নতুন মাত্রায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক by এম সাখাওয়াত হোসেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সমঝোতা ও শুভেচ্ছা স্মারক নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি |
২০১৪
সালের নির্বাচনে বিজেপির অবিশ্বাস্য জয়ের পেছনে ছিল হিন্দুত্ববাদী বলে
পরিচিত গুজরাটের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সফল মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির
ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও চমক। বাল্যকাল থেকেই যাঁর ধ্যানধারণায় ছিল হিন্দুত্ব
আর ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০২
সালের ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও ২০১৪ সাল পর্যন্ত
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীই ছিলেন। গুজরাটকে অর্থনৈতিক অঙ্গনে এক উচ্চ জায়গায়
নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর শক্ত অবস্থান টের পায় গোটা ভারত। বহু বছরের
পরিবারতন্ত্র ছিঁড়ে বের হয়ে মোদি হন অধুনা ভারতের একক নেতা। সবই তাঁর
ব্যক্তি ইমেজ ও ক্যারিশমা।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথের সময়েই ভারতের বৈদেশিক নীতিতে এক পরিবর্তনের সূচনা করেন তিনি। ওই শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হন দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের সরকারপ্রধানেরা, এমনকি চিরবৈরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও। শপথ অনুষ্ঠানেই তিনি তাঁর বিদেশনীতির ধারণা দিতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে অন্য এক মোদীর উত্থান হতে দেখা যায়। প্রায় এক বছরের শাসনকালে এ পর্যন্ত আঠারোটি দেশ যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ সফর করে মোদি বিশ্বের দরবারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। পরিচিত হয় নরেন্দ্র মোদির রাষ্ট্রনায়ক রূপ।
মোদি বাংলাদেশে এলেন। ব্যস্ত সময় কাটালেন। দেখলেন, শুনলেন, জয় করলেন এবং ফেরত গেলেন অনেক প্রাপ্তি নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের প্রধান চাহিদা উত্তরাঞ্চলের সমস্যা তিস্তা নদীর পানির হিস্যা সমাধানের আশার বাণী শুনিয়ে গেলেন। সরকারের রাজকীয় অভ্যর্থনা আর আপ্যায়নের পর প্রায় বিশটি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক, বিদ্যুৎ খাতে কিছু বিনিয়োগের ভরসা আর একগাদা যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির উদ্যোগ ছাড়াও পাওয়া গেল ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের ঘোষণা। এ ঋণের লক্ষ্য যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন।
যোগাযোগ বলতে গেলে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পূর্বে প্রায় অশান্ত সাত রাজ্যের সহজ পথে যোগসূত্র গাঁথার ব্যবস্থা। কিন্তু তিস্তার সুরাহা হলো না, বরং তিস্তার সঙ্গে জুড়ল ফেনী নদীর বিষয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন যে তিনি এ সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন, তবে রাজ্য সরকারদের অনুমোদন পেলেই তিনি পানি বণ্টনের কাজ ত্বরান্বিত করতে পারবেন। কাজেই বল এখন পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা সরকারের হাতে। অবশ্য পরিষ্কার নয় যে এ দুই বিষয় একত্রে সমাধান হবে, না আলাদাভাবে সমাধান হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার ব্যাখ্যায় বলা যায় যে এখন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রিপুরার বামপন্থী সরকারপ্রধান মানিক সরকার। এক কথায় বাংলাদেশকে এ দুই রাজ্য ও নেতাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে বহু দিন। ফেনী নদীর পানির ব্যবহার এবং মুহুরির চর নিয়ে বহু দিন ধরে ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ছোটখাটো সমস্যা লেগেই থাকে। সে বিষয়ের সঙ্গে তিস্তার পানির বিষয় জুড়ে দিলে এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অবশ্যই সৃষ্টি হবে।
নরেন্দ্র মোদি বরাবরই সুবক্তা হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে তিনি তাঁর বাগ্মিতার দক্ষতা রেখেছেন। তিনি পর্যটনের মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সমস্যা সহজীকরণের কথা উচ্চারণ করেননি। মোদির ভাষণ থেকে এ কথা প্রতীয়মান যে তিনি গত এক বছরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করা ছাড়াও বাংলাদেশের সরকার, মানুষ আর সমাজ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে এ দেশ সফরে এসেছেন।
মোদি জানেন কোন সময় কোথায় কী ধরনের বক্তব্য দিতে হবে। তিনি একবারও নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। তাঁর ভাষণ শুধু বাংলাদেশিদের জন্য ছিল না, ছিল ভারতীয় এবং বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো তথা জাতিসংঘ ব্যবস্থাপনার জন্যও। তাঁর ভাষণ ছিল বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জন্যও। তিনি তাঁর ও তাঁর দেশের মনোবাসনার কথা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। আর তা হলো বিশ্বদরবারে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্বে ভারতের দাবির ন্যায্যতা তুলে ধরা। দুই দশক ধরে ভারত সরকারগুলো এ লক্ষ্যে কাজ করছে। নরেন্দ্র মোদি তাঁর শাসনামলে এর চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত না যেতে পারলেও বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন। এখানেই ভারতের দক্ষিণ এশিয়া নীতির মূল।
বিশ্বের বড় আসরে বসতে হলে ভারতকে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তবে দক্ষিণের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মোদি তাঁর বিদেশনীতিতে অনেক সফলতা অর্জন করলেও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি করতে পারেননি, যেমন পেরেছিলেন তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক অটল বিহারি বাজপেয়ি। পাকিস্তানের অবস্থানের বিষয় তিনি অপ্রচ্ছন্নভাবে হলেও উল্লেখ করেছেন তাঁর ভাষণে। যদিও সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে মোদি ওই দেশের সঙ্গে ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতের সীমান্ত বিরোধের বিষয় উল্লেখ করেননি, তবে পাকিস্তান-চীন কৌশলগত সম্পর্ক সম্বন্ধে ভারতের মনোভাব জানিয়েছেন।
নতুন আঙ্গিকে ভারতের পরিবর্তিত নীতি, যাঁর সূচনা মোদি করেছেন, তাতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ভারতের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা পরিষ্কার করা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ অনেকাংশে পাকিস্তানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা এই প্রথমবারের মতো স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়েছে, যা মোদির শেষ ভাষণেও উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে যে যোগাযোগ বা সংযোগ বা কানেক্টিভিটির সূচনা হয়েছে, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। বিগত ছয় দশকে ভারতে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে পশ্চিমাংশের আত্তীকরণ তেমনভাবে হয়নি। অশান্ত রয়ে গেছে এসব রাজ্য। মাত্র কয়েক দিন আগেই মণিপুরে বিদ্রোহীদের আক্রমণে প্রায় ২০ জন ভারতীয় সেনাসদস্য নিহত হয়েছিলেন। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে এই যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি, যেমন জরুরি সার্বিক নিরাপত্তার জন্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়তো এনে দেবে স্থিতিশীলতা।
ভারত-বাংলাদেশ কানেক্টিভিটির বিষয়টি নতুন নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি বহুভাবে চর্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে ভারতের অন্যতম চাহিদা ছিল ভূখণ্ড ব্যবহারে যোগাযোগ। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল করিডর, যা আজকের কানেক্টিভিটি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন সরকার এ বিষয়ে তেমন উৎসাহ দেখায়নি বলে বিষয়টি এত দূর গড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওই সময়ে কেন উৎসাহী ছিলেন না, তার উল্লেখ ও বিশ্লেষণ প্রয়াত জে এন দীক্ষিত রচিত লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড এবং জেনারেল জ্যাকবের রচিত সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা নামক পুস্তকে বিস্তারিত বিশ্লেষিত হয়েছে। এ কানেক্টিভিটি বাংলাদেশের চাইতে ভারতের প্রয়োজন ছিল বেশি, যে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যোগাযোগব্যবস্থা। এ ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের কতখানি প্রাপ্তি, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সংসদে অথবা অন্যান্য ফোরামে এ বিষয়ে সরকার সম্যক ধারণা দেবে বলে আশা করা যায়।
ভারত মহাসাগর তথা ভারতের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাবের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রদর্শন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক লগ্নি ইত্যাদির সঙ্গে একরকমের প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থানে ভারত প্রবেশ করছে। উদাহরণ, ভারতের দূরপ্রাচ্য নীতি। ভারত চীনের কথিত ‘সামুদ্রিক সিল্ক রুটের’ বিষয়ে সন্দিহান, যেখানে সমগ্র পথে পঞ্চাশটি বন্দর যোগ করার কথা। নরেন্দ্র মোদি এই সফরে তাঁর ভাষণে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে বন্দর যোগাযোগের কথাও উল্লেখ করেছেন। হয়তো এটাও ক্ষুদ্র আকারে চীনের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতার বিষয় হতে পারে।
বাংলাদেশে ভারতের বেশ কিছু লগ্নির সমঝোতা হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের কথাও হয়েছে, তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতখানি সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে, তা দেখার বিষয় হবে। মোদীর এই সফর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জন্য এক স্বস্তির বিষয় নিশ্চয়ই। মোদি প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ইচ্ছা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য টলারেন্সের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সরকার অবশ্যই যথেষ্ট সফল ভাবতেই পারেন। তবে এই প্রথম বাংলাদেশে এ সফরকে ঘিরে সব রাজনৈতিক দলের এক সুর হওয়া অবশ্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যতের জন্য সুখকর হতে পারে।
অবশ্যই ভারত চাইবে বড় শক্তি হিসেবে ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলতে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতকে সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ দ্রুত যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ অঞ্চলে গণতন্ত্র সুসংহত করার বিষয়েও যথেষ্ট যত্নবান হতে হবে। মোদি ভালো করেই জানেন, ভারতীয় গণতন্ত্র শক্ত ভীতে না থাকলে একজন সামান্য নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি নরেন্দ্র মোদি হয়ে উঠতে পারতেন না।
সংক্ষেপে নরেন্দ্র মোদির এ সফরকে সার্বিকভাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি নিজেকে বিশ্বের দরবারে এবং এ অঞ্চলে পরিবর্তিত মোদি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এ সফরে মোদিও বাংলাদেশের জনগণের মনে দাগ কাটতে পেরেছেন। তবে বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক হয়তো আরও অনেক দিন চলবে। মোদির সফরের মধ্য দিয়ে সমতার ভিত্তিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও অগ্রসর হোক, এমনই আমাদের কাম্য।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথের সময়েই ভারতের বৈদেশিক নীতিতে এক পরিবর্তনের সূচনা করেন তিনি। ওই শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হন দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের সরকারপ্রধানেরা, এমনকি চিরবৈরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও। শপথ অনুষ্ঠানেই তিনি তাঁর বিদেশনীতির ধারণা দিতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে অন্য এক মোদীর উত্থান হতে দেখা যায়। প্রায় এক বছরের শাসনকালে এ পর্যন্ত আঠারোটি দেশ যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ সফর করে মোদি বিশ্বের দরবারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। পরিচিত হয় নরেন্দ্র মোদির রাষ্ট্রনায়ক রূপ।
মোদি বাংলাদেশে এলেন। ব্যস্ত সময় কাটালেন। দেখলেন, শুনলেন, জয় করলেন এবং ফেরত গেলেন অনেক প্রাপ্তি নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের প্রধান চাহিদা উত্তরাঞ্চলের সমস্যা তিস্তা নদীর পানির হিস্যা সমাধানের আশার বাণী শুনিয়ে গেলেন। সরকারের রাজকীয় অভ্যর্থনা আর আপ্যায়নের পর প্রায় বিশটি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক, বিদ্যুৎ খাতে কিছু বিনিয়োগের ভরসা আর একগাদা যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির উদ্যোগ ছাড়াও পাওয়া গেল ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের ঘোষণা। এ ঋণের লক্ষ্য যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন।
যোগাযোগ বলতে গেলে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পূর্বে প্রায় অশান্ত সাত রাজ্যের সহজ পথে যোগসূত্র গাঁথার ব্যবস্থা। কিন্তু তিস্তার সুরাহা হলো না, বরং তিস্তার সঙ্গে জুড়ল ফেনী নদীর বিষয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন যে তিনি এ সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন, তবে রাজ্য সরকারদের অনুমোদন পেলেই তিনি পানি বণ্টনের কাজ ত্বরান্বিত করতে পারবেন। কাজেই বল এখন পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা সরকারের হাতে। অবশ্য পরিষ্কার নয় যে এ দুই বিষয় একত্রে সমাধান হবে, না আলাদাভাবে সমাধান হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার ব্যাখ্যায় বলা যায় যে এখন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রিপুরার বামপন্থী সরকারপ্রধান মানিক সরকার। এক কথায় বাংলাদেশকে এ দুই রাজ্য ও নেতাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে বহু দিন। ফেনী নদীর পানির ব্যবহার এবং মুহুরির চর নিয়ে বহু দিন ধরে ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ছোটখাটো সমস্যা লেগেই থাকে। সে বিষয়ের সঙ্গে তিস্তার পানির বিষয় জুড়ে দিলে এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অবশ্যই সৃষ্টি হবে।
নরেন্দ্র মোদি বরাবরই সুবক্তা হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে তিনি তাঁর বাগ্মিতার দক্ষতা রেখেছেন। তিনি পর্যটনের মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সমস্যা সহজীকরণের কথা উচ্চারণ করেননি। মোদির ভাষণ থেকে এ কথা প্রতীয়মান যে তিনি গত এক বছরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করা ছাড়াও বাংলাদেশের সরকার, মানুষ আর সমাজ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে এ দেশ সফরে এসেছেন।
মোদি জানেন কোন সময় কোথায় কী ধরনের বক্তব্য দিতে হবে। তিনি একবারও নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। তাঁর ভাষণ শুধু বাংলাদেশিদের জন্য ছিল না, ছিল ভারতীয় এবং বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো তথা জাতিসংঘ ব্যবস্থাপনার জন্যও। তাঁর ভাষণ ছিল বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জন্যও। তিনি তাঁর ও তাঁর দেশের মনোবাসনার কথা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। আর তা হলো বিশ্বদরবারে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্বে ভারতের দাবির ন্যায্যতা তুলে ধরা। দুই দশক ধরে ভারত সরকারগুলো এ লক্ষ্যে কাজ করছে। নরেন্দ্র মোদি তাঁর শাসনামলে এর চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত না যেতে পারলেও বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন। এখানেই ভারতের দক্ষিণ এশিয়া নীতির মূল।
বিশ্বের বড় আসরে বসতে হলে ভারতকে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তবে দক্ষিণের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মোদি তাঁর বিদেশনীতিতে অনেক সফলতা অর্জন করলেও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি করতে পারেননি, যেমন পেরেছিলেন তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক অটল বিহারি বাজপেয়ি। পাকিস্তানের অবস্থানের বিষয় তিনি অপ্রচ্ছন্নভাবে হলেও উল্লেখ করেছেন তাঁর ভাষণে। যদিও সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে মোদি ওই দেশের সঙ্গে ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতের সীমান্ত বিরোধের বিষয় উল্লেখ করেননি, তবে পাকিস্তান-চীন কৌশলগত সম্পর্ক সম্বন্ধে ভারতের মনোভাব জানিয়েছেন।
নতুন আঙ্গিকে ভারতের পরিবর্তিত নীতি, যাঁর সূচনা মোদি করেছেন, তাতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ভারতের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা পরিষ্কার করা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ অনেকাংশে পাকিস্তানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা এই প্রথমবারের মতো স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়েছে, যা মোদির শেষ ভাষণেও উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে যে যোগাযোগ বা সংযোগ বা কানেক্টিভিটির সূচনা হয়েছে, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। বিগত ছয় দশকে ভারতে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে পশ্চিমাংশের আত্তীকরণ তেমনভাবে হয়নি। অশান্ত রয়ে গেছে এসব রাজ্য। মাত্র কয়েক দিন আগেই মণিপুরে বিদ্রোহীদের আক্রমণে প্রায় ২০ জন ভারতীয় সেনাসদস্য নিহত হয়েছিলেন। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে এই যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি, যেমন জরুরি সার্বিক নিরাপত্তার জন্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়তো এনে দেবে স্থিতিশীলতা।
ভারত-বাংলাদেশ কানেক্টিভিটির বিষয়টি নতুন নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি বহুভাবে চর্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে ভারতের অন্যতম চাহিদা ছিল ভূখণ্ড ব্যবহারে যোগাযোগ। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল করিডর, যা আজকের কানেক্টিভিটি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন সরকার এ বিষয়ে তেমন উৎসাহ দেখায়নি বলে বিষয়টি এত দূর গড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওই সময়ে কেন উৎসাহী ছিলেন না, তার উল্লেখ ও বিশ্লেষণ প্রয়াত জে এন দীক্ষিত রচিত লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড এবং জেনারেল জ্যাকবের রচিত সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা নামক পুস্তকে বিস্তারিত বিশ্লেষিত হয়েছে। এ কানেক্টিভিটি বাংলাদেশের চাইতে ভারতের প্রয়োজন ছিল বেশি, যে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যোগাযোগব্যবস্থা। এ ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের কতখানি প্রাপ্তি, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সংসদে অথবা অন্যান্য ফোরামে এ বিষয়ে সরকার সম্যক ধারণা দেবে বলে আশা করা যায়।
ভারত মহাসাগর তথা ভারতের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাবের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রদর্শন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক লগ্নি ইত্যাদির সঙ্গে একরকমের প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থানে ভারত প্রবেশ করছে। উদাহরণ, ভারতের দূরপ্রাচ্য নীতি। ভারত চীনের কথিত ‘সামুদ্রিক সিল্ক রুটের’ বিষয়ে সন্দিহান, যেখানে সমগ্র পথে পঞ্চাশটি বন্দর যোগ করার কথা। নরেন্দ্র মোদি এই সফরে তাঁর ভাষণে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে বন্দর যোগাযোগের কথাও উল্লেখ করেছেন। হয়তো এটাও ক্ষুদ্র আকারে চীনের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতার বিষয় হতে পারে।
বাংলাদেশে ভারতের বেশ কিছু লগ্নির সমঝোতা হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের কথাও হয়েছে, তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতখানি সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে, তা দেখার বিষয় হবে। মোদীর এই সফর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জন্য এক স্বস্তির বিষয় নিশ্চয়ই। মোদি প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ইচ্ছা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য টলারেন্সের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সরকার অবশ্যই যথেষ্ট সফল ভাবতেই পারেন। তবে এই প্রথম বাংলাদেশে এ সফরকে ঘিরে সব রাজনৈতিক দলের এক সুর হওয়া অবশ্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যতের জন্য সুখকর হতে পারে।
অবশ্যই ভারত চাইবে বড় শক্তি হিসেবে ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলতে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতকে সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ দ্রুত যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ অঞ্চলে গণতন্ত্র সুসংহত করার বিষয়েও যথেষ্ট যত্নবান হতে হবে। মোদি ভালো করেই জানেন, ভারতীয় গণতন্ত্র শক্ত ভীতে না থাকলে একজন সামান্য নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি নরেন্দ্র মোদি হয়ে উঠতে পারতেন না।
সংক্ষেপে নরেন্দ্র মোদির এ সফরকে সার্বিকভাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি নিজেকে বিশ্বের দরবারে এবং এ অঞ্চলে পরিবর্তিত মোদি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এ সফরে মোদিও বাংলাদেশের জনগণের মনে দাগ কাটতে পেরেছেন। তবে বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক হয়তো আরও অনেক দিন চলবে। মোদির সফরের মধ্য দিয়ে সমতার ভিত্তিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও অগ্রসর হোক, এমনই আমাদের কাম্য।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments