড়েন তার কোনো গুণের জন্য নয়। জিয়া সম্ভবত ভেবেছিলেন যে এরশাদের মতো একজন সেনাপ্রধান থাকলে তার ক্ষমতায় তিনি সম্ভবত ভাগ বসাবেন না। কিন্তু তার অনুমান ভুল ছিল। এরশাদ সাহেব ক্ষমতার লোভ সংবরণ করেনি।
মঞ্জুর অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কারণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়ার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা। তবে সব অভ্যুত্থানই সফল হবে এমন কোনো কথা নেই। মনজুর এরশাদের পথ না আগলালেও মনজুরকে নিয়ে এরশাদের স্বস্তি ছিল না। জিয়া হত্যার তদন্ত কমিশনে আমি একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলাম। সে জন্যই আঁচ করা সম্ভব হয়েছিল যে মনজুরের হত্যাটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এখনো যদি মনজুর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয় এ দেশের এক ক্রান্তিকালের ক্ষমতাকে ঘিরে আবর্তিত অনেক বিষয়ই স্পষ্ট হওয়ার সুযোগ আছে। সুযোগ আছে দেশের রাজনীতিকে একটি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
No comments