রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প- উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? by অরুণ কর্মকার

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, সে বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ‘গাইডলাইন’ অনুসরণ করে এগোচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএইএর গাইডলাইন কিংবা ‘মাইলস্টোন অ্যাপ্রোচ’ ও সরকারের কাজের মধ্যে বড় ব্যবধান আছে। দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ কর্মসূচিভুক্ত করেছে। কিন্তু আইএইএর সময়ভিত্তিক কর্মনির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী কোনো দেশের প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুততর করার সুযোগ নেই। আইএইএর নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনো দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে ১০ বছর সময় লাগে। কিন্তু ২০১৩ সালে রূপপুর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে ২০১৮-১৯ সালেই শেষ করতে চায় সরকার। আইএইএর সাবেক পরিচালক (তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ), দেশের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী জসিমউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেভাবে তাড়াহুড়া করে প্রকল্পটি মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। এখন পর্যন্ত এমন কোনো কারিগরি পেশাজীবী দলও গঠন করা হয়নি, যারা সার্বিকভাবে প্রকল্পটির তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম। সরকারের সংশ্লিষ্ট অনেকেও বলেছেন, জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি থেকে শুরু করে পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ) ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্বচ্ছ জ্বালানি (ক্লিন ফুয়েল) হিসেবে স্বীকৃত। একদিকে পৃথিবীতে এর প্রসার ঘটছে, অন্যদিকে বিপজ্জনক হিসেবেও এর ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে জুতসই প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলকে বলা হয় নিয়ামক শক্তি। রূপপুর প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ নিয়েই প্রধান বিতর্ক। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মাপাড়ের একটি জনপদ রূপপুর। সেখানে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ১৯৬২ সালে। তার পর থেকে একাধিকবার প্রাথমিক সমীক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে সরকার দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়। রাশিয়ার প্রযুক্তি ও ঋণ-সহায়তায় মাঠপর্যায়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের বিষয়ে ঈশ্বরদীর মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। গত বৃহস্পতিবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নানা প্রতিক্রিয়া জানা যায়। অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক ও ঈশ্বরদী নাগরিক মঞ্চের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিদ্যুতের প্রয়োজন বিবেচনায় তাঁর অবস্থান প্রকল্পের পক্ষেই। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। এ শঙ্কা নিরসনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ঈশ্বরদীর সমাজকর্মী পাভেল খান অবশ্য নিরাপত্তার বিষয়টিই প্রধান বলে বিবেচনা করেন। একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী সভা-সেমিনার ও প্রচারপত্র বিলি করে নিরাপত্তা ও দক্ষ জনবলের অভাবের বিষয়টি মানুষের সামনে এনেছে। কলাম লেখক মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি ও তাঁর মতো অনেক লোক দোদুল্যমান অবস্থায় অছেন। নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা পরমাণু প্রযুক্তি বোঝেন, তাঁরাও পক্ষে-বিপক্ষে—দুই দিকেই আছেন। অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন না যে এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে। এমনই একজন আকবর আলী প্রামাণিক বলেন, ‘৬২ সাল থেকে দেখছি। এখন এটি বাস্তবায়ন করছে রাশিয়া। তাতে আমেরিকা অখুশি। তাদের রাজনীতির কারণে যেকোনো সময় গিট্টু লেগে যেতে পারে।’ রাশিয়া-আমেরিকার এই দ্বন্দ্বের বিষয়টি সরকারি পর্যায়েও আলোচিত। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নিরাপত্তা, জনবল প্রভৃতি বিষয়ে যাঁরা সমালোচনা করেন, সরকারের নীতিনির্ধারদের অনেকে এই সমালোচকদের মনে করেন তাঁরা আমেরিকার পক্ষ অবলম্বনকারী। তাই কোনো সমালোচনা তাঁরা কানে তুলতে চান না। বর্তমান পৃথিবীতে ৩১টি দেশে ৪৩৬টি পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর সক্রিয় রয়েছে। এগুলো মোট তিন লাখ ৭৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যা পৃথিবীর মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম, সৌদি আরবসহ অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীন, ভারত, ইরান, বেলারুশসহ অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার ঘোষণা দিয়েছে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর থেকে সে দেশের সব কটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে অধিকতর নিরাপত্তা ও জনসমর্থন নিশ্চিত করে আবার দুটি কেন্দ্র চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
আইএইএর কর্মনির্দেশিকা: প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণকারী দেশগুলোর জন্য আইএইএ ২০১২ সালে একটি কর্মনির্দেশিকা ও সময়সূচি তৈরি করে। সে অনুযায়ী, প্রথম বছর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রকল্প এলাকার বিশদ জরিপ ও পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণে লাগে আরও দুই বছর। এর এক বছরের মধ্যে প্রকল্প এলাকার প্রাথমিক নিরাপত্তা বিশ্লেষণী প্রতিবেদন (পিএসএআর) তৈরি করা হয়। এরপর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ পিএসএআর পর্যালোচনা করে। এ পর্যায়ে শুরু হয় প্রকল্প এলাকা প্রস্তুত করার কাজ। অর্থাৎ প্রকল্প এলাকা প্রস্তুত করার পর্যায় শুরু হয় সম্ভাব্যতা যাচাই শুরুর তিন বছর পর, চতুর্থ বছরে গিয়ে। কিন্তু রূপপুরের ক্ষেত্রে গত বছর (২০১৩ সাল) অক্টোবরে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে। ২০১৫ সালেই প্রকল্প এলাকা প্রস্তুত করে মূল প্রকল্পের পুরো কাজ শুরুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অথচ আইএইএর নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রকল্প এলাকায় প্রথম সিমেন্ট ঢালাইয়ের কাজ (ফার্স্ট কংক্রিট) শুরু করার কথা পাঁচ বছরের মাথায়। আইএইএর ওই কর্মনির্দেশিকা অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাই শুরুর পরবর্তী ১০ বছরের মাথায় কোনো দেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হতে পারে। রূপপুরের ক্ষেত্রে ছয় বছরের মাথায় ২০১৮-১৯ সালেই প্রথম ইউনিট চালু করার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের নীতিনির্ধারক ও রূপপুর প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মুখে আইএইএর কর্মনির্দেশিকা অনুসরণ করার কথা বললেও সে অনুযায়ী কাজ করছেন না। তবে প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, তাঁরা আইএইএর ২০০৯ সালের মাইলস্টোন অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করছেন। পরমাণু শক্তি কমিশনের সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের মাইলস্টোন অ্যাপ্রোচটি তাত্ত্বিক। সেখানে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দেশের কোন সময় কী কাজ করতে হবে, তা নির্দিষ্ট করা নেই। কাজেই সেটি অনুসরণ করলে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করা যায়। ২০১২ সালের কর্মনির্দেশিকায় শুরু থেকে কোন কাজ কখন করতে হবে, তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তাই এটি অনুসরণ করলে ইচ্ছেমতো কাজ করা যায় না। সে জন্যই বাংলাদেশ ২০০৯ সালের অ্যাপ্রোচটি অনুসরণ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আমরা যে মাইলস্টোন অ্যাপ্রোচটি অনুসরণ করছি, তা আইএইএ জানে। প্রতি মাসে তাদের প্রতিনিধিদল এসে কাজ দেখে যায়। গত নভেম্বরেও এ রকম একটি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এসেছিলেন। আইএইএর মহাপরিচালকের সঙ্গে গত মাসেও কথা হয়েছে। আমাদের অনুসৃত অ্যাপ্রোচ ঠিক না হলে তাঁরা আমাদের বলতেন। তাঁরা বরং বলছেন, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি।’
প্রাক্‌-নির্মাণ পর্বে বিভ্রান্তি: প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ প্রাক্‌-নির্মাণ পর্বের নির্ধারিত কাজ ও ব্যয় এবং মূল নির্মাণ পর্বের সম্ভাব্য ব্যয় নিয়ে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য শুরুতেই অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ৬০টি আলাদা সমীক্ষার মধ্যে ২২টি দেশীয় বিশেষজ্ঞ-পেশাজীবীরা করবেন বলে শুরু থেকে বলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে বলা হচ্ছে, দেশের বিশেষজ্ঞরা এককভাবে একটি সমীক্ষাও করবেন না, রুশ বিশেষজ্ঞরা সবগুলো করবেন। তবে প্রয়োজন হলে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেওয়া হবে। প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি নিরাপদ ও নির্ভুলভাবে বাস্তবায়নের সব দায়িত্ব যেহেতু রস-অ্যাটমের (রাশিয়ান ফেডারেশনের পরমাণু শক্তি করপোরেশন), সেহেতু সব কাজ তারাই করবে। তাদেরই দায়িত্ব নিয়ে সব করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রস-অ্যাটম সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। আর যদি তারা সেই দায়িত্ব নিয়েই থাকে, তাহলে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাজ কী?
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন বলেন, প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সময় যেকোনো দেশেই সকল পর্যায়ের দক্ষ জনবল না থাকতে পারে। কিন্তু সে জন্য যে দেশ বা কোম্পানি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে, তারাই সব রকম সমীক্ষা ও নির্মাণকাজ করবে। তিনি বলেন, এ রকম ক্ষেত্রে ক্রেতা দেশের (বাংলাদেশ) উচিত অভিজ্ঞ কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগ করা এবং শুরু থেকেই প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া। ২০০৯ সালে যখন রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়, তখন থেকেই এই জনবল তৈরির কাজ শুরু করা হলে এত দিনে প্রকল্পের মৌলিক পদগুলোতে কাজ করার মতো দক্ষ জনবল তৈরি হয়ে যেত।
আইএইএর ‘গাইডবুক’: এর ‘টেকনিক্যাল সিরিজ নম্বর ২০০’-এর তথ্য অনুযায়ী, একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজে ৪৯ জন দক্ষ পেশাজীবী প্রয়োজন। এর মধ্যে ৪৬ জন পরমাণু প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ও তিনজন স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী দরকার। প্রকল্পের ‘লাইসেন্সিং অ্যান্ড রেগুলেশন’-সংক্রান্ত কাজে ৫৫ জন দক্ষ পেশাজীবী দরকার। এর মধ্যে ৪৪ জন পরমাণু প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ও ১১ জন স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকতে হবে। প্রকল্পের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ দলেও ৫৫ জন দক্ষ পেশাজীবী দরকার বলে বলা হয়েছে আইএইএর গাইডবুকে। এর মধ্যে ৫৩ জন পরমাণু প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ও দুজন স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন লোকের অভাব রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ দলের জনবল তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হবে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু হওয়ার সময় থেকে, ২০১৬ সাল নাগাদ। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষ জনবল ছাড়া শুধু আইএইএ এবং রাশিয়ার ওপর ভরসা করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের অভিমত। রাশিয়ার নির্মিত ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলাম কেন্দ্রটির উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলেন, সেটির নকশায় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ১৭টি ত্রুটি সংশোধন করতে হয়েছে। ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড ওই ত্রুটিগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। সরকার বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ার পাশাপাশি জনবল গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং লাইসেন্সিং অ্যান্ড রেগুলেশন পর্যায়ের দক্ষ জনবল শুরু থেকেই দরকার। এ কাজে অন্যদের ওপর নির্ভর করা বিপজ্জনক হতে পারে। আর যারাই যত সহায়তা করুক, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেই নিতে হবে।
আইএইএর আট প্রশ্ন: প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোন দেশের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে, তা নির্ধারণের জন্য আইএইএর আটটি প্রশ্নের একটি তালিকা রয়েছে। সংস্থার ‘মাইলস্টোনস অ্যাপ্রোচ অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাসেসমেন্ট’ দলিলে অন্তর্ভুক্ত এ প্রশ্ন-তালিকার প্রথমটি হচ্ছে, ‘আমাদের কি প্রয়োজনীয় জনবল আছে?’ এ প্রশ্নটির জবাব ‘না’ বোধক হলে পরবর্তী প্রশ্নে যাওয়ার দরকার নেই। সেখানেই উদ্যোগটি বন্ধ করে জনবল তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশও এই পর্যায়ভুক্ত। এর পরবর্তী প্রশ্নগুলো হচ্ছে, আমরা কি অর্থের সংস্থান করতে পারব? পরমাণু কর্মসূচির প্রতি সরকার ও দেশের জনগণের সমর্থন আছে কি? পারমাণবিক বর্জ্যের কী হবে? আমাদের জন্য জুতসই/উপযুক্ত রি-অ্যাক্টর পাওয়া যাবে তো? পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যথোপযুক্ত জায়গা আমাদের আছে কি? পারমাণবিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের খুচরা যন্ত্রাংশ আমরা পাব তো? এ প্রকল্প দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে কি? এ প্রসঙ্গে আবদুল মতিন বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, ‘না’। এ অবস্থায় রূপপুর প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। বুঝেশুনে উপযুক্ত সময় ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে এগোনো উচিত।
{প্রতিবেদনের সরেজমিন কাজে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর ঈশ্বরদী প্রতিনিধি মাহবুবুল হক}
পারমাণবিক বিদ্যুৎ​ প্রকল্প মডেল

নিয়ন্ত্রণ কাঠামো
পরমাণু চুল্লিকে ঘিরে থাকে ইস্পাত বা সিসার তৈরি এই কাঠামো। এটির কাজ জরুরি পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গমন আটকে রাখা।

চাপ দেওয়ার যন্ত্র বা প্রেশারাইজার
তাপ অপসারণকারী তরল বা গ্যাসকে শীতল রাখে

বাষ্প জেনারেটর
এটি তাপ বিনিময়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। চুল্লির ভেতরে পানিকে বাষ্পে রূপান্তর করে।

টারবাইন

জেনারেটর

নিয়ন্ত্রণ দণ্ড
এটি ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের ফিশনের হার নিয়ন্ত্রণে রাখে

পরমাণু চুল্লির ধারক
এটি চাপ ধারণ করে, চুল্লির শীতলীকরণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মূল অংশ হিসেবে কাজ করে

বাষ্পকে ঠান্ডা করার যন্ত্র কনডেনসার
প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরের নমুনা
ইনফোগ্রাফিকস: প্রথম আলো
সূত্র: আইএইএ

No comments

Powered by Blogger.