কার পায়ের নিচে শক্ত মাটি? by বিভুরঞ্জন সরকার
৫ জানুয়ারি সামনে রেখে দেশের রাজনীতির মাঠ
আবার গরম হয়ে ওঠার আশংকা দেখা দিয়েছে। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে খবর বের হয়েছে,
৫ জানুয়ারির বহুল আলোচিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে
বড় ধরনের আন্দোলন-পরিকল্পনা করছে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট। ডিসেম্বর মাসেই
আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও শোনা যাচ্ছে। আগামী মার্চের মধ্যেই
সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার আশা নাকি বিএনপি
নেতৃত্ব করছে। আন্দোলনের ধরন সহিংস, না শান্তিপূর্ণ, নাকি উভয়বিধ হবে সেটা
জানা না গেলেও বিএনপি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা যে সরকারকে আর বেশি সময় দিতে
চায় না, সেটা নেতাদের কথাবার্তা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বারবার বলছেন, সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। একটা
ধাক্কা দিলেই সরকার পড়ে যাবে। অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের
অনেকেই মনে করেন না যে, বিএনপি যে রকম বলছে সে রকম নড়বড়ে অবস্থানে আছে
সরকার। সরকারের সামনে সমস্যা অবশ্যই আছে, কিন্তু আন্দোলন করে সরকারকে ফেলে
দেয়ার মতো অবস্থা দেশে নেই। সাধারণ মানুষও আন্দোলনের নামে দেশের চলমান
শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ব্যাহত হোক সেটা চায় না।
বিএনপির আন্দোলন প্রস্তুতির কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি সরকার এবং আওয়ামী লীগও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রস্তুত হচ্ছে বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। আন্দোলনের নামে কাউকে কোনো ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না বলে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। প্রয়োজনে বিএনপি জোটের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। আন্দোলন নিয়ে বিএনপি নেতারা যত তর্জন গর্জন করেন, বাস্তবে তেমন কিছু করতে না পারার অভিজ্ঞতার কারণে একদিকে সরকার তাদের হাঁকডাক খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে খুব একটা আগ্রহ বোধ করে না। তবে বিএনপি যে কিছু একটা করার চেষ্টা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই বিএনপিকে মাঠে নামতে হবে। মাঠে নামলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
দুই
‘বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করতে হয় না। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় যায়’- বলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যে মন্তব্য করেছেন, তা সত্যি বলে ধরে নিলেও প্রশ্ন আসে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তারপর জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে পারে না কেন বিএনপি? ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে এমন সব কাজকর্ম করেন, যার ফলে পরের নির্বাচনে জনগণ আর তাদের সঙ্গে থাকে না। কেউ অবশ্য বলতে পারেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করা আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগও জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যায়। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। বিরোধী দল নিজেদের গুণে জনগণের সমর্থন বা সহানুভূতি লাভ করে না, সরকার এবং সরকারি দলের ভুল-ত্রুটি বা ব্যর্থতা অর্থাৎ এক ধরনের নেতিবাচক কারণে বিরোধী দলের প্রতি মানুষ ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়।
বর্তমান সরকারের প্রতি বিন্দুমাত্র জনসমর্থন নেই বলে দাবি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, ‘পায়ের নিচে মাটি শক্ত থাকলে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিন। তখন দেখা যাবে কার পায়ের নিচের মাটি কত শক্ত।’ সাধারণভাবে দেখলে তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই। সত্যি তো, জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা থাকলে যে কোনো সময়, যে কোনো পরিস্থিতিতে ভোটারদের মুখোমুখি হতে কোনো রাজনৈতিক দলের ভয় পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা নিজেদের জনপ্রিয় বলে দাবি করেন, তারা নির্বাচন এলেই নিজেদের সুবিধামতো অবস্থা তৈরি না করে নির্বাচনে যেতে চান না। বিএনপি যদি জনগণের শক্তির ওপরে যথেষ্ট আস্থাশীল হয়ে থাকে, তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি কেন? ক্ষমতাসীন দল কারচুপি বা অনিয়ম করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে এই আশংকা থেকে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে কোনো বিবেচনাতেই সঠিক কাজ করেনি। তারা নির্বাচন বর্জন করে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েও নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ যদি জবরদস্তি করে বিজয় ছিনিয়েও নিত তাহলেও বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দেশের মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো। এখন যে বিএনপি সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই অবস্থায় আছে সেটা দলটির জন্য মোটেও স্বস্তিকর নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধামতো ব্যবস্থাতেই নির্বাচন করবে সেটা বিএনপি মেনে নিতে পারছে না। অথচ বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও তাদের সুবিধামতো ব্যবস্থায় নির্বাচন করতে অনেক ফন্দি-ফিকিরই তো করেছে। ক্ষমতায় থেকে ভোটারদের মুখোমুখি হতে বিএনপিও ভয় পেয়েছিল বলেই তারা পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানোর জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো থেকে শুরু করে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি, বশংবদ নির্বাচন কমিশন গঠন করার মতো বিতর্কিত অনেক কিছুই করেছিল। বিএনপি তখন যদি এসব অপকৌশলের আশ্রয় না নিত, তাহলে দেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ের মতো তিক্ততার পরিবেশ হয়তো সৃষ্টি হতো না।
তিন
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, সেটা বিএনপি নেতৃত্ব প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। বরং বেগম জিয়া দলীয় শীর্ষ নেতাদের এক সভায় বলেছেন, নির্বাচনের পর আন্দোলন বন্ধ করা ভুল হয়েছে। তখন আন্দোলন অব্যাহত রাখলে সরকার নাকি এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারত না। কোন ভুলের কারণে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক গবেষণা কিংবা বিতর্ক হতেই পারে। তবে এখন বিএনপি চাইছে যে কোনো উপায়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় বসবে। দেশে গণঅভ্যুত্থানের কোনো লক্ষণ বাস্তবে দেখা না গেলেও বিএনপি নেতারা বলছেন, অচিরেই নাকি গণঅভ্যুত্থানে বর্তমান সরকারের পতন হবে। যদি ধরেও নেয়া হয়, আকস্মিক কোনো ঘটনা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করবে এবং তার ফলে দেশে এমন গণবিস্ফোরণ দেখা দেবে যাতে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে; সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, বর্তমান সরকারের পতন হলেই কি বিএনপির ক্ষমতায় ফেরাটা নিশ্চিত হবে? সরকার যদি নানামুখী চাপে দেশে আগাম নির্বাচন দিতে রাজিও হয় তাহলে বিএনপি কি সেই নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপির দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ আর ফিরে যাবে না বলেই মনে হয়। এ নিয়ে বিএনপির যেমন জেদ আছে, আওয়ামী লীগও তেমনি জেদের ঊর্র্ধ্বে নয়। তাছাড়া চাপ সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি আদায় করার ক্ষমতা যে বিএনপির নেই সেটাও একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অথচ সংবিধানসম্মত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়। আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বিএনপির মনঃপূত হবে না, আবার বিএনপির প্রস্তাব আওয়ামী লীগের কাছে বিবেচনাযোগ্য হবে না। সংলাপ ও সমঝোতা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও দেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আশংকা দূর করার মতো কোনো রাজনৈতিক ফর্মুলা কেউই দিতে পারছেন না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫ ডিসেম্বর একটি সভায় যুক্তরাষ্ট্রে আটক করার সময় পুলিশের হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের মৃত্যুর পর বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এদেশে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, শত শত মায়ের কান্না শোনা যায়, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তিনি দলের নেতাকর্মীদের প্রতিদিন সাধারণ মানুষের ঘরে গিয়ে দেশের অবস্থা তুলে ধরার পরামর্শ দেন। দেশের মানুষের মধ্যে কোনো বিষয়েই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা বিএনপি নেতৃত্ব করেছেন কি? বিএনপি নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে যেসব কথা প্রতিদিন বলছেন, তা মানুষের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে? সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপিকে কি দেশের মানুষ যোগ্যতর বলে মনে করছে? বিএনপি নেতাদের প্রতি দেশের মানুষের যদি পূর্ণ আস্থা থাকত, বিএনপিকে যদি বর্তমান সরকারের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে মনে করত তাহলে মানুষ নিশ্চয়ই অন্যভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত। দেশের পরিস্থিতি যতটা খারাপ বলে বিএনপি নেতারা প্রচার করে থাকেন, সেটা যদি মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলত, তাহলে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের ঘরে গিয়ে দেশের অবস্থা তুলে ধরার পরামর্শ মির্জা আলমগীরকে দলের নেতাকর্মীদের দিতে হতো না। কথায় কথায় আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সরকার পতন ইত্যাদি না বলে বিএনপির বরং চেষ্টা করা উচিত দেশের মানুষের কাছে নিজেদের আওয়ামী লীগের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে
প্রমাণ করা। না হলে সরকারের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলেও বিএনপির পায়ের নিচের মাটি শক্ত হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক, কলাম লেখক
বিএনপির আন্দোলন প্রস্তুতির কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি সরকার এবং আওয়ামী লীগও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রস্তুত হচ্ছে বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। আন্দোলনের নামে কাউকে কোনো ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না বলে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। প্রয়োজনে বিএনপি জোটের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। আন্দোলন নিয়ে বিএনপি নেতারা যত তর্জন গর্জন করেন, বাস্তবে তেমন কিছু করতে না পারার অভিজ্ঞতার কারণে একদিকে সরকার তাদের হাঁকডাক খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে খুব একটা আগ্রহ বোধ করে না। তবে বিএনপি যে কিছু একটা করার চেষ্টা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই বিএনপিকে মাঠে নামতে হবে। মাঠে নামলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
দুই
‘বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করতে হয় না। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় যায়’- বলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যে মন্তব্য করেছেন, তা সত্যি বলে ধরে নিলেও প্রশ্ন আসে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তারপর জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে পারে না কেন বিএনপি? ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে এমন সব কাজকর্ম করেন, যার ফলে পরের নির্বাচনে জনগণ আর তাদের সঙ্গে থাকে না। কেউ অবশ্য বলতে পারেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করা আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগও জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যায়। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। বিরোধী দল নিজেদের গুণে জনগণের সমর্থন বা সহানুভূতি লাভ করে না, সরকার এবং সরকারি দলের ভুল-ত্রুটি বা ব্যর্থতা অর্থাৎ এক ধরনের নেতিবাচক কারণে বিরোধী দলের প্রতি মানুষ ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়।
বর্তমান সরকারের প্রতি বিন্দুমাত্র জনসমর্থন নেই বলে দাবি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, ‘পায়ের নিচে মাটি শক্ত থাকলে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিন। তখন দেখা যাবে কার পায়ের নিচের মাটি কত শক্ত।’ সাধারণভাবে দেখলে তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই। সত্যি তো, জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা থাকলে যে কোনো সময়, যে কোনো পরিস্থিতিতে ভোটারদের মুখোমুখি হতে কোনো রাজনৈতিক দলের ভয় পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা নিজেদের জনপ্রিয় বলে দাবি করেন, তারা নির্বাচন এলেই নিজেদের সুবিধামতো অবস্থা তৈরি না করে নির্বাচনে যেতে চান না। বিএনপি যদি জনগণের শক্তির ওপরে যথেষ্ট আস্থাশীল হয়ে থাকে, তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি কেন? ক্ষমতাসীন দল কারচুপি বা অনিয়ম করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে এই আশংকা থেকে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে কোনো বিবেচনাতেই সঠিক কাজ করেনি। তারা নির্বাচন বর্জন করে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েও নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ যদি জবরদস্তি করে বিজয় ছিনিয়েও নিত তাহলেও বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দেশের মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো। এখন যে বিএনপি সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই অবস্থায় আছে সেটা দলটির জন্য মোটেও স্বস্তিকর নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধামতো ব্যবস্থাতেই নির্বাচন করবে সেটা বিএনপি মেনে নিতে পারছে না। অথচ বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও তাদের সুবিধামতো ব্যবস্থায় নির্বাচন করতে অনেক ফন্দি-ফিকিরই তো করেছে। ক্ষমতায় থেকে ভোটারদের মুখোমুখি হতে বিএনপিও ভয় পেয়েছিল বলেই তারা পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানোর জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো থেকে শুরু করে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি, বশংবদ নির্বাচন কমিশন গঠন করার মতো বিতর্কিত অনেক কিছুই করেছিল। বিএনপি তখন যদি এসব অপকৌশলের আশ্রয় না নিত, তাহলে দেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ের মতো তিক্ততার পরিবেশ হয়তো সৃষ্টি হতো না।
তিন
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, সেটা বিএনপি নেতৃত্ব প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। বরং বেগম জিয়া দলীয় শীর্ষ নেতাদের এক সভায় বলেছেন, নির্বাচনের পর আন্দোলন বন্ধ করা ভুল হয়েছে। তখন আন্দোলন অব্যাহত রাখলে সরকার নাকি এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারত না। কোন ভুলের কারণে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক গবেষণা কিংবা বিতর্ক হতেই পারে। তবে এখন বিএনপি চাইছে যে কোনো উপায়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় বসবে। দেশে গণঅভ্যুত্থানের কোনো লক্ষণ বাস্তবে দেখা না গেলেও বিএনপি নেতারা বলছেন, অচিরেই নাকি গণঅভ্যুত্থানে বর্তমান সরকারের পতন হবে। যদি ধরেও নেয়া হয়, আকস্মিক কোনো ঘটনা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করবে এবং তার ফলে দেশে এমন গণবিস্ফোরণ দেখা দেবে যাতে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে; সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, বর্তমান সরকারের পতন হলেই কি বিএনপির ক্ষমতায় ফেরাটা নিশ্চিত হবে? সরকার যদি নানামুখী চাপে দেশে আগাম নির্বাচন দিতে রাজিও হয় তাহলে বিএনপি কি সেই নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপির দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ আর ফিরে যাবে না বলেই মনে হয়। এ নিয়ে বিএনপির যেমন জেদ আছে, আওয়ামী লীগও তেমনি জেদের ঊর্র্ধ্বে নয়। তাছাড়া চাপ সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি আদায় করার ক্ষমতা যে বিএনপির নেই সেটাও একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অথচ সংবিধানসম্মত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়। আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বিএনপির মনঃপূত হবে না, আবার বিএনপির প্রস্তাব আওয়ামী লীগের কাছে বিবেচনাযোগ্য হবে না। সংলাপ ও সমঝোতা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও দেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আশংকা দূর করার মতো কোনো রাজনৈতিক ফর্মুলা কেউই দিতে পারছেন না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫ ডিসেম্বর একটি সভায় যুক্তরাষ্ট্রে আটক করার সময় পুলিশের হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের মৃত্যুর পর বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এদেশে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, শত শত মায়ের কান্না শোনা যায়, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তিনি দলের নেতাকর্মীদের প্রতিদিন সাধারণ মানুষের ঘরে গিয়ে দেশের অবস্থা তুলে ধরার পরামর্শ দেন। দেশের মানুষের মধ্যে কোনো বিষয়েই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা বিএনপি নেতৃত্ব করেছেন কি? বিএনপি নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে যেসব কথা প্রতিদিন বলছেন, তা মানুষের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে? সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপিকে কি দেশের মানুষ যোগ্যতর বলে মনে করছে? বিএনপি নেতাদের প্রতি দেশের মানুষের যদি পূর্ণ আস্থা থাকত, বিএনপিকে যদি বর্তমান সরকারের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে মনে করত তাহলে মানুষ নিশ্চয়ই অন্যভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত। দেশের পরিস্থিতি যতটা খারাপ বলে বিএনপি নেতারা প্রচার করে থাকেন, সেটা যদি মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলত, তাহলে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের ঘরে গিয়ে দেশের অবস্থা তুলে ধরার পরামর্শ মির্জা আলমগীরকে দলের নেতাকর্মীদের দিতে হতো না। কথায় কথায় আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সরকার পতন ইত্যাদি না বলে বিএনপির বরং চেষ্টা করা উচিত দেশের মানুষের কাছে নিজেদের আওয়ামী লীগের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে
প্রমাণ করা। না হলে সরকারের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলেও বিএনপির পায়ের নিচের মাটি শক্ত হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক, কলাম লেখক
No comments