মেয়েটিই নাকি খারাপ! by মাহবুব কামাল
প্রচণ্ড উত্তাপের একটি দেশী সূর্য, বায়ু
অফুরন্ত, ঈর্ষণীয় পানিসম্পদ, সাইজেবল প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ, উর্বরা জমি,
অজস্র শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্রমবিকাশমান প্রযুক্তিসমৃদ্ধ নতুন
প্রজন্ম, কর্মোস্পৃহ উদ্যোক্তা শ্রেণী, উৎপাদনক্ষম নারী সমাজ, দাতা দেশ ও
গোষ্ঠীর বিশেষ নজর, লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক, সর্বোপরি কোটি কোটি মানুষের
দ্বিগুণসংখ্যক সৃজনশীল হাত অধিকারে থাকার পরও এদেশ এখনও কেন উন্নয়নশীল
দেশের তালিকায়ই অন্তর্ভুক্ত, এ প্রশ্ন কাকে করবো আমরা? বাংলাদেশকে অনুন্নত
না বলে যে উন্নয়নশীল বলা হলো, তা মান বাঁচানোর জন্যই। দালালের মান বাঁচাই
আমরা যেমন তাকে মধ্যস্বত্বভোগী বলে, দেহপসারিণীকে ভদ্র ভাষায় বলি সেক্স
ওয়ার্কার। হ্যাঁ, প্রশ্নটি আমরা কাকে করবো? কয়েকদিন আগে মাহাথিরের সঙ্গে
শেখ হাসিনার একটি ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। বেশ তাহলে, এ দুজনকেই করা যাক
প্রশ্নটি। শেখ হাসিনাকে এ প্রশ্ন করলে তিনি সম্ভবত উত্তর দেবেন- আমরা
খারাপটা কীভাবে থাকলাম? প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ, গড় আয় দিনদিন বাড়ছে, গড় আয়ুও।
লোকে না খেয়ে মরছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বৈষম্যের কথা উহ্য রেখে তিনি
হয়তো আরও বলবেন- পাকিস্তান আমলে গাড়ি চালাতো কে? পিএইচডি অথবা এমআরসিপি
প্রোগ্রাম শেষ করে একটা ফোক্স ওয়াগন আর একটা ফ্রিজ নিয়ে আসতো লোকে। এছাড়া
গাড়ি চালাতো প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। এখন? যেখানেই ইলেকট্রিসিটি, সেখানেই
ফ্রিজ। আর বিএমডব্লিউ গুনে দেখুন তো।
মাহাথিরকে একই প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়ার আগে হয়তো বলবেন- একটু দাঁড়ান, লি কুয়ানের (সিঙ্গাপুরে গেলে আমরা যে বলে উঠি- আহা কী সুন্দর, সেই সৌন্দর্যের রূপকার) সঙ্গে কথা বলে নিই আগে। মোবাইলে কথা শেষ করে তিনি বলবেন- ইয়েস, আমরা একমত। বাংলাদেশকে আরও অনেক উপরে ওঠানো সম্ভব।
অনেকে বলেন, দেশটা যে খুব বেশি এগোতে পারছে না, এর বড় কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা। হবে হয়তো। স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে, টাকা ও চাকার চক্রের মতো। টাকা নেই, তাই চাকা নেই, তাই টাকা নেই, তাই চাকা নেই-এর মতো স্থিতিশীলতা নেই, তাই সমৃদ্ধি নেই, তাই স্থিতিশীলতা নেই, তাই সমৃদ্ধি নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, এদেশের মানুষই খারাপ, এর চেয়ে বেশি উন্নতি আর কী হবে দেশের! এদের একজন তো আমাকে বলেছেনই, মুক্তিযুদ্ধ বলার আগে মহান লাগান কেন? মানুষ কি যুদ্ধটাকে মহান ভেবে অস্ত্র ধরেছে? যুদ্ধে নেমেছে তো প্রাণে বাঁচার জন্য। মানুষ যদি মহৎ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ করতো, তাহলে স্বাধীনতার পরের অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না কেন? তার কথা ফেলে দেয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে বাঙালিকে ভালো মানুষ বানিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তো আর কোরআনকে অতিক্রম করতে পারবেন না। সেখানেই তো বলা আছে- প্রতিটি বস্তুই তার মূলের দিকে প্রত্যাবৃত হয়। বাঙালিও হয়তো ফিরে গেছে তার মূলের দিকে। আমার মধ্যেও এক ধন্ধ কাজ করে। আসলেই কি মানুষের খারাপত্বের জন্য দূরের যাত্রায় গতি বাড়াতে পারছি না আমরা? কখনও ভাবি- না, এ ভাবনা ঠিক নয়। ধর্ষণ মামলায় ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা পেয়ে পুলিশ ধর্ষিতার আত্মীয়স্বজনকে বলে- শুনতেছি মেয়েটিই নাকি খারাপ! আমি তো মানুষকে তেমন খারাপ বলতে পারি না। আবার কখনও মনে হয়, নেতা নির্বাচনে অপারগ, জ্ঞানচর্চায় অনাগ্রহী, ধর্মান্ধ, ঈর্ষাপরায়ণ, নিন্দুক, পরশ্রীকাতর এই মানুষ আসলে ব্যর্থই। এক বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানুষের এই মনন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ফলে যথার্থ নেতা পেতে আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। গ্যাটে তো আর ভুল বলেননি- মহান বক্তার জন্য দরকার মহান শ্রোতৃমণ্ডলী! বাঙালি যে অল্পে তুষ্ট থাকে, এটাও তার ভালো গুণ নয়। অল্পে তুষ্ট থাকলে গোলা ভরবে কীভাবে? যাকগে।
বাঙালির পক্ষে সত্যিই মহান শ্রোতা হওয়া সম্ভব কি-না, আমরা একটু দেখি। প্রশ্নটা হলো, হাসিনা-খালেদার বিপরীতে কোন্ মহান ব্যক্তিটি নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষণা করেছেন যে, এ দুজন থেকে মুখ ফিরিয়ে তার কথাই শুনবো আমরা? একটা মাইক্রো লেভেলের উদাহরণ দিই। কয়েক বছর আগে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষের নেতৃত্ব দিয়ে শরীরে মহানত্বের চাদর জড়িয়েছিলেন স্থানীয় গোলাম রাব্বানি। সেই ভাবমূর্তির সুবাদে তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন। হা হতোস্মি! কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে দেখলাম- তিনি তার বাড়িতে পলাতক হত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়েছেন! আরেকটু বলি। কিছুদিন আগে ড. কামাল হোসেনের বাসার সামনের লনে বসেছিলাম আমরা অনেকেই। উদ্দেশ্য, কী করা যায় তা খোঁজার চেষ্টা করা। আমি যে বুকভারা আশা নিয়ে সেখানে গিয়েছি, তা নয়। কামাল হোসেন কুড়ি বছর আগে যখন গণফোরাম ফ্লোট করেছিলেন, তখন সেখানে মোস্তফা মহসীন মন্টুর নাম দেখে এক কলামে লিখেছিলাম- একই জিনিস একই দামে কিনতে হলে মানুষ ছোট দোকানে যাবে কেন, তারা যাবে বড় দোকানেই। আরও লিখেছিলাম কামাল হোসেনকে তার আইটেনেরারিটা (ভ্রমণবৃত্তান্ত) জানাতে হবে প্রথম। তিনি আমাদের প্রেমে ফেলে, উত্তেজিত করে বাণিজ্য করতে নিরুদ্দেশ হবেন, তা হবে না। তাকে নেক্সট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইট ধরা বন্ধ করতে হবে; শুধু মেডিকেল চেক-আপের জন্য ব্যাংকক অ্যালাউড, এছাড়া কোথাও যেতে পারবেন না, এমন কথা দিলে তার সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। যাহোক, সেদিনের গেট-টুগেদারেও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম আইনশাস্ত্রে অতিকৌশলী ও রাজনীতিতে হধরাব (কলাকৌশলবর্জিত) এই মানুষটিকে। তিনি সদুত্তর দিতে না পারলেও তার গণতান্ত্রিক মানসের সুফল পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছেন তিনি। কিন্তু এক সম্পাদক, বর্তমান সরকার এখনও টিকে আছে বলে যার শরীরে অ্যালার্জির দাগ বসে গেছে, ক্ষেপে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন ড. কামাল, ক্ষেপলেন সম্পাদক মহোদয়! সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি- প্রথম কে অনুভব করেছিলেন এ দুয়ের তাপ?
আরেক বিকল্পের কথা শুনুন। কার্ল মার্কসের
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও বাইবেল দুটোই শুরু হয়েছে প্রতিশ্র“তি দিয়ে- সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্র“তি। এদেশেরও বামপন্থী নেতারা ছিলেন একসময় প্রতিশ্র“তিশীল। তারা অবশ্য এখনও প্রতিশ্র“তিবদ্ধ, তবে তা ব্যক্তিস্বার্থে। মার্কসবাদে কংক্রিট অ্যানালিসিস অব দ্য কংক্রিট টাইম বলে একটি আপ্তবাক্য আছে। বামপন্থীরা কংক্রিট টাইমের কংক্রিট অ্যানালিসিস করে দেখেছেন, যৌবন মানে নাস্তিকতা আর বার্ধক্য ধর্মচর্চা। আর তাই হজে গিয়ে হাজরে আসওয়াত পাথরে চুমু দিয়ে যৌবনের পাপমোচন করতে হবে। আর ইহলোকে শান্তিতে ঘুমানোর জন্য বাগাতে হবে প্লট।
না, বামপন্থীদের মধ্যেও মহত্ত্ব বলে কিছু নেই এখন। পিঁপড়া যেমন তার শরীরের চেয়ে কয়েকগুণ ভারি বস্তু মুখে বয়ে বেড়ায়, বামপন্থীরাও তেমনি বহন করছে বিপ্লবের মতো ভারি দর্শন। বহুদিন আগে দূরদর্শনে দেখা একটি নাটকের কথা মনে পড়ে। নাটকের মধ্যে নাটক। দেখানো হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি মার্কসবাদী দলের সহযোগী হিসেবে একটি লোকনাট্য দল গ্রামে-গঞ্জে নাটক দেখিয়ে বেড়ায়। নাটকের মাধ্যমে তারা জাগিয়ে তোলে মানুষের শ্রেণী সচেতনতা। তো একবার এক দর্শক নাটক দেখে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। মহা উত্তেজিত সে। এলাকায় ফিরে এক জোতদারকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে হত্যা করে। স্বাভাবিক নিয়েমেই এরপর তাকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। বেচারা কিছুদিন পলাতক জীবন কাটিয়ে সেই নাট্যদলের ম্যানেজারের দ্বারস্থ হয়। বলে- আমি তো আপনাদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই খুন করেছি, আমাকে সাহায্য করুন। ম্যানেজার অর্বাচীনের মূর্খতায় হেসে উত্তর দেয়- আরে এটা তো আর্ট ফর আর্ট সেক, শিল্পের জন্য শিল্প। আপনাকে বিপ্লবী সাজতে বলেছি আমরা?
আমি আগে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছি- মানুষই খারাপ, সেটা সন্দেহই। ধর্ষিতা কখনও খারাপ হয় না, ধর্ষকই খারাপ; অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্ষিত হচ্ছে, তারা খারাপ হতে পারে না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী পেনশনের টাকার জন্য হয়রান হচ্ছেন, সর্বনিু দরপত্রদাতা তার সব যোগ্যতা সত্ত্বেও কাজ পাচ্ছেন না, হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হওয়ার উপযুক্ত যিনি, তাকে বানানো হচ্ছে আসামি- এদের কেউই খারাপ নন, খারাপ প্রতিক্ষেত্রেই সরকারের অবতাররা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, গুম-খুন-অপহরণ করছে যারা, ঘুষ নিচ্ছে যে কেরানি, কিশোরীকে উত্যক্ত করছে যে যুবক- তারা কি সাধারণ মানুষ নন? মানি এ কথা। কিন্তু জন্মগতভাবে মানুষ যুগপৎ যে অ্যানিমিলিটি (পশুবৃত্তি) ও র্যাশনালিটি (যুক্তিবোধ) ধারণ করে, সেই অ্যানিমিলিটি দমন ও র্যাশনালিটি জাগ্রত করতে রাষ্ট্রনায়করা কী এমন প্রেরণা জুগিয়েছেন? ডাচ (ওলন্দাজ) ও ডেনিশরা তো একসময় দস্যুবৃত্তি করতো, সেই দস্যুরা এখন মাটির মানুষ। বাঙালির নৃ-তত্ত্বকে দুষে দায় সারা যাবে? একটু ভেবে দেখেছেন কি, মানুষের চিন্তা-পদ্ধতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, সে যেন আর কখনোই ভালো ও মন্দের প্রভেদ করতে না পারে?
আমার লেখায় কেন যে মাঝেমাঝেই শেক্সপিয়র এসে যান, বুঝি না। এ লেখায়ও এলেন। বলেছিলেন, একজন মানুষের জন্য অকৃতজ্ঞই সবচেয়ে খারাপ বিশেষণ। বেয়াদবের মতো প্রতিবাদ করি এ কথার। আসলে আপনাকে নির্ভর করা যায় না- কাউকে বলা এর চেয়ে খারাপ গালি আর কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই গালিই দিতে হচ্ছে আমাদের। তারা আমাদের নির্ভরশীলতার কোনো মূল্য দেননি, দেয়ার যোগ্যতা রাখেন কি-না, সেটাও এক প্রশ্ন।
তাহলে আমরা কী করব? এই লেখার প্রথম বাক্যে আমাদের সম্পদের কথা বলেছি। এই সম্পদের সদ্ব্যবহার পরের কথা, রক্ষা করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। আমরা আসলে বোকার হদ্দ। মিটসেফের ভেতর অঢেল মাছ-মাংস (সম্পদ)। এসব দিয়ে সুস্বাদু রান্না করা যায়। অথচ মিটসেফের দরজাটা খোলা রেখে বিড়ালকে সদুপদেশ দিয়ে চলেছি। দরজাটা বন্ধ করে দিলে কী হয়? তারপর সবাই মিলে রান্না চড়াই!
পুনশ্চঃ লক্ষ করে আসছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভগ্নদশার কথা লিখলেই আমার কিছু পাঠক মন খারাপ করেন। মজার ব্যাপার হলো, এরা আবার রবীন্দ্রভক্তও। রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এসে ১৯২২ সালেই, মানে রুশ বিপ্লবের পাঁচ বছরের মাথায় লিখেছিলেন- সোভিয়েত ব্যবস্থা হচ্ছে মানবাত্মার শৃংখল এবং এই ছাঁচ একদিন ভাঙবেই। ৬৫ বছর লেগেছে, তবে ছাঁচটি তো ভেঙেই গেছে শেষ পর্যন্ত। অবাক লাগে, গুরুর কথা ফলে গেল অথচ শিষ্যরা বেজার!
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
মাহাথিরকে একই প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়ার আগে হয়তো বলবেন- একটু দাঁড়ান, লি কুয়ানের (সিঙ্গাপুরে গেলে আমরা যে বলে উঠি- আহা কী সুন্দর, সেই সৌন্দর্যের রূপকার) সঙ্গে কথা বলে নিই আগে। মোবাইলে কথা শেষ করে তিনি বলবেন- ইয়েস, আমরা একমত। বাংলাদেশকে আরও অনেক উপরে ওঠানো সম্ভব।
অনেকে বলেন, দেশটা যে খুব বেশি এগোতে পারছে না, এর বড় কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা। হবে হয়তো। স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে, টাকা ও চাকার চক্রের মতো। টাকা নেই, তাই চাকা নেই, তাই টাকা নেই, তাই চাকা নেই-এর মতো স্থিতিশীলতা নেই, তাই সমৃদ্ধি নেই, তাই স্থিতিশীলতা নেই, তাই সমৃদ্ধি নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, এদেশের মানুষই খারাপ, এর চেয়ে বেশি উন্নতি আর কী হবে দেশের! এদের একজন তো আমাকে বলেছেনই, মুক্তিযুদ্ধ বলার আগে মহান লাগান কেন? মানুষ কি যুদ্ধটাকে মহান ভেবে অস্ত্র ধরেছে? যুদ্ধে নেমেছে তো প্রাণে বাঁচার জন্য। মানুষ যদি মহৎ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ করতো, তাহলে স্বাধীনতার পরের অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না কেন? তার কথা ফেলে দেয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে বাঙালিকে ভালো মানুষ বানিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তো আর কোরআনকে অতিক্রম করতে পারবেন না। সেখানেই তো বলা আছে- প্রতিটি বস্তুই তার মূলের দিকে প্রত্যাবৃত হয়। বাঙালিও হয়তো ফিরে গেছে তার মূলের দিকে। আমার মধ্যেও এক ধন্ধ কাজ করে। আসলেই কি মানুষের খারাপত্বের জন্য দূরের যাত্রায় গতি বাড়াতে পারছি না আমরা? কখনও ভাবি- না, এ ভাবনা ঠিক নয়। ধর্ষণ মামলায় ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা পেয়ে পুলিশ ধর্ষিতার আত্মীয়স্বজনকে বলে- শুনতেছি মেয়েটিই নাকি খারাপ! আমি তো মানুষকে তেমন খারাপ বলতে পারি না। আবার কখনও মনে হয়, নেতা নির্বাচনে অপারগ, জ্ঞানচর্চায় অনাগ্রহী, ধর্মান্ধ, ঈর্ষাপরায়ণ, নিন্দুক, পরশ্রীকাতর এই মানুষ আসলে ব্যর্থই। এক বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানুষের এই মনন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ফলে যথার্থ নেতা পেতে আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। গ্যাটে তো আর ভুল বলেননি- মহান বক্তার জন্য দরকার মহান শ্রোতৃমণ্ডলী! বাঙালি যে অল্পে তুষ্ট থাকে, এটাও তার ভালো গুণ নয়। অল্পে তুষ্ট থাকলে গোলা ভরবে কীভাবে? যাকগে।
বাঙালির পক্ষে সত্যিই মহান শ্রোতা হওয়া সম্ভব কি-না, আমরা একটু দেখি। প্রশ্নটা হলো, হাসিনা-খালেদার বিপরীতে কোন্ মহান ব্যক্তিটি নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষণা করেছেন যে, এ দুজন থেকে মুখ ফিরিয়ে তার কথাই শুনবো আমরা? একটা মাইক্রো লেভেলের উদাহরণ দিই। কয়েক বছর আগে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষের নেতৃত্ব দিয়ে শরীরে মহানত্বের চাদর জড়িয়েছিলেন স্থানীয় গোলাম রাব্বানি। সেই ভাবমূর্তির সুবাদে তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন। হা হতোস্মি! কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে দেখলাম- তিনি তার বাড়িতে পলাতক হত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়েছেন! আরেকটু বলি। কিছুদিন আগে ড. কামাল হোসেনের বাসার সামনের লনে বসেছিলাম আমরা অনেকেই। উদ্দেশ্য, কী করা যায় তা খোঁজার চেষ্টা করা। আমি যে বুকভারা আশা নিয়ে সেখানে গিয়েছি, তা নয়। কামাল হোসেন কুড়ি বছর আগে যখন গণফোরাম ফ্লোট করেছিলেন, তখন সেখানে মোস্তফা মহসীন মন্টুর নাম দেখে এক কলামে লিখেছিলাম- একই জিনিস একই দামে কিনতে হলে মানুষ ছোট দোকানে যাবে কেন, তারা যাবে বড় দোকানেই। আরও লিখেছিলাম কামাল হোসেনকে তার আইটেনেরারিটা (ভ্রমণবৃত্তান্ত) জানাতে হবে প্রথম। তিনি আমাদের প্রেমে ফেলে, উত্তেজিত করে বাণিজ্য করতে নিরুদ্দেশ হবেন, তা হবে না। তাকে নেক্সট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইট ধরা বন্ধ করতে হবে; শুধু মেডিকেল চেক-আপের জন্য ব্যাংকক অ্যালাউড, এছাড়া কোথাও যেতে পারবেন না, এমন কথা দিলে তার সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। যাহোক, সেদিনের গেট-টুগেদারেও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম আইনশাস্ত্রে অতিকৌশলী ও রাজনীতিতে হধরাব (কলাকৌশলবর্জিত) এই মানুষটিকে। তিনি সদুত্তর দিতে না পারলেও তার গণতান্ত্রিক মানসের সুফল পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছেন তিনি। কিন্তু এক সম্পাদক, বর্তমান সরকার এখনও টিকে আছে বলে যার শরীরে অ্যালার্জির দাগ বসে গেছে, ক্ষেপে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন ড. কামাল, ক্ষেপলেন সম্পাদক মহোদয়! সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি- প্রথম কে অনুভব করেছিলেন এ দুয়ের তাপ?
আরেক বিকল্পের কথা শুনুন। কার্ল মার্কসের
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও বাইবেল দুটোই শুরু হয়েছে প্রতিশ্র“তি দিয়ে- সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্র“তি। এদেশেরও বামপন্থী নেতারা ছিলেন একসময় প্রতিশ্র“তিশীল। তারা অবশ্য এখনও প্রতিশ্র“তিবদ্ধ, তবে তা ব্যক্তিস্বার্থে। মার্কসবাদে কংক্রিট অ্যানালিসিস অব দ্য কংক্রিট টাইম বলে একটি আপ্তবাক্য আছে। বামপন্থীরা কংক্রিট টাইমের কংক্রিট অ্যানালিসিস করে দেখেছেন, যৌবন মানে নাস্তিকতা আর বার্ধক্য ধর্মচর্চা। আর তাই হজে গিয়ে হাজরে আসওয়াত পাথরে চুমু দিয়ে যৌবনের পাপমোচন করতে হবে। আর ইহলোকে শান্তিতে ঘুমানোর জন্য বাগাতে হবে প্লট।
না, বামপন্থীদের মধ্যেও মহত্ত্ব বলে কিছু নেই এখন। পিঁপড়া যেমন তার শরীরের চেয়ে কয়েকগুণ ভারি বস্তু মুখে বয়ে বেড়ায়, বামপন্থীরাও তেমনি বহন করছে বিপ্লবের মতো ভারি দর্শন। বহুদিন আগে দূরদর্শনে দেখা একটি নাটকের কথা মনে পড়ে। নাটকের মধ্যে নাটক। দেখানো হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি মার্কসবাদী দলের সহযোগী হিসেবে একটি লোকনাট্য দল গ্রামে-গঞ্জে নাটক দেখিয়ে বেড়ায়। নাটকের মাধ্যমে তারা জাগিয়ে তোলে মানুষের শ্রেণী সচেতনতা। তো একবার এক দর্শক নাটক দেখে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। মহা উত্তেজিত সে। এলাকায় ফিরে এক জোতদারকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে হত্যা করে। স্বাভাবিক নিয়েমেই এরপর তাকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। বেচারা কিছুদিন পলাতক জীবন কাটিয়ে সেই নাট্যদলের ম্যানেজারের দ্বারস্থ হয়। বলে- আমি তো আপনাদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই খুন করেছি, আমাকে সাহায্য করুন। ম্যানেজার অর্বাচীনের মূর্খতায় হেসে উত্তর দেয়- আরে এটা তো আর্ট ফর আর্ট সেক, শিল্পের জন্য শিল্প। আপনাকে বিপ্লবী সাজতে বলেছি আমরা?
আমি আগে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছি- মানুষই খারাপ, সেটা সন্দেহই। ধর্ষিতা কখনও খারাপ হয় না, ধর্ষকই খারাপ; অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্ষিত হচ্ছে, তারা খারাপ হতে পারে না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী পেনশনের টাকার জন্য হয়রান হচ্ছেন, সর্বনিু দরপত্রদাতা তার সব যোগ্যতা সত্ত্বেও কাজ পাচ্ছেন না, হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হওয়ার উপযুক্ত যিনি, তাকে বানানো হচ্ছে আসামি- এদের কেউই খারাপ নন, খারাপ প্রতিক্ষেত্রেই সরকারের অবতাররা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, গুম-খুন-অপহরণ করছে যারা, ঘুষ নিচ্ছে যে কেরানি, কিশোরীকে উত্যক্ত করছে যে যুবক- তারা কি সাধারণ মানুষ নন? মানি এ কথা। কিন্তু জন্মগতভাবে মানুষ যুগপৎ যে অ্যানিমিলিটি (পশুবৃত্তি) ও র্যাশনালিটি (যুক্তিবোধ) ধারণ করে, সেই অ্যানিমিলিটি দমন ও র্যাশনালিটি জাগ্রত করতে রাষ্ট্রনায়করা কী এমন প্রেরণা জুগিয়েছেন? ডাচ (ওলন্দাজ) ও ডেনিশরা তো একসময় দস্যুবৃত্তি করতো, সেই দস্যুরা এখন মাটির মানুষ। বাঙালির নৃ-তত্ত্বকে দুষে দায় সারা যাবে? একটু ভেবে দেখেছেন কি, মানুষের চিন্তা-পদ্ধতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, সে যেন আর কখনোই ভালো ও মন্দের প্রভেদ করতে না পারে?
আমার লেখায় কেন যে মাঝেমাঝেই শেক্সপিয়র এসে যান, বুঝি না। এ লেখায়ও এলেন। বলেছিলেন, একজন মানুষের জন্য অকৃতজ্ঞই সবচেয়ে খারাপ বিশেষণ। বেয়াদবের মতো প্রতিবাদ করি এ কথার। আসলে আপনাকে নির্ভর করা যায় না- কাউকে বলা এর চেয়ে খারাপ গালি আর কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই গালিই দিতে হচ্ছে আমাদের। তারা আমাদের নির্ভরশীলতার কোনো মূল্য দেননি, দেয়ার যোগ্যতা রাখেন কি-না, সেটাও এক প্রশ্ন।
তাহলে আমরা কী করব? এই লেখার প্রথম বাক্যে আমাদের সম্পদের কথা বলেছি। এই সম্পদের সদ্ব্যবহার পরের কথা, রক্ষা করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। আমরা আসলে বোকার হদ্দ। মিটসেফের ভেতর অঢেল মাছ-মাংস (সম্পদ)। এসব দিয়ে সুস্বাদু রান্না করা যায়। অথচ মিটসেফের দরজাটা খোলা রেখে বিড়ালকে সদুপদেশ দিয়ে চলেছি। দরজাটা বন্ধ করে দিলে কী হয়? তারপর সবাই মিলে রান্না চড়াই!
পুনশ্চঃ লক্ষ করে আসছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভগ্নদশার কথা লিখলেই আমার কিছু পাঠক মন খারাপ করেন। মজার ব্যাপার হলো, এরা আবার রবীন্দ্রভক্তও। রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এসে ১৯২২ সালেই, মানে রুশ বিপ্লবের পাঁচ বছরের মাথায় লিখেছিলেন- সোভিয়েত ব্যবস্থা হচ্ছে মানবাত্মার শৃংখল এবং এই ছাঁচ একদিন ভাঙবেই। ৬৫ বছর লেগেছে, তবে ছাঁচটি তো ভেঙেই গেছে শেষ পর্যন্ত। অবাক লাগে, গুরুর কথা ফলে গেল অথচ শিষ্যরা বেজার!
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
No comments