উদ্ধার অভিযান নানা প্রশ্ন by নুরুজ্জামান লাবু, রোকনুজ্জামান পিয়াস, উৎপল রায় ও আল আমিন
শ্বাসরুদ্ধকর
অভিযান। দেশ জুড়ে উৎকণ্ঠা। কৌতূহলী মানুষের ভিড়। একের পর এক পদ্ধতি প্রয়োগ
করে শিশু জিহাদকে উদ্ধারে তৎপর উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে
পারেনি উদ্ধারকারীরা। ক্যামেরা দিয়ে দেখার চেষ্টাও চলেছে পাইপের ভেতরের
অবস্থা। দীর্ঘ প্রায় ২৩ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানের ইতি টেনে যখন হাল ছেড়ে
দেয় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান। তখন সবাইকে অবাক করে রাষ্ট্রীয় সামর্থ্যকে
তুচ্ছ করে ত্রাতা হয়ে ওঠেন স্থানীয় উদ্ধারকারীরা। সরকারি সংস্থার সব
কর্মীদের বোকা বানিয়ে তারাই হয়ে ওঠেন জিহাদ উদ্ধার অভিযানের নায়ক। এ অভিযান
ঘিরে আগের দিন বাতাসে ছড়ায় নানা প্রশ্ন। খোদ সরকারি সংস্থার
কর্তাব্যক্তিরাই ঘটনাস্থলে প্রশ্ন তুলেছিলেন পাইপে জিহাদের পড়ে যাওয়া নিয়ে।
গতকাল সকাল থেকে এসব প্রশ্ন আরও ডালপালা মেলে। দুপুরের পর যখন জিহাদের
নিথর দেহ পাইপ থেকেই উদ্ধার হয় তখন উদ্ধার অভিযান ঘিরে থাকা নানা প্রশ্ন আর
জিজ্ঞাসা রূপ নেয় বিক্ষোভে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সরকারি সংস্থাগুলোর
দায়িত্বপ্রাপ্তদের পদত্যাগ ও শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন।
সন্তানকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে থাকা পরিবারেও তখন শোকের মাতম।
দিনভর পুলিশের হেফাজতে থাকা পরিবারের সদস্যরা যখন বাসায় ফেরেন তখন তাদের
কান্নার সঙ্গে ক্ষোভের আওয়াজ। জিহাদের পিতা নাসির ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, রাতে
তার ছেলেকে উদ্ধার করলে হয়তো জীবিতই পাওয়া যেতো তাকে। আর রাষ্ট্রীয়
সংস্থার গাফিলতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
শুক্রবার রাতভর অভিযান চালিয়ে ভোররাতে যখন উদ্ধারকর্মীরা জানায়, পাইপে কোন
মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি তখন চারপাশে গুজব ছড়ায় পাইপের গভীরে শিশুটির
পড়ে যাওয়া পুরোটাই ‘নাটক’। সন্দেহ শুরু হয় আসলেই পাইপের ভেতরে শিশুটি আদৌ
আছে কিনা। রাতেই শিশু জিহাদের পিতা ও দুই প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞাসাবাদের
জন্য নিয়ে যায় পুলিশ। রাত পেরিয়ে দিন শুরু হলে গুজব আরও বাড়তে থাকে। দুপুরে
উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। বেলা তখন
আড়াইটা। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সাড়ে ২৩ ঘণ্টা। এর কিছুক্ষণ পরই
স্থানীয়দের প্রয়োগ করা পদ্ধতির মাধ্যমে উঠে আসে শিশু জিহাদের লাশ। ভেজা
শরীর। মাথা ও মুখম-লে বালু আর সুতো জড়ানো। পরনে সেই হলুদ জামা।
উদ্ধারকর্মীরা তাকে নিয়ে ছুটছে বাইরে। একটি গাড়িতে তুলে শিশুটিকে নেয়া হয়
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত
ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে শিশুটি। শুক্রবার
বিকাল ৩টার দিকে খেলতে গিয়ে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর
নলকূপের পাইপের ভেতরে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। প্রথমে জিহাদের খেলার
সঙ্গী সিয়াম বিষয়টি অন্যদের জানায়। ওই কূপের পাশেই ব্যাডমিন্টন খেলছিল
ফাতেমা নামে এক কিশোরী। উড়ে যাওয়া কর্ক আনতে গিয়ে সে-ও শুনতে পায় পাইপের
ভেতর থেকে আসছে কান্নার শব্দ। বিষয়টি সে-ও স্থানীয় সবাইকে জানায়। স্থানীয়রা
প্রথমে লম্বা দড়ি ফেলে তুলে আনার চেষ্টা করে শিশু জিহাদকে। খবর পেয়ে ছুটে
যায় ফায়ার সার্ভিসের একাধিক দল। শুরু হয় উদ্ধার অভিযান।
ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযানের প্রথমে দড়ির সঙ্গে বস্তা বেঁধে নিচে নামিয়ে দেন। তারপর ফেলা হয় টর্চ লাইট। কেউ কেউ বলতে থাকেন ভেতর থেকে জিহাদের কান্নার শব্দ এসেছে। পাইপের ভেতরে দড়ি দিয়ে পাঠানো হয় জুস। দেয়া হয় অক্সিজেন। পাঠানো হয় একাধিক ক্যামেরা। ১৭ থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের ভেতরে ছিল আরেকটি সরু পাইপ। রাতেই ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা শুরু হয় ওই পাইপ। প্রায় ৩০ ফুট করে তোলার পর কেটে ফেলা হচ্ছিল সেটি। এক পর্যায়ে পুরোটাই তুলে ফেলা হয়। এর শেষ অংশে ছিল ফিল্টার এবং সাবমার্সিবল পাম্প। এরপর সেখানে নামানো হয় ওয়াসার বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা। মাটির নিচের ছবি তোলার জন্য কেনা এই ক্যামেরা ব্যবহার উপযোগী করতে সময় লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। এটি যখন সচল হয় তখন ওয়াসার কর্মকর্তা এবং উপস্থিত উদ্ধারকর্মীরাই পর্যালোচনা করছিলেন ভেতরের ছবি। সেই ক্যামেরাতেও জিহাদের ছবি ধরা পড়েনি। দেখা যায় ব্যাঙ ও কিছু আবর্জনার ছবি। রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। উদ্ধার তৎপরতা তদারক করতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ। যান বিএনপির ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মির্জা আব্বাস। কিন্তু রাতভর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় উদ্ধার অভিযান। ভোররাতে হতাশার কথা শুনিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। চলে যান দায়িত্বরত অন্য সংস্থার ঊর্ধ্বতনরাও। সকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও সন্দেহ করতে থাকেন পুরো বিষয়টি ‘নাটক’। কেউ বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এই ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, বিরোধী জোটের একটি কর্মসূচি ঘিরে আলোচনা ভিন্ন খাতে নিতে এটি সরকারেরই নাটক। দিনের বেলা অনেকটা ঢিলেঢালা উদ্ধার অভিযান চলতে থাকে। দুপুর আড়াইটার দিকে উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণা করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান। তিনি এসময় বলেন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, রেলওয়ের এক্সপার্টরা ওই কূপে কোন শিশুর অস্তিত্ব ও প্রাণের স্পন্দন পায়নি। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হলো। এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা ওই পাইপটি পুরোটি উঠিয়ে দেখবেন যে, কোন শিশুর লাশ আছে কিনা। তিনি বলেন, স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় যে, ওই পাইপের ব্যাসার্ধ ১৮ ইঞ্চি। গভীরতা হচ্ছে ৪০০ ফুট। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা। বশির নামে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী পাইপের ভেতরে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কূপের ব্যাস অনেক সংকীর্ণ এবং গভীরতা অনেক, তাই সেখানে উদ্ধারকারী প্রবেশ করা অসম্ভব বলে তাকে নামতে দেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, বড় পাইপটির ভেতরে একটি সরু পাইপ ছিল। সেটি তুলে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাইপের সঙ্গে পাম্পমেশিন সংযুক্ত ছিল। পাইপটি তুলে আনার সময় শিশুটি উঠে আসতে পারে ধারণা করা হয়। কিন্তু পাইপটি সম্পূর্ণ ওঠার পরেও ওই শিশুটি উপরে উঠে আসতে পারেনি।
আলী আহমদ খান বলেন, সর্বশেষ ওই কূপে একটি ক্যামেরা নামানো হয়। কিন্তু ওই ক্যামেরায় একটি সাদা পলিথিন, কাদামাটি ও পোকামাকড় দেখা যায়। দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের অভিযানে ওই পাইপের ভেতরে কোন ভিকটিমের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ জন্য ওই অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুটি কূপের মধ্যে জুস খেয়েছে বা ডাকাডাকি করেছিল, উদ্ধারকাজের প্রথম দিকে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের এমন দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভিকটিমের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় তথ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যেহেতু ভিকটিমের পরিবার আমাদেরকে বলেছিল যে, শিশুটি নিচে পড়ে গেছে এ জন্য তাদের কথা আমরা বিশ্বাস করি এবং আমরা ভেতর থেকে কিছু প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এছাড়াও আমাদের আশা ছিল যে, শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করার। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন। কূপে যে ক্যামেরা নিচে নামানো হয়েছিল ওই ক্যামেরা কত ফুট নিচে গিয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২৮০ ফুট নিচে গিয়েছিল। ওই ক্যামেরায়ও শিশুটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এর আগে সকাল দশটায় ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি মোহাম্মদ হালিমও একই কথা বলেন সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, ভেতরে কোন ভিকটিম নেই। অভিযান শেষ পর্যায়ে। এখন আমাদের আর কোন কাজ নেই। দেশীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় মানুষ যে চেষ্টা করছে, আমরা তাতে সহায়তা করছি। ঘটনাস্থলে থাকা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভোরে সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারকর্মী দলের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে যে, পাইপের ভেতরে শিশুটি নেই। তারপরও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। পরে অবশ্য গতকাল বিকালে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শাজাহানপুরে পাইপের ভিতর থেকে শিশু জিহাদকে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। উদ্ধার অভিযান চলমান ছিল। যখন উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল ঠিক সেই মুহূর্তে জিহাদকে উদ্ধার করা হয়। পাইপের ভিতরে আবর্জনা সরিয়ে নিচ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, পাইপের ভেতরে শিশু নাই এটি বলা হয়নি। আপনারা ভুল শুনেছেন। আমরা বলেছিলাম অত্যাধুনিক ক্যামেরা দিয়ে আমরা শিশুটিকে দেখতে পাই নি। অভিযান অব্যাহত ছিল। এর কারণেই শিশুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
যেভাবে উদ্ধার হয় শিশুটির লাশ: ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণার ১০ মিনিটের মাথায় উঠে আসে শিশু জিহাদের লাশ। শফিকুল ইসলাম ফারুক, শাহ আব্দুল্লাহ আল মুন, রাহুল, আব্দুল মজিদসহ ৬-৭ জন সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় পাইপের তল থেকে অক্ষত অবস্থায় তোলা হয় জিহাদের নিথর দেহ। শফিকুল ইসলাম ফারুক জানান, সকালে তারা কয়েকজন মিলে পাশের কনস্ট্রাকশনের কাজ হওয়া স্থান থেকে লোহার রড সংগ্রহ করেন। পরে তারা পাইপের ব্যাসার্ধের চেয়ে একটু ছোট একটি ‘ক্যাচার’ তৈরি করেন। তিন পাশে তিনটি রড দিয়ে গোলাকার একটি ক্যাচার তৈরি করা হয়। মাঝখানে বসানো হয় একটি সিসি ক্যামেরা। সঙ্গে বাঁধা হয় একটি টর্চ লাইট। ক্যাচারের নিচের দিকে তিনটি লক লাগানো হয়। লকগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ক্যাচারের ভেতরে কিছু ঢোকার সময় লকগুলো খুলে যাবে, কিন্তু বের হবে না। দুপুর দু’টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা থামিয়ে দিলে তারা নিজেরা ওই ক্যাচার পাইপের ভেতরে নামান। দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় ক্যাচারের মাথার অংশে। সেই দড়ি ক্রেনের হুকের সঙ্গে আটকিয়ে ক্যাচারটি নিচে নামানো হয়। পাইপের ভেতরে পানির স্তরের উপরাংশে কিছু ময়লা-আবর্জনা ছিল। সেগুলো ভেদ করে আরও নিচে ঢুকে যায় ক্যাচার। এক পর্যায়ে বোঝা যায় ক্যাচারের ভেতরে কিছু একটা ঢুকেছে। এরপর তারা দড়ি আবার টানতে থাকেন। তাদের সহায়তা করেন ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মীও। ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসতে থাকে ক্যাচারটি। বেলা ২টা ৫৮ মিনিটে ক্যাচারটি পাইপের বাইরে আনা হয়। ভেতর থেকে বের করা হয় জিহাদের নিথর দেহ। তার হলুদ শার্ট তখন গলায় জড়ানো ছিল। পরনে ছিল হলুদ প্যান্ট। সারা শরীর পানিতে ভিজে কিছুটা সাদা রঙ ধারণা করেছে। দ্রুত জিহাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শাহজাহান পুরের মাঠে। সেখানে একটি ইসলামী জলসার জন্য প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরি ছিল। প্রথমে ওই প্যান্ডেলে নেয়া হয় শিশুটির লাশ। পরে দ্রুত সেখান থেকে একটি গাড়িতে তোলা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে।
ঢাকা মেডিক্যালে জিহাদের নিথর দেহ: বিকাল সাড়ে ৩টায় শিশুটির লাশ ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে প্রায় ২০ মিনিট ধরে পরীক্ষা করেন চিকিৎসকরা। এর আগে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতে করে শিশু জিহাদের নিথর দেহ ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এসময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে শ’ শ’ উৎসুক জনতা ভিড় করেন। জিহাদ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা জানতে চান। তিনটা ৫০ মিনিটে জরুরি বিভাগের দরজার সামনে থেকে একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, শিশু জিহাদ আর বেঁচে নেই। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে জিহাদের মৃত্যুর বিষয়টি উপস্থিত সংবাদকর্মীদের নিশ্চিত করেন জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন (ক্যাজুয়ালিটি) ডা. কে এম রিয়াজ মোর্শেদ। তিনি বলেন, জিহাদ আর বেঁচে নেই। হাসপাতালের আনার কয়েক ঘণ্টা আগেই সে মারা গেছে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। তবে কতক্ষণ আগে জিহাদ মারা গেছে সে বিষয়টি ময়না তদন্ত রিপোর্টে জানা যাবে বলে তিনি জানান। কি কারণে জিহাদ মারা গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ময়না তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এর সঠিক কোন কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে অনেক কারণের মধ্যে ঠা-ার কারণ একটি। এছাড়া অক্সিজেনের অভাব, প্রচ- ভয়ও কারণ হিসেবে কাজ করেছে। জিহাদের মৃত্যু সংবাদটি মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।
এরই মধ্যে জিহাদের পিতা নাসিরউদ্দিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সম্মুখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার বাবুরে আইন্না দেও, আমার জিহাদরে বাঁচাও, তারে আইন্না দেও।’ এরই মধ্যে জিহাদের লাশ দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের মর্গে। পরে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ময়না তদন্তের আগে পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট হবে। এরপরই লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হবে। তবে আজকে (গতকাল) তা সম্ভব না-ও হতে পারে। এদিকে ময়না তদন্তের বিষয়ে ঢামেকের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মোজাম্মেল হক বলেন, সংগত কারণে আজ (গতকাল) জিহাদের লাশের ময়না তদন্ত হবে না। আগামীকাল সকালে তা হতে পারে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, জিহাদের হাত, পা, উরু, পিঠ ও মাথার সামনের দিকে ডানপাশে ছিলে যাওয়ার দাগ রয়েছে। এছাড়া তার শরীরে বড় ধরনের কোন ক্ষতের দেখা মেলেনি।
জিহাদের পিতাকে ১২ ঘণ্টা আটকে রাখে পুলিশ: এদিকে পাইপের ভেতর শিশু পড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্রেফ গুজব বলে চারদিকে খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর তৎপরতা শুরু করে পুলিশ। শাহজাহানপুর থানা পুলিশ গতকাল ভোর তিনটার দিকে জিহাদের পিতা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈশপ্রহরী নাসিরউদ্দিনকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তাকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। থানায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিশু সিয়াম ও আরিফ নামে অপর একজনকে। থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রাহেলা নামে এক গৃহবধূকেও। গতকাল দুপুরে ৩টার দিকে জিহাদের লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। এ সময় তাদের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে পুলিশ। ঘটনাটি ‘নাটক’ বলে তাকে তিরস্কারও করা হয়। তবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই জিহাদের বাবাকে তারা নিজেদের হেফাজতে রেখেছিলেন। শাজাহানপুর থানার ওসি শেখ মেহেদী হাসান দাবি করেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর শিশুটির বাবা নাসিরকে সকালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের বিক্ষোভ-ভাঙচুর: রাজধানীর শাহজাহানপুরের পূর্ব কলোনিতে গভীর নলকূপের পাইপের ভেতর পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদের লাশ উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং ভাঙচুর করেছেন। তারা কূপের পাশে রেলওয়ের জমিতে তৈরি করা পাঁচটি ছোট-বড় টিনের ঘর ভাঙচুর করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক, ওয়াসার ও রেলওয়ের প্রধানসহ সবার পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাদের বিক্ষোভে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের বিক্ষোভে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত সতর্ক ছিল।
ওই কূপের পেছনের পাঁচতলা বাড়ির বাসিন্দা রেলওয়ে কর্মচারী লিটন হোসেন জানান, ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন একটি নাটক সৃষ্টি করেছেন। তারা একেক সময় একেক রকম কথা বলেছেন। কখনো বলেছেন, পাইপের মধ্যে শিশুটিকে জুস খাওয়ানো হয়েছে। শিশুটি সাড়া দিচ্ছে। আবার শেষ বিকালে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ওই পাইপের ভেতর কোন শিশুকে দেখতে পাওয়া যায়নি। রাতের বেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বশীরসহ আরও কয়েকজনকে কেন ওই কূপের মধ্যে নামতে দেয়া হলো না। এ প্রশ্ন এখন সবার। এটি কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটা হত্যাকা- বলা যায়। তিনি স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রীসহ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের পদ্যত্যাগ দাবি এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। শাহজাহানপুরের রেল-কলোনির কল্যাণ সমিতির সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, শিশু জিহাদ কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পরেই ওই এলাকার লোকজনের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। সবার আশা ছিল সে জীবিত উদ্ধার হয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসবে। ওই কূপের মধ্যে প্রায় ১৫ দিন আগে এক শিশু পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছিল যে কূপের মুখটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু, তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি শিশু জেয়াদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। নিহতের মামা মঞ্জুর হোসেন কান্না জড়িত কণ্ঠে করে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম শিশু জিহাদ খেলতে গিয়ে পাইপের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু, ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মী আমাদের বিশ্বাস করেনি। এমনকি জিহাদের বাবাকে ভোরে শাহজাহানপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে নানরকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। এই উদ্ধার অভিযানে যাদের গাফলতি আছে তাদের বিচারের আওতায় আনার তিনি দাবি জানান। মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন জানান, নিহতের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা বিক্ষোভ ভাঙচুর করলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গভীর নলকূপটি ওয়াসার নয়: এদিকে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ সংলগ্ন পানির পাম্পটি তাদের নয়। ঢাকা ওয়াসার উপ-প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া আল মাহমুদ স্বাক্ষরিত ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নির্মম এই দুর্ঘটনার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে অবহেলার কারণে খোলা রাখা পাইপে শিশু জিহাদের প্রাণ যাওয়ার পর গতকাল সেটির মুখ লোহার পাত দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযানের প্রথমে দড়ির সঙ্গে বস্তা বেঁধে নিচে নামিয়ে দেন। তারপর ফেলা হয় টর্চ লাইট। কেউ কেউ বলতে থাকেন ভেতর থেকে জিহাদের কান্নার শব্দ এসেছে। পাইপের ভেতরে দড়ি দিয়ে পাঠানো হয় জুস। দেয়া হয় অক্সিজেন। পাঠানো হয় একাধিক ক্যামেরা। ১৭ থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের ভেতরে ছিল আরেকটি সরু পাইপ। রাতেই ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা শুরু হয় ওই পাইপ। প্রায় ৩০ ফুট করে তোলার পর কেটে ফেলা হচ্ছিল সেটি। এক পর্যায়ে পুরোটাই তুলে ফেলা হয়। এর শেষ অংশে ছিল ফিল্টার এবং সাবমার্সিবল পাম্প। এরপর সেখানে নামানো হয় ওয়াসার বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা। মাটির নিচের ছবি তোলার জন্য কেনা এই ক্যামেরা ব্যবহার উপযোগী করতে সময় লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। এটি যখন সচল হয় তখন ওয়াসার কর্মকর্তা এবং উপস্থিত উদ্ধারকর্মীরাই পর্যালোচনা করছিলেন ভেতরের ছবি। সেই ক্যামেরাতেও জিহাদের ছবি ধরা পড়েনি। দেখা যায় ব্যাঙ ও কিছু আবর্জনার ছবি। রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। উদ্ধার তৎপরতা তদারক করতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ। যান বিএনপির ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মির্জা আব্বাস। কিন্তু রাতভর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় উদ্ধার অভিযান। ভোররাতে হতাশার কথা শুনিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। চলে যান দায়িত্বরত অন্য সংস্থার ঊর্ধ্বতনরাও। সকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও সন্দেহ করতে থাকেন পুরো বিষয়টি ‘নাটক’। কেউ বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এই ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, বিরোধী জোটের একটি কর্মসূচি ঘিরে আলোচনা ভিন্ন খাতে নিতে এটি সরকারেরই নাটক। দিনের বেলা অনেকটা ঢিলেঢালা উদ্ধার অভিযান চলতে থাকে। দুপুর আড়াইটার দিকে উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণা করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান। তিনি এসময় বলেন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, রেলওয়ের এক্সপার্টরা ওই কূপে কোন শিশুর অস্তিত্ব ও প্রাণের স্পন্দন পায়নি। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হলো। এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা ওই পাইপটি পুরোটি উঠিয়ে দেখবেন যে, কোন শিশুর লাশ আছে কিনা। তিনি বলেন, স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় যে, ওই পাইপের ব্যাসার্ধ ১৮ ইঞ্চি। গভীরতা হচ্ছে ৪০০ ফুট। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা। বশির নামে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী পাইপের ভেতরে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কূপের ব্যাস অনেক সংকীর্ণ এবং গভীরতা অনেক, তাই সেখানে উদ্ধারকারী প্রবেশ করা অসম্ভব বলে তাকে নামতে দেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, বড় পাইপটির ভেতরে একটি সরু পাইপ ছিল। সেটি তুলে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাইপের সঙ্গে পাম্পমেশিন সংযুক্ত ছিল। পাইপটি তুলে আনার সময় শিশুটি উঠে আসতে পারে ধারণা করা হয়। কিন্তু পাইপটি সম্পূর্ণ ওঠার পরেও ওই শিশুটি উপরে উঠে আসতে পারেনি।
আলী আহমদ খান বলেন, সর্বশেষ ওই কূপে একটি ক্যামেরা নামানো হয়। কিন্তু ওই ক্যামেরায় একটি সাদা পলিথিন, কাদামাটি ও পোকামাকড় দেখা যায়। দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের অভিযানে ওই পাইপের ভেতরে কোন ভিকটিমের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ জন্য ওই অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুটি কূপের মধ্যে জুস খেয়েছে বা ডাকাডাকি করেছিল, উদ্ধারকাজের প্রথম দিকে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের এমন দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভিকটিমের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় তথ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যেহেতু ভিকটিমের পরিবার আমাদেরকে বলেছিল যে, শিশুটি নিচে পড়ে গেছে এ জন্য তাদের কথা আমরা বিশ্বাস করি এবং আমরা ভেতর থেকে কিছু প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এছাড়াও আমাদের আশা ছিল যে, শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করার। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন। কূপে যে ক্যামেরা নিচে নামানো হয়েছিল ওই ক্যামেরা কত ফুট নিচে গিয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২৮০ ফুট নিচে গিয়েছিল। ওই ক্যামেরায়ও শিশুটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এর আগে সকাল দশটায় ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি মোহাম্মদ হালিমও একই কথা বলেন সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, ভেতরে কোন ভিকটিম নেই। অভিযান শেষ পর্যায়ে। এখন আমাদের আর কোন কাজ নেই। দেশীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় মানুষ যে চেষ্টা করছে, আমরা তাতে সহায়তা করছি। ঘটনাস্থলে থাকা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভোরে সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারকর্মী দলের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে যে, পাইপের ভেতরে শিশুটি নেই। তারপরও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। পরে অবশ্য গতকাল বিকালে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শাজাহানপুরে পাইপের ভিতর থেকে শিশু জিহাদকে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। উদ্ধার অভিযান চলমান ছিল। যখন উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল ঠিক সেই মুহূর্তে জিহাদকে উদ্ধার করা হয়। পাইপের ভিতরে আবর্জনা সরিয়ে নিচ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, পাইপের ভেতরে শিশু নাই এটি বলা হয়নি। আপনারা ভুল শুনেছেন। আমরা বলেছিলাম অত্যাধুনিক ক্যামেরা দিয়ে আমরা শিশুটিকে দেখতে পাই নি। অভিযান অব্যাহত ছিল। এর কারণেই শিশুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
যেভাবে উদ্ধার হয় শিশুটির লাশ: ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণার ১০ মিনিটের মাথায় উঠে আসে শিশু জিহাদের লাশ। শফিকুল ইসলাম ফারুক, শাহ আব্দুল্লাহ আল মুন, রাহুল, আব্দুল মজিদসহ ৬-৭ জন সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় পাইপের তল থেকে অক্ষত অবস্থায় তোলা হয় জিহাদের নিথর দেহ। শফিকুল ইসলাম ফারুক জানান, সকালে তারা কয়েকজন মিলে পাশের কনস্ট্রাকশনের কাজ হওয়া স্থান থেকে লোহার রড সংগ্রহ করেন। পরে তারা পাইপের ব্যাসার্ধের চেয়ে একটু ছোট একটি ‘ক্যাচার’ তৈরি করেন। তিন পাশে তিনটি রড দিয়ে গোলাকার একটি ক্যাচার তৈরি করা হয়। মাঝখানে বসানো হয় একটি সিসি ক্যামেরা। সঙ্গে বাঁধা হয় একটি টর্চ লাইট। ক্যাচারের নিচের দিকে তিনটি লক লাগানো হয়। লকগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ক্যাচারের ভেতরে কিছু ঢোকার সময় লকগুলো খুলে যাবে, কিন্তু বের হবে না। দুপুর দু’টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা থামিয়ে দিলে তারা নিজেরা ওই ক্যাচার পাইপের ভেতরে নামান। দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় ক্যাচারের মাথার অংশে। সেই দড়ি ক্রেনের হুকের সঙ্গে আটকিয়ে ক্যাচারটি নিচে নামানো হয়। পাইপের ভেতরে পানির স্তরের উপরাংশে কিছু ময়লা-আবর্জনা ছিল। সেগুলো ভেদ করে আরও নিচে ঢুকে যায় ক্যাচার। এক পর্যায়ে বোঝা যায় ক্যাচারের ভেতরে কিছু একটা ঢুকেছে। এরপর তারা দড়ি আবার টানতে থাকেন। তাদের সহায়তা করেন ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মীও। ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসতে থাকে ক্যাচারটি। বেলা ২টা ৫৮ মিনিটে ক্যাচারটি পাইপের বাইরে আনা হয়। ভেতর থেকে বের করা হয় জিহাদের নিথর দেহ। তার হলুদ শার্ট তখন গলায় জড়ানো ছিল। পরনে ছিল হলুদ প্যান্ট। সারা শরীর পানিতে ভিজে কিছুটা সাদা রঙ ধারণা করেছে। দ্রুত জিহাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শাহজাহান পুরের মাঠে। সেখানে একটি ইসলামী জলসার জন্য প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরি ছিল। প্রথমে ওই প্যান্ডেলে নেয়া হয় শিশুটির লাশ। পরে দ্রুত সেখান থেকে একটি গাড়িতে তোলা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে।
ঢাকা মেডিক্যালে জিহাদের নিথর দেহ: বিকাল সাড়ে ৩টায় শিশুটির লাশ ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে প্রায় ২০ মিনিট ধরে পরীক্ষা করেন চিকিৎসকরা। এর আগে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতে করে শিশু জিহাদের নিথর দেহ ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এসময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে শ’ শ’ উৎসুক জনতা ভিড় করেন। জিহাদ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা জানতে চান। তিনটা ৫০ মিনিটে জরুরি বিভাগের দরজার সামনে থেকে একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, শিশু জিহাদ আর বেঁচে নেই। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে জিহাদের মৃত্যুর বিষয়টি উপস্থিত সংবাদকর্মীদের নিশ্চিত করেন জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন (ক্যাজুয়ালিটি) ডা. কে এম রিয়াজ মোর্শেদ। তিনি বলেন, জিহাদ আর বেঁচে নেই। হাসপাতালের আনার কয়েক ঘণ্টা আগেই সে মারা গেছে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। তবে কতক্ষণ আগে জিহাদ মারা গেছে সে বিষয়টি ময়না তদন্ত রিপোর্টে জানা যাবে বলে তিনি জানান। কি কারণে জিহাদ মারা গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ময়না তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এর সঠিক কোন কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে অনেক কারণের মধ্যে ঠা-ার কারণ একটি। এছাড়া অক্সিজেনের অভাব, প্রচ- ভয়ও কারণ হিসেবে কাজ করেছে। জিহাদের মৃত্যু সংবাদটি মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।
এরই মধ্যে জিহাদের পিতা নাসিরউদ্দিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সম্মুখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার বাবুরে আইন্না দেও, আমার জিহাদরে বাঁচাও, তারে আইন্না দেও।’ এরই মধ্যে জিহাদের লাশ দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের মর্গে। পরে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ময়না তদন্তের আগে পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট হবে। এরপরই লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হবে। তবে আজকে (গতকাল) তা সম্ভব না-ও হতে পারে। এদিকে ময়না তদন্তের বিষয়ে ঢামেকের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মোজাম্মেল হক বলেন, সংগত কারণে আজ (গতকাল) জিহাদের লাশের ময়না তদন্ত হবে না। আগামীকাল সকালে তা হতে পারে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, জিহাদের হাত, পা, উরু, পিঠ ও মাথার সামনের দিকে ডানপাশে ছিলে যাওয়ার দাগ রয়েছে। এছাড়া তার শরীরে বড় ধরনের কোন ক্ষতের দেখা মেলেনি।
জিহাদের পিতাকে ১২ ঘণ্টা আটকে রাখে পুলিশ: এদিকে পাইপের ভেতর শিশু পড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্রেফ গুজব বলে চারদিকে খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর তৎপরতা শুরু করে পুলিশ। শাহজাহানপুর থানা পুলিশ গতকাল ভোর তিনটার দিকে জিহাদের পিতা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈশপ্রহরী নাসিরউদ্দিনকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তাকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। থানায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিশু সিয়াম ও আরিফ নামে অপর একজনকে। থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রাহেলা নামে এক গৃহবধূকেও। গতকাল দুপুরে ৩টার দিকে জিহাদের লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। এ সময় তাদের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে পুলিশ। ঘটনাটি ‘নাটক’ বলে তাকে তিরস্কারও করা হয়। তবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই জিহাদের বাবাকে তারা নিজেদের হেফাজতে রেখেছিলেন। শাজাহানপুর থানার ওসি শেখ মেহেদী হাসান দাবি করেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর শিশুটির বাবা নাসিরকে সকালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের বিক্ষোভ-ভাঙচুর: রাজধানীর শাহজাহানপুরের পূর্ব কলোনিতে গভীর নলকূপের পাইপের ভেতর পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদের লাশ উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং ভাঙচুর করেছেন। তারা কূপের পাশে রেলওয়ের জমিতে তৈরি করা পাঁচটি ছোট-বড় টিনের ঘর ভাঙচুর করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক, ওয়াসার ও রেলওয়ের প্রধানসহ সবার পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাদের বিক্ষোভে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের বিক্ষোভে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত সতর্ক ছিল।
ওই কূপের পেছনের পাঁচতলা বাড়ির বাসিন্দা রেলওয়ে কর্মচারী লিটন হোসেন জানান, ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন একটি নাটক সৃষ্টি করেছেন। তারা একেক সময় একেক রকম কথা বলেছেন। কখনো বলেছেন, পাইপের মধ্যে শিশুটিকে জুস খাওয়ানো হয়েছে। শিশুটি সাড়া দিচ্ছে। আবার শেষ বিকালে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ওই পাইপের ভেতর কোন শিশুকে দেখতে পাওয়া যায়নি। রাতের বেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বশীরসহ আরও কয়েকজনকে কেন ওই কূপের মধ্যে নামতে দেয়া হলো না। এ প্রশ্ন এখন সবার। এটি কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটা হত্যাকা- বলা যায়। তিনি স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রীসহ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের পদ্যত্যাগ দাবি এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। শাহজাহানপুরের রেল-কলোনির কল্যাণ সমিতির সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, শিশু জিহাদ কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পরেই ওই এলাকার লোকজনের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। সবার আশা ছিল সে জীবিত উদ্ধার হয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসবে। ওই কূপের মধ্যে প্রায় ১৫ দিন আগে এক শিশু পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছিল যে কূপের মুখটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু, তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি শিশু জেয়াদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। নিহতের মামা মঞ্জুর হোসেন কান্না জড়িত কণ্ঠে করে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম শিশু জিহাদ খেলতে গিয়ে পাইপের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু, ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মী আমাদের বিশ্বাস করেনি। এমনকি জিহাদের বাবাকে ভোরে শাহজাহানপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে নানরকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। এই উদ্ধার অভিযানে যাদের গাফলতি আছে তাদের বিচারের আওতায় আনার তিনি দাবি জানান। মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন জানান, নিহতের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা বিক্ষোভ ভাঙচুর করলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গভীর নলকূপটি ওয়াসার নয়: এদিকে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ সংলগ্ন পানির পাম্পটি তাদের নয়। ঢাকা ওয়াসার উপ-প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া আল মাহমুদ স্বাক্ষরিত ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নির্মম এই দুর্ঘটনার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে অবহেলার কারণে খোলা রাখা পাইপে শিশু জিহাদের প্রাণ যাওয়ার পর গতকাল সেটির মুখ লোহার পাত দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়।
No comments