পরিচালকদের বেনামি ঋণ ২৫০০ কোটি টাকা
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের
বেনামি ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারি হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
তদন্তে বেরিয়ে আসছে পরিচালকদের বেনামি ঋণের কাহিনী। ধরা পড়ার পর ওইসব ঋণকে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট পরিচালকের নামে দেখাতে বাধ্য করছে। গত কয়েক
বছরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের নামে বেনামি ঋণের
সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত পরিচালকদের এ ঋণের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি
টাকার বেশি হবে। এর বাইরে পরিচালকদের নামে আরও অনেক বেনামি ঋণ থাকার আশংকা
করা হচ্ছে, যেগুলো এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বতর্মানে প্রায় সব ব্যাংকই আইনের আওতায় চলে এসেছে। দু-একটি ব্যাংকে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তবে বেনামি ঋণের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়লে সেগুলোর দায় পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়। ফলে ব্যাংকে কোনো ঋণই বেনামি থাকছে না। এগুলো কারও না কারও নামে হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর দায় একপর্যায়ে পরিচালকদের ওপর চাপানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সময়ের তদন্তে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), সিটি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, শাহজালাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকে বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ওইসব ঋণের দায় সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ছয়টি ব্যাংকে পরিচালকদের প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২৫০, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১৫০, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২৩৫, শাহজালাল ব্যাংকে ৩১৫ ও এবি ব্যাংকে ৮৮ কোটি টাকা। এছাড়া এক্সিম ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৩০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ রয়েছে। যদিও এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঋণ থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এক্সিম ব্যাংকে কোনো বেনামি ঋণ নেই। যাদের ঋণ আছে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
এর আগে সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বা বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ৬০০ কোটি, উত্তরা ব্যাংকে ৩০০ কোটি, সিটি ব্যাংকে ২৫০ কোটি টাকার বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকার একটি ও চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্র“পের নামে ব্যাংকিং খাতে মোটা অংকের বেনামি ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে কিছু তথ্য উদ্ঘাটিত হলেও পরে আর এ বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত করা হয়নি। ফলে ওইসব বেনামি ঋণের বিষয়টি অনুৎঘাটিতই রয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাংকের পরিচালকদের নামে বেনামে ঋণ নেয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক মো. আবদুল হান্নান একজন ঋণ খেলাপি থাকা অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই তার বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ঘটনাটি ধরা পড়লে ওই ঋণকে পরিচালকের ঋণ হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণ বিতরণের আগে গ্রাহকের নামে কোনো খেলাপি ঋণ আছে কিনা যাচাই করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) হালনাগাদ তথ্য নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো ঋণ দেয়া যাবে না। কিন্তু এই বিধি ভঙ্গ করে পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে এককভাবে বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সিকদার পরিবারের হাতে। ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখা থেকে সিকদার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনালকে ১৩২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে গত বছরের ১৩ মে ওই শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। একই দিন ঋণের জন্য আবেদন করা হলে ওই দিনই তা পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। পরদিন ১৪ মে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি এই ঋণের অনুমোদন দেয়। প্রস্তাবটি পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ প্রতিষ্ঠানটি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজে নিবন্ধিত হয় ২১ মে। অর্থাৎ কোম্পানিটি নিবন্ধিত হওয়ার এক বছর ৭ দিন আগে এর নামে ওই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধন না থাকলে কোনো কোম্পানিকে বড় অংকের ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা পর্ষদের। নির্বাহী কমিটির ঋণ অনুমোদনের ব্যাপারে শুধু সুপারিশ করতে পারে। কোনো ঋণ অনুমোদন করতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলও সরেজমিন গিয়ে ওই নামে প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে রায়েরবাজার এলাকায় জমি কেনার নামে আরও ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নূর হোসেন ট্রেডার্সের ঋণ রয়েছে। যেগুলোকে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
এবি ব্যাংকের এলিফেন্ট রোড শাখা থেকে ব্যাংকিং বিধি বিধানের কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই বেসরকারি একটি ব্যাংকের বহুল আলোচিত একজন পরিচালকের প্রতিষ্ঠানের নামে ৮০ কোটি টাকা বেনামি ঋণ দেয়া হয়েছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ঘটনা ধরা পড়লে ঋণের দায়িত্ব ওই পরিচালকের মালিকানাধীন গ্র“পটি নিয়েছে।
পরিচালকদের বেনামি ঋণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কেউ অপরাধ করলে অব্যশই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। অপরাধীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে সবার ক্ষেত্রে সমান আচরণ করা উচিত।
ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা শক্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। আরও আগে থেকে এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল।
সূত্র জানায়, ইউসিবি থেকে ইউনিটেক্স নামের একটি কোম্পানিকে দেয়া ৬০ কোটি টাকা ঋণের কোনো গতি হয়নি। যদিও এই বেনামি কোম্পানিকে পরিচালকদের ঋণ হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইউসিবির সাবেক পরিচালক আক্তারুজ্জামান চৌধুরীর নামে ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ বোনামি শনাক্ত করা হয়েছিল। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে তাদের ব্যাংকে কিছু ঝামেলা ছিল- বর্তমানে তা নেই।
শাহজালাল ব্যাংকের পুরনো ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি শাখায় পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে। যেগুলোকে আগে বেনামি ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। পরে এগুলোর দায় পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী নুরুন্নবীর নামে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় ২০০৬ সালে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু ওই ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী নুরুন্নবী নয়। চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্র“প ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ওই ঋণের সুবিধা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এটি ছিল ওই পরিচালকের বেনামি ঋণ। এটি প্রমাণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যথেষ্ট তথ্য আসার পর ২০০৮ সালে একটি পরিদর্শক দল চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা গিয়ে তদন্ত শুরু করার পরের দিনই পরিদর্শক দলকে চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ওই বেনামি ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী এখনও আড়ালেই রয়ে গেছেন।
২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ওই ব্যাংকেরই তৎকালীন মালিকপক্ষ ওরিয়ন গ্রুপ। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে পরিচালকদের ঋণ হিসেবে শনাক্ত করে তাদের সমুদয় শেয়ার বাজেয়াপ্ত করেছিল।
সূত্র জানায়, পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মধ্যে এর আওতায় এসেছে যেসব কোম্পানিতে পরিচালকের বা তার ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ২০ শতাংশের শেয়ার রয়েছে। কিন্তু এই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পরিচালকরা ২০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকছেন। ফলে এই ধরনের ঋণগুলোকে আর পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসেবে শনাক্ত করতে পারছে না। তারপরেও ঋণের সুবিধাভোগীর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওইসব ঋণকে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের বেনামি ঋণ হিসাবে শনাক্ত করছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, একই পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাইকে বুঝাবে। পরিচালকদের এসব আত্মীয়স্বজনের বা ব্যক্তির নামে ঋণকে সরাসরি পরিচালকদের ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে। এর আওতা থেকে বের হওয়ার জন্য অনেক পরিচালক তাদের কর্মচারী বা গাড়ি চালকের নামে ঋণ নিচ্ছে। শনাক্ত হলে এসব ঋণকে বেনামি ঋণ হিসেবে শনাক্ত করে এর দায় পরিচালকের কাঁধে চাপানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বতর্মানে প্রায় সব ব্যাংকই আইনের আওতায় চলে এসেছে। দু-একটি ব্যাংকে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তবে বেনামি ঋণের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়লে সেগুলোর দায় পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়। ফলে ব্যাংকে কোনো ঋণই বেনামি থাকছে না। এগুলো কারও না কারও নামে হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর দায় একপর্যায়ে পরিচালকদের ওপর চাপানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সময়ের তদন্তে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), সিটি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, শাহজালাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকে বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ওইসব ঋণের দায় সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ছয়টি ব্যাংকে পরিচালকদের প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২৫০, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১৫০, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২৩৫, শাহজালাল ব্যাংকে ৩১৫ ও এবি ব্যাংকে ৮৮ কোটি টাকা। এছাড়া এক্সিম ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৩০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ রয়েছে। যদিও এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঋণ থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এক্সিম ব্যাংকে কোনো বেনামি ঋণ নেই। যাদের ঋণ আছে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
এর আগে সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বা বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ৬০০ কোটি, উত্তরা ব্যাংকে ৩০০ কোটি, সিটি ব্যাংকে ২৫০ কোটি টাকার বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকার একটি ও চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্র“পের নামে ব্যাংকিং খাতে মোটা অংকের বেনামি ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে কিছু তথ্য উদ্ঘাটিত হলেও পরে আর এ বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত করা হয়নি। ফলে ওইসব বেনামি ঋণের বিষয়টি অনুৎঘাটিতই রয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাংকের পরিচালকদের নামে বেনামে ঋণ নেয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক মো. আবদুল হান্নান একজন ঋণ খেলাপি থাকা অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই তার বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ঘটনাটি ধরা পড়লে ওই ঋণকে পরিচালকের ঋণ হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণ বিতরণের আগে গ্রাহকের নামে কোনো খেলাপি ঋণ আছে কিনা যাচাই করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) হালনাগাদ তথ্য নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো ঋণ দেয়া যাবে না। কিন্তু এই বিধি ভঙ্গ করে পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে এককভাবে বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সিকদার পরিবারের হাতে। ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখা থেকে সিকদার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনালকে ১৩২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে গত বছরের ১৩ মে ওই শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। একই দিন ঋণের জন্য আবেদন করা হলে ওই দিনই তা পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। পরদিন ১৪ মে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি এই ঋণের অনুমোদন দেয়। প্রস্তাবটি পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ প্রতিষ্ঠানটি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজে নিবন্ধিত হয় ২১ মে। অর্থাৎ কোম্পানিটি নিবন্ধিত হওয়ার এক বছর ৭ দিন আগে এর নামে ওই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধন না থাকলে কোনো কোম্পানিকে বড় অংকের ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা পর্ষদের। নির্বাহী কমিটির ঋণ অনুমোদনের ব্যাপারে শুধু সুপারিশ করতে পারে। কোনো ঋণ অনুমোদন করতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলও সরেজমিন গিয়ে ওই নামে প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে রায়েরবাজার এলাকায় জমি কেনার নামে আরও ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নূর হোসেন ট্রেডার্সের ঋণ রয়েছে। যেগুলোকে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
এবি ব্যাংকের এলিফেন্ট রোড শাখা থেকে ব্যাংকিং বিধি বিধানের কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই বেসরকারি একটি ব্যাংকের বহুল আলোচিত একজন পরিচালকের প্রতিষ্ঠানের নামে ৮০ কোটি টাকা বেনামি ঋণ দেয়া হয়েছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ঘটনা ধরা পড়লে ঋণের দায়িত্ব ওই পরিচালকের মালিকানাধীন গ্র“পটি নিয়েছে।
পরিচালকদের বেনামি ঋণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কেউ অপরাধ করলে অব্যশই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। অপরাধীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে সবার ক্ষেত্রে সমান আচরণ করা উচিত।
ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা শক্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। আরও আগে থেকে এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল।
সূত্র জানায়, ইউসিবি থেকে ইউনিটেক্স নামের একটি কোম্পানিকে দেয়া ৬০ কোটি টাকা ঋণের কোনো গতি হয়নি। যদিও এই বেনামি কোম্পানিকে পরিচালকদের ঋণ হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইউসিবির সাবেক পরিচালক আক্তারুজ্জামান চৌধুরীর নামে ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ বোনামি শনাক্ত করা হয়েছিল। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে তাদের ব্যাংকে কিছু ঝামেলা ছিল- বর্তমানে তা নেই।
শাহজালাল ব্যাংকের পুরনো ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি শাখায় পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে। যেগুলোকে আগে বেনামি ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। পরে এগুলোর দায় পরিচালকদের ওপর চাপানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী নুরুন্নবীর নামে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় ২০০৬ সালে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু ওই ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী নুরুন্নবী নয়। চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্র“প ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ওই ঋণের সুবিধা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এটি ছিল ওই পরিচালকের বেনামি ঋণ। এটি প্রমাণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যথেষ্ট তথ্য আসার পর ২০০৮ সালে একটি পরিদর্শক দল চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা গিয়ে তদন্ত শুরু করার পরের দিনই পরিদর্শক দলকে চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ওই বেনামি ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী এখনও আড়ালেই রয়ে গেছেন।
২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ওই ব্যাংকেরই তৎকালীন মালিকপক্ষ ওরিয়ন গ্রুপ। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে পরিচালকদের ঋণ হিসেবে শনাক্ত করে তাদের সমুদয় শেয়ার বাজেয়াপ্ত করেছিল।
সূত্র জানায়, পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মধ্যে এর আওতায় এসেছে যেসব কোম্পানিতে পরিচালকের বা তার ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ২০ শতাংশের শেয়ার রয়েছে। কিন্তু এই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পরিচালকরা ২০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকছেন। ফলে এই ধরনের ঋণগুলোকে আর পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসেবে শনাক্ত করতে পারছে না। তারপরেও ঋণের সুবিধাভোগীর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওইসব ঋণকে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের বেনামি ঋণ হিসাবে শনাক্ত করছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, একই পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাইকে বুঝাবে। পরিচালকদের এসব আত্মীয়স্বজনের বা ব্যক্তির নামে ঋণকে সরাসরি পরিচালকদের ঋণ হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে। এর আওতা থেকে বের হওয়ার জন্য অনেক পরিচালক তাদের কর্মচারী বা গাড়ি চালকের নামে ঋণ নিচ্ছে। শনাক্ত হলে এসব ঋণকে বেনামি ঋণ হিসেবে শনাক্ত করে এর দায় পরিচালকের কাঁধে চাপানো হচ্ছে।
No comments