বীরকন্যারা by উৎপল রায়
একাত্তরে
যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন, এমন বীরকন্যাদের খুঁজে বের করার
চেষ্টা করেছি এবার সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে। আত্মগোপনে
থাকা ওই বীরকন্যাদের কাছে বীরত্বের কথা শুনেছি। এবার আরও ৫ জনের কষ্টের কথা
শুনেছি। বর্তমানে এরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন। ওদের কেউ কোনদিন
খোঁজ করেনি। জানতেও চাননি তাদের কুশল। এমন কয়েক জনকে নিয়েই এই প্রতিবেদনটি
তৈরি করেছেন স্টাফ রিপোর্টার উৎপল রায়।
সাবিহা আহমেদ
সাবিহা আহমেদ (৬০)। একাত্তরে নির্যাতিতা এক নারী। তখন তিনি ছিলেন ১৭ বছরের তরুণী। সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন। স্বপ্ন দেখছিলেন উচ্চশিক্ষার। কিন্তু তার এই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। একটি একাত্তর সাবিহার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। তাই সেই স্মৃতি এখন আর মনে করতে চান না তিনি। মুক্তিযুদ্ধের আগের দিনগুলো স্মরণ করে এখনও তার চোখ ভিজে ওঠে জলে। সাবিহা জানান, বরিশালের লাইনরোড গলির বাসায় বাবা বই ব্যবসায়ী সরফুদ্দিন আহমেদ ও গৃহিণী মা সালেহা বেগমের সংসারে সুখেই ছিলেন। সঙ্গে ছিল দুই ভাই মনির ও মাছুম। ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ। সারাদেশ দখলের পরিকল্পনায় বরিশালেও এসে যায় পাক হানাদার বাহিনী। বরিশাল লাইন রোডের বাসায় তখন আতঙ্কে অস্থির সাবিহাদের পরিবার। সকাল দশটার দিকে পাকবাহিনী তাদের বাসায় এসে সবাইকে একটি ঘরে আটকে রাখে। তাদের কয়েকজন সাবিহাকে তুলে নিয়ে যায়। শুধু সাবিহা নয়, ওই এলাকার কম বয়সী অনেক নারীকেই তুলে নিয়ে যায় বরিশাল শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যাম্পে। জীবন বাঁচানোর জন্য পুরুষের পোশাক পরেছিলেন সাবিহা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তাকে চিনে ফেলে। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর সাবিহাসহ অন্য মেয়েদের ধর্ষণ করে পাকসেনারা। সাবিহাকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তার ডান বুকে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৪৩ বছর পরেও সেই দাগ এখনও আছে। তিনি জানান, ধর্ষণের পর একটি খালের পাড়ে গুলি করে হত্যার জন্য কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে নারীদেরও লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু ব্রাশফায়ারের আগ মুহূর্তে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যান তিনি। দুই ঘণ্টা কচুরিপানার নিচে থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। কিন্তু ততক্ষণে তার শরীর অসার হয়ে ওঠে। সমপূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে। সাবিহা জানান, সুস্থ হয়ে শহরে ফিরে এসে দেখেন বাড়ির সবাই প্রাণভয়ে তাকে ছেড়েই চলে গেছে ঢাকার নারিন্দায়। মা-বাবার খোঁজে ঢাকায় আসার পর সাক্ষাৎ হয় মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়ার সঙ্গে। তিনিই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর নির্যাতনে সাবিহার ভবিষ্যতে মা হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। সাবিহা বলেন, ১৯৭৪ সালে মতিউর রহমান নামে একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ সবাই একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে আমার নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাটি জেনে যায়। তারা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তখন থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। স্বামী মতিউর আমাকে তালাক দেন। পরে টিউশনি করে কোনমতে জীবন পার করি। সাবিহা জানান, মা হওয়ার তীব্র আকাঙক্ষা ছিল তার। এ কারণে দোলা নামের এক শিশুকন্যাকে নিজের কাছে এনে লালন পালন করেন তিনি। দোলা ও তার স্বামী রাসেলই এখন তাকে কিছুটা দেখাশোনা করছে। রাত কাটান রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানের একটি ঘরে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বয়স্কভাতার অল্প কিছু টাকা দিয়ে কোনমতে দিন যাচ্ছে। কিন্তু এমন জীবন কখনও চালান তিনি। লোকলজ্জায় কোথাও যেতে পারেন না তিনি। সবাই কেমন দৃষ্টিতে দেখে। ষাটোর্ধ্ব সাবিহা বলেন, আমার সময় শেষ। বুড়ো হয়ে গেছি। শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তবু মৃত্যুর আগে সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই।
রেজিয়া বেগম
রেজিয়া বেগম। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিতা এক নারী। স্বীকৃতি মেলেনি বীরাঙ্গনা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারেন না তিনি। মেয়ে জাহানারার সংসারে রাজধানীর তেজগাঁও রেলগেট সংলগ্ন অস্থায়ী বস্তিতে থাকেন রেজিয়া। মেয়ে আর নাতি-নাতনির অকৃত্রিম ভালবাসায় ভাল থাকলেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা ও হাহাকার অনুভব করেন তিনি। মাঝে মাঝে বুকে চাপাকষ্ট নিয়ে কেঁদে ওঠেন। কাঁদছেন প্রায় ৪৩ বছর ধরে। এক সময় লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। এখন কাঁদেন প্রকাশ্যেই। ভাতের কষ্ট নেই তার। কিন্তু কষ্ট একটাই, একাত্তরে একজন নারী হিসেবে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি অবহেলিত। যদিও কন্যা জাহানারা ও নাতি নাতনি জাহিদ ও জান্নাতুনের আদরের কমতি নেই। বলা যায় এদের বদৌলতেই তিনি জীবনের দুঃখ কষ্ট পার করছেন। তার সারাবেলার চালচিত্র দেখে কে বলবে এই বৃদ্ধার অতীত ছিল যন্ত্রণার। সমপ্রতি তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তির একটি স্যাঁতসেতে ঘরে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি সুখে আছেন। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে চান না তিনি বীরাঙ্গনা ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তার কষ্ট হয়। কৌতূহলবশত নাতি-নাতনিরা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়। তাদের নিরাশ করেন। রেজিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তেজগাঁও তেজতুরিবাজার এলাকায় বাস করতেন তিনি। স্বামী আবু মিয়ার ফলের ব্যবসা ছিল। তিনি নিজেও বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়। তেজগাঁও, ফার্মগেট, তেজতুরি বাজার এলাকায় চলছে বাঙালি নিধন অভিযান। স্বামী আবু মিয়াকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তিনি লুকিয়ে পড়েন তেজতুরি বাজার এলাকায় একটি মাটির গুহায়। তিনি বলেন, অভিযানের পর স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পাক মোটর (বর্তমান বাংলামোটর) এলাকায় আসতেই কয়েকজন রাজাকার তাকে ধরে নিয়ে যায় সেনা ক্যাম্পে। অন্তত ১০ থেকে ১২ জন সেনা ও রাজাকারের দ্বারা তিনি ধর্ষণের শিকার হন। এভাবে চলে এক সপ্তাহ। পরে তাকে ফেলে যায় বাংলামোটরের পাশেই খাল ও জংলামতো একটি জায়গায়। তিনি জানান, তখন তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। কোথাও কেউ নেই। শুধু খালে আছে অগণিত লাশ। লাশের রক্তে খালের পানিও লাল হয়ে আছে। ক্ষুধায় সেখানেই পড়ে থাকা শাপলা শালুক খেয়েছেন তিনি। পিপাসায় পান করেছেন খালের রক্তাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি। এক সময় মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত বাহিনীর (বীরবিক্রম হেমায়েত উদ্দীন হিমু) সদস্যরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়া তাকে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কিন্তু রেজিয়ার ভয় ছিল স্বামী আবু মিয়া তাকে গ্রহণ করবে কিনা। ভয় অমূলক প্রমাণ করে স্বামী তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। কারণ, তার বিশ্বাস রেজিয়ার মতো কয়েক হাজার নারী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন তাকে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। সেখানে তখন তিনিসহ আরও অনেক নির্যাতিতা নারী ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন সেখানে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন সবে স্বাধীন দেশে এসেছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তাকে মেয়ে বলে সম্বোধন করে একটি সনদপত্র দেন। অনেক দিন যত্নে রাখার পরও সনদটি আগলে রাখতে পারেননি। হারিয়ে যায়। রেজিয়া জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ওপর যে পাশবিক নির্যাতন হয়েছে সে খবর গ্রামের মানুষ জেনে যায়। গ্রামের ছোট বড় সবাই বলাবলি করতে থাকে রেজিয়া নষ্টা। যখন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকেও এরকম কটূক্তি আসতে লাগলো তিনি তখন অভিমানে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর দীর্ঘ ৪৩ বছরেও আর ফেরা হয়নি তার স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে।
রঙ্গমালা
একাত্তরের রঙ্গমালা। সুখের সংসার ছিল তার। ১৯৭১ সালে জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার ছিনারচর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি হানাদারদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের আগে কাঁদার অপরাধে তার শিশুপুত্রকে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে ফেলে হানাদাররা। এরপর লোকলজ্জায় তিনি চলে আসেন ঢাকায়। বর্তমানে রাজধানীর তেজগাঁও তেজকুনীপাড়ার রেলগেট এলাকার বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ছোট একটি ঘরে বীরাঙ্গনা রঙ্গমালার সংসার। ষাটোর্ধ রঙ্গমালা এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যের সহানুভূতিই এখন তার একমাত্র ভরসা। তিনবেলা আহারের জন্য সকাল থেকেই শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ- ভিক্ষাযুদ্ধ। রঙ্গমালা জানান, সারাদিন ভিক্ষা করে যা আসে তা একবেলার খাবারের জন্যও যথেষ্ট নয়। তাছাড়া বয়সের কারণে ভিক্ষাও করতে পারেন না নিয়মিত। আর সে কারণে কোনদিন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। রঙ্গমালার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার ছিনারচর গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হানা দেয়। অনেকেই পালিয়ে গেলেও তারা পালাতে পারেননি। তাদের বাড়িতে এসে পাকিস্তানি সেনারা রঙ্গমালাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। কাঁদার অপরাধে তার শিশু সন্তান আলামিনকে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। এর তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তিনি অচেতন হয়ে যান। তাকে মৃত মনে করে পাশেই একটি ডোবায় ফেলে যায় রাজাকাররা। এ ঘটনার পরপরই লোকলজ্জার ভয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। তিনি বলেন, বেঁচে আছি এখনও। স্বামী ভোলা মিয়া আমার অসহায়ত্বকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। কিন্তু আমার সন্তানরা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। দুই ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে কন্যা হেনার আশ্রয়ে আছি। খেতাব চাই।
রাজিয়া বেগম
মা রাজিয়া বেগম (৫৯)। একাত্তরে নির্যাতিতা নারী। লোকলজ্জায় তার দুই ছেলে আনসার ও ইউনুস মায়ের খোঁজ রাখে না। তেজগাঁও তেজকুনিপাড়া রেলওয়ে বস্তির একটি ঘরে কথা হয় রাজিয়ার সঙ্গে। লোকলজ্জার ভয়ে বছরের পর বছর এখানেই পড়ে আছেন তিনি। কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে যান না তাও প্রায় ৪০ বছর। ভাইয়ের ছেলেদের আয়ে সংসার চলে তার। সংসার বলতে বস্তির ঐ ঘরটুকু। রাজিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে পনের বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামী-সংসার নিয়ে দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার সরবরাহ করেছিলেন তিনি। এ খবর পেয়ে যায় স্থানীয় রাজাকাররা। এ অপরাধে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণ করে তাকে। চিরজীবনের মতো ভেঙে যায় রাজিয়ার স্বপ্ন-সাধ। আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। চলে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন শুধু মরণের অপেক্ষা তার। তবে মৃত্যুর আগে একটি আকুতি- কিছুই চান না। শুধু বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান তিনি। এ স্বীকৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চান আমৃত্যু। রাজিয়া জানান, তার জন্ম কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার পীরকাশেমপুর গ্রামে। তখন (১৯৭১ সালে) বয়স মাত্র পনের। অভাবের সংসার তাই তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। তবে স্বামীর ভালবাসার সংসারে অভাব থাকলেও সুখ ছিল। রাজিয়া জানান, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কোন একদিন। হঠাৎ বাড়ির পাশে গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে প্রবেশ করে কয়েকজন পাকবাহিনীর সদস্য ও রাজাকার। তারা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে। রাজিয়ার স্বামী জামাল মিয়াকেও খোঁজে। না পেয়ে চলে যায়। একদিন পর আবার আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাওয়ানোর কারণে তাকে ধরে নিয়ে যায় তাদেরই একটি ঘরে। পাকবাহিনীর একজন অফিসার ধর্ষণ করে তাকে। ধর্ষণের পর মৃত মনে করে গ্রামেরই অচেনা, নির্জন এক স্থানে ফেলে দেয় রাজাকাররা। স্বামী জামাল মিয়া হতভম্ভ। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলছে কানাঘুষা। লোকলজ্জায় রাজিয়া ৩ মাসের ছেলে আনসারকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। রাজিয়া জানান, শাহবাগ এলাকায় কয়েকজন নারীর সঙ্গে তার দেখা হয়। ওরাই তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নেয়ার পর স্বামী তাকে খুঁজে পায় তেজগাঁও রেলস্টেশনে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। জামাল সবকিছু ভুলে প্রিয়তম স্ত্রীকে কাছে নিতে চায়। কিন্তু নিজেকে অপবিত্র মনে করে আর কোনদিন রাজিয়া স্বামীর সংসারে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১০ বছর আগে রাজিয়ার স্বামী জামাল মিয়া মারা যান।
নূরজাহান
একাত্তরে তার নাম ছিল মোহরজান বেগম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দ্বারা সম্ভ্রমহানি ঘটে তার। সবাই চিনে ফেলে তাকে। লজ্জা, ঘৃণায় নিজেকে ছোট মনে হয় তার। তাই চিন্তা করেন নাম পাল্টালে হয়তো এ সমস্যা থাকবে না। এরপরেই মোহরজান নাম পরিবর্তন করে তিনি নূরজাহান নাম ধারণ করেন। এরপরও রক্ষা হয়নি। যেখানেই গিয়েছেন অপমান লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে তাকে। গ্রামের বাড়িতে যান না বহুদিন। ৬১ বছরের নূরজাহান জানালেন একাত্তরে তার জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামঝি সময়ের ঘটনা। স্বামী লিলু মিয়ার সঙ্গে তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় থাকতেন অষ্টাদশী নূরজাহান। দু’জনই ছিলেন শ্রমজীবী। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকাবাসী মিলে তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় মাটি খুঁড়ে তৈরি করলেন একটি বাঙ্কার। একদিন পাকিস্তানি সেনারা গেরিলা বাহিনীর খোঁজে এ এলাকায় আক্রমণ চালায়। তাদের সহযোগী রাজাকাররা বাঙ্কারের খোঁজ পেয়ে যায়। শেষ রক্ষা হয়নি। বাঙ্কার থেকে রাজাকাররা তাদের বের করে আনে। এমন অন্তত ১০ জন নারীকে পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সদরঘাট এলাকায়। সেখান থেকে একটি লঞ্চে তোলা হয় তাদের। পাকবাহিনীর হাতে আটক নারীরা জানতে পারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদেরকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিৎকার চেঁচামিচির একপর্যায়ে লঞ্চের ভেতরেই নূরজাহানসহ অন্তত পাঁচজনকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকররা। পরে তাকে মুন্সীগঞ্জের একটি ঘাটে ফেলে রেখে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর একদল মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহানকে উদ্ধার করে ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে তার ঠাঁই হয়নি। গ্রামের বাড়িতে চলতে থাকে গুঞ্জন। চলে আসেন ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় এসে দেখতে পান তাদের ঘরবাড়ির কোন চিহ্নই আর নেই। স্বামী লিলু মিয়া ও সন্তানদের খুঁজতে চলে যান শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। সেখানে তাদের খুঁজে পেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। স্বামী লিলু মিয়াও নিয়তির ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নূরজাহানকে মেনে নেন। নূরজাহান জানান, স্বামী মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। তখন থেকেই তার অভাব শুরু। মা একাত্তরে নির্যাতনের শিকার- এ কারণে ছেলেরা তার খোঁজ রাখে না। তাই এই বয়সেও বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন তিনি।
সাবিহা আহমেদ
সাবিহা আহমেদ (৬০)। একাত্তরে নির্যাতিতা এক নারী। তখন তিনি ছিলেন ১৭ বছরের তরুণী। সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন। স্বপ্ন দেখছিলেন উচ্চশিক্ষার। কিন্তু তার এই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। একটি একাত্তর সাবিহার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। তাই সেই স্মৃতি এখন আর মনে করতে চান না তিনি। মুক্তিযুদ্ধের আগের দিনগুলো স্মরণ করে এখনও তার চোখ ভিজে ওঠে জলে। সাবিহা জানান, বরিশালের লাইনরোড গলির বাসায় বাবা বই ব্যবসায়ী সরফুদ্দিন আহমেদ ও গৃহিণী মা সালেহা বেগমের সংসারে সুখেই ছিলেন। সঙ্গে ছিল দুই ভাই মনির ও মাছুম। ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ। সারাদেশ দখলের পরিকল্পনায় বরিশালেও এসে যায় পাক হানাদার বাহিনী। বরিশাল লাইন রোডের বাসায় তখন আতঙ্কে অস্থির সাবিহাদের পরিবার। সকাল দশটার দিকে পাকবাহিনী তাদের বাসায় এসে সবাইকে একটি ঘরে আটকে রাখে। তাদের কয়েকজন সাবিহাকে তুলে নিয়ে যায়। শুধু সাবিহা নয়, ওই এলাকার কম বয়সী অনেক নারীকেই তুলে নিয়ে যায় বরিশাল শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যাম্পে। জীবন বাঁচানোর জন্য পুরুষের পোশাক পরেছিলেন সাবিহা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তাকে চিনে ফেলে। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর সাবিহাসহ অন্য মেয়েদের ধর্ষণ করে পাকসেনারা। সাবিহাকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তার ডান বুকে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৪৩ বছর পরেও সেই দাগ এখনও আছে। তিনি জানান, ধর্ষণের পর একটি খালের পাড়ে গুলি করে হত্যার জন্য কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে নারীদেরও লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু ব্রাশফায়ারের আগ মুহূর্তে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যান তিনি। দুই ঘণ্টা কচুরিপানার নিচে থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। কিন্তু ততক্ষণে তার শরীর অসার হয়ে ওঠে। সমপূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে। সাবিহা জানান, সুস্থ হয়ে শহরে ফিরে এসে দেখেন বাড়ির সবাই প্রাণভয়ে তাকে ছেড়েই চলে গেছে ঢাকার নারিন্দায়। মা-বাবার খোঁজে ঢাকায় আসার পর সাক্ষাৎ হয় মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়ার সঙ্গে। তিনিই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর নির্যাতনে সাবিহার ভবিষ্যতে মা হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। সাবিহা বলেন, ১৯৭৪ সালে মতিউর রহমান নামে একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ সবাই একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে আমার নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাটি জেনে যায়। তারা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তখন থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। স্বামী মতিউর আমাকে তালাক দেন। পরে টিউশনি করে কোনমতে জীবন পার করি। সাবিহা জানান, মা হওয়ার তীব্র আকাঙক্ষা ছিল তার। এ কারণে দোলা নামের এক শিশুকন্যাকে নিজের কাছে এনে লালন পালন করেন তিনি। দোলা ও তার স্বামী রাসেলই এখন তাকে কিছুটা দেখাশোনা করছে। রাত কাটান রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানের একটি ঘরে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বয়স্কভাতার অল্প কিছু টাকা দিয়ে কোনমতে দিন যাচ্ছে। কিন্তু এমন জীবন কখনও চালান তিনি। লোকলজ্জায় কোথাও যেতে পারেন না তিনি। সবাই কেমন দৃষ্টিতে দেখে। ষাটোর্ধ্ব সাবিহা বলেন, আমার সময় শেষ। বুড়ো হয়ে গেছি। শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তবু মৃত্যুর আগে সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই।
রেজিয়া বেগম
রেজিয়া বেগম। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিতা এক নারী। স্বীকৃতি মেলেনি বীরাঙ্গনা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারেন না তিনি। মেয়ে জাহানারার সংসারে রাজধানীর তেজগাঁও রেলগেট সংলগ্ন অস্থায়ী বস্তিতে থাকেন রেজিয়া। মেয়ে আর নাতি-নাতনির অকৃত্রিম ভালবাসায় ভাল থাকলেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা ও হাহাকার অনুভব করেন তিনি। মাঝে মাঝে বুকে চাপাকষ্ট নিয়ে কেঁদে ওঠেন। কাঁদছেন প্রায় ৪৩ বছর ধরে। এক সময় লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। এখন কাঁদেন প্রকাশ্যেই। ভাতের কষ্ট নেই তার। কিন্তু কষ্ট একটাই, একাত্তরে একজন নারী হিসেবে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি অবহেলিত। যদিও কন্যা জাহানারা ও নাতি নাতনি জাহিদ ও জান্নাতুনের আদরের কমতি নেই। বলা যায় এদের বদৌলতেই তিনি জীবনের দুঃখ কষ্ট পার করছেন। তার সারাবেলার চালচিত্র দেখে কে বলবে এই বৃদ্ধার অতীত ছিল যন্ত্রণার। সমপ্রতি তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তির একটি স্যাঁতসেতে ঘরে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি সুখে আছেন। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে চান না তিনি বীরাঙ্গনা ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তার কষ্ট হয়। কৌতূহলবশত নাতি-নাতনিরা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়। তাদের নিরাশ করেন। রেজিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তেজগাঁও তেজতুরিবাজার এলাকায় বাস করতেন তিনি। স্বামী আবু মিয়ার ফলের ব্যবসা ছিল। তিনি নিজেও বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়। তেজগাঁও, ফার্মগেট, তেজতুরি বাজার এলাকায় চলছে বাঙালি নিধন অভিযান। স্বামী আবু মিয়াকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তিনি লুকিয়ে পড়েন তেজতুরি বাজার এলাকায় একটি মাটির গুহায়। তিনি বলেন, অভিযানের পর স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পাক মোটর (বর্তমান বাংলামোটর) এলাকায় আসতেই কয়েকজন রাজাকার তাকে ধরে নিয়ে যায় সেনা ক্যাম্পে। অন্তত ১০ থেকে ১২ জন সেনা ও রাজাকারের দ্বারা তিনি ধর্ষণের শিকার হন। এভাবে চলে এক সপ্তাহ। পরে তাকে ফেলে যায় বাংলামোটরের পাশেই খাল ও জংলামতো একটি জায়গায়। তিনি জানান, তখন তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। কোথাও কেউ নেই। শুধু খালে আছে অগণিত লাশ। লাশের রক্তে খালের পানিও লাল হয়ে আছে। ক্ষুধায় সেখানেই পড়ে থাকা শাপলা শালুক খেয়েছেন তিনি। পিপাসায় পান করেছেন খালের রক্তাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি। এক সময় মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত বাহিনীর (বীরবিক্রম হেমায়েত উদ্দীন হিমু) সদস্যরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়া তাকে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কিন্তু রেজিয়ার ভয় ছিল স্বামী আবু মিয়া তাকে গ্রহণ করবে কিনা। ভয় অমূলক প্রমাণ করে স্বামী তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। কারণ, তার বিশ্বাস রেজিয়ার মতো কয়েক হাজার নারী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন তাকে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। সেখানে তখন তিনিসহ আরও অনেক নির্যাতিতা নারী ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন সেখানে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন সবে স্বাধীন দেশে এসেছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তাকে মেয়ে বলে সম্বোধন করে একটি সনদপত্র দেন। অনেক দিন যত্নে রাখার পরও সনদটি আগলে রাখতে পারেননি। হারিয়ে যায়। রেজিয়া জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ওপর যে পাশবিক নির্যাতন হয়েছে সে খবর গ্রামের মানুষ জেনে যায়। গ্রামের ছোট বড় সবাই বলাবলি করতে থাকে রেজিয়া নষ্টা। যখন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকেও এরকম কটূক্তি আসতে লাগলো তিনি তখন অভিমানে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর দীর্ঘ ৪৩ বছরেও আর ফেরা হয়নি তার স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে।
রঙ্গমালা
একাত্তরের রঙ্গমালা। সুখের সংসার ছিল তার। ১৯৭১ সালে জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার ছিনারচর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি হানাদারদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের আগে কাঁদার অপরাধে তার শিশুপুত্রকে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে ফেলে হানাদাররা। এরপর লোকলজ্জায় তিনি চলে আসেন ঢাকায়। বর্তমানে রাজধানীর তেজগাঁও তেজকুনীপাড়ার রেলগেট এলাকার বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ছোট একটি ঘরে বীরাঙ্গনা রঙ্গমালার সংসার। ষাটোর্ধ রঙ্গমালা এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যের সহানুভূতিই এখন তার একমাত্র ভরসা। তিনবেলা আহারের জন্য সকাল থেকেই শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ- ভিক্ষাযুদ্ধ। রঙ্গমালা জানান, সারাদিন ভিক্ষা করে যা আসে তা একবেলার খাবারের জন্যও যথেষ্ট নয়। তাছাড়া বয়সের কারণে ভিক্ষাও করতে পারেন না নিয়মিত। আর সে কারণে কোনদিন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। রঙ্গমালার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার ছিনারচর গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হানা দেয়। অনেকেই পালিয়ে গেলেও তারা পালাতে পারেননি। তাদের বাড়িতে এসে পাকিস্তানি সেনারা রঙ্গমালাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। কাঁদার অপরাধে তার শিশু সন্তান আলামিনকে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। এর তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তিনি অচেতন হয়ে যান। তাকে মৃত মনে করে পাশেই একটি ডোবায় ফেলে যায় রাজাকাররা। এ ঘটনার পরপরই লোকলজ্জার ভয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। তিনি বলেন, বেঁচে আছি এখনও। স্বামী ভোলা মিয়া আমার অসহায়ত্বকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। কিন্তু আমার সন্তানরা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। দুই ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে কন্যা হেনার আশ্রয়ে আছি। খেতাব চাই।
রাজিয়া বেগম
মা রাজিয়া বেগম (৫৯)। একাত্তরে নির্যাতিতা নারী। লোকলজ্জায় তার দুই ছেলে আনসার ও ইউনুস মায়ের খোঁজ রাখে না। তেজগাঁও তেজকুনিপাড়া রেলওয়ে বস্তির একটি ঘরে কথা হয় রাজিয়ার সঙ্গে। লোকলজ্জার ভয়ে বছরের পর বছর এখানেই পড়ে আছেন তিনি। কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে যান না তাও প্রায় ৪০ বছর। ভাইয়ের ছেলেদের আয়ে সংসার চলে তার। সংসার বলতে বস্তির ঐ ঘরটুকু। রাজিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে পনের বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামী-সংসার নিয়ে দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার সরবরাহ করেছিলেন তিনি। এ খবর পেয়ে যায় স্থানীয় রাজাকাররা। এ অপরাধে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণ করে তাকে। চিরজীবনের মতো ভেঙে যায় রাজিয়ার স্বপ্ন-সাধ। আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। চলে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন শুধু মরণের অপেক্ষা তার। তবে মৃত্যুর আগে একটি আকুতি- কিছুই চান না। শুধু বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান তিনি। এ স্বীকৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চান আমৃত্যু। রাজিয়া জানান, তার জন্ম কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার পীরকাশেমপুর গ্রামে। তখন (১৯৭১ সালে) বয়স মাত্র পনের। অভাবের সংসার তাই তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। তবে স্বামীর ভালবাসার সংসারে অভাব থাকলেও সুখ ছিল। রাজিয়া জানান, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কোন একদিন। হঠাৎ বাড়ির পাশে গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে প্রবেশ করে কয়েকজন পাকবাহিনীর সদস্য ও রাজাকার। তারা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে। রাজিয়ার স্বামী জামাল মিয়াকেও খোঁজে। না পেয়ে চলে যায়। একদিন পর আবার আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাওয়ানোর কারণে তাকে ধরে নিয়ে যায় তাদেরই একটি ঘরে। পাকবাহিনীর একজন অফিসার ধর্ষণ করে তাকে। ধর্ষণের পর মৃত মনে করে গ্রামেরই অচেনা, নির্জন এক স্থানে ফেলে দেয় রাজাকাররা। স্বামী জামাল মিয়া হতভম্ভ। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলছে কানাঘুষা। লোকলজ্জায় রাজিয়া ৩ মাসের ছেলে আনসারকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। রাজিয়া জানান, শাহবাগ এলাকায় কয়েকজন নারীর সঙ্গে তার দেখা হয়। ওরাই তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নেয়ার পর স্বামী তাকে খুঁজে পায় তেজগাঁও রেলস্টেশনে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। জামাল সবকিছু ভুলে প্রিয়তম স্ত্রীকে কাছে নিতে চায়। কিন্তু নিজেকে অপবিত্র মনে করে আর কোনদিন রাজিয়া স্বামীর সংসারে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১০ বছর আগে রাজিয়ার স্বামী জামাল মিয়া মারা যান।
নূরজাহান
একাত্তরে তার নাম ছিল মোহরজান বেগম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দ্বারা সম্ভ্রমহানি ঘটে তার। সবাই চিনে ফেলে তাকে। লজ্জা, ঘৃণায় নিজেকে ছোট মনে হয় তার। তাই চিন্তা করেন নাম পাল্টালে হয়তো এ সমস্যা থাকবে না। এরপরেই মোহরজান নাম পরিবর্তন করে তিনি নূরজাহান নাম ধারণ করেন। এরপরও রক্ষা হয়নি। যেখানেই গিয়েছেন অপমান লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে তাকে। গ্রামের বাড়িতে যান না বহুদিন। ৬১ বছরের নূরজাহান জানালেন একাত্তরে তার জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামঝি সময়ের ঘটনা। স্বামী লিলু মিয়ার সঙ্গে তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় থাকতেন অষ্টাদশী নূরজাহান। দু’জনই ছিলেন শ্রমজীবী। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকাবাসী মিলে তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় মাটি খুঁড়ে তৈরি করলেন একটি বাঙ্কার। একদিন পাকিস্তানি সেনারা গেরিলা বাহিনীর খোঁজে এ এলাকায় আক্রমণ চালায়। তাদের সহযোগী রাজাকাররা বাঙ্কারের খোঁজ পেয়ে যায়। শেষ রক্ষা হয়নি। বাঙ্কার থেকে রাজাকাররা তাদের বের করে আনে। এমন অন্তত ১০ জন নারীকে পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সদরঘাট এলাকায়। সেখান থেকে একটি লঞ্চে তোলা হয় তাদের। পাকবাহিনীর হাতে আটক নারীরা জানতে পারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদেরকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিৎকার চেঁচামিচির একপর্যায়ে লঞ্চের ভেতরেই নূরজাহানসহ অন্তত পাঁচজনকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকররা। পরে তাকে মুন্সীগঞ্জের একটি ঘাটে ফেলে রেখে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর একদল মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহানকে উদ্ধার করে ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে তার ঠাঁই হয়নি। গ্রামের বাড়িতে চলতে থাকে গুঞ্জন। চলে আসেন ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় এসে দেখতে পান তাদের ঘরবাড়ির কোন চিহ্নই আর নেই। স্বামী লিলু মিয়া ও সন্তানদের খুঁজতে চলে যান শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। সেখানে তাদের খুঁজে পেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। স্বামী লিলু মিয়াও নিয়তির ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নূরজাহানকে মেনে নেন। নূরজাহান জানান, স্বামী মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। তখন থেকেই তার অভাব শুরু। মা একাত্তরে নির্যাতনের শিকার- এ কারণে ছেলেরা তার খোঁজ রাখে না। তাই এই বয়সেও বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন তিনি।
No comments