শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা চূড়ান্ত হল না আজও
বিজয়ের পর ৪৩ বছর চলে গেলেও অদ্যাবধি
চূড়ান্ত হয়নি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। এ
পর্যন্ত সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে পাঁচটি তালিকা। আবার এ মুহূর্তে চলছে আরও
একটি তালিকা প্রণয়নের কাজ। ‘নির্ভুলভাবে তালিকা হয়নি’- এমন অজুহাতে
প্রতিবারই নতুন করে তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ষষ্ঠবারের
মাথায় এসেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্ভুল করতেই নতুন করে তালিকা তৈরি হচ্ছে-
মন্তব্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যখনই নতুন তালিকা করা হয়েছে, তখনই দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। আর আগের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাম। এসব তালিকায় সর্বনিু মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন, সর্বোচ্চ দুই লাখেরও বেশি। আর ষষ্ঠ তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এজন্য সরকারের কাছে সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে এক লাখ ৩৩ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেছেন। জামুকায় অনলাইন বা সরাসরি আবেদন জমা দিয়েছেন তারা। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করতে দেশের প্রতি উপজেলায় জানুয়ারি মাসেই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা। মূলত রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বছরের পর বছর টালবাহানা চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ষষ্ঠ তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আকম মোজাম্মেল হক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আবেদন যাচাই-বাছাই করতে শিগগিরই উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। জানুয়ারিতে কমিটি কাজ শুরু করলে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই শেষ হবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে গেজেট জারি করবে মন্ত্রণালয়।
তিনি জানান, বর্তমানে গেজেটভুক্ত দুই লাখ ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এদের মধ্যে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন এক লাখ ৯২ হাজারের কিছু বেশি। বাকিদের নানা জটিলতা রয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি তালিকা রয়েছে। তারপরও কেন নতুন তালিকা করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ওইসব তালিকায় ভুয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে আপনারাই পত্রপত্রিকায় লেখেন। যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেই প্রায় সবাই এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ যে, নতুন তালিকা না করে উপায় নেই। এ কারণেই মূলত নতুনভাবে যাচাই-বাছাই কমিটি করে তালিকা করা হচ্ছে।
নতুন এক লাখ ৩৩ হাজার আবেদনের প্রসঙ্গে আকম মোজাম্মেল হক বলেন, এদের বেশির ভাগই নতুন। তবে কিছু পুরাতন মুক্তিযোদ্ধাও থাকতে পারে। আগের গেজেটে ভুল থাকার কারণেও অনেকে আবেদন করেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মধ্যে রয়েছে- মুক্তিবার্তা লালবইয়ে এক লাখ ৫৪ হাজার, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ৪৪ হাজার এবং মহাজোট সরকারের সময় ১১ হাজার। এর মধ্যে নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন হাজার নামের গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয়েছে। আর প্রায় ৬০ হাজারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। যাচাই-বাছাই কমিটি মূলত জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার, অভিযুক্ত ৬০ হাজার এবং নতুনভাবে আবেদনকৃত এক লাখ ৩৩ হাজার আবেদনের ওপর কাজ করবে। এছাড়াও মুক্তিবার্তা লালবইয়ের তালিকায় থাকা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এই কমিটি।
একাধিক তালিকার কারণেই কি অমুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি মন্ত্রী। যারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং পরে ধরা পড়েছেন এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলেও মন্ত্রী ছিলেন নীরব। তবে তিনি বলেন, ভারতীয় তালিকায় এবং মুক্তিবার্তা লালবইয়ে যাদের নাম রয়েছে তাদেরই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করার নির্দেশনা দেয়া হবে যাচাই-বাছাই কমিটিকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এক্ষেত্রে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধার হদিস পাওয়া যায়নি। এটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত রয়েছে। যেটি ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত।
এর আগে ১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ওই তালিকায় ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকা নামে প্রকাশ করা হয়। যার সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। তবে এ তালিকা গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও ভোটার-সূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার।
আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় এক লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজি মমিনউল্লাহ পাটোয়ারির নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদেও নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন লালবই নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে সময়ে আগের নীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। তাদের সুপারিশের ব্যক্তিরাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যান। এভাবে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট; যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার জনে। অর্থাৎ জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার, যা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভুয়া বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে বিএনপির নীতিমালা মেনে ১১ হাজার ৫০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৯ হাজার ৫০০ জনে দাঁড়িয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. ক. (অব.) মো. আবু ওসমান চৌধুরী রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, আমার মতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। তবে যারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা তাদের তালিকা করলে কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কারণ গুটিকয়েক রাজাকার-আলবদর ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। যারা তালিকা তৈরি করেছে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সাবেক মহাসচিব লে. জে. (অব.) হারুন অর রশীদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা যায়নি রাজনৈতিক কারণে। কারণ যারাই তালিকা করেছেন তারাই কোনো এজেন্ডা নিয়ে করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য মোটেও সৎ ছিল না। বর্তমানেও যারা তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে তাদের যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে তাহলে ফলাফল আগের মতোই হবে।
জামুকা সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ সাড়ে ৯ হাজার। গেজেটের বাইরে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয় জামুকা। অনলাইন ও সরাসরি আবেদন জমা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারা দেশের এক লাখ ৩৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনলাইনে এক লাখ ২৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়েছে। বাকি ১০ হাজার আবেদন হার্ডকপি (কাগুজে আবেদন) জমা পড়েছে সরাসরি। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জানতে চাইলে জামুকার মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব শ্যামাপদ দে রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমরা মুক্তিবার্তা লালবই, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত ভারতীয় তালিকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ দেখে তালিকা চূড়ান্ত করব। যারা এসব ক্যাটাগরির ভেতর না পড়বে তাদের গেজেট ও সনদ বাতিল করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যখনই নতুন তালিকা করা হয়েছে, তখনই দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। আর আগের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাম। এসব তালিকায় সর্বনিু মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন, সর্বোচ্চ দুই লাখেরও বেশি। আর ষষ্ঠ তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এজন্য সরকারের কাছে সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে এক লাখ ৩৩ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেছেন। জামুকায় অনলাইন বা সরাসরি আবেদন জমা দিয়েছেন তারা। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করতে দেশের প্রতি উপজেলায় জানুয়ারি মাসেই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা। মূলত রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বছরের পর বছর টালবাহানা চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ষষ্ঠ তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আকম মোজাম্মেল হক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আবেদন যাচাই-বাছাই করতে শিগগিরই উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। জানুয়ারিতে কমিটি কাজ শুরু করলে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই শেষ হবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে গেজেট জারি করবে মন্ত্রণালয়।
তিনি জানান, বর্তমানে গেজেটভুক্ত দুই লাখ ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এদের মধ্যে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন এক লাখ ৯২ হাজারের কিছু বেশি। বাকিদের নানা জটিলতা রয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি তালিকা রয়েছে। তারপরও কেন নতুন তালিকা করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ওইসব তালিকায় ভুয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে আপনারাই পত্রপত্রিকায় লেখেন। যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেই প্রায় সবাই এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ যে, নতুন তালিকা না করে উপায় নেই। এ কারণেই মূলত নতুনভাবে যাচাই-বাছাই কমিটি করে তালিকা করা হচ্ছে।
নতুন এক লাখ ৩৩ হাজার আবেদনের প্রসঙ্গে আকম মোজাম্মেল হক বলেন, এদের বেশির ভাগই নতুন। তবে কিছু পুরাতন মুক্তিযোদ্ধাও থাকতে পারে। আগের গেজেটে ভুল থাকার কারণেও অনেকে আবেদন করেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মধ্যে রয়েছে- মুক্তিবার্তা লালবইয়ে এক লাখ ৫৪ হাজার, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ৪৪ হাজার এবং মহাজোট সরকারের সময় ১১ হাজার। এর মধ্যে নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন হাজার নামের গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয়েছে। আর প্রায় ৬০ হাজারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। যাচাই-বাছাই কমিটি মূলত জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার, অভিযুক্ত ৬০ হাজার এবং নতুনভাবে আবেদনকৃত এক লাখ ৩৩ হাজার আবেদনের ওপর কাজ করবে। এছাড়াও মুক্তিবার্তা লালবইয়ের তালিকায় থাকা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এই কমিটি।
একাধিক তালিকার কারণেই কি অমুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি মন্ত্রী। যারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং পরে ধরা পড়েছেন এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলেও মন্ত্রী ছিলেন নীরব। তবে তিনি বলেন, ভারতীয় তালিকায় এবং মুক্তিবার্তা লালবইয়ে যাদের নাম রয়েছে তাদেরই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করার নির্দেশনা দেয়া হবে যাচাই-বাছাই কমিটিকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এক্ষেত্রে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধার হদিস পাওয়া যায়নি। এটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত রয়েছে। যেটি ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত।
এর আগে ১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ওই তালিকায় ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকা নামে প্রকাশ করা হয়। যার সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। তবে এ তালিকা গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও ভোটার-সূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার।
আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় এক লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজি মমিনউল্লাহ পাটোয়ারির নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদেও নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন লালবই নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে সময়ে আগের নীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। তাদের সুপারিশের ব্যক্তিরাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যান। এভাবে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট; যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার জনে। অর্থাৎ জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার, যা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভুয়া বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে বিএনপির নীতিমালা মেনে ১১ হাজার ৫০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৯ হাজার ৫০০ জনে দাঁড়িয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. ক. (অব.) মো. আবু ওসমান চৌধুরী রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, আমার মতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। তবে যারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা তাদের তালিকা করলে কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কারণ গুটিকয়েক রাজাকার-আলবদর ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। যারা তালিকা তৈরি করেছে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সাবেক মহাসচিব লে. জে. (অব.) হারুন অর রশীদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা যায়নি রাজনৈতিক কারণে। কারণ যারাই তালিকা করেছেন তারাই কোনো এজেন্ডা নিয়ে করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য মোটেও সৎ ছিল না। বর্তমানেও যারা তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে তাদের যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে তাহলে ফলাফল আগের মতোই হবে।
জামুকা সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ সাড়ে ৯ হাজার। গেজেটের বাইরে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয় জামুকা। অনলাইন ও সরাসরি আবেদন জমা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারা দেশের এক লাখ ৩৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনলাইনে এক লাখ ২৩ হাজার ১৭০টি আবেদন জমা পড়েছে। বাকি ১০ হাজার আবেদন হার্ডকপি (কাগুজে আবেদন) জমা পড়েছে সরাসরি। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জানতে চাইলে জামুকার মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব শ্যামাপদ দে রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমরা মুক্তিবার্তা লালবই, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত ভারতীয় তালিকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ দেখে তালিকা চূড়ান্ত করব। যারা এসব ক্যাটাগরির ভেতর না পড়বে তাদের গেজেট ও সনদ বাতিল করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
No comments